নিত্য স্বাধ্যায়ঃ বেদমন্ত্র-০২
শাস্ত্র যাঁকে পরমপদ বলেন-পরব্রহ্ম বলেন তাঁর দ্বারা এই সূক্ষ্ম আকাশও ওতপ্রোত ভাবে পরিব্যাপ্ত। এই জন্য ইনি অতি সূক্ষ্ম। অতি সূক্ষ্ম বলেই একে পরমব্যোম বলা হয়। পরমব্যোম ক্ষরণরহিত, ব্যয়রহিত, এই জন্য ইনি অক্ষর। এর আত্মমায়া যখন একে আচ্ছাদন করেন তখন ইনিই শব্দব্রহ্মাত্মিকা বাগ্দেবীরূপে বিবর্ত্তিত হন। ইনিই অনন্ত বাক্সন্দর্ভ দ্বারা সহস্ৰাক্ষরা। এরই ছন্দোবদ্ধ যে স্পন্দন তাই হচ্ছে ঋক্। ঋক্গুলি ছন্দ বিশিষ্ট শব্দ। এই ছন্দ বিশিষ্ট সাধুশব্দই বেদের মন্ত্র। বেদের মন্ত্রগুলিতে কতকগুলি শব্দ পাওয়া যায়। শব্দ বিশ্লেষণ করলে কতকগুলি বৰ্ণ পাওয়া যায়। বর্ণ জ্ঞানশাস্ত্র হতে শব্দের জ্ঞানলাভ হয়। শব্দজ্ঞান সম্বন্ধে বলা হয় “যত্র চ ব্ৰহ্মবৰ্ত্ততে।” শব্দজ্ঞান হতে ব্ৰহ্মকে পাওয়া যায়। ভগবান্ পতঞ্জলি মহাভাষ্যে বলেন বর্ণজ্ঞানং বাগ্বিষয়ো যত্ৰ চ ব্ৰহ্ম বৰ্ত্ততে। সোহয়মক্ষরসমাম্নায়ো বাক্ সমাম্নায়ঃ; পুষ্পিতঃ ফলিতশ্চন্দ্ৰতারকাবৎ প্ৰতিমণ্ডিতো বেদিতব্যো ব্ৰহ্মরাশিঃ। “চন্দ্ৰতারকাদিবৎ প্ৰবাহরূপে নিত্য বাক্সমাম্নায়ই বেদ”। এই যে পরিদৃশ্যমান বিশ্ব দাঁড়িয়ে আছে দেখা যায় তা মায়াচ্ছাদিত পরম ব্যোমের একদেশ মাত্র। এই জন্য বিশ্বকে ব্রহ্মেরই বিবর্ত্ত বলা হয়। “সুষুপ্তং স্বপ্নবৎ ভাতি ভাতি ব্রহ্মৈব সৰ্গবৎ”। সুষুপ্তি যেমন স্বপ্ন মত প্রকাশ পায় তেমনি ব্রহ্ম ও সৃষ্টি মত প্রকাশ পান। রজ্জু যেমন অজ্ঞান দ্বারা সর্প মত ভাসে ব্ৰহ্মও তেমনি মায়া দ্বারা বিশ্বরূপে ভাসেন। বিবিধ ছন্দে নৃত্য করতে করতে এই শব্দব্রহ্মাত্মিকা গৌরবর্ণ বাগদেবীই দেবতারূপে বিবর্তিত হন। পরম ব্যোমের ত্রিপাদ অমৃত, অক্ষর হয়ে অবস্থিত। এর একপাদ মাত্র মায়াতে আচ্ছাদিত হয়ে বিশ্বরূপে বিবর্তিত হচ্ছেন। পরমাণুই বল, প্ৰকৃতিই বল বা মায়াই বল এটা শক্তি মাত্র অথবা এটা এই শব্দব্ৰহ্মাত্মিকা বাগদেবী। যেখানে শক্তির স্পন্দন সেখানে শব্দ থাকবেই। শব্দ হতেই জগতের সৃষ্টি। শক্তির সুপ্ত অবস্থা যা তাই সাম্যাবস্থা বা মায়া। শক্তির স্পন্দনবস্থা বা অভিব্যক্তি অবস্থা যা তাই প্রকৃতি। প্রকৃতিই এই ব্রহ্মাণ্ডরূপে পরিদৃশ্যমান।
শব্দ যেখানে লয় হয় তাই পরমব্যোম। বিবিধ শব্দজাত উপশান্ত হলে যে শব্দ সামান্য অবশিষ্ট থাকেন তাই পরমব্যোম। “কস্মিন্নু খল্বাকাশ ওতশ্চ প্ৰোতশ্চেতি” এর উত্তর যা তাই পরমব্যোম। ঋগাদি বেদ প্রতিপাদ্য শব্দ সামান্য স্বরূপ যে পরমব্যোমে, বেদ-স্তুত নিখিল দেবতা অধিনিষন্ন সেই পরমব্যোমকে যে জানে না ঋগ আদি মন্ত্রে তার কি করবে? যিনি তাঁকে জানেন তিনিই মোক্ষ লাভ করেন।
জনক সভাতে যাজ্ঞবল্ক্যের সাথে ব্রাহ্মণদের বিবাদ উপস্থিত হলে গর্গকন্যা বাচক্লবী যাজ্ঞবল্ক্য কে যে প্রশ্ন করেন যাজ্ঞবল্ক্য সেই প্রশ্নটি বলছেন। সেই যাজ্ঞবল্ক্য নিশ্চয় করে গাৰ্গীকে উত্তর দিচ্ছেন। আরে গার্গি! তুমি যা জিজ্ঞাসা করেছ তা ত এই; যা স্বর্গ হতেও উপরে, যা পৃথিবীরও অধোদেশে, আর যন্মধ্যে এই দৃশ্যমান দ্যাবাপৃথিবী, আর যা গত হয়ে গেছে, যা বর্তমান আছে, যা আগামী - এই সমস্ত পদার্থ কাহাতে ওতপ্রোত রয়েছে ? তোমার প্রশ্নের উত্তরে আমি বলছি আকাশই সমস্ত পদার্থকে ওতপ্ৰোত ভাবে ব্যাপিয়া আছে। তুমি পুনরায় জিজ্ঞাসা করেছে কস্মিন্নু খল্বাকাশ ওতশ্চ প্রোতশ্চেতি? আকাশ কাহাতে ওতপ্রোত ভাবে অবস্থিত? তার উত্তর দিতেছি শ্রবণ কর। ভো গার্গি! ব্ৰাহ্মণগণ, ব্ৰহ্মজ্ঞপুরুষেরা একেই অবিনাশী ব্ৰহ্ম বলেন। সেই অক্ষরে সেই ব্ৰহ্মে আকাশ ওতপ্ৰোত ভাবে রয়েছে। এই অক্ষর কেমন যদি জিজ্ঞাসা করে তার উত্তরে বলি ইনি অস্থুল, স্থুলাদি চতুর্বিধ পরিণাম এর নাই। ইনি আলোহিত-লোহিতাদি বর্ণাতীত। ইনি অস্নেহ, চিক্কণতাদি গুণরহিত। ইনি অচ্ছায়-ইনি মূৰ্ত্তি রহিত। ইনি অতম তমোভাবটি হচ্ছে অজ্ঞান, মায়া; ইনি অজ্ঞান মায়ার অতীত। ইনি অবায়ু, অনাকাশ, বায়ু এবং আকাশেরও অতীত। ইনি অসঙ্গ, অসম্মিলিত। ইনি অস্পৰ্শ, স্পর্শরহিত। ইনি অচক্ষুষ্ক ইত্যাদি অর্থাৎ ইনি ইন্দ্রিয় রহিত। আবার ইনি ইন্দ্ৰিয়াদি-গত অধিদৈবতরূপ তেজও নন এজন্য অতেজস্ক। তবে কি তিনি ইন্দ্ৰিয় চালক প্ৰাণ? না ইনি অপ্ৰাণ; অমুখ, মুখরহিত এবং নাম গোত্র রহিত। ইনি অজর, জরাতীত, অমরণ স্বভাব। ইহা হতে দ্বিতীয় কেউ নাই বলে ইনি অভয়। ইনি অমৃত, নিত্যমুক্তস্বভাব। ইনি অরজ, গুণাতীত এবং লোকাতীত। ইনি অশব্দ, শব্দের অগোচর। ইনি অবিবৰ্ত্ত, বিবৰ্ত্তবৰ্জিত। ইনি অসংবৃত, অবচ্ছেদ রহিত। ইনি অপূর্ব, যার পূর্বে আর কিছুই নাই। ইনি অনপর, যাঁ হতে অপর আর কিছুই নাই। ইনি অনন্তর, এর ভিতর বলে কিছুই নাই। ইনি অবাহ্য, এর বহিরাবরণী কিছুই নাই। এই প্রকার যিনি তাঁকে কেউই অঙ্গীকার করে না-অসঙ্গ উদাসীন বলেই কেউ অঙ্গীকার করে না। আর কিছুই তাঁকে ব্যাপিয়াও নাই- কারণ তিনি অগ্রাহ্য।
১। যিনি পৃথিবীতে ওতপ্রোতভাবে থেকেও পৃথিবী হতে পৃথক, যাঁকে পৃথিবীর অধিষ্ঠাতৃ দেবতা ও জানেন না, যার পৃথিবী শরীর, যিনি পৃথিবী দেবতাকে প্রেরণা করেন এই তোমার এবং সকলের আত্মা, ইনিই সর্বভূতের অন্তর্যামী, সর্বসংসার- ধর্মবর্জিত অবিনাশী আত্মা।
২-৫। যিনি জলরাশিতে, অগ্নিতে, অন্তরীক্ষে, বায়ুতে ওতপ্রোত ভাবে থেকেও এদের হতে পৃথক; জল, অগ্নি, অন্তরীক্ষ, বায়ু ইত্যাদির অধিষ্ঠাতৃ দেবতা যাঁকে জানেন না, যার এই গুলি শরীর। যিনি এঁদেরকেও এদের দেবতাকে প্রেরণা করেন, ইনিই আত্মা অন্তৰ্যামী অমৃত।
যিনি স্বর্গে, সুর্যে, দিক সকলে, চন্দ্রতারকায়, আকাশে, অন্ধকারে, তেজে অবস্থান করেও এ সমস্ত হতে পৃথক, যাঁকে এদের অধিষ্ঠাত্রী দেবতাগণ জানেন না, যাঁর দ্যুলোক, আদিত্য মণ্ডল, দিক্সকল, চন্দ্রতারকা, আকাশ, অন্ধকার, তেজ এই সমস্ত শরীর, যিনি এদের ভিতরে থেকে প্রেরণা করেন। তিনি আত্মা অন্তর্যামী অমৃত।
এই পর্যন্ত দেবতার অন্তৰ্যামীর কথা বলা হল।
ব্ৰহ্মাদি স্তম্ভ পর্যন্ত ভূত সকলের অন্তৰ্যামীর কথা।-
যিনি সমস্ত ভূতে রয়েও সমস্ত ভূত থেকে পৃথক, যাঁকে ভূত সকল জানেন না, সকল ভূত যার শরীর, যিনি সকল ভূতের ভিতর থেকে প্রেরণা দেন তিনি আত্মা, অন্তৰ্যামী, অমৃত।
এই পর্যন্ত অধিভূতের কথা।
যিনি প্ৰাণে, যিনি বাক্যে, যিনি চক্ষুতে অবস্থান করেও প্ৰাণ হতে, বাক্য হতে, চক্ষু হতে ভিন্ন, যাঁকে প্ৰাণ, বাক্য, চক্ষু জানেন না। যাঁর প্রাণ, বাক্য, চক্ষু, শরীর, যিনি এদের অন্তরে থেকে প্রেরণা করেন, এই সেই আত্মা অন্তৰ্যামী অমৃত।
যিনি কৰ্ণে, যিনি মনে, যিনি ত্বগিন্দ্ৰিয়ে, যিনি বুদ্ধিতে, যিনি বীর্যে অধিষ্ঠিত হয়েও, শ্রবণেন্দ্ৰিয়, মন, ত্বগিন্দ্ৰিয়, বুদ্ধি ও বীর্য হতে ভিন্ন, যাঁকে এই সকলের কেউই জানে না, যিনি উহাদের ভিতরে থেকে প্রেরণা করেন এই সেই আত্মা অন্তর্যামী অমৃত।
পৃথিবী-দেবতাদি কেন সেই আত্মস্থ অন্তর্যামী পুরুষকে জানেন না ? কারণ এই অন্তর্যামী, সর্বাপদার্থের দ্রষ্টা কিন্তু অসঙ্গ স্বভাব বলেই নিজে স্বভাবতঃ কারও দৃষ্টিগোচর হন না, তিনি সমস্ত শব্দ শ্রবণ করেন, কিন্তু তাকে কেউ শুনতে পায় না; তিনি সকল বিষয়ের মনন করেন কিন্তু তাঁকে কেউ মনন, চিন্তা তর্ক দ্বারা তাঁর তত্ত্বাবধারণ করতে পারে না; তিনি সমস্ত জানেন কিন্তু তাঁকে কেউই জানিতে পারে না। কেন না এই অন্তৰ্যামী ভিন্ন আর দ্বিতীয় দ্রষ্টা, শ্রোতা, মন্তা, বা বিজ্ঞাতা নাই। যখন কেউই আর তাঁকে জানিতে পারে না তখন অন্তৰ্যামী আর কারো দৃষ্ট, শ্রুত, মত, বিজ্ঞাত হন না। হে উদ্দালক তোমার আমার ও ব্ৰহ্মাদি স্তম্ব পর্যন্ত ভূতসকলের অন্তৰ্যামী এই কথিত পুরুষই অমৃত নিত্য-অবিনাশী। এতদ্ভিন্ন আর যা আছে তাই আর্ত, নশ্বর। এই কথা শুনিয়া অরুণ তনয় উদ্দালক বিরত হলেন।
যে দ্যুতিশালী ক্রীড়াশীল পুরুষ অগ্নিতে, যিনি জল সমূহে, যিনি ত্ৰিভুবনে প্রবেশ করে আছেন, যিনি ওষধীতে, যিনি বনস্পতিতে সেই দেবতাকে পুনঃ পুনঃ প্ৰণাম করি।
কোন মন্তব্য নেই