sanatansangbed

Introduction of SANATAN dharma scriptures

শারদীয়া

নমস্তস্মৈ নমস্তস্মৈ নমস্তস্মৈ নমো নমঃ। 
যা দেবী সর্ব্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা।। 
মাতৃরূপে সৰ্ব্বভূতে অধিষ্ঠান যাঁর।
বারবার তাঁর পদে করি নমস্কার।। 
যিনি মাতৃরূপে সর্বভূতে বিরাজমান, যােগী ঋষিগণ ধ্যানে যাঁর সন্ধান পায় না, যাঁর জন্য স্বয়ং দেবাদিদেব মহাদেব সােনার কৈলাস ত্যাগ করে শ্মশানে বৈরাগী- গলে হাড়মালা, কটিতে বাঘছাল, পড়ে যার তত্ত্বান্বেষণে নিরত, সেই জগদারাধ্য জগদীশ্বরী জগ-জন-মন-মােহিনী-জগন্মাতা দুর্গার তত্ত্ববিষয়ে আমার আলােচনার প্রয়াস পঙ্গুর গিরি-লঙ্ঘন প্রয়াসের মতো নিষ্ফল। আমার ন্যায় বিষয়-বিষ-পান-নিরত সাধন-ভজনহীন ব্যক্তির সেই ত্রিলােক আরাধ্যা সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ান্তকারিণী জগদ্ধাত্রীর লীলা-গুণ-কীর্তন করতে যাওয়া ধৃষ্টতা ভিন্ন আর কিছুই নয়; সে যে বিচার-বিবেচনা-আলােচনায় লভ্য নয়; সে তত্ত্ব যে “যােগী ঋষির সাধনের ধন ভক্তি মূলে বিকিয়ে থাকে, “সৰ্ব্বং সমর্পিতমস্তু' বলে যে জন ডাকে” তার’ই।
মা, বর্ষা ঋতুর অবসানে শরতের আগমনে প্রকৃতি দেবী নব শােভায় সুশােভিতা হয়েছেন, যেন বর্ষার বারিবর্ষণ শ্রান্তি দূর করছেন। এই বিশ্রামের অবসরে শারদীয় সুনীল গগনে মেঘমুক্ত চাদের আলো ধরার বুকে হাসিরাশি ছড়িয়ে দিচ্ছে। এই শুভ দিনে, মা তাের আবাহন আগমনে বাংলার ঘরে ঘরে মঙ্গল আরতি বেজে উঠেছে, ঘরে ঘরে আনন্দের ঢেউ বয়ে যাচ্ছে। দীন দুঃখী ও আজ তোর আগমনের মাঙ্গলিক উৎসবসূচক একখানি নব বস্ত্রে দেহষষ্টি আবরণ করছে। মা আনন্দময়ী তোর এ দীন সন্তানের আঁধার গৃহে কি তোর একবার শুভাগমন হবে না মা? আসলে যে কিসে বসতে দিব, তা পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছি। মা তোর আসন অপহরণ করে নিয়ে ছয় চোর তার উপর তাণ্ডব নৃত্য করছে, মা আমার শক্তিতে কুলায় না, তোর আসন তুই উদ্ধার করে তোর এই দুঃস্থ সন্তানের মনােবাসনা পূর্ণ কর।
দুর্গা, কালী, তারা ইত্যাদি নাম এবং রূপ একই ঈশ্বরের ভিন্ন ভিন্ন রূপে। সগুণ অবস্থার স্থূল বিকাশ। ঈশ্বর সগুণ ও নির্গুণ উভয়ই। যখন নির্গুণ তখন তিনি ব্রহ্মা, আর যখন সগুণ তখন তিনি সৃষ্টিস্থিতিপ্রলয়ান্তকারিণী কালকামিনী কালী মহাশক্তি, আদ্যাশক্তি জগৎপ্রসবিনী-জগদ্ধাত্রী, তিনি প্রকৃতি রূপা সগুণা, সত্ত্ব, রজ ও তম এই তিন গুণের অধিষ্ঠাত্রী, তিনি ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরে সৃষ্টি, স্থিতি ও পালিনী শক্তিরূপে বিকাশমানা। এই প্রাপঞ্চক জগৎ তার স্থূল বিকাশ- এটা বাহির ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য এবং সূক্ষ্ম বিকাশে তিনি পঞ্চ তন্মাত্র -এটা অন্তর ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য এবং তৃতীয় অবস্থায় তুরীয় বা অব্যক্ত। তিনিই ভক্তের ষড়ৈশ্বর্যশালিনী মাতা-ভগবতী বা ষড়ৈশ্বর্যাশালী পিতা ভগবান। তিনি আমাদের কাতর ক্রন্দন, করুণ প্রার্থনা শ্রবণ করেন; ভক্ত-বাঞ্ছাকল্পতরু তিনিই “ঘটে ঘটে বিরাজ করেন, ইচ্ছাময়ীর ইচ্ছা যেমন।" তিনি ভিন্ন জগৎজীবের অন্য গতি নেই। বিপদে অভয়দাত্রী, শােকে সান্ত্বনাপ্রদায়িনী, বেদনায় শান্তিবিধায়িনী, পাপ পঙ্কে-নিমজ্জিত বিষয়বিষ পানে হতচেতন, কাম-কামনা-কলুষিত চিত্তে দুঃস্থ সন্তানদের রক্ষাকর্তী “মা”। তারই স্নেহ আচলের-ছায়ায় সন্তপ্ত জীবগণ সুখে নিদ্রিত রয়েছে এবং তারই বলে বলীয়ান হয়ে জগতে বিচরণ করছে। ব্রহ্মের এই নির্গুণ ও সগুণ ভাব সাংখ্যপ্রতিপাদ্য পুরুষ ও প্রকৃতি। পুরুষ নিষ্ক্রিয় আর প্রকৃতি ক্রিয়াশীলা। তাই নিষ্ক্রিয় শিবপুরুষ বক্ষে বরাভয়করা করালবদনা কালীপ্রকৃতি। এই নির্গুণ-সগুণ-তত্ত্ব ও পুরুষ-প্রকৃতি-তত্ত্ব অভেদ। কোনটি পরিত্যাগ করে অপরটিকে গ্রহণ করার উপায় নেই, ঐ তত্ত্ব, অগ্নি, ও তাঁর দাহিকা-শক্তির ন্যায় চির-বিচ্ছেদ শূন্য। অগ্নি চিন্তা করলে যেমন তার দাহিকা-শক্তি চিন্তা করতে হয় এবং দাহিকাশক্তি চিন্তা করলে, অগ্নিকে চিন্তা করতে হয়; তদ্রুপ নির্গুণ পরিত্যাগ করে সগুণ বা পুরুষ পরিত্যাগ করে প্রকৃতি বিষয়ে ধারণা অসম্ভব। একের অভাব দুইয়েরই অভাব এবং একের অস্তিত্বে দুইয়েরই অস্তিত্ব মানতে হবে।
দেখা যাচ্ছে, ব্রহ্মের বা ঈশ্বরের সগুণ অবস্থা-মহাশক্তি। এর থেকে সৃষ্টিতত্ত্বের আরম্ভ। এই মহাশক্তি ত্রিগুণাত্মিকা মায়া বিস্তার করে এই দৃশ্যমান জগতরূপে একাংশে প্রকাশ পাচ্ছেন। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব হতে কীটাণুকীট পর্যন্ত তাঁর মায়ার রাজ্যের অন্তর্গত। তিনিই ব্রহ্মারূপে সৃষ্টি করে বিষ্ণুরূপে পালন করেন এবং শিবরূপে সংহার করেন।
দুর্গানাম শুনলেই মহিষাসুরমর্দিনী দশভূজা মাতৃমূর্তির কথা মনে হয়। জীব যখন তার পাপ-প্রবৃত্তি দ্বারা পরিচালিত হয়ে যাতনায় জর্জরিত প্রাণে মায়ের করুণা প্রার্থনা করে, তখন মা দুর্গতিনাশিনী দুর্গারূপে সেই সন্তানের দেহস্থিত পাপরূপী মহিষাসুরকে বধ করেন এবং দেহস্থিত সৎ-প্রবৃত্তির শক্তি-দেবশক্তি আশ্রয় করে আবির্ভূত হোন। এই কথাই শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন যথা-
পরিত্রাণায় সাধূনাম বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম।
ধর্ম সংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে। 
আমি (ভগবান) সাধুগণের পরিত্রাণের জন্য, অসাধুগণের নাশের জন্য এবং ধর্ম সংস্থাপনের জন্য যুগে যুগে আবির্ভূত হয়ে থাকি।
যখন যেখানে যেইভাবে আবশ্যক তখন সেখানে সেইভাবে সেইরূপে তিনি আবির্ভূত হয়ে থাকেন। মহিষাসুরভয় হতে দেবগণকে রক্ষা করার জন্য তিনিই মায়ার দুর্গতিনাশিনী দুর্গারূপে প্রকাশিত হয়েছিলেন, আবার ভূভার হরণ জন্য তিনিই কংসকারাগারে দেবকীর অঙ্কোজ্জ্বল করেছিলেন। পশ্চিম এশিয়ায় প্রভু যিশুখ্রিস্ট এবং প্রেম-প্রবাহ বুকে ধরে নদীয়ায় শচীগৰ্ভসিন্ধু মাঝে প্রেমাবতার গােরাচাদ আবির্ভূত হয়েছিলেন।
মহিষাসুরের দোর্দণ্ড প্রতাপে দেবগণ তাদের স্বাধিকার স্বর্গ হতে বিতাড়িত হলেন। বিষ্ণু আদি সকল দেবতায় সম্মিলিত হয়ে মহিষাসুর-নাশ ও ভ্রষ্ট রাজ্য স্বর্গ উদ্ধারের উপায় উদ্ভাবনে নিবিষ্টচিত্ত ছিলেন; সেই সময়, মহামায়া তাঁর প্রিয় সন্তান দেবগণের দুঃখ অপনােদন জন্য তাঁদের অত্যুৎকট একাগ্রতা আশ্রয় করে ভুবন-মনমােহিনী সাজে দশভুজা মূর্তিতে আবির্ভূতা হলেন। দেবগণ, যার যে দিব্য অস্ত্র ছিল। তা মায়ের করে প্রদান করলেন। মা সন্তানগণকে রক্ষার নিমিত্ত রণসাজে সজ্জিতা হয়ে রণাঙ্গনে অবতীর্ণা হলেন এবং দেবদ্বেষী পাপরূপী মহিষাসুরকে বিনাশ করে দেবতাগণের ভয় দূর করলেন।
মহিষাসুর ব্যতীত দেবদ্বেষী শুম্ভ নিশুম্ভ আদি অসুরগণ বর্তমান ছিল। তাদেরকে বিনাশ করে দেবগণকে শত্রুশূন্য করার জন্য সন্তানবৎসলা মা জগজনমনমােহিনীরূপে হিমাচলের অত্যুচ্চ শিখরে কাঞ্চন গিরিতে রূপের ছটায় জগৎ আলোকিত করে বসলেন। দূতমুখে রূপবতীর সংবাদ শ্রবণ করে স্থানীয় অধিপতি অসুররাজ। শুম্ভ ও নিশুম্ভের মাথা ঘুরে গেল এবং রূপসীকে বলপূর্বক বিবাহ করতে এসে তারা একে একে সদলবলে মায়ের ইচ্ছায় বিনাশপ্রাপ্ত হল। এই যুদ্ধকালে কালরূপিণী করালবদনা অসম্ভবা এক নারীর মায়ের ললাটভ্রূভঙ্গি হতে উদ্ভবা হল। এর নাম কালী । চণ্ড মুণ্ডু নাশ করেছিলেন বলেই ইনি দেবী চামুণ্ডা নামে অভিহিতা হন। এর মুখে অট্ট অট্ট হাসি, করে উন্মুক্ত অসি, গলে শব-মালা, চর্মবস্ত্র পরিধানা, গাত্রচর্ম শুষ্ক এবং লেলিহান জিহ্বা, সতত দৈত্যগণ-ভােজনে নিযুক্তা এবং গণ্ড বেয়ে রুধির ধারা প্রবাহিত হচ্ছে। এই চতুর্ভুজা কালীমূর্তির পূজা এতদ্দেশে প্রচলিত আছে।
মহিষাসুর বধকালীন মায়ের যে দশভুজামূর্তির বিকাশ হয়েছিল সে মূর্তিতে মাতৃপূজা এই দেশে ঘরে ঘরে এখনও হয়। এই মূর্তিতে মাতৃপূজা, মহারাজ সুরথ ও সমাধি বৈশ্য কর্তক মহর্ষি মেধসের উপদেশানুসারে হৃতসর্বস্ব পুনরুদ্ধার কামনায় নর্মদা নদীর তীরে অনুষ্ঠিত হয়। এই পূজার সময় বসন্তকাল এবং এখন এই দেশে বাসন্তীপূজা নামে অভিহিত হচ্ছে। এই পূজায় মহারাজ সুরথ ও সমাধিবৈশ্য মায়ের পূজা সুনির্বাহ এবং কামনা সিদ্ধির জন্য নিজদেহ হতে রক্তদান করেন। আজকাল সেই রক্তদান অনুকরণ করেই নিরীহ ছাগ-শিশুর রক্তদানের ব্যবস্থা হয়েছে বলে মনে হয়। এমন ছাগবলির মূলে কি তত্ত্ব নিহিত তা না বুঝলেও স্বাভাবিক বুদ্ধি দিয়ে এটাই বােধ হয় যে সৃষ্ট জীব মাত্রেই জগন্মাতার সন্তান, তিনি আমাদের ভালবাসেন। আর ছাগশিশুর রক্তপান করে তৃপ্তি লাভ করেন,এটা কখনই সম্ভব না। এমন ভাব মনে করতে গেলে মায়ের ভালবাসা একদেশদর্শী বলেই বােধ হয়। আবার এটাও সম্ভব যে এমন বলিদান নিম্নাধিকারী তমােগুণী মানবদের ধর্ম-কার্যে, মাতৃ-পূজায় নিয়ােজিত করার একটি কৌশল বিশেষ। যারা মাংসভােজী, বিনা কারণে কতশত ছাগশিশু ত দূরের কথা তার বড়ও অনেক উদরসাৎ করছে তারা ত আর মাংসাহার ত্যাগ করবে না। যখন খাওয়া ছাড়তে পারবে না তখন মায়ের নাম করে খাও। মায়ের নামে উৎসর্গ করে খাও, মাংসাহারও হবে, মায়ের নাম লওয়াও হবে। নামের গুণে ক্রমে প্রাণের তম দূর হবে। তখন আর তার ছাগ-শিশুর দিকে মন থাকবে না। মায়ের নামে, মায়ের ভাবে প্রাণ মন মেতে উঠবে; তখন প্রাণীবধ করে মাংস খাওয়া তো দুরের কথা, নিজের প্রাণ বিসর্জন করেও জগতের জীবের প্রাণ রক্ষার জন্য ইচ্ছা হবে।
এই বলি-প্রথা বহু পূর্বকাল হতে এই দেশে প্রচলিত। বৈদিক যুগে যখন কর্মকাণ্ড লােকের একমাত্র অবলম্বনীয় ছিল, তখন অশ্বমেধ, গােমেধ, নরমেধ ইত্যাদি যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হত। এই সকল যজ্ঞে যজ্ঞের অধিষ্ঠাত্রী দেবতাকে পরিতুষ্ট করার জন্য এবং যাজকের মনােভিলাষ পূরণের জন্য, যজ্ঞে পূর্ণাহুতি প্রদান করার সময় অশ্ব, গাে বা মানুষ বলি দেওয়া হত এবং উহার মাংস দ্বারা অগ্নিতে আহুতি প্রদান করা হত, এমনও শ্রুত হওয়া যায় যে যজ্ঞ শেষে যাজ্ঞিক ঋষিগণ নিহত প্রাণিদের প্রাণদান করতেন। আধুনিক ক্রিয়াকাণ্ডে সেই কালের বলিদান প্রথা অনুসরণ করেই এখন ছাগ ও মহিষাদি বলি প্রচলিত রয়েছে।
“বলি" শব্দে আমরা সাধারণতঃ যেমন জীবদেহ খড়গঘাতে দ্বিখণ্ডিত করা বুঝি, কিন্তু উহার অন্য অর্থও আছে। বলি শব্দ ইংরাজিতে 'Sacrifice' ও বাংলায় উৎসর্গ অর্থে গ্রহণ করা যায় । এই উৎসর্গ অর্থে দানও বুঝায়। পূজায় ভগবৎপ্রীতির জন্য এই দানকার্য সম্পাদিত হয়। জগন্মাতার পূজায় এই বলি জীবের পশু (বিবেক-বিহীন) আত্মা (দেহে আত্মবুদ্ধি) এরং দৃঢ়তা এর যুপ। জ্ঞান-খড়গ মায়ের দুয়ারে এই পশুর বলি হয়। জীব বলিপ্রদান করে ভববন্ধন হতে মুক্ত হয়। এটাই বলির তাৎপর্য।
জগন্মাতা দুর্গার দ্বিতীয় পূজা লঙ্কায়। শ্রীরামচন্দ্র সীতা উদ্ধারার্থে রাবণ বধের কামনা করে শরৎকালে মায়ের বােধন করেছিলেন। পূর্ব প্রচলিত পূজাকালের পরিবর্তন হল বলেই একে অকালবোধন বলে। আজকাল এই দেশে এই শারদীয়া পূজাই সমধিক প্রচলিত।
এই দুর্গোৎসবের সাথে আগমনী ও বিজয়া যুক্ত আছে। আগমনী অর্থাৎ হরপত্নী উমার পিত্রালয় আগমন এবং বিজয়া তাঁর পিত্রালয় ত্যাগ করে কৈলাসে স্বামীভবনে গমন। মায়ের যে মূর্তির পূজা করা হয়, উমার সাথে উহার মূলতঃ মিল থাকলেও মূলতঃ কোন সাদৃশ্য দেখা যায় না। আগমনী এইরূপে আরম্ভ হয়। গিরিরাজমহিষী মেনকা স্বপনে দেখলেন, উমা তার স্বামীর গৃহে কতকষ্টে কালক্ষেপ করছেন, তাই গিরিরাজকে কন্যা গৃহে আনতে অনুরোধ করলেন। গিরিরাজ লোক পাঠিয়ে কৈলাসেশ্বর মহাদেবগৃহিণী উমাকে গৃহে আনলেন। এটাই আগমনী উৎসব।
উমা জগদীশ্বরী জগন্মাতার সাকার মূর্তি। পুরাণে কথিত আছে প্রথমে তিনি দক্ষরাজ গৃহে সতীরূপে জন্মগ্রহণ করেন এবং মহাদেবের সাথে তাঁর বিবাহ হয়। সতী তাঁর পিতা দক্ষ কর্তৃক অনুষ্ঠিত যজ্ঞক্ষেত্রে পিতা কর্তৃক পতির নিন্দা শ্রবণ করে যজ্ঞকুণ্ডে দেহত্যাগ করেন। পত্নী-শােক-মুগ্ধ মহাদেব তাঁর পর কাঁধে ধারণ করে ভারতবর্ষে ইতস্ততঃ ভ্রমণ করতে লাগলেন। এইদিকে ভগবান বিষ্ণু, সতীদেহ সম্পূর্ণ পরিণাম না হওয়া পর্যন্ত মহাদেব প্রকৃতিস্থ হবেন না বুঝে সুদর্শন চক্র দ্বারা শবদেহ ৫২ খণ্ডে বিভক্ত করে ৫২ স্থানে পাতিত করেন। যে যে স্থানে এইরূপে বিষ্ণু কর্তৃক কর্তিত সতীদেহ-খণ্ড পতিত হয় তা এক একটি পীঠ নামে প্রসিদ্ধ তীর্থক্ষেত্র রূপে পরিগণিত হয়ে এখনও বর্তমান রয়েছে।
সতীদেহ খণ্ডিত হবার পর তাঁকে পুনর্বার পত্নীপে লাভ করার জন্য মহাদেব ঘাের তপস্যায় নিযুক্ত হন। এইদিকে গিরিরাজ হিমালয় ও তৎপত্নী মেনকা আদ্যাশক্তিকে কন্যারূপে লাভ মানসে উগ্র তপস্যা করেন। ভগবতীগীতায় গল্পচ্ছলে মহাদেব নারদকে বলেছিলেন, যথা- 
শ্রীমহাদেব উবাচ। 
ত্রৈলােক্যজননী দুর্গা ব্রহ্মরূপা সনাতনী। 
প্রার্থিতা গিরিরাজেন তৎপত্ন্যা মেনাকায়াপি চ।। 
মহােগ্রতপসা পুত্রী ভাবেন মুনিপুঙ্গব। 
প্রার্থিতাচ মহেশেন সতীবিরহদুঃখিনা।।
প্রযযৌ মেনকা গর্ভে পূর্ণব্রহ্মময়ী স্বয়ম্। 
মহাদেব বললেন- হে মুনিশ্রেষ্ঠ, গিরিরাজ হিমালয় এবং তৎপত্নী মেনকা তাঁকে (আদ্যাশক্তিকে) কন্যারূপে পাবার নিমিত্ত অতি কঠোর তপস্যা করেন এবং আমিও সতীবিরহে ব্যথিত হয়ে তাকে পুনর্বার পাবার জন্য প্রার্থনা করি। আমাদিগের প্রার্থনা পূর্ণ করিবার জন্য সেই পূর্ণব্রহ্মময়ী স্বয়ং মেনকাগর্ভে আবির্ভূত হন।
মাতা জগদম্ভা ভক্তবাঞ্ছা পূর্ণ করতে মেনকার গর্ভে জন্মগ্রহণ করলেন এবং দেবাদিদেব মহাদেবকে পতিত্বে বরণ করতে অত্যন্ত ব্যাকুলা হলেন। সময় ও সুবিধা মত গিরিরাজ-তনয়া উমার বিবাহ মহাদেবের সঙ্গে সুসম্পন্ন হল। উমা প্রতি বৎসর স্বামীগৃহে হতে পিতৃগৃহে এসে সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী এই তিন দিন অবস্থান করেন এবং দশমীর দিন পতিগৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। 
এই দিবসত্রয়ব্যাপী উৎসব, ষষ্ঠীর দিন বােধন এবং দশমীর দিন. বিসর্জন নিয়ে দুর্গতিনাশিনী দুর্গামায়ের পূজা-আবাহন, আরাধনা এবং বিসর্জন বাঙ্গালীর ঘরে ঘরে অন্তরে বাইরে অনুষ্ঠিত হয়। জ্ঞানীর জ্ঞান-নয়নে এই শক্তি আরাধনা সাধকের সাধনার স্তরবিশেষ। তিনি দেখবেন বােধন কুলকুণ্ডলিনী শক্তির মূলাধারে জাগরণ, তৎপরবর্তী কয়েক দিনের পূজায় শক্তিদেবী মণিপুরাদি চক্রভেদ করে আজ্ঞাচক্রে উপস্থিত হন। এই স্থানেই বিজয়ার আরম্ভ। সহস্রারে পরম শিবের সাথে এই কুলকুণ্ডলিনী শক্তির মিলনই বিসর্জন। জীব যখন অহংজ্ঞান ভুলে ভগবানে ডুবে যায় তখনই শারদীয়া তার প্রকৃত বিসর্জন। এই বিসর্জনই মহামিলনের ফল। বিসর্জন যদি বাস্তবিক বিসর্জন হত-চিরদিনের মত বিদায় কি অবসান হত, তাহলে মানব এই উৎসব উপলক্ষে কখনও আনন্দে উৎফুল্ল হতে পারত না; যেহেতু যা ত্যাগ অভাবের পরিচায়ক, এরূপ কোন বস্তু কখন বিমল আনন্দ প্রদান করতে পারে না।
উমার চরিত্রগুণে হিমালয়ের রাজ্যস্থ প্রজাবৃন্দ সকলেই তাঁর প্রতি অতিশয় অনুরক্ত ছিল। তিনি প্রত্যেকের ঘরে যেতেন। দুঃখীর দুঃখ দূর করে আর্তের সেবা করে অন্ধের চক্ষু দান করে, পঙ্গুকে চলৎ-শক্তি দান করে তিনি ঘরে ঘরে ফিরতেন। যখন উমা স্বামীগৃহে প্রস্থান করতেন তখন দেশময় হাহাকার পড়ে যেত। সকলেই কেঁদে আকুল হত; আবার কবে উমার মুখ দেখবে এই চিন্তায় কালাতিপাত করত। উমামায়ের কেউ যেন মনে না করেন যে এই ব্যাখ্যাই শেষ; স্থূলে কোন লীলা বিলাস হয় নাই। অবতার বা সূক্ষ্ম কারণ শক্তির স্থলে বিকাশের বিশেষত্ব বা উদ্দেশ্য এই যে তাতে (লীলাতে) সৃষ্টিতত্ত্বের একটি অতি বিশদ ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। এবং দেহ তত্ত্বেও তার সম্যক্ মিলন দেখা যায়। এটাই অবতারের বিশেষত্ব। সকল ভাবের একত্র সমাবেশ।
এইরূপে স্বামীগৃহে গমন বিজয়া। এখন আর কৈলাসে শিবপাশ্বে মায়ের প্রতিষ্ঠা করে বিজয়ার আনন্দ উপভােগের সৌভাগ্য নেই। তাই হিমালয় রাজ্যবাসীর ন্যায় বিজয়াকে আমরা নিরানন্দেই বরণ করে নিয়ে থাকি।
-শ্রীসুরেন্দ্রমােহন দাসগুপ্ত।
নিবেদনে- সনাতন সংবেদ 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.