অক্রূর বৃত্তান্ত
অক্রূর শ্রীকৃষ্ণের পিতৃব্য। যদু বংশীয় ধর্মাত্মা রাজা শ্বফল্কের ঔরসে ও কাশীরাজ দুহিতা গান্দিনীর গর্ভে এনার জন্ম। অক্রূর যমুনা হ্রদে নিমগ্ন হয়ে নাগলোক দর্শন করেন এবং সেখানে বাসুদেবকে দেখে যৎপরোনাস্তি বিস্মিত হন।
এক সময়ে রাজা কংস তার শত্রু কৃষ্ণ ও বলরামকে বিনাশ করার জন্য ছলে ধনুর্যজ্ঞের আয়োজন করেন এবং তাদেরকে মথুরায় আনার জন্য নিজ বোনের দেবর অক্রূরকে দূত করে নন্দের আয়লে পাঠান। অক্রূর নন্দালয়ে উপস্থিত হয়ে নন্দের অনুমতি নিয়ে কৃষ্ণবলরামকে সাথে নিয়ে মথুরায় ফিরে আসেন।
কংসের সভায় যাওয়ার সময় তিনি দুই ভাইকে বিশেষতঃ কৃষ্ণকে বলেন, দেখ, তোমার পিতা কংসের অত্যাচারে উৎপিড়িত হয়ে অবিরত রোদন করে অন্ধ হয়েছেন, আর তোমারও কংসকে বধ করার জন্য ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছ, অতএব কাল বিলম্ব না করে কংসকে নিধন করে তার উপযুক্ত প্রতিফল দাও। পরে কংস কৃষ্ণের হাতে নিহত হন।
অক্রূর অত্যন্ত কৃষ্ণ-ভক্ত ছিলেন। কংসবধের পর শ্রীকৃষ্ণ পাণ্ডবদের প্রতি ধৃতরাষ্ট্রের ব্যবহার জানার জন্য অক্রূরকে হস্তিনায় পাঠান। সেখান থেকে ফিরে অক্রূর ধৃতরাষ্ট্রের বিদ্বেষভাব পোষণের কথা শ্রীকৃষ্ণকে জানিয়ে দেন।
কৃষ্ণ পত্নী সত্যভামার পিতা রাজা সত্রাজিতের স্যমন্তক নামে এক মণি ছিল। এক সময়ে অক্রূর এই সত্যভামার পাণি প্রার্থী হয়েছিলেন কিন্তু কৃষ্ণের সাথে তার বিবাহ হওয়ায় তিনি ব্যর্থ হন। এতে করে অক্রূরের মনে কৃষ্ণ বিদ্বেষ জেগে উঠে। তিনি ক্রোধের বশে শতধন্বাকে সত্রাজিতের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তোলেন, শতধন্বা রাতের বেলায় গোপনে রাজাকে নিহত করেন। শতধন্বা রাজা সত্রাজিতের ঐ স্যমন্তক মণি অপহরণ করে অক্রূরকে দিয়েছিলেন। সত্যভামা তার পিতৃহত্যার বিবরণ শ্রীকৃষ্ণকে জানালে তিনি ঐ মণীর উদ্ধারের জন্য শতধন্বার সাথে যুদ্ধ করেন এবং মিথিলার উপবনে গোপনে তাকে বধ করেন। শতধন্বার মৃত্যুর খবরে ভীত হয়ে অক্রূর মণিটি নিয়ে কাশীধামে পালিয়ে যান এবং শ্রীকৃষ্ণের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য নানা উপায় অবলম্বন করতে থাকেন। যাগযজ্ঞে ব্রতী থাকলে কেউ আর তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়াবেন না এইভেবে তিনি দীর্ঘসময়ের জন্য যাগযজ্ঞে ব্যস্ত থাকলেন।
অক্রূর যতদিন দ্বারকাতে ছিলেন, ততদিন স্যমন্তক মণির প্রভাবে সেখানে কোনরকম উপদ্রম ঘটেনি। তার দ্বারকা ত্যাগের সাথে সেখানে দুর্ভিক্ষ, মহামারী, সর্পভয় প্রভৃতি নানারকম উপসর্গ দেখা দিল। এসব অনর্থের কারণ নির্ণয়ের জন্য দ্বারকায় এক মহতী সভা আহত হয়। সেই সভায় স্থির হয় যে, পূণ্যাত্মা অক্রূরের মথুরা ত্যাগের পর থেকে এই সমস্ত আধি-ব্যাধির সূচনা হয়েছে; সুতরাং অবলম্বে তাকে পুনরায় ফিরিয়ে আনা কর্তব্য এবং ফিরিয়ে আনা হল। তার আগমনের সাথে সাথেই দেশের সমস্ত উৎপাত প্রশমিত হল, সমস্ত অমঙ্গল দূর হল। তখন শ্রীকৃষ্ণ মনে মনে চিন্তা করে স্থির করলেন, স্যমন্তক মণি নিশ্চয়ই অক্রূরের কাছে আছে। এদিকে শতধন্বার হত্যা সংবাদে সমস্ত যাবদ মন্ডলী, এমন কি বলভদ্রও শ্রীকৃষ্ণ এই হত্যা কাণ্ডে জড়িত আছে মনে করে সন্দেহ করলেন। এই সংশয়ে শ্রীকৃষ্ণ চরিত্রে কলঙ্ক আরোপ হলো, কিন্তু তিনি তাতে বিচলিত হলেন না। বরং তিনি কৌশলে অক্রূরের কাছ থেকে ঐ মণী হস্তগত করতে চেষ্টা করতে লাগলেন।
স্যমন্তক মণির প্রভাবে অতুল ঐশ্বর্যের অধিপতি হয়ে অক্রূর দান ধ্যান করে দানপতি হয়েছেন। শ্রীকৃষ্ণ তার পরম-ভক্ত অক্রূরকে একদিন নিমন্ত্রণ করলেন, সাথে সাথে সমস্ত যদুবংশও নিমন্ত্রিত হল। উপস্থিত যাদবদের সামনে শ্রীকৃষ্ণ অক্রূরকে বললেন, আজ আমার গৃহ পবিত্র। দানপতির কাছে আজ আমি জানতে চাইবো। আমরা বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছি যে শতধন্বা স্যমন্তকমণি হরণ করে আপনার হাতে দিয়ে যান, এখন ঐ মণি আপনার কাছে আছে। সেটি একবার আমাদের দেখান।
শ্রীকৃষ্ণের এরকম কথায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে অক্রূর নিজের পরিধেয় কাপড়ের মধ্য থেকে সুবর্ণ কৌটায় লুকিয়ে রাখা স্যমন্তক মণী সবার সামনে বের করলেন। মণির প্রভায় চারদিক উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। শতধন্বাকে বধ করে কৃষ্ণই যে মণি আত্মসাৎ করেছেন এই ভ্রান্ত ধারণা তখন যাদবদের মন থেকে দূর হল। মণি দেখে বলভদ্র সেটি চেয়ে বসলেন, সত্যভামাও তার পিতৃধন বলে দাবী করলেন। তখন বিবাদ মেটানোর জন্য শ্রীকৃষ্ণ সবার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে বললেন, এই মণিতে সত্যভামার দাবী সকলের অপেক্ষা অধিক, এটি অস্বীকার করা যায় না; কেন না এটি তার পিতৃধন। আবার আমি শতধন্বাকে হত্যা করেছি, অতএব বলভন্দ্রও আমার এতে তুলনামূলক অধিকার আছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমরা কেউই এর অধিকারী হতে পারি না। কারণ জিতেন্দ্রিয়, ধার্মিক ও সুখসম্ভোগ বিহীন না হলে যিনি একে ধারণ করবেন, এটি তার মঙ্গলের কারণ না হয়ে ধ্বংসের কারণ হবে। অতএব আমাদের মধ্যে কারও কাছে এটি থাকা উচিত নয়, কেননা আমরা ঐ সমস্ত গুণগ্রামে ভূষিত নই। বাস্তবিক অক্রূরই এটি রক্ষা করার সম্পূর্ণ উপযুক্ত। এমনটি বলার পর, সকলের পরামর্শ নিয়ে ঐ সূর্যতল্য প্রভাবশালী মণি তাকেই প্রত্যর্পণ করলেন। তিনিও সানন্দে সেটি গলদেশে ধারণ করলেন।
অক্রূরের স্ত্রী উগ্রসেনীর গর্ভে প্রসেন ও উপদেব নামে দুই পুত্র জন্মগ্রহণ করেন।
মহাভারত, হরিবংশ, ভাগবত, ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ প্রভৃতিতে অক্রূরের এমন পরিচয় আছে।
গর্গসংহিতা থেকে জানতে পারি যে, রাজা প্রদ্যুম্ন দিগ্বিজয়ে বের হলে অক্রূর তার সহগামী হয়েছিলেন। তিনি শিশুপালের সেনাপতি দ্যুমানের সাথে যুদ্ধ করেন।
পদ্মপুরাণ সৃষ্টি খণ্ড মতে অনমিত্রের অন্যতম পুত্র ছিত্র বা জয়ন্ত থেকে জয়ন্তীর গর্ভে অক্রূর জন্মগ্রহণ করেন।
আবার লিঙ্গপুরাণ মতে গর্গমুনির এক পুত্রের নাম ছিল অক্রূর। রাজা জনমেজয় তাকে বধ করে ব্রহ্মহত্যা পাপে জড়িয়ে যান। পরে অশ্বমেধ যজ্ঞ করে তিনি সে পাপ থেকে মুক্ত হন।
কোন মন্তব্য নেই