sanatansangbed

Introduction of SANATAN dharma scriptures

বৃহদারণ্যক উপনিষদে গো মাংস খাওয়ার কথা নেই!

অনেকেই বৃহদারণ্যক উপনিষদ থেকে উদৃতি দিয়ে বলে থাকেন সেখানে গো মাংস খাবারের নির্দেশ আছে। আসুন জেনে নেই আসল সত্য-
বৃহদারণ্যক উপনিষদের ৬/৪/১৮ মন্ত্রটি এখানে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। মন্ত্রটি এই যে—“অথ য ইচ্ছেৎ পুত্রো মে পণ্ডিতো বিগীতঃ সমিতিঙ্গমঃ শুশ্ৰুষিতাং বাচং ভাষিতা জায়েত সর্বান্ বেদান্ অনুব্রুবীত সর্বমায়ুরিয়াদিতি মাংসৌদনং পাচয়িত্বা সর্পিষ্মন্তমশ্লীয়াতামীশ্বরৌ জনয়িতবা ঔক্ষেপ বার্ষভেণ বা।” আপাত দৃষ্টিতে এই মন্ত্রের অর্থ দেখলে মনে হবে যে, এখানে গোমাংস ভক্ষণের কথাই উল্লেখ করা হয়েছে। দুর্গাচরণ সাংখ্যবেদান্ত তীর্থ মহাশয় বৃহদারণ্যক উপনিষদের যে অনুবাদ করেছেন তাতে তিনিও এইরকম'ই অর্থ করেছেন। যেমন- “যে লোক ইচ্ছা করে যে, আমার পুত্র পণ্ডিত, দেশবিখ্যাত, সভাসদ ও শ্রুতিপ্রিয় বচনভাষী হোক; এবং সে সমস্ত বেদ অধ্যয়ন করুক, সম্পূর্ণ আয়ু লাভ করুক, (সেই লোক ও তার পত্নী) মাংসমিশ্রিত অন্ন পাক করে ঘৃতযুক্ত করে ভোজন করবে। যৌবনাবস্থ বা ততোধিক বয়স্ক ষাঁড়ের মাংস দ্বারা (মিশ্রিত ওদন ভক্ষণ করবে, তাহলে, ঐরকম পুত্র) সমুৎপাদনে সমর্থ হয়।” (বৃহদারণ্যক উপনিষদ, ১৫৭০ পৃঃ)। এই মন্ত্রের শাঙ্করভাষ্য পড়লেও আপাতদৃষ্টিতে গোমাংস ভক্ষণ বিহিত হয়েছে বলেই মনে হবে। শঙ্করাচার্য এই অংশের ভায্যে লিখেছেন- “বিবিধং গীতো বিগীতঃ প্রখ্যাত ইত্যর্থঃ...মাংসন -মিশ্রমোদনং মাংসৌদনম্‌ তন্মাংসনিয়মাৰ্থৰ্মাহ –ঔক্ষেণ বা মাংসেন; উক্ষা সেচনসমর্থঃ পুঙ্গবঃ, তদীয়ং মাংসম ঋষভস্ততোহপ্যধিকবয়াঃ, তদীয়মার্ষভং মাংসম্‌।” এই শঙ্করভাষ্যের অর্থও দুর্গাচরণ সাংখ্যবেদান্ততীর্থ বলেছেন- ‘মাংসৌদন’ অর্থ মাংস মিশ্রিত ওদন, যে মাংস গ্রহণ করতে হবে। তাহা নিয়মিত করে বলছেন যে, ঔক্ষ মাংস; উক্ষা অর্থ রেতঃসেকসমর্থ পুং গো (ষাঁড়); তার মাংস (ঔক্ষ); তদপেক্ষাও অধিক বয়স্ক যাঁড় ঋষভ; তার মাংস আর্ষভ।”
এইভাবে মন্ত্র ও ভাষ্যে গোমাংস ভক্ষণের বিধান আছে বলে মনে হলেও পূর্বাপর সঙ্গতি বিচার করলে দেখা যাবে যে, এই মন্ত্রের ও ভাষ্যের অর্থ সম্পূর্ণ অন্যরকম। উক্ষা (উক্ষণ্‌), পুঙ্গব, ঋষভ ও মাংস এই চারিটি শব্দের প্রকৃত ও প্রাসঙ্গিক অর্থেই এই বিষয়ের সমাধান হবে। সাধারণতঃ সকলের মতে অন্যান্য স্থানের মতো এই স্থানের উক্ষা, পুঙ্গব ও ঋষভ শব্দের অর্থ গরু। সুতরাং ভাষ্যের ‘তদীয়ং মাংসম্‌’ বললে গরুর মাংসই বুঝাবে। কিন্তু উক্ষা, পুঙ্গব ও ঋষভ শব্দগুলির প্রকৃত অর্থ এখানে ‘অষ্টবর্গান্তর্গত একটি বিশেষ ওষধি’, যার ঔষধ হিসাবে প্রয়োগের বিধান আছে। আর “মাংস” শব্দের অর্থ “শাঁস”। ভাষ্যে আছে উক্ষা সেচনমর্থঃ পুঙ্গবঃ অর্থাৎ রেতঃসেবকসমর্থ ওষধি বিশেষ। উদ্ভিদ মাত্রেরই প্রজনন শক্তি আছে, তাদের রেতঃসেকের দ্বারাই যে ফুলফলের সৃষ্টি হয় তা বৈজ্ঞানিকরা প্রমাণ করেছেন। সুতরাং ‘সেচ নসমর্থঃ পুঙ্গবঃ এই অংশের অর্থ ‘রেতঃসেবকসমর্থ ওষধি বিশেষ’ বললে কোন ক্ষতি হয় না।
শালিগ্রাম বৈশ্যবর্যের লেখা- ‘শালিগ্রামনিঘণ্টভূষণম্‌’ অর্থাৎ ‘বৃহন্নিঘন্টুরত্নাকর’ নামক বিখ্যাত আয়ুর্বেদীয় গ্রন্থে(১৬৪ পৃ.) বলা হয়েছে যে, ঋষভ, পুঙ্গব, উক্ষা, বৃষভ প্রভৃতি একটি বিশিষ্ট ওষধিরই নাম, তাহা ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তার গুণ বর্ণনা প্রসঙ্গে তাতে বলা হয়েছে-
ঋষভকো মধুঃ শীতো গর্ভসন্ধানকারকঃ।
শুক্ৰধাতুফানাং চ কারকে বলদায়কঃ।।
বৃষ্যঃ (বীর্যজনক)..ইত্যাদি।
সন্তান উৎপাদনের কামনায় ঋষভ নামক এরকম গুণসম্পন্ন ঔষধ সেবন যথোপযুক্ত বলেই বিবেচিত হয়। স্মরণ রাখা উচিত যে ঋষভ ও ঋষভক একই বস্তু। ঋষভের বর্ণনা প্রসঙ্গেই যখন তার গুণের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তখন ঋষভ না বলে ঋষভক বলা হয়েছে। কেবল ছন্দ রক্ষার জন্য অথবা ওই নামেও প্রসিদ্ধি ছিল বলে ‘ক’ যুক্ত করা হয়েছে।
কেশব স্বামীর ‘নানার্থাকসংক্ষেপ’- এ ঋষভ শব্দের অর্থ ঔষধ বলা আছে—“ঋষভো বৃষভে...শৃঙ্গিসংজ্ঞে চ ভৈষজ্যে...। হেমচন্দ্রের ‘অনেকাৰ্থসংগ্রহে’ ও আছে- “ঋষভঃ...ভেষজে স্বরে।”(৮৬ পূ.)। শব্দকল্পদ্রুমে ঋষভ শব্দের অর্থে আছে- “অষ্টবর্গান্তৰ্গতৌষবিশেষঃ। তৎপর্যায়- ‘বৃষঃ, ঋষভকঃ...গৌঃ...লাঙ্গলী...।” সেখানে ঋষভের আকার সম্বন্ধেও বলা আছে “ঋষভো বৃষশঙ্গবৎ।” হয়ত এই জন্যই ওই ওষধির নাম ঋষভ বা গো-বাচক শব্দসমূহ। বাচস্পত্য অভিধানে ঋষভ শব্দের প্রথম অর্থই দেওয়া আছে- ওষধি। এম উইলিয়ামস তাঁর অভিধানে ‘ঋষভ One of the eight principal medicaments.
পুঙ্গব শব্দের অর্থ প্রসঙ্গে হেমচন্দ্র লিখেছেন- “পুঙ্গবো গবি ভৈষজ্যে...।” (১০৬ পৃ.)। শব্দকল্পদ্রুমে আছে- “ঔষধভেদঃ, ঋষভৌষধম্‌।” বাচস্পত্যে আছে- “পুঙ্গব ঋষভৌষধৌ।” এম উইলিয়ামস লিখেছেন— a kind of drug।
শব্দকল্পদ্রুমে উক্ষন শব্দের অর্থে আছে- ‘ঋষভৌষধৌ। বাচস্পত্যেও আছে- ‘উক্ষন্ ঋষভৌষধৌয’, এম উইলিয়ামসও লিখেছেন- 'One of the eight chief chief medicaments (Rishabha)'
মাংস শব্দের অর্থে ম্যাকডোনেল-এর অভিধানে আছে- 'flesh, meat (Also of fish, crabs and fruit)' আপ্‌টের অভিধানে আছে- ‘The flashy part of a fruit'। এম উইলিয়ামস্-এর অভিধানে আছে- '...the flesh, of fish, the fleshy part or pulp of fruit' l
এই শব্দগুলির অর্থের প্রামাণ্য দেখানোর জন্য যে কয়েকটি প্রামাণিক গ্রন্থের উল্লেখ করা হল। আশা করি, পূর্বোক্ত মত প্রতিষ্ঠিত করার পক্ষে তা যথেষ্ট।
ঋষভের অর্থ বলার সময় শঙ্করাচার্যবলেছেন- ‘ঋষভস্ততোহপ্যধিকবয়াঃ অর্থাৎ ঋষভ পুঙ্গব হতে অধিক বয়সের। একটু বেশিদিনের পুরাতন পুঙ্গবের নামই ঋষভ। সুতরাং অসামঞ্জস্যের কোন কারণই ঘটে না।
মন্ত্র বা ভাষ্যের আক্ষরিক অর্থ ব্যাখ্যার পর আরও দুইটি কথা বলার আবশ্যকতা আছে। প্রথমতঃ একটি স্বাভাবিক প্রশ্ন আসে যে, ‘গরু বা ষাঁড়’ অর্থ করলেও হয় আবার ‘ঔষুধ’ অর্থ করলেও যখন হয়, তখন কোন্ অর্থটি গ্রহণীয় আর কোনটিই বা পরিত্যাজ্য? তার উত্তরে বলতে হয় যে, যে ক্রমে (Order) ভক্ষ্যের বিধান করা হয়েছে সেই ক্রম অনুযায়ী মাংস ভক্ষণের বিধান বিশেষ অসঙ্গতিপূর্ণ। কারণ এই মন্ত্রটির (৬/৪/১৮) পূর্বে ৬/৪/১৪ সংখ্যক মন্ত্রে আছে যে, এক বেদজ্ঞ পুত্র লাভের জন্য ঘৃতের সঙ্গে মিশিয়ে দুধ ভাত খেতে হবে, ৬/৪/১৫ সংখ্যক মন্ত্রে আছে যে, দ্বিবেদজ্ঞ পুত্রলাভের জন্য ঘৃতের সঙ্গে মিশিয়ে গো মাংস ভাত খাবে। দুধভাত, দইভাত, শুধু ভাত, তিলভাতের পর হঠাৎ গো মাংস ভাত খাওয়ার কথাটি বিশেষ অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে পড়ে না কি? কিন্তু উক্ষা বা ঋষভের অর্থ 'ওষধি’ বললে এবং তার মাংস অর্থে ‘শাঁস’ বুঝলে এমন অসামঞ্জস্যের সৃষ্টি হয় না।
দ্বিতীয়ত, বৃহদারণ্যক উপনিষদ্ আত্মতত্ত্বের শিক্ষা দেয়। তার দ্বারা আত্মজ্ঞান লব্ধ হওয়ার পর সুপুত্র উৎপাদনের জন্য নিষ্ঠুর পশুহত্যার কথা অত্যন্ত অযৌক্তিক হয়ে পড়ে।
ডাঃ ডঃ সীতনাথ গোস্বামী (যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, কোলকাতা) এর লেখা থেকে তুলে ধরা হয়েছে। কৃতজ্ঞতায় স্বস্তিক পত্রিকা। 
#কৃষ্ণকমল মিন্টু

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.