দুর্গম ভবসাগরে নৌকাস্বরূপ বলে তিনি দুর্গা
আমেজটি ছিল উৎসবের। দেবরাজ ইন্দ্রসহ অন্যান্য দেবতার বিজয় উত্সব। খাদ্য, অন্ন, পানীয় কোনও কিছুরই কমতি ছিল না। দেবকুলের আজ আনন্দের সীমা নেই। অনেক দিন পর দৈত্যকুলকে পরাজিত করেছেন তারা। চারিদিকে তাই বিজয় উৎসবের আনন্দ। দর্পভরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন দেবকুল। এই রকম এক মুহূর্তে ঘটনাটি ঘটল। হঠাৎ আকাশ জুড়ে আবির্ভূত হলেন এক জ্যোতির্ময় মূর্তি। কে ইনি? আগে তাে কখনও একে দেখিনি? দেবরাজ ইন্দ্র উৎসবের কেন্দ্রভূমি থেকে দ্রুত উঠে এলেন! প্রথমে তিনি জাতবেদা অগ্নিকে আহ্বান করলেন, জেনে আসুন, এই মূর্তির প্রকৃত পরিচয় কী? অগ্নি এগিয়ে গেলেন। তাকে দেখে এগিয়ে এলেন অদ্ভুত পুরুষ! অদ্ভুত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কে, তােমার মধ্যে কী শক্তি আছে?" অগ্নি গর্বভরে উত্তর দিলেন, “আমি জাতবেদা, সব কিছুকে পুড়িয়ে ধ্বংস করতে পারি।" অগ্নির কথা শুনে কৌতুকের হিন্দোল খেলে গেল পুরুষের মুখে। তিনি একটি তৃণখণ্ডকে অগ্নিদেবের সম্মুখে রেখে বললেন, “একটিমাত্র তৃণকেই তুমি দগ্ধ কর।” অগ্নির অহংকারে ঘা লাগল। একটিমাত্র তৃণ! এক্ষুণিই তাকে ছাইতে পরিণত করতে পারি, কিন্তু অবাক কাণ্ড। বহু চেষ্টা করেও তিনি সেই তৃণটি পােড়াতে সক্ষম হলেন না। তিনি হতােদ্যম হয়ে বসে পড়লেন। অগ্নিদেবের এই অবস্থা দেখে বায়ুকে দ্রুত পাঠালেন ইন্দ্র। আপনি চেষ্টা করুন। জানুন এই অদ্ভুত মানুষের পরিচয়। বায়ু এবার এগিয়ে গেলেন। এবারও সেই অদ্ভুত মানুষ আগেই প্রশ্ন করলেন, “তুমি কে? তােমার শক্তি কী?" বায়ু উত্তর দিলেন, “আমি পবনদেব, আমি জগত্সংসারকে এক মুহর্তে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারি।”
-বেশ তুমি এই তৃণখণ্ডটিকে স্থানচ্যুত কর।
-মনে রাখবেন, আমি জগৎসংসারকে উড়িয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখি।
-আমি তােমার ক্ষমতা দেখতে চাই।
পবনদেব আর দেরি করেন না। এক নিঃশ্বাসে উড়িয়ে দিতে যান তৃণখণ্ডটি, কিন্তু সর্বশক্তি নিয়ােগ করেও এতটুকু স্থানচ্যুত করতে পারেন না তিনি। অবশেষে তিনিও অগ্নিদেবের মতাে বিধ্বস্ত হয়ে বসে পড়েন। এবার দেবরাজ ইন্দ্র নিজেই এগিয়ে যান। ধীর পদক্ষেপে এসে দাঁড়ান মুর্তির কাছে। দেবরাজ যখন মূর্তির কাছে উপস্থিত হলেন তখন সেই মূর্তির অবয়বে পরিবর্তন এসেছে। ইন্দ্র দেখলেন, আকাশে শােভামানা হৈমবতী উমা। দেবরাজ আনত হলেন তাঁর কাছে। এই বহুশোভাধারী দেবী জ্ঞানদান করলেন দেবকুলকে-তােমরা নিজের শক্তিতে বিজয়লাভ করনি। এই জগৎ প্রপঞ্চে এক শক্তি। তার শক্তিতে সকলে শক্তিমান। নিজেদের অহংবশত তােমরা নিজেদের শক্তির আস্ফালন করছিলে।
কেনােপনিষদে উল্লিখিত এই কাহিনীতে দেখা যায় উমা হৈমবতী দেবকুলের জ্ঞানদায়িনী। তিনি সরস্বতী। পণ্ডিতগণের মতে, কোনােপনিষৎকার যখন আবির্ভূত হয়েছিলেন তখন হিমবৎ পর্বতের কন্যা উমা নিশ্চয়ই একজন বিশিষ্ট দেবীরূপে প্রসিদ্ধ ছিলেন। কারণ, ব্রহ্মবাদিনী এই দেবীর সঙ্গে ‘হৈমবতী' ও 'উমা' দুটি নামই জড়িত। যে দুটি নাম আমরা দেবী দুর্গার পৌরাণিক রূপকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে থাকতে দেখি।
দেবী দুর্গা বাঙালির জীবনে-মননে। দুর্গতিনাশিনীর থেকেও বেশিভাবে শিবজায়া পার্বতীরূপে বিরাজিতা। তিনি হিমালয়কন্যা, সিংহ তাঁর বাহন। অর্থাৎ, দেবীর সঙ্গে পর্বতের একটি নিগূঢ় সম্পর্ক সর্বদাই থেকে যায়। মাতৃপূজা এশিয়া, ইউরােপ এবং আফ্রিকার বহু অঞ্চলে প্রাচীন যুগ থেকেই দেখতে পাওয়া যায়। গ্রিকদেবীর হাতে বর্শা, তিনি পর্বতশিখরে দণ্ডায়মান এবং সিংহকর্তৃক রক্ষিতা। পণ্ডিতদের মতে, ক্রিটের মাতৃদেবী এশিয়ার প্রসিদ্ধ মাতৃদেবীর সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে বিচিত্ররূপ ধারণ করেছেন। এই দেবীর চারপাশে সিংহ, ভল্লুক, চিতাবাঘ এবং অন্য পশুদের দেখা যায়। প্রাচীনকালের মাতৃ উপাসনায় যে সব দেবীর উপস্থিতি ছিল, তারই ভারতীয়রূপ আমাদের দুর্গতিনাশিনী দুর্গা বা মহিষাসুরমর্দিনী দেবী।
আবার ভিন্ন দিক দিয়ে দেখলে ‘উমা’ শব্দটি কোনও সংস্কৃত শব্দ নয়। ব্যাবিলনীয় ভাষায় ‘উন্মু' শব্দের অর্থ হল মা। দ্রাবিড়ীয় প্রতিশব্দ হল ‘উন্মু'। এই উন্মু থেকেই কি উমার উদ্ভব? উদ্ভবের ইতিহাস যাই হােক না কেন, আমাদের কাছে যিনি দুর্গা তিনিই উমা। আবার তিনিই মহিষাসুরমর্দিনী। তার রূপ ও ইতিহাস বিশাল হলেও বাঙালির মনে কন্যারূপে দেবী কোমল স্থান অধিকার করেছেন।
মহাভারতের আনুশাসনিক পর্বে ১৪০শ থেকে ১৪৭শ অধ্যায়ে এক অপূর্ব চিত্র উপহার দেয়া হয়েছে। উপাখ্যানটির নাম, “উমা-মহেশ্ব সংবাদ।” ভগবান দেবাদিদেব মহাদেব জটাজুটধারণ করে, ব্যাঘ্রচর্ম পরিধান করে বসে আছেন সুখাসনে। গলায় সর্পের উপবীত, সঙ্গে সিংহচর্মে উত্তরীয়। চারিদিকে হিমগিরি পর্বতের অপূর্ব শােভা। এমন সময় পার্বতী উপস্থিত হলেন, তার পরিধানে মহাদেবেরই মতাে পােশাক, কাঁধে কলসিপূর্ণ জল। কোনও ঝরনা থেকে জল আনতে গিয়েছিলেন দেবী। দেবাদিদেবের কাছে উপস্থিত হয়ে তার মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি চাপল। তিনি তার কোমল হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন দেবাদিদেবের চোখ দুটি। দেবাদিদেবের চোখ দুটি আবৃত হওয়া মাত্রই সমস্ত জগৎ অন্ধকারে ছেয়ে গেল। সৃষ্টি প্রায় ধ্বংস হয় হয়। এমন সময় সৃষ্টিকে রক্ষার তাগিদে দেবাদিদেবের কপাল থেকে তেজরাশি নির্গত হল এবং এই তেজ থেকে সৃষ্টি হল তৃতীয় নয়নের। তৃতীয় নয়নের তেজে হিমালয় পর্বত দগ্ধ হল। এইবার সম্বিৎ ফিরল পার্বতীর। এ কী হল! পিতা পর্বতরাজ যে আমার কৌতুকের জন্য দগ্ধ হলেন! তিনি এবার কৌতুক ছেড়ে শিবের কাছে আনত হলেন।
পার্বতীর অনুরােধে শিব প্রাণ ফিরিয়ে দিলেন পর্বতরাজ হিমালয়ের।
দেবীরূপ আর তার শক্তি-এই দুটির মধ্যে নিগূঢ় সম্বন্ধ আছে। দেবীরূপে কখনও তিনি পার্বতী, শিবনির্ভর। আবার কখনও তিনি দৈত্যকে জয় করে দেবকুলকে রক্ষা করছেন। এই দুই ক্ষেত্র ব্যতীত আরেকটি ক্ষেত্র আছে, যেটি বর্ণিত হয়েছে মার্কণ্ডেয় পুরাণের মধ্যে। এখানে মেধা ঋষির আশ্রমে উপস্থিত হয়েছেন রাজা সুরথ আর সামধি বৈশ্য। রাজা বিধ্বংসী শক্রর হাতে পরাজিত। আত্মীয়-পরিজন সবই তাঁকে ত্যাগ করেছেন। একাকী মনের দুঃখে ঘুরতে ঘুরতে উপস্থিত হয়েছেন বনের মধ্যে। এক গাছের তলায় বসে অদূরে চোখে পড়ল এক ব্যক্তিকে। তিনিও তারই মতাে, একাকী, হতাশ! ধীরে ধীরে এগিয়ে যান সুরথ। দুই জনের পরিচয় হয়। রাজা জানতে পারেন, সমাধি বৈশ্যকেও তার আত্মীয়পরিজন ত্যাগ করেছেন। তিনিও তারই মতাে ঘুরতে ঘুরতে উপস্থিত হয়েছেন বনে। দুই জনে পরস্পর আলােচনা করতে থাকলেন। কি আশ্চর্য! যে প্রিয়জনেরা তাদের ত্যাগ করেছেন, যারা তাদের কথা একবারও মনে রাখেননি, তবু সেই আত্মীয়দের কথাই কেন মনে পড়ছে বারংবার? কেন তাদের প্রতি যথেষ্ট বিরূপ হতে পারছেন না তাঁরা। কী জন্য মনের এই দুর্বলতা, যা বুদ্ধিকে অতিক্রম করে যায়? দুই বিষাদমগ্ন এগিয়ে যান সামনে অবস্থিত এক ঋষির আশ্রমের দিকে, মেধা ঋষির আশ্রম। ঋষির কাছে আনত হয়ে মেলে ধরেন তাদের সেই প্রশ্ন, কেন এই দুর্বলতা? কেন এত মায়া? মেধা ঋষির দুই বিষাদঃ মনকে শােননি সেই মহাশক্তির বাণী। যে শক্তি জগৎসংসার পরিচালিত করছে, মা পাখি যখন তার শিশু পাখির মুখে খাবার গুজে দেয় তখন সেই শক্তিই পিছনে কাজ করে। “এই মহাশক্তি যিনি জীবকে মায়ায় আবৃত করে রেখেছেন! এই মায়া দূরত্যয়া, তাকে অতিক্রম করা জীবের অসাধ্য। শক্তির কৃপা বিনা এক পদক্ষেপও মানব অগ্রসর হতে পারে না। তাই এই দেবীর আরাধনা কর?" মেধা ঋষির পরামর্শে তিনবার মূর্তি গড়ে পূজা সম্পন্ন করলেন সমাধি বৈশ্য আর রাজা সুরথ। দেবীর কৃপা লাভ করে দুই জনেই ফিরে পেলেন বিনষ্ট সম্পদ। সমগ্র চণ্ডীতে মেধা ঋষি-উক্ত দেবীমাহাত্ম্যসূচক কাহিনীই বর্ণিত আছে। এই মহাশক্তির আরাধনাই আমাদের দেবীবন্দনা রূপে উপস্থিত। তাই শ্রীশ্রীচণ্ডীতে বলা হয়েছে, “দুর্গাসি দুর্গ-ভবসাগর-নৌরসঙ্গা” (৪/১১) অর্থাৎ দেবী দুর্গম ভবসাগরে নৌকাস্বরূপ বলে তিনি দুর্গা। দুর্গা কী করেন? তিনি কেবল দুর্গম নামে দৈত্য বধ করেন না; মানবের মহাবিঘ্ন, ভববন্ধ, কুকর্ম, শােক, দুঃখ, নরক, যমদণ্ড, জন্ম, মহাভয় এবং অতিরােগ বিনষ্ট করেন। তাই দেবী আমাদের রক্ষাকর্ত্রী রূপে চিরবন্দিতা। আমরা দেবীর চিরআশ্রিতা। 'খিল হরিবংশ’ গ্রন্থে দেবী মাহাত্ম্য বর্ণনা করে বলা হয়েছে, “এবং স্তুতা মহাদেবী দুর্গা দুর্গপরাক্রমা। / সান্নিধ্যং কল্পয়ামাস অনিরুদ্ধস্য বন্ধনে।।” (১২০/৩৫)।
এখানে দুর্গপরাক্রমা বলতে কী বােঝানাে হচ্ছে তার একটি ব্যাখ্যায় পণ্ডিতগণ বলেছেন, দুর্গা কি প্রাথমিকরূপে নগরপালিকা দুর্গক্ষিণী দেবী ছিলেন? আবার কোনও কোনও মতে, গ্রিক, যােদ্ধা আলেকজান্ডারের ভারত বিজয় এবং যুদ্ধ, দেবী আর তার বধ্য মহিষাসুরের রূপকল্পনায় প্রভাব বিস্তার করেছে। তাই আজকের মহিষাসুরের মাথায় কখনও কখনও দুটি শিং! যা আমরা গ্রিক যােদ্ধাদের শিরস্ত্রাণরূপে পাই।
দেবীর বিবর্তনের ইতিহাস যতই সুদীর্ঘ করে তোলা হোক না কেন, দেবী বাঙালির কাছে, কন্যারূপে, মাতৃরূপে নেমে আসেন। ঋতুচক্রের দিনগুলাে ঘুরে চলে। শরতের আগমন হলেই শুরু হয় দেবীবন্দনা। সিংহারূঢ়া মহাদেবী পুত্রকন্যা নিয়ে উপস্থিত হন। বাংলার আঙিনায়
পূর্বা সেনগুপ্ত
কোন মন্তব্য নেই