অক্ষক্রীড়া বা দ্যুতক্রীড়া (পাশা খেলা)
“ন স স্বো দক্ষো বরুণ ধ্রুতিঃ সা সুরা মন্যুর্বিভীদকো অচিত্তিঃ” (ঋক ৭/৮৬/৬)
“প্রাবেপা মা বৃহতো মাদয়ংতি প্রবাতেজা ইরিণে বর্বৃতানাঃ। সোমস্যেব মৌজবতস্য ভক্ষো বিভীদকো জাগৃবির্মহ্যমচ্ছান্।” (ঋক ১০/৩৪-১)
এই ঋক মন্ত্র দুটি থেকে বুঝা যায়, বিভীদক বা বহেড়া ফল থেকে অক্ষ বা পাশা তৈরি হতো। সায়ণ বলেছেন, “বিভীদকো বিভীতকবিকারোহক্ষো”। “ন্যুপ্তাশ্চ বভ্রুবো বাচমক্রত”(ঋক ১০/৩৪/৫) এই ঋকের টীকায় সায়ণ বলেছেন, “বভ্রবো বভ্রুবর্ণা অক্ষা ন্যুপ্তাঃ কিতবৈরবক্ষিপ্তাঃ সংতো বাচমক্রত। শব্দং কুবংতি।” এর থেকে বুঝা যায়, বৈদিক যুগে পাশার রং ছিল বভ্রু বর্ণ বা পিঙ্গল বর্ণ (বহেড়ার রং সেটাই) এবং তা কিতব বা দ্যুত খেলোয়ার হাত থেকে ফেললে শব্দ করে। সময়ে সময়ে এই বিভীদক থেকে তৈরি অক্ষের অনুকরণে স্বর্ণের অক্ষ তৈরি করা হতো। (তৈত্তি স ১/৮/৬/১২ সায়ণ টীকা); শত ব্রা ৫/৪/৪/৬। “চতুরশ্চিদ্দদমানাদ্বিভীয়াদা নিধাতোঃ” (১/৪১/৯), এই ঋকের ভাষ্যে সায়ণ বলেছেন “অক্ষদ্যূতং কুর্বতোরুভয়োর্মধ্যে যঃ পুরান্ চতুরশ্চতুঃসংখ্যাকান্কপর্দকান্দদমানাদ্দদতো হস্তে ধারয়তঃ পুরুষাৎ আ নিধাতোঃ কপর্দকনিপাতপর্যংতং বিভীয়াৎ অস্য জয়ো ভবিষ্যতি।” এবং বাজসনেয়ী সংহিতায় (১০/২৮) মহীধরের ভাষ্য থেকে বুঝা যায় যে পরবর্তী যুগে কপর্দক বা কড়ি নিয়ে পাশাখেলে হতো। এখনও পল্লীগ্রামে কড়ি নিয়ে দশপচিশ খেলা হয়। এর ছক ঠিক পাশা খেলার ছকেরই মতো এবং আধুনিক পাশাখেলার মতো চার রংয়ের ঘুটি নিয়ে খেলা হয়ে থাকে। কেবল প্রভেদ এই যে, এতে পাশার বদলে কড়ি দিয়ে দান ফেলা হয় ও চাল চালার প্রথাও কিছু স্বতন্ত্র।
বৈদিক যুগে কত গুলি অক্ষ নিয়ে খেলা হতো, সে সম্পর্কে অধিক বিবরণ পাওয়া যায় না। “ত্রিপংচাশঃ ক্রীড়তি ব্রাত এষাং” (ঋক্ ১০/৩৪/৮), এই ঋক্ থেকে অনেকে মনে করেন তিপ্পান্নটি অক্ষ নিয়ে খেলা হতো। কিন্তু এই ঋকের প্রকৃত অর্থ কি? তা বুঝার উপায় নেই। তারপর আর এক স্থানে আছে, “যো বঃ সেনানীর্মহতো গণস্য” (ঋক ১০/৩৪/১২)। এর থেকে কেউ কেউ অনুমান করেন, অক্ষের সংখ্যা অন্ত্যন্ত অধিক ছিল। কিন্তু “চতুশ্চিদ্দদমানাৎ” (ঋক ১/৪১/৯) থেকে ও সায়ণের ব্যাখ্যা থেকে মনে হয়, অক্ষের সংখ্যা ছিল চার। আমাদের মনে হয় “ত্রিপংচাশঃ” ও “সেনানীর্মহতো গণস্য” এর অর্থ অক্ষ বুঝাচ্ছে না- চালার ঘুটি বুঝাচ্ছে। তিপ্পান্নটি অক্ষ কোন লোক হাতের মুষ্টির মধ্যে গ্রহণ করতে পারে না।
পরবর্তি যুগে তৈত্তিরীয় সংহিতা (৪/৩/৩/১-২), বাজসনেয়ী সংহিতা (৩০/১৮), শতপথব্রাহ্মণ (৫/৪/৪/৬) প্রভৃতিতে কৃত, ত্রেতা, দ্বাপর, আস্কন্দ, অভিভূ, কলি প্রভৃতি শব্দ অক্ষ খেলা সম্পর্কে ব্যবহৃত হয়েছে। সেই শব্দগুলির প্রকৃত অর্থ কিন্তু সহজে বোধগম্য হয় না। তবে মনে হয়, আধুনিক পাশাখেলার দানের ছয় তিন নয়, কচে বার, শে পঞ্জা প্রভৃতি যে নাম আছে, সে যুগেও এমন নাম ছিল; ঐ শব্দগুলি তেমনি দান পড়ার নাম মাত্র। পাশাখেলার ছকের আভাস আমরা বৈদিক সাহিত্যে পাই না। তবে ভূমিতে যেখানে অক্ষ নিক্ষেপ করা হতো, সেখানে একটু গর্ত করে দেওয়া হতো, তার নাম ছিল অধিদেবন (অথর্ববেদ ৫/৩১/৬; ৬/৭০/১; মৈত্রায়ণী সংহিতা ১/৬/১১; ৪/৪/৬), দেবন (ঋক ১০/৪৩/৫), ইরিণ (ঋক্ ১০/৩৪/১) ইত্যাদি। যে কৌটায় অক্ষ রাখা হতো তাকে বলা হতো অক্ষাবপন (শতপথ ব্রাহ্মণ ৫/৩/১/১১); এবং যে খেলার পরিদর্শক তার নাম ছিল অক্ষাবাপ বা অক্ষাধ্যক্ষ। দান বা নিক্ষেপকে গ্রহ (অথর্ববেদ ৪/৩৮/১) বা গ্রাভ (ঋক ৪/৮১/১; ৯/১০৬/৩) বলা হতো। খেলার পণের নাম ছিল ‘বিজ’। ঋগ্বেদ থেকে আমরা জানতে পারি যে, দ্যুতে আসক্ত ব্যক্তি (কিতব) সর্বস্ব এমন কি স্ত্রী পর্যন্ত পণ দিয়ে পথের ভিখারী হতো।
মহাভারতে অক্ষ খেলা সম্পর্কে আমরা অনেক কথা জানতে পারি। দুর্যোধন রাজসূয় যজ্ঞ সভায় যুধিষ্ঠিরের ঐশ্বর্য দেখে ঈর্ষান্বিত হন এবং শকুনির পরামর্শে যুধিষ্ঠিরকে অক্ষ খেলায় নিমন্ত্রণ করেন। শকুনি আত্মশ্লাঘা করে দ্যূত খেলায় নিজের দক্ষতা দেখিয়েছিলেন-
পণ আমার ধনু, অক্ষ আমার শর, অক্ষ হৃদয় আমার জ্যা ও আমার স্ফূর্তিই আমার রথ।
গ্লহ (পণ), দুরোদর(অক্ষ খেলা), অক্ষদেবী (অক্ষ খেলার অত্যন্ত নিপুণ) প্রভৃতি শব্দ মহাভারতে আমরা পেয়ে থাকি। অক্ষ খেলার জন্য বিপুল আয়োজন এবং অক্ষ খেলার জন্য সভা নির্মাণের বর্ণনা অতি বিশদভাবে মহাভারতে বর্ণনা করা আছে।
যুধিষ্ঠির নিজে দ্যূত খেলাকে অত্যন্ত অমঙ্গলকারী জেনেও অত্যন্ত আসক্তির কারণে কপট অক্ষদেবী শকুনির সাথে দ্যূত খেলায় ধনরন্ত, রাজ ঐশ্বর্য, ভাই, এমনি কি প্রাণ অপেক্ষা প্রিয় পাঞ্চালীকে পর্যন্ত হেরে গিয়েছিলেন। মহাভারতে আমরা কপট দ্যূতক্রীড়ক অর্থে কিতব শব্দের ব্যবহার দেখি। বৈদিক যুগে দ্যূতক্রীড়ক মাত্রই কিতব বলা হতো। কালক্রমে পেশাদার দ্যূতক্রীড়করা ছলনার আশ্রয় নেওয়ার কিতব অর্থে তাদেরকে বুঝাতো।
আমরা দেখেছি, মহাভারতের সময়েও প্রাচীন কাব্য সাহিত্যে দ্যূতক্রীড়ার সমধিক আদর ছিল। বিরাট রাজ নিজের পুত্র উত্তরের বিজয় বার্তা শুনে দ্যূতক্রীড়ায় আমোদ করতে চাইলে দ্যূতক্রীড়ায় হৃতসর্বস্ব কঙ্ক তাকে নিষেধ করলেন। তাতে বিরাট বললেন “দ্যূতক্রীড়া আমর অত্যন্ত প্রিয়, সুতরাং তোমার কোন যুক্তিই শুনব না” (মহাভা, বিরাট পর্ব ৬৮ অধ্যায়)। অন্য স্থানে পূণ্যশ্লোক নলরাজাও দ্যূতক্রীড়াসক্ত হয়ে পথের ভিখারী হয়েছিলেন, সে বৃত্তান্তও বর্ণনা করা ছে (মহাভারত বন পর্ব ৫৩-৭৯ অধ্যায়ে)। সুতরাং দ্যূতক্রীড়া সে যুগে বিলাসের সামগ্রী ছিল। এর বিষময় ফল প্রত্যক্ষ করেও যুধিষ্ঠির ও নলের মতো বুদ্ধিমান ব্যক্তিও তার মোহের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেননি। প্রাচীনকালে ভারতে হাতির দাঁত, কাঠ, হাঁড়, মাটি ও স্বর্ণের অক্ষ তৈরি করা হতো এবং কিতবরা অন্যদের বঞ্চনা করার জন্য ধাতুগর্ভ অক্ষ তৈরি করতো। এই অক্ষ নির্মাণ কৌশল চতুঃষষ্টি কলার অন্তর্গত একটি কলা। মহাভারতে শকুনি ও পুষ্কর এই অক্ষহৃদয় জ্ঞাত হয়ে যুধিষ্ঠির ও নলকে পরাজিত করেছিল। ঋগ্বেদে আমরা অক্ষাবপন শব্দ পেয়েছি, তার অর্থ অক্ষাধার; অক্ষ গুলি তার ভেতর রেখে ফেলা হতো এবং দ্যূতফলকে গুটি দিয়ে চালে খেলা হতো।
কোন মন্তব্য নেই