অগস্ত্য
অগস্ত্যমুনি।
অগস্ত্য নক্ষত্র দক্ষিণ দিকে উদিত হয় বলে দক্ষিণ দিকের নাম আগস্ত্য দিক্।
কেীবেরদিগ্ভাগমপাস্যমাৰ্গ—
মাগস্ত্যমুষ্মাংশুরিবাবতীর্ণঃ। মাঘ। ৩/১।
সংসারে আদর গুণেরই অধিক। লোকে বংশ মর্যাদা আগে দেখেন, কিন্তু কৈ ? কেবল সৎকুলের তো ততটা গৌরব দেখি না। সদ্গুণের উপর কুলমর্যাদা থাকে-ভালই; না থাকে ক্ষতি নেই। মুক্তার জন্ম ঝিনুকে। ঝিনুকে জন্ম বলে মুক্তার অনাদর নেই। মৃণালের কাদায় উৎপত্তি, ডাঁটায় কাঁটা; তাই বলে প্রস্ফুটিত পদ্ম পুষ্পে কারও অযত্ন দেখি না। অগস্ত্য মহাতেজা, মহাতপা, জন্ম তাঁর কুম্ভে।
ঋগ্বেদে বলা আছে যে, যজ্ঞ স্থানে উর্বশীকে দেখে মিত্র ও বরুণের রেতঃস্খলন হয়। সেই শুক্র যজ্ঞীয় কুম্ভে পড়েছিল। তাতেই বশিষ্ট ও অগস্ত্যের উৎপত্তি।
‘সত্রেহ জাতবিষিতা নমোভিঃ কুম্ভে রেতঃ সিষিচতুঃ সমানং।
ততোহ মান উদিয়ায় মধ্যাত্ততো জাত্মৃষিমাহুর্বশিষ্ঠম্। (৭/৩৩/১৩)।
এখানে অগস্ত্যের নাম মান লেখা হয়েছে। সায়ণাচার্য্য ঋগ্বেদের উক্ত মণ্ডলের ও সূক্তের একাদশ ঋকের ব্যাখ্যায় বৃহৎ সংহিতা থেকে কয়েকটি শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন। এই মহর্ষি কি কারণে প্রথমে মান নামে প্রসিদ্ধ হন, তার কারণ ঐ শ্লোকে নির্দিষ্ট আছে।
তরোরাদিত্যরোঃসত্রে দৃষ্ট্বাস্পরসমুর্ব্বশীঃ।
রেতশ্চষ্কন্দ তৎকুম্ভে ন্যপতদ্বাসতীবরে।
তেনৈব তু মুহূর্ত্তেন বীর্য্যবন্তৌ তপস্বিনৌ।
অগস্ত্যশ্চ বশিষ্ঠশ্চ তত্রর্ষী সম্বভূবতুঃ।
বহুধা পতিতং রেতঃ কলসে চ জলে স্থলে।
স্থলে বশিষ্ঠস্তু মুনিঃ সম্বভূবর্ষিসত্তমঃ।
কুম্ভে ত্বগস্ত্যঃ সম্ভূতো জলে মৎস্যো মহাদ্যুতিঃ।
উদিয়ায় ততো হগস্ত্যঃ শম্যামাত্রো মহাতপাঃ।
মানেন সন্মিতো যস্মাত্তস্মাদ্ মান্য ইহোচ্যতে।
যদ্বা কুম্ভাদৃষির্জাতঃ কুম্ভেনাপিহি মীয়তে।
কুম্ভ ইত্যভিধানঞ্চ পরিমাণস্য লক্ষ্যতে॥
অর্থাৎ, মিত্র ও বরুণ দেবতা আদিত্য যজ্ঞে উর্বশীকে দেখলে বাসতীবর নামক যজ্ঞীয় কুম্ভে তাদের রেতঃস্খলন হয়। মুহূর্ত মধ্যে তাতে অগস্ত্য ও বশিষ্ঠ নামে দুই বীর্য্যবন্ত তপস্বী উৎপন্ন হলেন। সেই রেতঃ কলসে ও জলে স্থলে বহুধা হয়ে পতিত হয়েছিল। স্থলে ঋষিসত্তম বশিষ্ঠ জন্ম নিলেন; কুম্ভে অগস্ত্য এবং জলে দ্যুতিমান্ মৎস্য। মহাতপা অগস্ত্যের আকার লাঙ্গলের জোয়ালের ন্যায় হয়েছিল। এই আকার পরিমিত, সে জন্য তিনি মান্য নামে প্রসিদ্ধ হন। অথবা কুম্ভ একটি পরিমাণের নাম (কুম্ভ ১/৪ সের, দ্রোণাভ্যং শূৰ্পকুম্ভৌ চ চতুঃষষ্টিশরাবকঃ)। অগস্ত্য কুম্ভে জন্মেছিলেন, অতএব কুম্ভ দ্বারা তাঁর পরিমাণ হচ্ছে (তজ্জন্য তিনি মান নামে প্রথিত)।
বিষ্ণুপুরাণে এবং ভাগবতে মিত্রাবরুণ হতে বশিষ্ঠের পুনর্জন্মের কথা উল্লিখিত হয়েছে, কিন্তু সেখানে অগস্ত্যমুনির জন্মগ্রহণের নামপ্রসঙ্গও নাই। ইক্ষ্বাকুতনয় নিমি, সহস্ৰ বৎসরব্যাপী একটা যজ্ঞ আরম্ভ করেন। সেই যজ্ঞে হোতা হইবার জন্য তিনি বশিষ্ঠকে বরণ করেছিলেন। কিন্তু সেই সময় ইন্দ্রও পঞ্চশতবর্ষব্যাপী এক মহাযজ্ঞে বশিষ্ঠকে নিযুক্ত করেছিলেন বলে তিনি নিমিরাজের যজ্ঞে আসতে পারলেন না। সুতরাং নিমি গৌতমকে নিয়ে যজ্ঞারম্ভ করলেন। ইন্দ্রের যজ্ঞ সম্পন্ন হলে, বশিষ্ঠ এসে দেখেন যে, গৌতম মুনি তাহার শিষ্যের যজ্ঞে ব্ৰতী হয়েছেন। এই অপমানে মহৰ্ষি ক্রুদ্ধ হয়ে রাজাকে অভিসম্পাত করলেন –
‘তুমি দেহহীন হও।’ নিমিও ক্রুদ্ধ হয়ে শাপ দিলেন – ‘গুরুরও দেহের পতন হোক।’ এই শাপের জন্য বশিষ্ঠতেজ মিত্রাবরুণের তেজে প্রবিষ্ট হল। তারপর, উর্ব্বশীদর্শনে মিত্রাবুরুণের রেতঃপাত হলে বশিষ্ঠ অন্য দেহ প্রাপ্ত হলেন। (বিষ্ণুপুরাণ ৪/৫)।
অগস্ত্যমুনির প্রথম নাম মান; পরে বিদ্ধ্যাগিরির দর্প চূর্ণ করে তিনি অগস্তি নাম প্রাপ্ত হন। এখন দেখছি, উপরের প্রমাণ অনুসারে এই মহর্ষি মিত্রাবরুণের পুত্র। মিত্র ও বরুণ এরা দেবতা। কিন্তু বংশরক্ষা না হলে দেবতাদেরও সদগতি হয় না, তাই আশ্চর্য্যের বিষয়। ভগবান্ অগস্ত্য দারপরিগ্রহ করবেন না, এরূপ ইচ্ছা করেছিলেন। কিন্তু তিনি দেখলেন, একটি গর্ত্তের মধ্যে তাঁর পিতৃপুরুষেরা অধোমূখে ঝুলতেন। মহর্ষি ব্যস্ত হয়ে এর কারণ জানতে চাইলেন। তাঁরা বললেন,-বৎস্য! আমরা তোমার পিতৃলোক; তুমি বংশরক্ষা করলে আমাদের সদগতি হয়।’ [মহাভারত বন-৯৬ অং]।
তবে বিবাহ করা আবশ্যক হল। কিন্তু বিবাহ করতে হলে মনের মত কন্যারত্ন চাই। সংসারে সুন্দর অনেক সামগ্ৰী আছে, কিন্তু দশটি সুন্দর দশ ঠাঁই ছড়ান। তাই মহর্ষি সুস্থিরচিত্তে চক্ষু বুঝে জগতের যত সৌন্দর্য্য বাছতে বসলেন। মনে মনে গাছের চাপা ফুল পাড়িলেন, কন্যার গায়ের রঙ্ ফলাবেন। জলের পদ্মফুল তুললেন, মুখ গড়বেন; আর আকাশ হতে পূর্ণিমার চাঁদ আনলেন-হাসির সঙ্গে মিশিয়ে দিবেন। বাছতে বাছতে ঋষির হৃদয়ে শুধুই রূপসাগর উথলে উঠল। সেই সময় বিদর্ভরাজ পুত্রকামনায় তপস্যা করছিলেন। স্ত্রীরত্ন নিৰ্ম্মাণ করা হল; অগস্ত্য সেই কন্যা মহারাজকে অর্পণ করলেন। ইনিই মহর্ষির স্ত্রী, পরে লোপামুদ্রা নামে প্রসিদ্ধ হন। লোপামুদ্রার গর্ভে দৃঢ়স্যু নামে এক সস্তান জন্ম নিয়েছিল। সেই তেজস্বী পুত্র বাল্যাবস্থা হতে ইন্ধন আহরণ করতেন বলে অতঃপর তাহার নাম ইধ্মবাহ হয়।
ইধ্মানাংভারমাজহ্রে ইধ্মবাহস্ততোভবৎ।
[মহাভারত বনপৰ্ব্ব ৯৯ অং ২৩—২৭ শ্লোক দেখ]
এই স্থানে মহা গোল। তাহার শৈলী করবার কোন উপায় দেখি না। রামায়ণের অরণ্যকাণ্ডে সুতীক্ষ্ণমুনি, রামচন্দ্রকে অগস্ত্যাশ্রমের পথ দেখালেন—
(দক্ষিণেন মহাঞ্ছ্রীমানগস্ত্য ভ্রাতুরাশ্রমঃ। ১১/৩৭।)
তুমি ঐদিক্ দিয়ে যাবে, ঠিক ঐদিকে। দক্ষিণদিকে আর চারি যোজন পথ। চারি যোজন পথ গেলেই অগস্ত্যভ্রাতার মহা শ্ৰীমান্ আশ্রম দেখতে পাবে।
অগস্ত্যের ভাই কে, বাল্মীকি তাই বলে দিলেন না। কিন্তু স্বামিকৃত টীকায় লেখা হয়েছে, তাঁর নাম-ইধ্মবাহ। যথা-(তত্রাগস্ত্য ভ্রাতাশ্রমে ইধ্মবা হেতি অস্য নাম। অগস্ত্যঃ প্রাগ্দুহিতরমুপয়েমেহব্রতা মস্যাং দৃঢ়ব্রতোজাত ইধ্মবাহাত্মজমুনিরিতি ভাগবতংতু দেবয়াচ্চসুতোৎপত্তিরিতি ন্যায়েনেত্যেকে)।
অগস্ত্যমুনির আশ্রমও এক স্থানে ছিল না। সুতীক্ষ্ণমুনি রামকে যে প্রকার পথ বলে দিলেন, তার অনুসারে দণ্ডকারণ্যে তাঁহার আশ্রম। দণ্ডকারণ্য গোদাবরীর উত্তর কূলে, আধুনিক বেরারের পূর্ব্ব উত্তর সীমা। মহাভারতের মতে অগস্ত্যাশ্রম গয়ার নিকটে ছিল।
[ বনপৰ্ব্ব ৯৭-৯৯ অধ্যায় দেখ ]।
এই মুনির অসাধারণ তপোবল। তিনি দেবতাদের অনুরোধে সাগর শোষণ করেন; ইল্বল ও বাতাপি অসুরকে নষ্ট করে ফেলেন। বিন্ধ্যাচল, সূৰ্য্যপথ রোধ করবার জন্য সংকল্প করেছিল, তিনি সেই পৰ্ব্বতের দর্পচূৰ্ণ করেন। রাম দণ্ডকারণ্যে তাহার আশ্রমে উপস্থিত হলে মহর্ষি তাকে বৈষ্ণবধনু, ব্ৰহ্মাদত্ত শর, অক্ষয় তুণীর ও খড়গ প্রদান করেছিলেন। কিন্তু এত প্রতাপ থাকলেও অগস্ত্য মুনি নহুষরাজার শিবিকা বয়ে বেড়াতেন। এক দিন মহারাজ শিবিকা চড়ে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ তাহার পা মহর্ষির গায়ে লাগল। সেই অপরাধে অগস্ত্য নহুষরাজকে সৰ্প করে দিলেন।
[মহাভারত বনপৰ্ব্ব দেখ ]।
বিন্ধ্যগিরির দর্পহরণের পর অগস্ত্য মুনি দাক্ষিণাত্যে গিয়ে অবস্থিতি করেন। দ্রাবীড়াদি অঞ্চলের লোকেরা তাঁহার নিকট নানা প্রকার বিদ্যাধ্যয়ন করেছিলেন। ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা অনুমান করেন, অগস্ত্য তিব্বত দেশের লোক। এই মহর্ষি এখন নক্ষত্র রূপে আকাশের দক্ষিণদিকে অবস্থিতি করছেন।
বিশ্বকোষ
নিবেদনে- সনাতন সংবেদ
বিশ্বকোষ
নিবেদনে- সনাতন সংবেদ
অগস্ত্য (পুং) অগ-স্ত্যৈ-ক। অগং বিন্ধ্যাচলং স্ত্যায়তি। অগস্ত্যমুনি। বকবৃক্ষ। অগস্ত্যের পুত্র-আগস্ত্য।ঋষ্যন্ধকবৃষ্ণিকুরুভ্যশ্চ। পা ৪/১/১১৪। বশিষ্ঠ আদি প্রসিদ্ধ ঋষিদের নামের উত্তর এবং অন্ধক, বৃষ্ণি ও কুরু শব্দের উত্তর অপত্যার্থে অণ্ প্রত্যয় হয়। বাচস্পতি লিখেছেন-‘যস্কা যঞ্। আগস্ত্যস্তদপত্যে।’ এটি পাণিনি বিরুদ্ধ প্রসঙ্গ করা হয়েছে। অগস্ত্য শব্দ যস্কাদি গণের অন্তর্গত নহে। উহার উত্তর অণ্ হবে, যঞ্ নহে। ‘অগস্ত্যশব্দাদৃষ্যণ্’ ইতি জয়াদিত্যঃ।
শেয়ার অপশন থাকলে ভালো হত।
উত্তরমুছুন