অক্রিয়াবাদী-
গৌতম বুদ্ধের সময় ছয় শ্রেণীর অজ্ঞেয়বাদী বা বস্তুতন্ত্রবাদী বিদ্যমান ছিল। এরা না ছিলেন হিন্দু, না ছিলেন বৌদ্ধ। এই ছয় শ্রেণীর মধ্যে এক শ্রেণীর সাথে জৈনদের সম্বন্ধ দেখা যায়। অপর পাঁচটি শ্রেণীর উপদেষ্টাদের মধ্যে পাঁচজনের নাম বিশেষ প্রসিদ্ধ। এদের একজনের নাম বেলট্ঠ্পুত্র সঞ্জয়। দীঘ-নিকায় ১ম খণ্ডে (২৩-২৮) সঞ্জয়মত অবলম্বীদের অনুরূপ সম্প্রদায়ের উল্লেখ আছে।
অপর চারটি শ্রেণীর মতবাদীকে অদৃষ্টবাদী ও বস্তুতন্ত্রবাদী বলা হয়। এদের মতে ‘খাও দাও স্ফুর্ত্তি করে- ভাবনা চিন্তার কোন কারণ নাই, কেন না কালই আমরা মরতে পারি।’ এই মত ভারতবর্ষে কখনও এ সকল মত চালাতে চেষ্টা করে নাই। কেবল ‘বার্হস্পত্যদর্শনে’ এমন মতের উল্লেখ আছে। পণ্ডিতেরা বলেন, বৃহস্পতি নামে কোন ব্যক্তির এমন মত ছিল না। এটি কোন উর্বর-মাথার পণ্ডিতের কল্পনা প্রসূত হবে হয়তো। এই শেষোক্ত চার শ্রেণীর মতবাদীরাই অক্রিয়বাদী নামে পরিচিত।
এদের মতে ইচ্ছার স্বাধীনতা নাই; অন্যান্য কাজের যেমন কারণ আছে, ইচ্ছারও তেমনই কারণ আছে। মানুষের দায়িত্বজ্ঞান এর অস্তিত্ব আছে তারা এটি স্বীকার করে না। ভাল বা মন্দ কাজ করলে মানুষ উৎকর্ষ বা অপকর্ষ লাভ করে না। জন্মান্তরে বা দেহান্তর আশ্রয়ে এরা বিশ্বাসী, এরা সন্যাসী। এদের মতে মানব প্রকৃতির নিয়মে বারবার জন্মগ্রহণ করে থাকে। কর্মফলে এনাদের আস্থা নেই। সুকৃতির ফলে মানুষ যে উচ্চবর্ণে জন্মগ্রহণ করে, একথা এনারা স্বীকার করেন না। সন্ন্যাসধর্ম আত্মার গতি বৃদ্ধির সহায়ক। এটি মুক্তির পথে উন্নিত করার অনিবার্য উপাদান। এমন মতবাদীদের প্রকৃত মত কি তা জানার উপায় নেই। বৌদ্ধদের অঙ্কিত বিকৃত চিত্র থেকে আমরা কতক ধারণা পেতে পারি মাত্র।
এনাদের মধ্যে পুরাণ কাশ্যপের মতে ধর্মকর্ম করলে কোনরকম উৎকর্ষ লাভ অথবা মানবকে হত্যা করলে কোনরকম অপরাধ বা ক্ষতি হয় না।
এই মতাবলম্বী সন্ন্যাসী অজিত কেশবকম্বলী বলেন, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে চারটি মূল পদার্থ ভিন্ন আর কিছুই নেই। দেহের ধ্বংসের সাথে মূর্খ ও জ্ঞানীর কিছুমাত্র অস্তিত্ব থাকে না। ইনি লোমবহুল ছিলেন তাই লোকে তাকে কেশকম্বলী বলতো।
পুকুধ কচ্চায়নের মত স্বতন্ত্র। তিনি বলেন, যখন একটি তীক্ষ্ণ তরবারি মাথাকে দুইভাগ করে, তখন আত্মা ও যন্ত্রণার অনুভূতি ঠিক সেরকম কাজ করে থাকে, যেমন তরবারি ও মাথার মূল উপদান গুলি কাজ করে।
এই মতের অবলম্বীদের ভিতর সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করেছিলেন মঙ্খলি গোসাল। ইনি কার্য-কারণ বাদের অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। এনার মতে মানুষের স্বাধীনভাবে চিন্তা করার শক্তি নেই। মূর্খ ও বিজ্ঞ ব্যক্তি ৮৪ লক্ষ যোনি পরিভ্রমণ করার পর সমস্ত যন্ত্রণার অনুভূতি থেকে পরিত্রাণ পায়। এই মতের অবলম্বীদের ‘অজীবিক’ বলা হয়। অশোকের সময় থেকে খৃষ্টীয় ১৩শ শতক পর্যন্ত দক্ষিণ ভারতের লেখমালায় আজীবিক সম্প্রদায়ের উল্লেখ দেখা যায়। অশোকের সময় এদের স্বাধীন সত্ত্বা ছিল। অনেকের মতে দিগম্বর সম্প্রদায়ের জৈনদের আজীবিক বলা হতো।
এই মত প্রতিষ্ঠাতার সম্বন্ধে নানা বিরুদ্ধ মত প্রচলিত আছে। কারণ ইনি জৈন ও বৌদ্ধ উভয় সম্প্রদায়ের লোকের কাছে কিছুমাত্র আদরনীয় ছিলেন না, ফলে উভয় সম্প্রদায়ের লেখকেরাই এর নামে কুৎসা রটাতে কুণ্ঠিত হতেন না।
জৈন দিগম্বর সম্প্রদায়ের সাথে এদের মতের অনেকটা মিল আছে। কিন্তু উক্ত উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে পার্থক্যো যথেষ্ট। ঐ মতভেদ গুলি সামাজিক মঙ্গলের পরিপন্থী। মঙ্খলি গোসাল ভাতৃমণ্ডলী বা সংঘ স্থাপনের বিরোধী ছিলেন, নির্জনে বাস ও সম্পূর্ণ নগ্নভাবে থাকার পক্ষপাতী ছিলেন না, দূষিত পদার্থ খেয়ে আত্ম নিগ্রহ করতেও চাইতেন না।
কোন মন্তব্য নেই