sanatansangbed

Introduction of SANATAN dharma scriptures

ভারতে মূর্তি-পূজা

নিরাকার এক অদ্বিতীয় ঈশ্বরের ধারণা করা সাধারণ মানবের পক্ষে সহজ নয়। সেইজন্যই নিরাকার ব্রহ্মকে সাকাররূপে কল্পনা করে মানুষ তৃপ্তি পায়। 
কারো মতে, সনাতন/হিন্দু ধর্মের ক্রমবিকাশ সূচনা হয় বৈদিক যুগ থেকেই। বেদের যুগ ছিল খৃষ্টপূর্ব ১৫০০ সালে(অনুমান)। আবার কোন কোন গবেষক মনে করেন খ্রিস্টের জন্মের প্রায় দু’হাজার বছর আগে, মধ্য এশিয়া থেকে আসা আর্য জাতিগোষ্ঠী ভারতবর্ষে এসে যে ধর্মাচারণের সূত্রপাত ঘটিয়েছিল, তারই এক পরিবর্তিত রূপ আজকের হিন্দুধর্ম। খ্রীস্টপূর্ব ৫৫০০-২৬০০ অব্দের দিকে যখন কিনা হাপ্পান যুগ ছিল ঠিক সেই সময়ই এ ধর্মের গোড়ার দিক। অনেকের মতে খ্রীস্টপূর্ব ১৫০০-৫০০ অব্দ। কিন্তুইতিহাস বিশ্লেষকদের মতে আর্য বা Aryan জাতিগোষ্ঠি ইউরোপের মধ্য দিয়ে ইরান হয়ে ভারতে প্রবেশ করে খ্রীস্টপূর্ব ৩০০০-২৫০০ অব্দের মধ্যে, তারাই ভারতে বেদ চর্চা করতে থাকে এবং তারা সমগ্র ভারতে তা ছড়িয়ে দেয়। সেই সূত্রে আর্যদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদ— হিন্দু ধর্মের প্রধান আকর গ্রন্থ হিসাবে বিবেচিত হয়।আর্যগণ প্রথমে উত্তর ভারতে সিন্ধুতে অবস্থান শুরু করে। এরপর তারা উত্তর প্রদেশে বসতি গড়ে তুলে।এখান থেকে উত্তর ভারতে হিন্দু ধর্মের ব্যাপক প্রসার ঘটতে থাকে।এই সময় এই ধর্ম আর্য্যবর্ত নামে পরিচিতি ছিল।কালক্রমে তারা বিন্ধা পর্বত অতিক্রম করে দক্ষিণ ভারতের দিকে আসতে থাকে এবং হিন্দু ধর্মের প্রসার ঘটতে থাকে। আর্য জাতিগোষ্ঠিরা অনেক নিয়ম কানুন মেনে চলত। তারা চারটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল এরা হলঃ ব্রাহ্মন, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শুদ্র। এই সম্প্রদায়গুলো তৈরি করার অন্যতম কারণ হল কাজ ভাগ করে নেওয়া অর্থাৎ এক এক সম্প্রদায় এর লোক এক এক ধরনের কাজ করবে। ।এই ধর্মের যেহেতু কোন সুনির্দিষ্ট উদ্ভাবক নেই তাই এই ধর্মের উৎপত্তি সংক্রান্ত প্রকৃত দিন তারিখ নির্ণয় করা একটি দুরুহ কাজ। তাই কেদারনাথ তিওয়ারী বলেন, এই ধর্মের উৎপত্তির না কোন সঠিক তারিখ আছে না কোন সুনির্দিষ্ট প্রবর্তক আছেন।
হিন্দু ধর্মের প্রবর্তক কোন বিশেষ নয়। যরদুশত,মূসা,ঈসার মত এমন কোন ব্যক্তির উপর সন্ধান পাওয়া যায় না। যাকে হিন্দু ধর্মের প্রদর্শক হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। তেমনিভাবে হিন্দু ধর্মের গ্রন্থাবলী কোণ নির্দিষ্ট ব্যক্তি-সংক্লিষ্টের সাথে সম্পৃক্ত নয়। পরবর্তীতে কিছু ব্যক্তি বিশেষের আগমন ঘটলেও হিন্দুধর্মের সূচনাপূর্বে নৈর্ব্যক্তিগণ সীলমোহরে লেগে আছেন। যেহেতু হিন্দু ধর্মের ধর্মীয় ব্যবস্থা সংগঠনে অসংখ্য ব্যক্তিত্ব অংশগ্রহণ করেছেন, যার ফলে এই ধর্মে একক কোন বিশ্বাস,ধর্মীয় রীতি-নীতি বা আচার অনুষ্ঠান লক্ষ্য করা যায় না। বিশ্বাসের বৈচিত্র্য,উপাসনা পদ্বতির বিভিন্নতা এবং আরাধ্যের আধিক্যের জন্য এই ধর্মকে এমন এক গহীন অরণ্যের মত মনে হয়,যেখানে হাজারো পথ রয়েছে।

তাই স্যার চার্লস এলিয়ট বলেন,
Hinduism has not been made, but has grown,it is a jungle not a building.
কে.এম সেন বলেন,
হিন্দুত্ববাদ হল এমন ধর্ম যা একটি বৃক্ষের ন্যায় যা অনেকদিন যাবৎ গড়ে উঠেছে যেমনটি একটি দালান নির্মাণে অনেকদিন সময় লাগলে তার স্থাপত্য নির্ধারণ করা একটি দুরুহ কাজ। কিন্তু কোন পথ সঠিকভাবে সরল ও পরিচ্ছন্ন নয়।
যখন আর্যহিন্দুগণ সর্বপ্রথন ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করে তখন তাদের ধ্যান-ধারনা ছিল নেহায়াত সাদামাঠা। ঐসব ধ্যান-ধারনা ও বিশ্বাস বেদসমূহে সঙ্কলিত হয়েছে। কিন্তু সেই সময় থেকে তা এক বিশেষ ধর্মীয় শ্রেণী অর্থাৎ, ব্রাহ্মণদের ধর্মীয় নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। তারা তাদের ধর্মীয় নেতৃত্বকে বৈধ করার জন্য যেসকল গ্রন্থ রচনা শুরু করে তাদের ব্রাহ্মণ্য বলা হয়। ব্রাহ্মণ্যকে বৌদ্ব ও জৈন ধর্মগ্রন্থের সাথে তুলনা করলে উপলব্দ্বি করলে এই বিষয়টি প্রতীয়মান হয় যে, তাতে তত্ত্ব ও তথ্যসমূহ বিকৃতি করা হয়েছে এবং পুরাতন বৈদিক বিশ্বাসসমূহ এমনভাবে সংশোধন করা হয়েছে, যাতে ব্রাহ্মণদের পৌরসাহিত্যের ধারাবাহিকতা সপ্রমাণিত হয়। এইজন্যে হিন্দু ধর্মের সেইসকল গ্রন্থসমূহের সঠিক প্রতিনিধিত্ব হয় নাই। জৈন ও বৌদ্ব মতবাদরুপে যে নতুন ধর্মীয় আন্দোলনের সৃষ্টি হয়,ব্রাহ্মণ্যে তা সম্পূর্ণরুপে এড়িয়ে চলা হয়।খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে প্রবর্তিত হয় বৌদ্ধ ধর্ম। এই ধর্ম প্রাথমিক ভাবে হিন্দু ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ উদ্ভুত হলেও, একটা সময়ের পরে, বিশেষ করে গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর, এর মধ্যেও তন্ত্র-মন্ত্রজাত বিভিন্ন সংস্কার প্রবেশ করে। হিন্দু ধর্মের মতো বৌদ্ধ ধর্মেও রয়েছে অজস্র তন্ত্র-গ্রন্থ। বৌদ্ধেরা হিন্দুদের তথাকথিত দেবদেবীতে বিশ্বাসী না হলেও হিন্দু তন্ত্রকে তারা শুধু গ্রহণই করেনি, তাকে আরও পরিশীলিত ও পরিমার্জিত করেছিল বলা যায়।হিন্দু ধর্ম থেকে আরেক ক্ষত্রিয় পুত্র জৈন ধর্মের প্রবর্তন করেন যদিও তা বৌদ্ব ধর্মের ন্যায় ব্যাপকভাবে প্রসারতা লাভ করতে পারে নাই। হিন্দুধর্মের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় কোন শূন্যতা সৃষ্টি হয় নাই। তেমনিভাবে এই ধর্মগ্রন্থসমূহে উপমহাদেশে গ্রীক, শক,হুন ইত্যাদি জাতির হামলার কথা উল্লেখ করা হয় নাই।
এই সনাতন ধর্মের সাধু সন্ন্যাসিরাই বেদ শ্রুতিবদ্ধ করেন অর্থাৎ ধ্যানের মাধ্যমে বেদ আয়ত্ব করেন। বেদ কোন একজন সাধু বা সন্ন্যাসির লব্ধকৃত নয়, বেদ হল বহু সাধু সন্ন্যাসিদের লব্ধকৃত এক মহান শ্রুতিবদ্ধ গ্রন্থ যা প্রথম অবস্থায় সবার মনে মনে ছিল পরে তাকে লিপিবদ্ধ করা হয়। বেদ এই লিঙ্কটির মাধ্যমে বেদ সম্পর্কে আরো জানতে পারবেন। তখন কার যুগে এই বেদের আধিপত্য ছিল ব্যাপক, অর্থাৎ সমাজের সকল কাজ বেদের মাধ্যমে চলত কারণ বেদে সমাজ চালানো, চিকিৎসা করা, গণনা করা এমন সব উপাদানই আছে। এই কারনে তখনকার সভ্যতাকে বলা হয় বৈদিক সভ্যতা। এই বৈদিক সভ্যতায় অর্থাৎ ঐ আমলে কোন মূর্তি পুজা করা হত না। সেই সময় হিন্দুদের প্রধান দেবতা ছিলেন ইন্দ্র, বরুন, অগ্নি এবং সোম। তারা যজ্ঞের মাধ্যমে পূজিত হত। তখনকার ঈশ্বর আরাধনা হত যজ্ঞ এবং বেদ পাঠের মাধ্যমে। সকল কাজের আগে যজ্ঞ করা ছিল বাঞ্ছনীয়। সে আমলে কোন মূর্তি বা মন্দির ছিল না। ।আর্যদের এ দেশে আসার আগে এখানকার অধিবাসীদের মধ্যে যে সমস্ত ধর্মাচারণ ছিল, মূর্তিপুজো তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। আর্যরা এ দেশের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে যতই মিশে যেতে থাকে, এখানকার প্রাচীন আচার-ব্যবহার এবং বিভিন্ন ধর্মীয় আচরণ আর্য-সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত হতে থাকে তত বেশি মাত্রায়। এই সময়কাল থেকেই ঋগবেদের প্রধান ত্রিদেব ইন্দ্র, মিত্রাবরুণ ও যমের স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন অনার্য দেবতা ব্রহ্মা, বিষ্ণু,শিব ও মহেশ্বর। পাওয়া যায় মাতৃরূপিনী আদ্যাশক্তি মহামায়ার উপাসনার কথাও।এই সাংস্কৃতিক আদান প্রদানের একটা পর্বে রচিত হয়েছিল রামায়ণ ও মহাভারতের মতো দু’খানি মহাকাব্য। মনে রাখতে হবে এই দুই কাব্য কিন্তু ধর্মগ্রন্থ নয়। ধারনা করা হয়ে থাকে যে খ্রীস্টপূর্ব ৫০০ থেকে ১০০ অব্দের মধ্যে রামায়ণএবং মহাভারত শ্রুতিবদ্ধ হয়। বর্তমানে এই সমস্ত মহান ধর্ম গ্রন্থগুলোর লিখিত রূপ হয়েছে। এই রামায়ণ এবং মহাভারতে লিপিবদ্ধ আছে ধর্ম এবং যুদ্ধেরকাহিনী। এছারাও পুরাণ নামে যে ধর্মগ্রন্থগুলো রয়েছে তাতে দেবতাদের এবং অসুরদের যুদ্ধ নিয়ে ঘটনা আছে।
তথ্যসূত্র- শ্রীহংসনারায়ণ এর দেবদেবীর উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ বই থেকে নেওয়া। 
নিবেদনে- সনাতন সংবেদ। 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.