sanatansangbed

Introduction of SANATAN dharma scriptures

বেদের পরিচয় এর ভূমিকা

 বেদের পরিচয়



ভূমিকা

[স্যার মন্মথনাথ মুখোপাধ্যায় কর্ত্তৃক লিখিত]

হিন্দুজাতির ও হিন্দুধর্মের এই যুগ-সন্ধিক্ষণে "বেদের পরিচয়" এর আবির্ভাব মহা মঙ্গলের সূচনা। এই মহামূল্য গ্রন্থের ভূমিকা রচনা বাহুল্য মাত্র। অত্যুজ্জল হীরকখণ্ডের পরিচয় দেওয়ার জন্য ভূমিকার প্রয়োজন হয় না। তথাপি এই গ্রন্থখানির ভূমিকা লেখার ভার আমার উপর অর্পিত হয়েছে। আমি অধীত-শাস্ত্র নহি, সুতরাং 'বেদের পরিচয়' এর কোনও পাণ্ডিত্যপূর্ণ পরিচয় দিবার সাধ্য আমার নাই। তবে বেদের আবির্ভাব ও মহিমা সম্বন্ধে চিন্তা করতে গিয়ে যা আমার মনে এসেছে তাই লিখেছি।

সমগ্র জগৎ অন্ধকার-সমাচ্ছন্ন! অজ্ঞানতার ঘনঘোর মহানিশার ক্রোড়ে সমুদয় জীব-জগৎ গাঢ়নিদ্রায় অভিভূত। সহসা প্রাচ্যদিক্‌চক্রবাল অরুণাভ হয়ে উঠল। সারা জগতের পবিত্র-তীর্থ এই ভারতের পুণ্য পঞ্চনদের তীর হতে গভীর উদাত্তস্বরে শাশ্বত প্রশ্ন উচ্চারিত হল- "কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম"- কে সেই দেবতা? কাহাকে হবি প্রদান করব?

 চিরন্তন প্রশ্ন! ভারতের আকাশ বাতাস কম্পিত করে-পঞ্চনদের বুক মথন করে- এই প্রশ্ন হিমালয়ের কন্দরে কন্দরে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরতে লাগল। ভারতের বুকে এই প্রশ্ন প্রথম জেগেছিল- কে সেই দেবতা, কাকে পূজা করব? বিশ্বমানবের এই আকুল জিজ্ঞাসা সর্ব্বপ্রথম উত্থিত হল যে পূণ্যতীর্থে, সেখানেই মিলল এর উত্তর ও এর সমাধান; এবং এই অভিনব আবিষ্কারের তীব্র আনন্দে যাঁদের দেহের শোণিত-প্রবাহ রক্তিমরাগে রঞ্জিত হয়ে উঠল, তাঁহারা এই ভারতের আর্য্য সন্তান-পুণ্যশ্লোক মন্ত্রদ্রষ্টা সর্ব্বত্যাগী মহর্ষিগণ। তাঁদের মুখনিঃসৃত সনাতন ও অপৌরুষেয় বাণী হিন্দুস্থানের স্বাধ্যায়নিষ্ঠ হিন্দুর মুখে মুখে ফিরতে লাগল। এই ধ্রুতমন্ত্রের ধ্যান ও ধারণা হতে পৃথিবীর যে পরম মঙ্গলকর বিশ্ব-ধর্ম্মের সৃষ্টি হইল, তারই নাম বৈদিক সনাতন ধর্ম/হিন্দু-ধর্ম। শ্রুতি বা বেদের উপর মূলভিত্তি করেই এই ধর্মের সৃষ্টি। 

পৃথিবীর ইতিহাসে বৈদিকগ্রন্থ(চতুর্ব্বেদের মধ্যে বিশেষতঃ ঋগ্বেদ) মানব-সমাজের প্রাচীনতম গ্রন্থ বলে সর্ব্ববাদিসম্মত। ঐতিহাসিক গবেষণার ফলে মানব-সভ্যতার বহু প্রাচীন নিদর্শন মিসর ও মেসোপটেমিয়া হতে আবিষ্কৃত হয়েছে সত্য, কিন্তু সেখানেও বেদের ন্যায় জ্ঞানধর্ম্মের কোনও বিরাট্‌ সৌধের আবিষ্কার হয় নাই। চরম ও পরম সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত এই বৈদিক ধর্ম্ম ও তন্নিঃসৃত এই বৈদিক সভ্যতা যে অদ্যবধি অবিচ্ছেদে প্রবাহিত হয়ে আসছে, ইহাই বেদের বিশেষত্ব। বেদের প্রাচীনত্ব নিয়ে ঐতিহাসিকগণ বহু গবেষণা করেছেন ও নানারূপ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। কিন্তু ঐতিহাসিক যুক্তি-পদ্ধতি অভ্রান্ত নয় এবং একদিন হয়ত বেদের বয়স-নির্ণয়-প্রচেষ্টা সত্যই বাতুলতা বলে প্রমাণিত হবে। এই ভারতের হিন্দুগণ বহু সহস্র বৎসর পূর্ব্ব হতেই বেদকে অনাদি ও অপৌরুষেয় বলে আসছেন। পরাশর সংহিতায় দেখা যায়- 

ঋষয়ঃ মন্ত্রদ্রষ্টারঃ ন তু বেদস্য কর্ত্তারঃ।

ন কশ্চিৎ বেদকর্ত্তা চ বেদস্মর্ত্তা চতুর্ম্মুখঃ পর্য্যন্ত ॥  

পূর্ব্বেই বলেছি বেদ হিন্দুধর্ম্মের মূলভিক্তিস্বরূপ। ভারতীয় সভ্যতায় ও ভারতীয় ধর্ম-জীবনে এমন কোনও স্তর বা পর্য্যায় নেই যেখানে বেদের প্রভাব লক্ষিত হয় না। বেদ প্রাচীন সভ্যতার শ্রেষ্ঠ ইতিহাস ও প্রাচীন সমাজের অপূর্ব্ব জ্ঞান-ভাণ্ডার। হিন্দুর যাহা কিছু বৈশিষ্ট্য, হিন্দুত্বের যাহা কিছু গরিমা ও ভারতের যাহা কিছু বৈচিত্র্য, তাহা এই বেদের পূত মন্দাকিনী-ধারার প্রতি অমৃত-বিন্দুতে দেদীপ্যমান। ভারতীয় সভ্যতা ও ধর্ম্ম-জীবনের মূল তথ্য জ্ঞাত হওয়া এই বেদের প্রকৃত অনুশীলন ব্যতীত কখনই সম্ভবপর নহে। পাশ্চাত্য জগতের সভ্যতাভিমানী জাতিসমূহ বিজ্ঞান ও দর্শনের গবেষণা দ্বারা জগৎবাসীকে যতই মুগ্ধ করুন না কেন, বেদের প্রতি অনুবাক ও মন্ত্র নিহিত সৃষ্টিতত্ত্বের মূল মর্ম্ম-কথা তাদের গবেষণা লব্ধ জ্ঞান হতে বহু উর্দ্ধে। ইথার তরঙ্গকে করায়ত্ত করে যতই কেন রেড়িয়ম্‌ চর্চ্চা হোক, বিজ্ঞানের বলে পঞ্চতত্ত্বের প্রকৃতিগত শক্তিকে যতই কেন উপেক্ষা করা হোক-বিজ্ঞান-গর্ব্বস্ফীত সভ্য জগৎ এখনও বহু পশ্চাতে পড়িয়া আছে। ইথার-তরঙ্গ ভেদ করে দুইটি শব্দ প্রেরণ করলে কি হবে, বায়ু-তরঙ্গ ভেদ করে দুইটি শব্দ প্রেরণ করলে কি হবে, বায়ু-তরং অতিক্রম করে গগনমার্গে মেঘ পুঞ্জের সাথে ক্রীড়া করতে পারলেই বা কি হতে পারে, শব্দ-গন্ধ-স্পর্শের একত্ব-প্রতিপাদনের দ্বারাই বা কি ফল উৎপাদন ঘটবে? অন্তঃসংজ্ঞাসমন্বিত জীবনিচয়ের সৃজনীশক্তি লাভ করেও মহর্ষি বিশ্বামিত্র ব্রাহ্মণত্ব লাভ আশে যে মহর্ষি বশিষ্ঠের আশ্রম গ্রহণ করলেন, সেই বশিষ্ঠ প্রমুখ ঋষিগণও উর্দ্ধমুখে আকুল প্রার্থনা জানাইতেছেন-

অসতো মা সদ্‌গময়-

তমসা মা জ্যোতির্গময়, মৃত্যোর্মামৃতং গময়।

যাঁহারা সপ্তলোকে ইচ্ছামাত্র অভিলষিত বাণী প্রেরণ করেছেন, যাঁহারা সৌরমণ্ডলের অধিদেবকে এই বিরাট সৌরজগতের অসংখ্য গ্রহ ও নক্ষত্রনিচয়ের মধ্য হতে আবিষ্কার করেছেন, তাঁদেরও মুখে এই প্রার্থনা! কন্ঠ রোধ হয়ে যায়, বাক্য স্তব্ধ হয়ে আসে, বুদ্ধি তাহার বিচার শক্তি হারিয়ে ফেলে। এই প্রার্থনা তাঁহারা কোথায় প্রেরণ করেছেন? কার উদ্দেশ্যে উচ্চারণ করেছেন? 

এ প্রশ্নের উত্তর বিংশ শতাব্দীর মানব দিতে অসমর্থ। কিন্তু এর উত্তর আছে, ভারতের এই নিত্য, সনাতন ও অপৌরুষেয় বেদ মধ্যে। 

সহস্র সহস্র বৎসর পূর্ব্বে ভারতের বক্ষঃভেদ করে হিরণ্যগর্ভ প্রজাপতি প্রমূখ্যাৎ পূতমন্ত্র-নিঃসৃত ত্রিষ্টুপ্‌ছন্দে স্থাবর জঙ্গম দুলে উঠিল-

য আত্মদা বলদা যস্য বিশ্ব

উপাসতে প্রশিষং যস্য দেবাঃ

যস্য ছাউয়ামৃতং যস্য মৃত্যুঃ!

অর্থাৎ- আত্মা যে দেয়, শক্তি যে দেয়, বিশ্বধ্যেয়,

সকল দেবতা যে করে শাসন সবার শ্রেয়,

অমৃত-মৃত্যু যাঁহার দুইটি ছায়া ও ছবি

সেই সে দেবতা পূজিব আমরা প্রদানি হবি!

আত্মার পরেও যে চিন্তা করবার আরো কিছু আছে বা থাকতে পারে, এ কথা শুনিলে পাশ্চাত্যদার্শনিকগণ হয়ত স্তম্ভিত হয়ে যাইবেন; কিন্তু হিরণ্যগর্ভ প্রজাপতির মুখ হতে যে মন্ত্র উচ্চারিত হইল, তাহার সর্ব্বপ্রথম শব্দ- যঃ। য আত্মদা। কে সে, যে সৃষ্টির সারভূত এই আত্মাকেও দান করে বিশ্বধ্যেয় হয়েছেন? যিনি দেবতাকেও শাসন করেন, তিনি কে? ইহার উত্তরও সমগ্র পৃথিবী-মধ্যে একমাত্র বেদই দিয়েছেন। বৈবস্বত মনুর মন্ত্রে বাণী শুনিলাম-যিনি বিশ্বদেব। 

এই বিশ্বদেববাদ সম্বন্ধে অজ্ঞতা বশতঃই অনেক আমাদেরকে পৌত্তলিক বলে অবজ্ঞা করে থাকেন। 

এস্থলে এই বিশ্বদেববাদ-সম্বন্ধে স্বর্গীয় উমেশচন্দ্র বটব্যাল মহাশয় যা বলেছিলেন, তাহার কিঞ্চিৎ উল্লেখ করলেই আমাদের সাকারবাদ ও পৌত্তলিকতার প্রকৃত মর্ম্ম সম্যক উপলব্ধি হবে। এতৎ সম্বন্ধে তিনি বলেছিলেন যে, হিন্দুর দেবতারা অসংখ্য, অথচ মিলিত। তাঁদের মন সমান, হৃদয় সমান, অভিপ্রায় সমান, কার্য্য সমান। তাঁদের 'মহৎ অসুরত্ব' অর্থাৎ সমবেত দেবশক্তি এক। ঋগ্বেদ প্রধানতঃ দেবতাদের এই সমবেত মহতী ঐশী শক্তিকেই পূজা করে। কেননা যদিও ঋগ্বেদী ঋষিদের বিবেচনায় প্রকৃতপক্ষে দেবতার সংখ্যা করা যায় না, তথাপি ঋগ্বেদে উপাস্য বলে যে সকল দেবতার নাম পাওয়া যায়, তাঁহারা এই সমবেত ঐশী শক্তিরই জ্ঞানের বৈচিত্র্য-বশতঃ ভিন্ন রকমের বিচিত্রতা মাত্র। মূল কথা, বেদে দেবতা শব্দ দুই অর্থে ব্যবহৃত এবং এই দুই অর্থের ভেদ সম্যক্‌ না বুঝলে ভ্রম জন্মে। প্রথম অর্থে দেবতা সিদ্ধ-পুরুষ এবং তাঁহারা অসংখ্য। দ্বিতীয় অর্থে দেবতা সিদ্ধপুরুষগণের মিলিত ঐশী শক্তি, তাহা এক। এই মিলিত দেব-শক্তির নামান্তর ব্রহ্ম; সমগ্র বেদ সেই ব্রহ্মেরই মহিমা প্রকাশ করে। এই কথাটি বিশেষ প্রণিধানের যোগ্য এবং তজ্জন্যই দ্বিতীয় অর্থে এক এক দেবতা অন্যান্য সর্ব্বদেবতার সমুতুল্য।

এই বাদ সম্বন্ধে বেদ-প্রবেশিকায় দেখা যায়- "আমাদের ঋগ্বেদের নাম বিশ্বদেব-বাদ, অর্থাৎ অসংখ্য দেবতার সমবেত ঐশী শক্তির নাম 'বিশ্বদেবাঃ' বা বিশ্বদেব ব্রহ্ম; এবং অগ্নি, বিষ্ণু প্রভৃতি উপাস্য দেবতারা সেই মহাশক্তির নামান্তর মাত্র।

এক হতে বহু এবং হতে এক, এটাই হল মূলতত্ত্ব। একক ব্রহ্মের বহু হবার সঙ্কল্প হয়েছিল, তাই 'সর্ব্ব' শব্দের সহিত 'ব্রহ্ম' এর অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে এই হিন্দুধর্মে। পরম ব্রহ্মের স্বরূপ উপলব্ধির নিমিত্ত এই বিশ্বদেবের ধ্যান ও ধারণা ব্যতীত জীবের আত্যন্তিক মঙ্গলের আর অন্য কোনও উপায় নাই। হিন্দুর দর্শনে ও উপনিষদে এরই প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। যে সনাতন বেদের মধ্যে, আমাদের এই পবিত্র জন্মভূমির পূণ্য-যজ্ঞশালা প্রসূত যে অমৃতের মধ্যে, মানবের চরম ও পরম কল্যাণ সুন্দর ভাবে নিহিত রয়েছে সেই বেদের পরিচয় আমরা রাখি না, ইহাপেক্ষা পরিতাপের বিষয় আর কি হতে পারে? 

আর একটি কথা, একথা এখন সর্ববাদী সম্মত যে, বেদ অধ্যয়ন করতে হলে শুধু অর্থ হৃদয়ঙ্গম করলে হয় না, বিধিমত পাঠ করাও বিশেষ আবশ্যক। নিয়মিত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পরিচালনা সহ পাঠ করলে শারীরিক ও মানসিক উন্নতি প্রকৃষ্টরূপে সাধিত হয়ে থাকে। পণ্ডিতপ্রবর সত্যব্রত সামশ্রমী মহাশয়ের নিকট শুনেছিলাম যে, তিনি যখন বারাণসী ধামে বেদ অধ্যয়ন করেছিলেন তখন তাঁহাকে দুই গুরুর আশ্রয় নিতে হয়েছিল- একজনের নিকট অর্থের জন্য অধ্যয়ন করতেন, ও অপরের নিকট পাঠ শিক্ষা করতেন। 

বেদের সম্যক্‌ পরিচয় এই "বেদের পরিচয়" গ্রন্থে আছে। বেদের ঐতিহাসিকতা তাহার সাহিত্য ও কাব্যরূপ, তাহার বিজ্ঞান ও ধর্ম্মসম্বন্ধীয় সকল তথ্যই এই আলোচ্য গ্রন্থখানিতে অতি সুষ্ঠভাবে বিচার বিশ্লেষণ-পূর্ব্বক আলোচিত হয়েছে। বৈদিক পাঠ এবং পুরুষসূক্তের ও ঈশোপনিষদের বন-ব্যাখ্যাগুলির এই সুন্দর ও প্রাঞ্জল সমাবেশ বড়ই উপাদেয় হয়েছে। বেদের বহুল প্রচার কল্পে এই সাধু ও মহতী প্রচেষ্টা সফল হোক। ভারত তাহার এই নিজ বৈশিষ্ট্যের দ্বারা সমগ্র বিশ্বের শান্তি প্রতিষ্ঠায় সমর্থ হোক, ইহাই আমার অন্তরের প্রার্থনা। 



কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.