sanatansangbed

Introduction of SANATAN dharma scriptures

বেদের পরিচয়_প্রথম অধ্যায় _প্রস্তাবনা

সে এক অতীত গৌরবের শান্তিময় কথা। জগতের সভ্যতা তখন এই স্নেহময়ী জননী-স্বরুপিনী পরমপূতভূমি আমাদের সমুজ্জল ভারতবর্ষে চরম সীমা লাভ করেছিল। গ্রীক্‌সভ্যতার সংবাদ তখনও লোক-সমাজে পৌঁছায় নাই-জগৎ তখনও বিচলিত হয় নাই কুহকিনীর কুটিলনাট্যসম জড়-সভ্যতার মনোমুগ্ধকর বাহ্যিক চাকচিক্যে। এমন কি, বর্তমান সময়ের তথাকথিত বহু সভ্য জাতির অস্তিত্ব পর্যন্ত তখন ছিল কি না সন্দেহ। আর যদিও সেই সকল জাতির কোনও অস্তিত্বের সংবাদ পাওয়া যায়, তাদের আচার-ব্যবহার, শিক্ষা-দীক্ষা, শারীরিক ও মানসিক বৃত্তি বন্য পশু হতে বিশেষ শ্রেষ্ঠ ছিল বলে স্বীকার করা যায় না। 

ভারতের সেই গৌরব-রবি আজ পরমার্থ আকাশের পশ্চিমাচলে অস্তমিতপ্রায়। অনন্ত ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে আবহমান কাল যে পারমার্থিক সভ্যতার জয়-পতাকা আজও পর্যন্ত কোনপ্রকারে উড্ডীন রয়েছে, তাকে চিরতরে ধূলিসাৎ করবার জন্য চারদিক থেকে যে প্রবলা বাত্যা উত্থিতা হয়েছে, তার সর্বগ্রাসিনী শক্তির হাত থেকে ভারতের সেই সর্ব-প্রাচীন পরমার্থ-জয়পতাকা আজ রক্ষা করে অভ্রভেদি-গিরিশৃঙ্গসম উন্নত রাখবার জন্য কি সেই গৌরবে গৌরবান্বিত শতসহস্র ঋষিসন্তান উন্নতমস্তকে স্ফীতবক্ষে উঠে দাঁড়াবেন না? নিভৃতে নির্ঝরিত বক্ষ-ভাসান চক্ষের তপ্তবারি মুছে ফেলে অতীত গৌরব অক্ষুন্ন রাখবার জন্য কি আর্য-পুত্রগণ প্রবল উৎসাহে বিপুলা চেষ্টার আবাহন করবেন না? 

সেই পারমার্থিক গৌরব কেবল মাত্র আর্য সন্তানদেরই সম্পত্তি নয়; সমগ্র বিশ্ব-যাবতীয় চেতনাচেতন জগতের প্রাণীই অনাদিকাল থেকে ভারতের ভাগ্যাকাশে উদিত পরমার্থরবির কিরণে উদ্ভাসিত, জ্যোতিতে অনুপ্রাণিত ও আকর্ষণে নিত্য-শ্রেয়ের পথে পরিচালিত। এই আদি-আদিত্যেরই অতি ক্ষুদ্র কিরণচ্ছটায় পথ দেখিয়ে পরবর্তী কালের পথভ্রষ্ট দিশাহারা বহু জীবকে পথ প্রদর্শনের প্রয়াস পেয়েছেন কতশত আচার্য, ধর্মগুরু ও ধর্মমত-প্রবর্তক। নিরপেক্ষভাবে আলোচনা করলে সহজেই প্রমাণিত হয় যে, তাঁদের যাবতীয় শিক্ষা, ধর্ম উপদেশ ও প্রচারপ্রচেষ্টার অশেষ যন্ত জ্ঞাত অজ্ঞাতভাবে এই পারমার্থিক ভারতেরই অফুরন্ত আদি রত্নভাণ্ডার হতে উৎপত্তি লাভ করেছিল। বর্তমান সময়ে সেই অমূল্য রত্নরাজির সনাতনী বীর্যবতী কথার আলোচনা অভাবে তা বিস্মৃতির অগাধ জলধিগর্ভে নিক্ষিপ্ত দেখে অনেক সদয়-হৃদয়, ধর্মপ্রাণ সজ্জনের শঙ্কার কারণ হয়েছে এবং এই জন্যই সেই অপ্রাপ্য রত্ন-ভাণ্ডারের গভীরতম তলদেশ হতে দুই একটি রত্ন আহরণ করে তার দিগদর্শন করবার জন্য বর্তমান প্রয়াস। অতীত গৌরবের মূলভিত্তি হল ঋষিসন্তানদের হৃদয়-ধন বেদশাস্ত্র ও তার শিক্ষা। এ হেন বেদশাস্ত্র কি, এর উৎপত্তি কি প্রকারে হয়েছিল এবং এতে আছেই বা কোন্‌ রত্ন কি ভাবে নিহিত, তা উদ্‌ঘাটনের প্রযন্ত করব সকলের বোধগম্য সহজ-সরল ভাষার মধ্য দিয়ে, যাতে আর্যসন্তান বেদ-রত্ন আভরণে সজ্জিত হয়ে দাঁড়াতে  পারেন সহাস্যবদনে বেদপুরুষের সন্মুখে।

বেদসংহিতা তুলে ধরেছেন বিশ্বদরবারের সন্মুখে সকল প্রকার হিতকর বস্তুর সারপদার্থটি। যদি কিছু জগতে গ্রহণীয় হয়, তবে মঙ্গলকামীর পক্ষে বেদশাস্ত্রই সর্ব অগ্রণী। যদি সর্বকল্যাণকর অবিনশ্বর পরম-রত্নের সন্ধান করতে হয়, তবে বেদই তা সম্যক্‌ প্রদান করতে যোগ্যতম বলে চিরপরিচিত। ভারতের ঋষিসন্তানদের নিত্যধর্মের মূল ও অবলম্বনস্বরূপ এই বেদ। রাক্ষসী-স্বরূপিণী পাপিয়সী নাস্তিকতা স্বতঃই পরমশত্রুর ন্যায় মানব-জাতিকে ধর্মপথ থেকে বিচ্যুত করে অন্তিমে ভগবদ্বিদ্বেষে নিযুক্ত করতে যত্নবতী; তার এই অকল্যাণকারণী চেষ্টার হাত থেকে রক্ষা করতে বেদই সর্বোত্তম শক্তিশালী বান্ধব। সনাতন সিদ্ধান্তের বেদই একমাত্র আগম এবং পরোক্ষ-বস্তুর বিভিন্ন ধর্ম আদির তারতম্যবিচারে ভ্রমশূন্যতা সূচনাকারী বেদ। পুরাকালে কতশত মহর্ষি-রাজর্ষিই না বেদপ্রভাবে সংসারে সুখ-সম্পত্তির অধিকারী হয়েও অন্তিমে পরাৎপর ভগবানের অশোক-অভয়-চরণামৃত-পানে প্রমত্ত হয়ে নিত্য-কল্যাণ প্রাপ্তিতে ধন্যাতিধন্য হয়েছিলেন। গোভিল-আশ্বলায়ন-মনু প্রভৃতি কত কত মহর্ষি বেদ্র বিধিনিষেষ-বাক্য অনুশীলন করে সূত্র-সংহিতা, স্মৃতি-শাস্ত্রাদি রচনা করে অমরত্ব লাভ করে গেছেন-মার্কণ্ডেয়-ব্যাসাদি উপদেষ্টাগণ বেদের আখ্যায়িকাভাগ পল্লবিত করে বিবিধ বিস্তৃত ইতিহাস-পূরাণ আদি প্রচার করে বিশ্বের মহা মঙ্গল বিধান করে গেছেন-কঠ-বাল্মীকি প্রভৃতি মুনিগণ বেদের কবিত্বের আশ্রয় করেই 'আদি-কবি' বলে যশঃ অর্জন করেছেন- যাজ্ঞবল্ক্য-পাণিনি প্রভৃতি মনীষিগণ বেদের বোধ সরল করবার মানসে কতই বা পরিশ্রম করে ব্যাকরণশাস্ত্র প্রচার করে গেছেন-স্থৌলাপ্টীবী-শাকপূনি-যাস্ক প্রভৃতি ঋষিগণ বেদের শব্দার্থ হৃদয়ঙ্গম করাবার জন্য অঙ্কশাস্ত্র প্রণয়ন করেছিলেন- বেদের ভাগবত বিবাদ মীমাংসা করে জৈমিনি প্রভৃতি মহামুনিগণ শিষ্যপরম্পরায় অটুটকীর্ত্তি লাভ করেছেন-মহর্ষি-কপিলাদি যোগিগণও বেদের দোহাই না দিয়ে চলতে সমর্থ হন নাই এবং বেদের কোটি অংশের এক অংশ আশ্রয় করেই বর্তমানকালে কতশত ব্যক্তিই না সাহিত্যিক, কবি, জ্ঞানী, ধার্মিক প্রভৃতি আখ্যায় যশঃশোভা লাভ করে সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। এই বেদশাস্ত্রের অধ্যয়ন হতেই পুরাতন আর্যগণ বহুপ্রকার অস্ত্র-শস্ত্র ব্যোমযান-ধূমযানাদি আবিষ্কার করে তাঁদের আক্ররয্যকুশলতার পরিচয় দিয়েছেন। যে আর্যাবর্তে শতসহস্র রাজবিপ্লব, রাষ্ট্রবিপ্লব, বিধর্মীর কূটনাট্য, ম্লেচ্ছের কূটনীতি সত্ত্বেও বেদ ভাস্কর এতাবৎকালে সমুজ্জ্বল থেকেই আজ তমসাবৃত হতে বসেছেন, সেই অতীতের পরমগৌরমস্বরূপ বেদসংহিতার পরিচয় জ্ঞাত হতে এবং তাঁর মর্যাদা রক্ষার্থে কঠিনতম হৃদয়ও কি কেঁদে উঠবে না?  আজ এই মহাদুর্দিনে আর্যসন্তানদের হৃদয় কি এই ক্ষোভ-বারিতে বিগলিত হবে না? আমরা নিকট ভবিষ্যতের দিকে লক্ষ্য করে আশাবদ্ধ মাত্র পোষণ করছি।

পরমকারুণিক শ্রীভগবানের পাদপদ্মমধু পানে বিমুখ এবং বিপথগমনকারিণী দাসীস্বরূপিণী অঘটন-ঘটন-পটীয়সী পরমা দুস্তরা ত্রিগুণাত্মিকা মায়ার ঘৃণ্যপদ-লেহনে সতত নিরত স্বরূপবিভ্রান্ত ত্রিতাপক্লিষ্ট বদ্ধ-জীবকুলের মধ্যে মানব-জাতিই শ্রেষ্ঠ। বিচার করলে দেখা যায় যে, এই মানব-সমাজ ধর্মপ্রবৃত্তির তুলাদণ্ডে চারভাগে বিভক্ত। 

(১) অতি স্বল্পসংখ্যক লোকই বর্তমান কলিহত জগতে আছেন যাঁরা নিত্য-মঙ্গলস্বরূপ শ্রীভগবানের অনুকম্পায় স্বশ্বর-নৈতিক-জীবন যাপন করে শ্রেয়ঃপথ আশ্রয়ে পরমা গতি লাভের জন্য উন্মুখ। 

(২) অনেকেই আছেন যাঁরা ভজন তো দূরে থাকুক, ভগবানের অস্তিত্বে পর্যন্ত বিশ্বাস করে না- না আছে তাঁদের আত্মবল আর না আছে তাঁদের নৈতিক ও মনোবল-দৈত্যপ্রকৃতি-সদৃশ সেই নিরীশ্বর নীতিবিহীন নাস্তিককূল সমাজের মহা কল্যাণকারী। 

(৩) তৃতীয় শ্রেণীর লোক যদ্যপি নিরীশ্বরবাদী বা নাস্তিক, তথাপি নৈতিক ও মানসিক বলে বলীয়ান্‌ হয়ে প্রতিমুহূর্তে পরিবর্তনশীল হয়ে জগতে সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি প্রভৃতি বিষয়ক অকিঞ্চিৎকর বস্তুর উন্নতি সাধনে ক্ষণভঙ্গুর সুখস্বচ্ছন্দ প্রদান করে পরোপকার-ব্রতে আগ্রহান্বিত,

(৪) আর চতুর্থ শ্রেণীর ব্যক্তি জগতে এখনও অনেক আছেন, বিশেষতঃ ধর্মক্ষেত্র এই ভারতভূমিতে, যাঁরা সমগ্র ঐশ্বর্য-মাধুর্য-ঐদার্য-বিগ্রহ সর্বশক্তিমান্‌ ভগবানের অচিন্ত্য শক্তিতে বিশ্বাস-পরায়ণ এবং স্বভাবের নিত্য রাজ্য হতে অভাবের ভূমিকায় হৃদয়-দৌর্বল্য বশতঃ স্থলিতপদ হলেও পরমার্থ-পথের পথিক হয়ে বিশ্বের যাবতীয় জীবের ইহ-পরকালের সুযোগ সুবিধা প্রদানে নিষ্কপট পরোপকারব্রত। 

এই চারশ্রেণীর মানবদের মধ্যে প্রথম শ্রেণীই সর্বোত্তম এবং দ্বিতীয় শ্রেণীই সর্বনিকৃষ্ট। মায়ার প্রলোভবে মুগ্ধ বদ্ধজীবগণ অসৎ চিন্তা-হৃদয়দৌর্বল্য-দ্বিতীয় অভিনিবেশ(গভীর মনঃসংযোগ)-দেহাত্মবুদ্ধি দোষ চতুষ্টয়ে ক্লিষ্ট হয়ে আহার-নিদ্রা-ভয়-মৈথুন আদি কাজে ব্যস্ত। সুতরাং বেদসমুদ্রের নিন্মতমভাগে লুকায়িত পরমার্থরত্ন সংগ্রহে তাঁদের সময় কোথায়?- সময় থাকলেও আগ্রহ কোথায়? এবং কারও কারও আগ্রহ থাকলেও যোগ্যতা অভাবে সৎসাহস কোথায়? এই প্রকারের সর্বস্বহারা মৃতপ্রায় সন্তানের যদি বেদ আলোচনায় কিঞ্চিৎ মাত্রও উৎসাহ জাগ্রত হয়, তবে অদূর ভবিষ্যতে যে আশার ক্ষীণ রেখা দৃষ্ট হবে তাতে আর সন্দেহ কি? যে 'সুজলা-সফলা' বঙ্গমাতার পুণ্যস্রোতে ভেসেছিল একদিন তাঁর কৃতিসন্তানদের গৌরব-গাথা, তার মূলে ছিল বেদানুরাগ। যে আর্যাবর্তে একদিন গভীর ওঁকারে সামঝঙ্কারে কাঁপিত দূর বিমান- যেখানে বেদ-ধ্বনিতে চেতনাচেতন জগৎ মুখরিত হত- যে দেশের বেদগানের মূর্চ্ছনা সুপ্তহৃদয়েও দিব্যভাব উদ্দীপিত করত- যে পূত-বেদভূমির এক প্রান্ত হতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত দ্বিজগণ-মুখোচ্চারিত ঋক-যজুঃ-সামমন্ত্র দিগন্ত সজীব করে ব্রহ্মাণ্ড ভেদপূর্বক পরব্যোমের দিকে আনন্দের আবেগে জীবন-গতি পরিচালিত করত- যে ধর্মক্ষেত্রে যজ্ঞবেদীতে যাজ্ঞিক ঋত্বিক্‌-অধ্বর্যদের অর্পিত আহুতি মন্ত্রের সহিত ধুমায়িত অগ্নির লেলিহান জিহবার অগ্রভাগ হতে এক দিব্যগন্ধ নিঃসৃত হয়ে ভূলোকবাসিদেরকে পুলকিত ও দ্যুলোকবাসী দেবগণের আনন্দ বিধান করে যজ্ঞেশ্বর শ্রীহরির জয়গাথাকে সুষমাযুক্তা করে দিত, সেই বেদশাস্ত্রে কি নিগূঢ় তত্ত্ব আছে, তা জ্ঞাত হওয়া সকল শ্রেয়স্কামীরই নিত্যাবশ্যকীয় ব্যাপার।

শ্রেয়ঃ ও প্রেয়োভেদে জগতের বস্তু দ্বিবিধ। তন্মধ্যে অনেকেই প্রেয়ের প্রার্থী-যা যাকে প্রীতি প্রদান করে, তা বরণ করা জীবের স্বাভাবিকী বৃত্তি। কিন্তু বিচার্য বিষয় এই যে, জগতের প্রিয়বস্তু কি সর্বসময়ে আমাদের নিকট হিতকর হয়? বস্তুতঃ বস্তু আমাদের বর্তমান রসনার তৃপ্তি বিধান করে না; যেমন, রুগ্ন ব্যক্তি অম্ল মধুর সুস্বাদু খাদ্য গ্রহণ করতে আকাঙ্ক্ষা করেন, কিন্তু প্রিয়বস্তু যে তাঁর মৃত্যুকে নিকটে আহবান করবে, তা তিনি বুঝতে পারেন না; আবার, সেই রুগ্ন ব্যক্তির রোগ আরোগ্যকরণযোগ্য তিক্ত-ঔষধ তাঁর রসনার তৃপ্তি বিধান না করলেও অন্তিমে তাঁর ক্লেশকর রোগ প্রশমিত করবে। এই বিশ্বে এমন কোন প্রাকৃতিক বস্তু লভ্য হয় না, যা সর্বপ্রাণীর পক্ষে সর্ব অবস্থায় যুগবৎ মধুর ও উপকারী। কিন্তু অনুসন্ধান করলে জ্ঞাত হওয়া যাবে যে, এক নিত্য-সুস্বাদু ও পরম মঙ্গলপ্রদ বস্তু গুপ্ত আছে ঐ বেদবাক্যের অন্তরালে। 

এমন যে আমাদের জীবনসর্বস্ব পরম মঙ্গলের আশ্রয়স্বরূপ এই বেদ-মহামণি, তা কোন এক সময়ে ভারতের প্রতি-ঘরে প্রতি-শরীরে শিরোরত্নরূপে দেদীপ্যমান ছিল। সর্বত্র তখন বেদধ্বনিতে মুখরিত হত- প্রতি বর্ষে অসংখ্য যজ্ঞ সম্পাদিত হত। কারোও কোন প্রকারের শঙ্কা ছিল না। আস্তিকতা ও ধর্মভাবে দেশ ভরপূর ছিল এবং সার্থ-সুস্বরসমন্বিত বেদসংহিতা তখন দ্বিজাতিদের কন্ঠাগ্রে থাকত। কিন্তু সময় চিরদিন এক রকম থাকে না, কালক্রমে বৈদিক ক্রিয়া অজ্ঞান অন্ধকারে আচ্ছাদিতা হতে লাগল। যে দেশে অসংখ্য বেদজ্ঞ ছিলেন, সেখানে আজ বহু অনুসন্ধান করলে ক্বচিৎ কোথাও দুই একজন মাত্র বেদজ্ঞ পাওয়া যায়। তন্মধ্যে আবার মন্ত্রার্থ-জ্ঞানসহ সুবেদজ্ঞ অতি বিরল-পাঠকমাত্র জ্ঞাতা বৈদিকই অধিক। যদি এই সময় একজন সামবেদজ্ঞের প্রয়োজন হয়, তবে অনুসন্ধান করে পাওয়া এক দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। বারাণসী হতে কান্যকুজ্ব পর্যন্ত যে দেশ বেদবিদ্যার ভাণ্ডার ছিল, সেই বারাণসীতেই বা অযোধ্যাদি ধর্মক্ষেত্রে বর্তমান সময়ে দুই একজন মাত্র বেদজ্ঞ পাওয়া যায়।

হিন্দুধর্ম অন্তর্গত বিভিন্ন সৎসম্প্রদায়ের বিদ্বৎ-সমাজে স্ব স্ব সাম্প্রদায়িক বন্ধনে এত ব্যাপৃত হয়ে পড়েছেন যে, বেদ কি বস্তু এবং তাতে কি আছে সে সম্বন্ধে তাঁদের কৌতূহল পর্যন্ত জাগ্রত হয় না। তাঁরা স্বীয় সাম্প্রদায়িক ভজনের নামে বেদাধ্যায়নে সময় বৃথা নষ্ট হবে প্রভৃতি বাক্যের প্রচারদ্বারা স্বীয় ভজন উৎকর্ষ্য প্রতিপন্ন করে ভজনানন্দী নামের প্রতিষ্ঠা লাভের গুপ্ত আশা হৃদয়ে পোষণ করেই বেদের প্রতি তাচ্ছিল্য করে শ্রুতিশাস্ত্র-নিন্দনরূপ অপরাধ করতেও ত্রুটী করেন না। কত বড় দুঃখের বিষয় যে, এক এক সাম্প্রদায়িক গ্রন্থের উপর বিংশিক টিকা-টিপ্পনী হয়ে গেছে, কিন্তু ভগবৎ-বিষয়ক জ্ঞানের যে মূল আশ্রয়-সর্বশাস্ত্রের যে প্রাণস্বরূপ-যাবতীয় সম্প্রদায়প্রবর্তক জগদ্‌গুরু আচার্য্যগণের প্রতিপাদ্য বিষয়ের যে মূলাধার, সেই বেদের অর্থবিস্তারের নিমিত্ত দুই চার ভাষ্যও পাওয়া যায় না। উবট, সায়নাচার্য, মহীধর এবং ইদানীন্তন পণ্ডিত মিশ্র ও স্বামী দয়ানন্দ ব্যতীত বেদার্থ-জ্ঞানার্জনের নিমিত্ত কয় জন সাম্প্রদায়িক মহাত্মা বেদ ব্যাখ্যা করবার জন্য জীবন নিয়োগ করেছেন? আজ এই সুবিস্তীর্ণ ভারতবর্ষে সুবেদজ্ঞ বিদ্বানের এক রকম সম্পুর্ণ অভাব বললেও অত্যুক্তি হবে না। তথাপি হৃদয়ে আশাবদ্ধ পোষণ করছি যে, আবার এমন এক সময় আসবে যখন কালচক্রের গতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বৈদিক যুগের সুষমা বিস্তারিত এবং সর্ব জগতে বেদের নিগূঢ় ধর্ম প্রসারিত হয়ে, অতীতের গৌরব-বিজয়-ডঙ্কা নিনাদিত করবে। এইজন্য এখন হতেই ধর্মপ্রাণ পণ্ডিতগণের মধ্যে বেদ-বিদ্যার আলোচনা হওয়া বিশেষ আবশ্যক। এতেই জীবের পরম মঙ্গল সাধিত হবে।

বেদজ্ঞ ও বেদধর্মের অভাব হেতুই আজ দেশে বহুপ্রকারের মত-মতান্তর নিয়ে সাম্প্রদায়িক কলহ। কলহে ও পরস্পর দোষ-নির্দ্দেশ-কাজে ব্যাস্ত থেকে ঐ প্রকার ধর্মপ্রচারকগণ ধর্মের মূল শাস্ত্র, যা হতে বিশ্বচরাচর ও যাবতীয় ধর্মভাব ও সাধন-পদ্ধতির উদ্ভব হয়েছে, তার আলোচনা, এমনি কি সেই বেদ-গ্রন্থ একবার চোখে মাত্র দেখারও অনেকেই অবসর পান না। সঙ্কীর্ণতায় অন্ধীভূত সাম্প্রদায়িকদের চিত্ত পরস্পর নিন্দাবাদে মলিন ও অবশেষে হিংসানলে দগ্ধ হয়ে যায়। তাঁরা তখন পরমার্থপথ হতে বিচ্যুত হয়ে বাহ্যিক ধর্মের আবরণে অতি ঘৃণ্য কুকাজে ব্রতী হতে কুন্ঠিত হন না। সাম্প্রদায়িক রহস্য আলোচনা ও সিদ্ধান্তে সুদৃঢ় নিশ্চয়তার যে আবশ্যকতা নাই, এমন কথা নয়। কিন্তু বক্তব্য এই যে, যে মূলাধার হতে যাবতীয় সম্প্রদায়ের উদ্ভব, সেই ভগবৎস্বরূপ বেদশাস্ত্রের প্রতি লক্ষ্য রাখা সম্প্রদায়িক সজ্জন পণ্ডিতদের উচিত। ভগবদ্দত্তা সর্বাদি, মূলাশ্রয়স্বরূপা, ভগবানের সাক্ষাৎ মুখ-নিঃসৃতা বেদবাণীর অনুসন্ধান, আলোচনা ও তদর্থবোধের প্রয়াস ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিচার পরিত্যাগ করে প্রশান্ত ও প্রশস্ত হৃদয়ে প্রত্যেক ধর্ম্মানুরাগী সাম্প্রদায়িকগণ গ্রহণ করলে, ভারতের মেঘাবৃত বেদ-ভাস্কর আবার সহাস্যবদনে আমাদের প্রতি তদীয় দিব্যজ্ঞান-কিরণ বিতরণ করবেন। 

আজ বাংলার ব্রাহ্মণসমাজের দুর্গতির সীমা নাই। ইষ্টি, যজ্ঞাদি করা দূরের কথা, এমন কি নিত্য-নৈমিত্তিক সন্ধ্যাবন্দনা ও পঞ্চযজ্ঞের পর্যন্ত লোপ হতে বসেছে। নাস্তিক্যবাদ রাষ্ট্রনীতির ভিতর দিয়ে জগৎকে পশুত্বের দিকে নিয়ে চলছে। ভারতের আর্যগণ যদি ঐভাবে বেদবিহীন-দেশ ও জাতির অনুকরণে রাষ্ট্রনীতিতে নিমজ্জিত হন, তাহলে পরমার্থ ভারতের, তথা বিশ্বের এক মহা অন্ধকার যুগ উপস্থিত হবে। ভারত ও ভারতের আর্য-ঋষিসন্তান হিন্দুগণ বেদ-ধর্মের ভিক্তি উৎপাটন করে স্বারাজ্যলক্ষ্মীর কৃপা কখনও পেতে পারেন না। ভারতে বেদরাজ্য পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হবে।

যেদিন বেদ-ধর্ম আমাদের নিকট থেকে অনেক দূরে সরে পড়ল, সেদিন হতে অনেক স্বার্থপরায়ণ ব্যক্তি স্বীয় প্রাকৃত প্রয়োজন সিদ্ধির উদ্দেশ্যে বেদের অনেক কদর্থ করে বেদধর্মের নামে বেদের প্রকৃত অর্থের প্রতি কুঠারাঘাত করতে কুন্ঠিত হন নাই। বর্তমান যুগের তথাকথিত সভ্যতা, বৈদিক আচার ব্যবহার, শৌচাশৌচ বিচার, যজ্ঞানুষ্ঠান-পূজন-পঠন-জপ-তপাদি বর্জিত হয়ে সর্বসাধারণকে মনোমুগ্ধকর আপাত সুখপ্রদ বস্তুর প্রলোভনে প্রলুব্ধ করে নিত্যকল্যাণ হতে চিরবঞ্চিত করতে কৃৎসঙ্কল্প। এমন দুর্দ্দিনে বেদ কি বস্তু এবং তাতে কি তথ্য ও সিদ্ধান্ত আছে, তা হিন্দুমাত্রই অবগত হওয়া অত্যাবশ্যক। 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.