মহাভারতের ধর্মযুদ্ধ কি?
মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে কৌরব ও পাণ্ডব উভয় পক্ষের রাজা, সেনাপতি, সৈন্যরা মুখােমুখি দাঁড়িয়েছে, যুদ্ধ শুরু হতে চলেছে। এই যুদ্ধকে বলা হচ্ছে ধর্মযুদ্ধ, ধর্মযুদ্ধে উভয় পক্ষই মনে করছে আমরাই ঠিক। তখন অন্যান্য ক্ষত্রিয় রাজারা যে পক্ষকে ঠিক মনে করত তারা সেই পক্ষে যােগদান করে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করত। এক পক্ষ যদি মনে করে আমি ঠিক নই, তাহলে অন্যরা যুদ্ধ করতে যাবে না। আবার যারা শুধু মাত্র নিজের শক্তি ও পরাক্রম দেখানোর জন্য যুদ্ধ করত, যেমন আলেকজণ্ডারের মত রাজারা যখন সাম্রাজ্য বিস্তার করতে যুদ্ধ করতে বেরিয়ে পড়তেন, তাদের কিন্তু সাহায্যের জন্য কেউ এগিয়ে আসত না। ধরে বেঁধে কাউকে জোর করে নিয়ে আসাটা অন্য জিনিষ, কিন্তু নিজে থেকে কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসত না। ভারতবর্ষে এই ধরণের যুদ্ধকে, অর্থাৎ তুমি শুধু অপরের রাজ্যকে গ্রাস করার জন্য যুদ্ধ করবে, কখনই সমর্থন করা হতো না। তাহলে নিজেদের শক্তি সামর্থকে কিভাবে প্রদর্শন করবে? তখন এরা কোন একটা বিরাট যজ্ঞের আয়ােজন করতেন, যেমন বাজপেয় যজ্ঞ, অশ্বমেধ যজ্ঞ, রাজসূয় যজ্ঞ এই ধরণের যজ্ঞ করতেন। আবার ছিল চক্রবর্তী যজ্ঞ। এই ধরণের যজ্ঞে দেখান হতাে যে আমার শক্তির পরাক্রমের সামনে কেউ দাঁড়াতে পারবে না। এইসব যজ্ঞের জন্য প্রচুর অর্থের দরকার হত। এখন এই অর্থ কিভাবে আসবে? তখন সেই রাজার সৈন্যরা অর্থ সংগ্রহের জন্য বেরিয়ে পড়ত, বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে দিয়ে সেই সৈন্যরা যাবে। তারা কিন্তু সৈন্য পাঠিয়ে অন্য রাজ্যকে নিজের রাজ্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে নিত না। তােমার রাজ্য আমরা দখল করতে আসেনি, কিন্তু তুমি একটা পরিমাণ কর দিয়ে দাও, হয় যুদ্ধের আগে দিয়ে দাও, আর তা নাহলে যুদ্ধ করে সমাধান করে নাও তুমি দেবে কি দেবে না। ওরা কিন্তু বলেই নিত আমরা আমাদের শক্তি প্রদর্শন করতে এসেছি। এখন তুমিও যদি শক্তি দেখাতে চাও তাহলে যুদ্ধে নেমে ফয়সালা করে নাও।
ধর্মযুদ্ধের ক্ষেত্রে কিন্তু ব্যাপারটা পুরাে আলাদা। বাজপেয়, অশ্বমেধাদি যজ্ঞাদিতে অন্যরা কেউ এগিয়ে আসত না, তারা নিজেরাই এগিয়ে যেত। ধর্মযুদ্ধে দুই পক্ষই কোন একটা ব্যাপারে বলবে এই ব্যাপারে আমিই ঠিক। তখন দুই পক্ষ থেকেই অন্যান্য রাজাদের কাছে নিমন্ত্রণ পাঠিয়ে দেওয়া হত, সেখানে বলা হত, এই ব্যাপারটাতে আমি মনে করছি আমি ঠিক, আপনি যদি মনে করে থাকেন আমি ঠিক তাহলে আপনি আমার পক্ষে যােগদান করে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করুন। অনেক সময় এমনও দেখা গেছে যে, হয়তাে আমন্ত্রিত রাজা মনে করছে যে, এ হয়তাে পুরােপুরি ঠিক নয়, কিন্তু এমন একটা সম্পর্ক আছে যে, সেই সম্পর্কের খাতিরে তার বিরােধী শিবিরে না গিয়ে এই শিবিরেই যােগদান করত।
অর্জুনরা মনে করছে কৌরবরা পুরােপুরি ভুল করছে। সত্যি কথা বলতে, মহাভারত যদি খুঁটিয়ে খুব গভীর ভাবে ঠিক ঠিক পড়া হয় তাহলে বােঝা খুব মুশকিল কে ঠিক ছিল আর কার ভুল ছিল। এটাই ধর্মযুদ্ধের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য। দ্বন্দ্ব, বৈপরিত্যের সমাবেশ এমন ভাবে থাকে যে বুঝা যায় না কোনটা ঠিক আর কোনটা ঠিক নয়, একদিক থেকে দেখলে মনে হবে এটা ঠিক, অন্য দিক থেকে দেখলে আবার মনে হবে অন্যটাই ঠিক। ধর্মযুদ্ধে আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, তােমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, এবার তােমাকে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতেই হবে, কেউ না বলতে পারত না। ধর্মযুদ্ধের আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যুদ্ধে এক পক্ষকে না মারা পর্যন্ত জয়পরাজয়ের কোন ফয়সালা হবে না। এক পক্ষকে মরতেই হবে।
মহাভারতে বর্ণনানুযায়ী কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের আগে অর্জুন টুকটাক এদিক সেদিক এক আধটা যুদ্ধ করেছিল, কিন্তু সেখানে কোথাও আমি মরব কি তুমি মরবে এই ধরণের যুদ্ধ অর্জুনকে কখনই করতে হয়নি। এর আগে পর্যন্ত যে যুদ্ধ করেছিল সেটা হচ্ছে আমি তােমার থেকে শক্তিমান, তুমি আমাকে মেনে নাও আমি তােমার থেকে বড় স্বীকার করে নিলেই সব মিটে যাবে। আগেকার দিনে রাজায় রাজায় যে যুদ্ধ হত সেটা রক্তারক্তি যুদ্ধ করে হয় আমি মরব না হয় তুমি মরবে, এই ধরণের হতো না। এর ভালাে দৃষ্টান্ত হচ্ছে বিরাট রাজ্যের যুদ্ধে। রাজা বিরাটের রাজ্যে পাণ্ডবরা অজ্ঞাত বাস করছেন। সেই সময় দুর্যোধনরা এসেছে বিরাট রাজার গােধন অপহরণ করবার জন্য। এখানে এখন এক পক্ষ নিজের সম্পত্তিকে বাঁচাতে চাইছে, আরেক পক্ষ কৌশল করে পালাচ্ছে, কিন্তু হয় তুমি মরবে না হয় আমি মরব এই অবস্থাতে কখনই যায়নি। আবার যদি কেউ তিরস্কার করে দেয় তখন পিছিয়ে আসবে। কিন্তু কুরুক্ষেত্রের এই যুদ্ধ হচ্ছে হয় তুমি বাঁচবে না হয় আমি বাঁচব। প্রথম অবস্থায় কুস্তি লড়াইয়ে আগে কোন পয়েন্টের ব্যাপার ছিল না, মাটিতে ফেলে চিৎ করে তার বুকে না বসা পর্যন্ত কোন মীমাংসা হবে না। ধর্মযুদ্ধে মৃত্যুই শেষ কথা। বন্দির কোন প্রশ্নই নেই, বন্দি হওয়া মানেই মৃত্যু, তােমাকে বধ করাটা শুধু কিছু সময়ের ব্যবধান।
এখানে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে সবাই মরার জন্য বা মারার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। এর আগে অর্জুন এইভাবে কাউকে মারেনি। এর আগেও যুদ্ধ হয়েছে কিন্তু তােমাকে আমি বধ করার জন্যই দাঁড়িয়েছি, এই অনুভাবনা নিয়ে কোন যােদ্ধাই এর আগে দাঁড়ায়নি। অর্জুনেরও এই অভিজ্ঞতা নেই। এই কারণে অর্জুনের মনটা হঠাৎ বিচলিত হয়ে পড়েছে। যাদের কোলে পিঠে বড় হয়েছি, যাদের সাথে এক সময় খেলাধুলা করেছি, যাঁর কাছে শস্ত্রবিদ্যা, শাস্ত্রবিদ্যা পেয়েছি তাঁদেরকে শেষ করে দিতে হবে, আমি যদি শেষ না করি তাহলে তারা আমায় শেষ করে দেবে। হয় অর্জুন মরবে না হয় অর্জুন এদের মারবে। অর্জুন এখন এই অবস্থায় এসে যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়েছে।
ইদানিং কালে অবশ্য এই যুদ্ধ অনেক বেড়ে গেছে। এখন জানে যে আমি যদি শত্রুকে শেষ না করে দিই শত্রুপক্ষের সৈন্য সুযােগ পেলেই আমাকে মেরে দেবে। আর আমি তাে যুদ্ধে মরার জন্য যাইনি, আমি গেছি তােমাকে মারার জন্য, এই বােধটাই ইদানিং কালের যে কোন যুদ্ধে সমস্ত সৈন্যের মধ্যে গেঁথে গেছে। এই জায়গাটাতে এসে অর্জুন চিন্তা করছে আমি তাে আমার আত্মীয়, বন্ধু, ভাইদেরই হত্যা করতে যাচ্ছি। এই সব চিন্তা অর্জুনের মনকে বিষাদগ্রস্ত করে দিয়েছে। তারপর তাে আমরা সবাই জানি, অর্জুন তার গাণ্ডীব রথের উপর নামিয়ে রেখে বলছে আমি এই যুদ্ধ করব না। তখন শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে গীতার উপদেশ দিলেন।
স্বামী সমর্পণানন্দ প্রদত্ত লেকচার থেকে সংকলিত।শ্রীকৃষ্ণকমল মিন্টু
সনাতন,বাংলাদেশ
কোন মন্তব্য নেই