অগ্নি
অগ্নি বিভিন্ন নামে খ্যাত- অনল, বহ্নি, পাবক, হুতাশন, অগ্নিদেবতা। পরম পুরুষের মুখে এর জন্ম (ঋক্ ১০/৯০/১)। মতান্তরে ধর্মের ঔরসে বসু-ভার্যার গর্ভে অগ্নির জন্ম। কোন স্থানে দেখা যায় ইনি কশ্যপ ও অদিতির পুত্র। অগ্নি স্থূলকায়, লম্বোদর, রক্তবর্ণ, এর কেশশ্মশ্রু ভ্রু ও চক্ষু পিঙ্গলবর্ণ, হাতে শক্তি ও অক্ষসূত্র, বাহন ছাগল। পুরাণে এর আরও নানা প্রকার মূর্ত্তির বর্ণনা আছে। কোথাও তাঁর- তিন পা, সাত হাত, দুই মুখ এবং বালার্কের ন্যায় বর্ণ। ইনি দক্ষিণ পূর্বকোণের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা। ঋগ্বেদের এক চতুর্থাংশেরও অধিক শ্লোকে কেবল অগ্নির স্তব করা হয়েছে। প্রাচীনকালে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশেই অগ্নিদেবের পূজা হত। এখন ভারতবর্ষের হিন্দু ও পার্সীরাই কেবল এর অর্চনা করেন। পারস্য দেশে অগ্নিপূজা প্রায় উঠে গেছে। স্বাহা অগ্নির স্ত্রী। পুরাতন রোমকেরা একে ভেষ্টা(Vesta) নামে পূজা করতেন, কিন্তু মন্দিরে এর কোন প্রতিমূর্ত্তি রাখতেন না, কেন না-
“No image Vestas semblance can express, Fire is too subtle to admit of dress.” (Ovid)
কোন প্রতিমূৰ্ত্তিই ভেষ্টার রূপ প্রকাশ করতে পারে না। অগ্নি অতি তেজঃপুঞ্জ, একে আবার কে বেশভূষায় পরিশোভিত করতে পারে ? )
পাবক, পবমান এবং শুচি এর পুত্র। তৈত্তিরীয় সংহিতায় উল্লেখিত হয়েছে, প্রজাপতি অগ্নির সৃষ্টি করে দেবতাদের বিশ্রাম ভূমি স্বরূপ দান করেন।
এই কয়েকটি অগ্নির নামের পর্য্যায়—১) বৈশ্বানর। ২) বহ্নি। ৩) বীতিহোত্র। ৪) ধনঞ্জয়। ৫) কৃপীটযোনি। ৬) জলন। ৭) জাতবেদ। ৮) তনূনপাৎ। ৯) তনূনপা। ১০) বহিঃশুষ্মন্। ১১) বৰ্হিস্ ১২) শুষ্মন্। ১৩) কৃষ্ণবর্ত্মন্। ১৪) শোচিষ্কেশ। ১৫) উষর্বুধ। ১৬) আশ্রয়াশ। ৭) বৃহদ্ভানু। ১৮) কৃশানু। ১৯) পাবক। ২০) অনল। ২১) রোহিতাশ্ব। ২২) বায়ুসখা। ২৩) বায়ুসখ। ২৪) শিখাবৎ। ২৫) শিখিন্। ২৬) আশুশুক্ষণি। ২৭) হিরণ্যরেতস্। ২৮) হুতভূক্। ২৯) হব্যভুক্। ৩০) দহন। ৩১) হব্যবাহন। ৩২) সপ্তার্চ্চিস্। ৩৩) দমনস্ ৩৪) দমূনস্। ৩৫) শুক্র। ৩৬) চিত্রভানু। ৩৭) বিভাবসু ৩৮)শুচি। ৩৯) অপ্পিত্ত। ৪০) বৃষাকশি। ৪১) জুহূবাল। ৪২) কপিল। ৪৩) পিঙ্গল। ৪৪) অরণি। ৪৫) অগির। ৪৬) পাচন। ৪৭) বিশ্বস্পস্। ৪৮) ছাগবাহন। ৪৯) কৃষ্ণার্চ্চিস্। ৫০) জহুবার। ৫১) উদর্চ্চিস্। ৫২) ভাস্কর। ৫৩) বসু। ৫৪) শুষ্ম। ৫৫) হিমা রাতি। ৫৬) তমোনুৎ। ৫৭) সুশিথ। ৫৮) সপ্তজিহব। ৫৯) অপপারিক। ৬০) সৰ্ব্বদেবমুখ। ৬১) অগ্নি।
কর্ম বিশেষে অগ্নির পৃথক পৃথক্ নাম নির্দিষ্ট আছে।
নবগৃহে প্রবেশ কর্মে- পাবক। গর্ভধানে- মারুত। পুংস্রবনে- চন্দ্ৰমস্। শুঙ্গাকর্মে- শোভন। সীমন্তে- মঙ্গল। জাতকর্মে- গ্ৰগল্ভ। নামকরণে- পার্থিব। অন্নপ্রাশনে- শুচি। চুড়াকরণে- সত্য। ব্ৰতে- সমূদ্ভব। গোদান সংস্কারে- সুর্য। সমাবর্ত্তনে- অগ্নি। সাগ্নিকের বেদ সমাপন ক্রিয়ার- বৈশ্বানর। বিবাহে- যোজক। বিবাহের পর চতুর্থ হোমে- শিখী। ধৃতি হোমাদিতে- অগ্নি। প্রায়শ্চিত্তাত্মক মহাব্যাহৃতিহোমে- বিধু। বৃষোৎসর্গ গৃহপ্রতিষ্ঠাদি কর্মে- সাহস। লক্ষহোমে- বহ্নি। কোটিহোমে- হুতাশনো। পূর্ণাহুতিতে- মৃড়ু। শান্তিকর্মে- বরদ। পৌষ্টিকে- বলদ। অভিচারে- ক্রোধ। বশীকরণে- শমন। বরদানে- অতিদূষক। কোষ্ঠে- জঠর। অমৃতভক্ষণে- ক্রব্যাদ।
সংস্কৃত অগ্নি এবং লাটিন্ ইগ্নিস্ (Ignis) এই উভয় শব্দে সাদৃশ্য রয়েছে। গ্রিস্দেশে প্রাচীন কালের একটা গল্প আছে যে, প্রমিথিয়স্ নামে জনৈক ব্যক্তি বিলক্ষণ জ্ঞানী হয়ে উঠেছিলেন। তিনি মাটির পুতুল নির্মাণ করতেন। তারপর স্বৰ্গ থেকে অগ্নি এনে তা দিয়ে সেই সকল মাটির পুতুলের প্রাণপ্রতিষ্ঠা করতে পারতেন। আর্যেরা অরণি মথিয়া অগ্ন্যুৎপাদন করতেন, অতএব সংস্কৃত প্রমন্থ শব্দের সঙ্গে গ্রিক্ প্রমিথিয়স্ শব্দের সম্পূর্ণ সাদৃশ্য রয়েছে। বোধ হয় প্রাচীন গ্রিস ও ইতালীর লোকেরা আর্যদের থেকে অগ্ন্যুৎপাদন কৌশল ও অগ্নির নাম শিখেছিলেন।
আদিম অবস্থায় মানুষ অগ্নুৎপাদন করতে জানতেন না। অগ্নি কি, বিদ্যুৎ ও দাবানল দেখে মানুষের প্রথম সে জ্ঞান জন্মে। আল্ভারো ডি সাভেডারা (Alvaro de Saavadara) নামক স্পেন্ দেশীয় জনৈক পরিব্রাজক লিখেছেন যে, প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্য স্থিত লোস্ জার্ডিন্ (Los Jardines) দ্বীপের লোকেরা আগে অগ্নি কখনও দেখেনি। সমুদ্রের কুলে জাহাজ ভিড়লে দ্বীপবাসীরা এসে জাহাজীদের কাছে প্রথম আগুন দেখল। বিদ্যুৎ ও সুর্যের মত কি সব তেজঃপুঞ্জ, দপ্ দপ্ করছে, উপর দিয়ে ধূম উড়ছে। চোখের উপর এই ভয়ঙ্কর ব্যাপার দেখে সকলে প্রাণ নিয়ে পালাতে থাকলো। একবার মাগিলান্ তাদের কুটিরে আগুন লাগিয়ে দেন। কুটির ধূ ধূ করে পুড়তে লাগল। দ্বীপবাসীরা স্থির করল যে, নূতন রকম কোন একটা ভয়ঙ্কর বন্য পশু এসে তাদের ঘর দ্বার খেয়ে ফেলছে।
হিন্দু, পারস্য, কাল্ডিয়া, মিসর, ইহুদী, গ্রিক্, রোমক, চীন প্রভৃতি সকল জাতির শাস্ত্রেই দেখা যায় যে, তাদের দেবমন্দিরে রাত্রিদিন অগ্নি প্রজ্বলিত থাকত। দেবালয়ে অগ্নি জ্বেলে রাখবার বাবস্থা বাইবলেও দেখা যায়। (Levicus IV, 13 )। এখনো কোন কোন খৃষ্টান সম্প্রদায় প্রকারান্তরে অগ্নিপূজা করেন। কিন্তু কোন জাতির মধ্যেই আগের মত অগ্নিপুজার ঘটা নাই।
তথ্যসুত্র- বিশ্বকোষ প্রথম খণ্ড।
কোন মন্তব্য নেই