বেদের একেশ্বরত্ব
হিউমেব মতে, প্রাচীনকালের সকলদেশের সকল মানুষই ছিল বহু দেবতার উপাসক।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশে আদিম মানুষের ধর্মবিশ্বাস যাই হোক না কেন, ভারতবর্ষের দেব-উপাসনা বহুদেবতার বিশ্বাস সত্ত্বেও একেশ্বরের উপাসনায় পর্যবসিত। ঋগ্বেদে যে পৃথিবীর আদিমতম ধর্মগ্রন্থ, তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। ভারতীয় সাহিত্যের ও প্রাচীনতম গ্রন্থ ঋগ্বেদ। সময় সম্পর্কে বিতর্কের অবকাশ থাকলেও ঋগ্বেদের নিন্মতর সময়-সীমা দুহাজার খৃষ্টপূর্বাব্দের পরে নয়। সাধারণতঃ পঞ্চ-সহস্র খৃষ্টপূর্বাব্দ অথবা আরো বহুপূর্বকাল পর্যন্ত ঋগ্বেদের সময়সীমা প্রসারিত। পৃথিবীর এই প্রাচীনতম মহাগ্রন্থ থেকে পাঁচ-সাত হাজার কিংবা আরও পূর্ববর্তীকালের মানুষের ধর্মবিশ্বাস এবং ধর্মচর্যার যে বিশ্বত্ব আলেখ্য পাওয়া যায়, তা আর কোথাও সুলভ নয়। ভারতীয় আর্যধর্মের প্রভাব এককালে পৃথিবীর নানা দেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল। ঋগ্বদের দেব-উপাসনার বৈশিষ্ঠ্যই বহুর মধ্যে একত্বের অনুভূতি। একজন পাশ্চাত্য ভারততত্ত্ববিদ এ সম্পর্কে লিখেছেনঃ- The hindus have from time immemorial believed in the existence of one supreme being, in the immortality of soul and in a future stats of reward and punishment, but in their opinion respecting the nature of supreme being they are unqestionable pantheists. Hindu Mythology-lieut, col vans kunedy.
ঋগ্বেদে বহু দেবতার উপাসনা দৃষ্ট হয়। দেবতাদের যজ্ঞে আহবান করা হয়েছে এবং দেবতাদের উদ্দেশ্য আগ্নিতে হবিঃ অর্পিত হয়েছে। আগ্নি, ইন্দ্র, বরুণ, সোম, সূর্য, পূষণ্, মরুৎ, দৌঃ, পর্জন্য, অশ্বিদ্বয়, পৃথিবী, অদিতি, সরস্বতী প্রভৃতি বহুদেবতার অস্বিত্ব ঋগ্বেদের পাঠকমাত্রেই অবগত আছেন। অন্যান্য বৈদিক সংহিতা এবং ব্রাহ্মণেও বহু দেবতার অর্চনা স্থান লাভ করেছে। সুতরাং বৈদিক আর্যগণ যে বহুদেবতায় বিশ্বাসী ছিলেন, এ মত প্রায় সর্বজন স্বীকৃত। আধুনিক হিন্দুধর্ম বৈদিক ধর্মোপাসনার বিবর্তন ও রুপান্তরের ফলে গড়ে উঠেছে। সেইজন্যই আধুনিক হিন্দুধর্মেও বহু দেবতার পূজা প্রচলিত। বরঞ্চ দেবতার সংখ্যা ক্রমে ক্রমে বর্ধিত হতে হতে বিপুল আকার ধারণ করেছে।
ঋগ্বেদে দেবতার সংখ্যা তেত্রিশঃ
অপর একটি ঋকে আছেঃ-
ঋষি অপর একটি মন্ত্রে অগ্নিকে উদ্দেশ করে বলেছেন,
অর্থ- হে অগ্নি, তুমি তেত্রিশজন দেবতাকে এখানে নিয়ে এস।
অথর্ববেদেও ত্রয়স্ত্রিংশৎ দেবতার উল্লেখ আছে। তেত্রিশসংখ্যক দেবতাকে তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছেঃ-
ঋগ্বেদের পূর্বোদ্ধৃত মন্ত্রটিতে (১/১৩৯/১১) ও দেবগণকে স্বর্গবাসী, মর্তবাসী ও অন্তরীক্ষবাসী- এই তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে। তৈত্তিরীয় সংহিতাতে(তৈঃ সংহিতা ১/৪/১০/১) ও স্বর্গ অন্তরীক্ষ ও পৃথিবীতে স্থিত মোট তেত্রিশজন দেবতার উল্লেখ আছে। তেত্রিশ সংখ্যক দেবতার বিবরণ প্রসঙ্গে ঐতরেয় ব্রাহ্মণ বলেন, "অষ্টৌ রসবঃ, একাদশ রুদ্রা, দ্বাদশ আদিত্যাঃ প্রজাপতিশ্চ বষট্কাবশ্চ।" ঐতঃ ব্রাঃ- ১/১০
-আটজন বসু, একাদশ রুদ্রা, দ্বাদশ আদিত্য, প্রজাপতি এবং বষট্কার মিলে তেত্রিশ দেবতা। বৃহদারণ্যকোপনিষদে তেত্রিশ সংখ্যক দেবতার তালিকায় বষট্কার স্থলে ইন্দ্র আসন পেয়েছেন, "ত্রয়স্ত্রিংশত্ত্বের দেবা ইতি। কতমে তে ত্রয়স্ত্রিংশদিত্যষ্টৌ বসব একাদশ রুদ্রা দ্বাদশাদিত্যাস্ত একত্রিংশদিন্দ্রশ্চৈব প্রজাপতিশ্চ ত্রয়স্ত্রিংশাবিতি।"- বৃহঃ উপঃ-৩/৯/২ (শাকল্য জিজ্ঞাসা করিলেন -ভাল)সেই তেত্রিশটি দেবতাই বা কে কে ?-(যাজ্ঞবল্ক্য বলিলেন,)অষ্টবসু, একাদশ রুদ্রম দ্বাদশ আদিত্য-এই একত্রিশ, আর ইন্দ্র ও প্রজাপতি দুই মিলিত হইয়া তেত্রিশ হইল।- শতপথ ব্রাহ্মণে (৪/৫/৭/২) অষ্টবসু, একাদশ রুদ্র, দ্বাদশ আদিত্য, দৌস্ ও পৃথিবী নিয়ে তেত্রিশ দেবতা। ঐতরেয়-ব্রাহ্মণানুসারে(২/১৮) একাদশ প্রয়াজ দেবতা, একাদশ অনুযাজ দেবতা এবং একাদশ উপযাজ দেবতা দ্বারা গঠিত দেবতার সংখ্যা তেত্রিশ।
উপরের বিবরণ থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, বৈদিক ঋষিদের বিশ্বাস অনুয়ায়ী দেবতার সংখ্যা ত্রয়স্ত্রিংশৎ। কিন্তু দেবতার নাম গণনা করলে দেখা যাবে যে প্রকৃত সংখ্যা তেত্রিশের অনেক বেশী। পূর্বোদ্ধৃত একটি ঋকে (১/৩৪/১১)তেত্রিশ দেবতার অতিরিক্ত হিসাবে অগ্নির নাম পাই। আর একটি ঋকে অষ্টবসু, দ্বাদশ আদিত্য ও একাদশ রুদ্র ছাড়াও অগ্নি, ইন্দ্র, বরুণ, বিষ্ণু উষা ও সুর্যের একত্র অবস্থানের কথা বলা হয়েছেঃ
কোন কোন স্থলে উল্লিখিত দেবতার সংখ্যা তেত্রিশশত উলচল্লিশঃ
শুক্ল যজুর্বেদের বাজসনেয়ী সংহিতায় (৩৩/৭) এই মন্ত্রটি উদ্ধৃত হয়েছে। সুতরাং যুজুর্বেদের মতেও ৩৩৩৯ জন দেবতা আছেন। সায়নাচার্য মনে করেন যে দেবতার সংখ্যা প্রকৃতপক্ষে তেত্রিশ, ৩৩৩৯ সংখ্যা দেবতাদের মহিমাপ্রকাশক মাত্র।
দশম মণ্ডলের পুরুষ সুক্তেসর্ব্ব্যাপী বিরাট পুরুষের বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছেঃ
এই সুক্তের বিরাট পুরুষের সঙ্গে গীতার পরম পুরুষ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ বর্ণনায় অর্জুন বলেছেন-
উপনিষদের ব্রহ্মের সঙ্গে ঋগ্বেদের সহস্রশীর্ষা পুরুষ ও ভগবদ্গীতার শ্রীকৃষ্ণের কোন তফাৎ নেই। উপনিষদ্ ব্রহ্ম সম্পর্কে বলেছেনঃ
ঋগ্বেদের পুরুষ এবং উপনিষদের ব্রহ্ম স্বরূপতঃ অভিন্ন। উপনিষদের ব্রহ্মতও্বই ঋগ্বেদে আত্মপ্রকাশ করেছে। দশম মণ্ডলের আবার একটি সুক্তে বিশ্বকর্মার মহিমা-কীর্তন প্রসঙ্গে বলা বলেছেঃ
দশম মণ্ডলেই হিরণ্যগর্ভস্তুতি আছে। হিরণ্যগর্ভ্যও বিশ্বস্রষ্টা পালয়িতা আদি দেব।
আচার্য সায়ন 'ক' শব্দের অর্থ করেছেন 'প্রজাপতি' -বিশ্বস্রষ্টা। হিরণ্যগর্ভ প্রজাপতি, বিশ্বকর্মা এবং বিরাটপুরুষের অভিন্নতা স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়। হিরণ্যগর্ভ পুরুষ বিশ্বকর্মা- বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা- সৃষ্টির আদিতেও বর্তমান এবং সর্বময় পরিব্যাপ্ত। তিনিই সর্বব্যাপী ব্রহ্ম-'সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম'। বেদের বহুদেবতা যে তিনি ছাড়া আর কিছু নয়, ে সত্য একেবারে দিবালোকের মত স্পষ্ট। দশম মণ্ডলেই একটি ঋকে বলা হয়েছে,- "সুপর্ণং বিপ্রা করয়ো বচোভিবেকং সন্তং বহুধা কল্পয়ন্তি।" (ঋগ্বেদ- ১০/১১৪/২৫) -পক্ষী একই আছেন, বুদ্ধিমান পণ্ডিতগণ তাঁহাকে কল্পনাপূর্বক অনেক প্রকার বর্ণনা করেন।
এই এক পক্ষী অবশ্যই প্রজাপতি বা বিশ্বকর্মা অথবা পুরুষ-উপনিষদ ব্রহ্ম।
দশম মণ্ডলের একটি সুক্ত দেবীসুক্ত নামে সুপ্রসিদ্ধ। সুক্তটিতে অম্ভৃণ ঋষির কন্যা বাক্ নিজেকে সকল দেবতার সঙ্গে এবং বিশ্বভূবনের সঙ্গে একাত্মতার অনুভবে ঘোষনা করেছেনঃ
ঋষিকবি বাকের এই আত্মানুভূতি ব্রহ্মানুভূতির সমতুল্য। সাধনার দ্বারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আত্মাস্বরূপ এক ঈশ্বরের সাক্ষাৎকার তাঁর অন্তরে ঘটেছে বলেই তিনি বিশ্বদেবের সঙ্গে একাত্মা বোধ করেছেন। উপনিষদের ঋষিও ব্রহ্মানুভূতির ফলে অনুরূপভাবে ঘোষণা করেছিলেন,-
সর্বভূতে বিশ্বাত্মার উপলব্ধিই ব্রহ্মোপলব্ধি। উপনিষদের ঋষির কন্ঠে ঘোষিত হয়েছেঃ
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাতেও ভগবান এই কথারই প্রতিধ্বনি করেছেনঃ
সর্বভূতে আত্মাসাক্ষাৎকার ঘটেছিল যে ঋষিকবির, তিনি যে একেশ্বরে বিশ্বাসী, সে কথা বলাই বাহুল্য। বহু দেবতায় বিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও একেশ্বরবাদের স্ফূর্তি ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে সম্যক্ভাবে ঘটেছিল, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।
কিন্তু পণ্ডিদের মতে ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলটি অন্যান্য মণ্ডলের তুলনায় পরবর্তী-কালের রচনা। Dr. A.B keith লিখেছেন, "The tenth book alsodisplays both in metrioal form and linguistic details, signs of more recent origin than the bulk of the collection" -Cambridge history of india, vol 1, page 77
ডঃ বি কে. ঘোষ লিখেছেন, "That the tenth Mandala is later in origin than the first nine is, however, perfectly cartain from the evidence of the language"- Vedic Age, page227
ঋগ্বেদের বঙ্গানুবাদে মনীষী রমেশ চন্দ্র দত্ত লিখেছেন, "ঋগ্বেদের নবম মণ্ডলের সহিত যেরূপ সামবেদের সম্পর্ক সেইরূপ ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের সহিত অথর্ববেদের সম্পর্ক। অথর্ববেদের অনেকগুলি সুক্ত এই দশম মণ্ডল হইতে লওয়া। দশম মণ্ডল ঋগ্বেদ রচনাকালের শেষ অংশে রচিত হইয়াছে, তাহা বিবেচনা করিবার অনেক কারণ আছে, তাহা আমরা ক্রমশঃ নির্দেশ করিব।- ঋগ্বদে সংহিতা- বঙ্গানুবাদ, ২য়, পৃঃ ১৩৯৪
রমেশচন্দ্র পুরুষসুক্ত সম্পর্কে লিখেছেন, "ঋগ্বেদ রচনাকালের অনেক পরে এই অংশ রচিত হইয়া প্রক্ষিপ্ত হইয়াছে, তাহার সন্দেহ নাই।"(ঋগ্বেদের বঙ্গানুবাদ-২য়) বিশ্বকর্মা সম্পর্কিত ৮১ সংখ্যক সূক্তটিকেও রমেশচন্দ্র পরবর্তীকালে রচিত বলে স্থির করেছেন। তিনি হিরণ্যগর্ভ সুক্তটিকে "অপেক্ষাকৃত আধুনিক" বলে রায় দিয়েছিলেন।
দেশী বিদেশী পণ্ডিতগণের এই অভিমত স্বীকার করে নিলেও একথা সত্য যে, ঋগ্বেদের যে কোন অংশ বৈদিক বা সংস্কৃত ভিন্তারনিৎস(Winternitz)alfred ludwingo এর একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করে সমর্থন করেছেন। উদ্ধৃতিটি নিন্মরূপঃ
"The Rigveda pre-supposes nothing of that which we know in Indian literature, while on the other hand, the whole of indian literature and the whole of indian life presuppose the veda."- A history of indian literature vol 1, p 1, page 52.
ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে একেশ্বরের ধারনা ও অনুভূতি সুস্পষ্ট এবং সুতীব্র, একথা সত্য। কিন্তু এই বিশেষ অনুভব কেবলমাত্র দশম মণ্ডলেই সীমাবদ্ধ থাকে নি। অন্যান্য মণ্ডলে পুরুকুৎসপুত্র ত্রসদস্যু রাজা ঋষিকবি বাকের মতই আত্মোপলব্ধির কথা ঘোষণা করেছেনঃ
অহং রাজা বরুণো মহ্যং অন্যসূর্যাণি প্রথমা ধারয়ন্ত।
ক্রতু সচন্তে বরুণস্য দেবা রাজাসি কৃষ্টেরুপমস্য রুব্রেঃ।।
অহমিদ্রো বরুণস্তে মহিত্বোর্বী গভীরে রজসী সুমেকে।
অষ্টেব বিশ্বভুবনানি বিদ্বান্ৎসমৈবয়ং রোদসী ধারয়ং চ।।- ঋগ্বেদ - ৪/৪২/২-৩
অর্থ- আমিই রাজা বরুণ, আমার জন্যই দেবগণ সেই প্রসিদ্ধ অসুর-বিঘাতক শক্তি ধারণ করেন। আমি সকলের ঈশ্বর। আমি ইন্দ্র, আমি বরুণ, মহং বিস্তীর্ণ দুরবগাহ সুরুপবিশিষ্ট দ্যাবাপৃথিবী(রজসী) আমিই। সকলই পরিজ্ঞাত হয়ে আমিই প্রজাপতির মত বিশ্বভুবন প্রেরণ করি এবং দ্যাবাপৃথিবী ধারণ করে থাকি।
উক্ত মন্ডলেই ঋষি বামদেব বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আত্মস্বরূপ উপলব্ধি করেছেন।
তিনিও বলেছেনঃ
অর্থ- আমি মনু(প্রজাপতি), আমি সর্বপ্রেরক সূর্য, মেধাবী কক্ষীবান্ নামক ঋষিও আমি, আর্জুনীপুত্র কুৎস নামক ঋষিকে আমিই প্রসাধিত করি। উশনা নামক ক্রান্তদর্শী(ত্রিকালজ্ঞ)ঋষিও আমি। হে জনগন, উত্তমরূপে সিত্যদ্রষ্টা আমাকে দেখ। আমি আর্যমানবকে ভূমি দান করেছি। হবিদান-কারী মনুষ্যকে আমিই বৃষ্টিদান করি। আমিই শব্দকারী জলসমূহকে সর্বস্থানে প্রেরণ করি। দেবতারা আমার সংস্কার বহন করেন। আমিই ইন্দ্ররূপে সোমপানে মত্ত হয়ে নয়শত নিরাননব্বই বার শম্বর নামক অসুরের পুর ধ্বংস করেছি, দিবোদাসের প্রবেশযোগ্য করেছি শতসংখ্যক পুর।
ঋষি বামদেবের এই উপলব্ধি ব্রহ্মজ্ঞানের চূড়ান্ত। যে ঈশ্বর সর্বনিয়ন্তা অথচ সর্বময় ঋষি বামদেব ত্রসদস্যু এবং বাকের আত্মজ্ঞানে তারই প্রকাশ ঘটেছে। সকল দেবতা যে এক ও অদ্বিতীয় ঈশ্বরের ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ-এই সত্য ঋগ্বেদের ঋষি প্রথম মণ্ডলেই ঘোষণা করেছিলেনঃ-
ঋগ্বেদের অপর একটি মন্ত্রে পারিঃ "একং বা ইদং বিবভূব সর্বম্"(ঋগ্বেদ ৮/৫২/২) -এই একই সকল রূপ ধারণ করেছেন। তৃতীয় মণ্ডলের ৫৫নং সুক্তে প্রতি ঋকের শেষে আছেঃ- "মহদ্দেবানামসুবত্বমেকম্।"- তুমিই মহৎ দেবগণের একমাত্র প্রাণস্বরুপ। অসুর শব্দের অর্থ প্রাণদাতা। ঋগ্বদের অনেক দেবতাকেই অসুর বলা হয়েছে। এই বাক্যটীর অনুবাদে maxmuller লিখেছেন, "The great divinity of the gods is one." Muir লিখেছেন, "The divine power of the gods is unique" শুক্লযজুর্বেদো একেশ্বরের তত্ত্ব উদাত্ত কণ্ঠে উচ্চারিত করেছেন,- "এতসৈব স বিসৃষ্টিবেষ উহ্যেব সর্বে দেবাঃ।"- এই সবই তাঁর সৃষ্টি, তিনিই সকল দেবতা। অর্থবেদের ঋষিও বহুদেবতার মধ্যে এক সর্বব্যাপী ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করে বলেছেন,- "তদগ্নিবাহ তদু সোম আহ বৃহস্পতিঃ সবিতা তদিন্দ্রঃ।"- তাঁকেই অগ্নি বলা হয়, তাঁকেই সোম বলা হয়, তিনিই বৃহস্পতি সবিতা, তিনিই ইন্দ্র।
বৈদিক ঋষিগণ বহুদেবতার উপাসক হওয়া সত্ত্বেও মূলতঃ ছিলেন একেশ্বরবাদী। কেবল ঋগ্বদের দশম মণ্ডলে নয়, কেবল উপনিষদে নয়্ সমগ্র বৈদিক সংহিতায়, ব্রাহ্মণে, উপনিষদে-সর্বত্রই একেশ্বরে বিশ্বাস প্রকটিত। একই ঈশ্বর রূপগুণভেদে ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রকাশিত হন, এ বিশ্বাস আর্যসভ্যতা ও সংস্কৃতির মর্মকথা। একেরই বহুরূপে প্রকাশ অথবা বহুত্বের মধ্যেই একের অস্ত্বিত্বের অনুভূতি ভারতীয় সংস্কৃতির চিরন্তন বৈশিষ্ট্য। বৈদিক দেবতার এই বৈশিষ্ট্য প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য পণ্ডিত ভারতীয় দেবতত্ত্বের স্বরূপটি যথাযথাভাবে উপলব্ধি করেছেন, এ কথা সত্য।
Sir Charles Eliot বৈদিক দেবতাদের একত্বনুভব সম্পর্কে সুন্দরভাবে বিশ্লেষণ করেছেনঃ- "The Gods are frequently thought of as joined in couples, triads or larger companies and early worship probably showed the beginnings
হিন্দুদের দেবদেবী উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ এ বেদের একেশ্বরত্ব নিয়ে হংসনারায়ণের তথ্যমূলক বক্তব্য সমাপ্ত।
নিবেদনে- স্বস্তিক সভা
পৃথিবীর অন্যান্য দেশে আদিম মানুষের ধর্মবিশ্বাস যাই হোক না কেন, ভারতবর্ষের দেব-উপাসনা বহুদেবতার বিশ্বাস সত্ত্বেও একেশ্বরের উপাসনায় পর্যবসিত। ঋগ্বেদে যে পৃথিবীর আদিমতম ধর্মগ্রন্থ, তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। ভারতীয় সাহিত্যের ও প্রাচীনতম গ্রন্থ ঋগ্বেদ। সময় সম্পর্কে বিতর্কের অবকাশ থাকলেও ঋগ্বেদের নিন্মতর সময়-সীমা দুহাজার খৃষ্টপূর্বাব্দের পরে নয়। সাধারণতঃ পঞ্চ-সহস্র খৃষ্টপূর্বাব্দ অথবা আরো বহুপূর্বকাল পর্যন্ত ঋগ্বেদের সময়সীমা প্রসারিত। পৃথিবীর এই প্রাচীনতম মহাগ্রন্থ থেকে পাঁচ-সাত হাজার কিংবা আরও পূর্ববর্তীকালের মানুষের ধর্মবিশ্বাস এবং ধর্মচর্যার যে বিশ্বত্ব আলেখ্য পাওয়া যায়, তা আর কোথাও সুলভ নয়। ভারতীয় আর্যধর্মের প্রভাব এককালে পৃথিবীর নানা দেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল। ঋগ্বদের দেব-উপাসনার বৈশিষ্ঠ্যই বহুর মধ্যে একত্বের অনুভূতি। একজন পাশ্চাত্য ভারততত্ত্ববিদ এ সম্পর্কে লিখেছেনঃ- The hindus have from time immemorial believed in the existence of one supreme being, in the immortality of soul and in a future stats of reward and punishment, but in their opinion respecting the nature of supreme being they are unqestionable pantheists. Hindu Mythology-lieut, col vans kunedy.
ঋগ্বেদে বহু দেবতার উপাসনা দৃষ্ট হয়। দেবতাদের যজ্ঞে আহবান করা হয়েছে এবং দেবতাদের উদ্দেশ্য আগ্নিতে হবিঃ অর্পিত হয়েছে। আগ্নি, ইন্দ্র, বরুণ, সোম, সূর্য, পূষণ্, মরুৎ, দৌঃ, পর্জন্য, অশ্বিদ্বয়, পৃথিবী, অদিতি, সরস্বতী প্রভৃতি বহুদেবতার অস্বিত্ব ঋগ্বেদের পাঠকমাত্রেই অবগত আছেন। অন্যান্য বৈদিক সংহিতা এবং ব্রাহ্মণেও বহু দেবতার অর্চনা স্থান লাভ করেছে। সুতরাং বৈদিক আর্যগণ যে বহুদেবতায় বিশ্বাসী ছিলেন, এ মত প্রায় সর্বজন স্বীকৃত। আধুনিক হিন্দুধর্ম বৈদিক ধর্মোপাসনার বিবর্তন ও রুপান্তরের ফলে গড়ে উঠেছে। সেইজন্যই আধুনিক হিন্দুধর্মেও বহু দেবতার পূজা প্রচলিত। বরঞ্চ দেবতার সংখ্যা ক্রমে ক্রমে বর্ধিত হতে হতে বিপুল আকার ধারণ করেছে।
ঋগ্বেদে দেবতার সংখ্যা তেত্রিশঃ
যে দেবাসো দিব্যেকাদশ স্থ পৃথিব্যা মধ্যেকাদশ স্থ।
যে অপ্সুক্ষিতো মহিনৈকাদশ স্থ তে দেবাসো যজ্ঞমিমং যুযধ্বম্।।
ঋগ্বেদ ১/৩৩৯/১১ অনুবাদ রমেশ্চন্দ্র দত্ত।
অর্থাৎ যে দেবগণ স্বর্গে একাদশ, পৃথিবীর উপরেও একাদশ, যখন অন্তরীক্ষে বাস করেন তখনও একাদশ, তাঁহারা নিজ মহিমায় যজ্ঞ সেবা করেন।অপর একটি ঋকে আছেঃ-
আ নাসত্যা ত্রিভিবেকাদশৈরিহ দেবেভির্ষাতং মধু পেষমশ্বিনা।।
ঋগ্বেদ ১/৩৪/১১
অর্থ- হে নাসত্য অশ্বিদ্বয়। ত্রিগুণ একাদশ(তেত্রিশ) দেবগণের সহিত মধুপানার্থ এখানে আইস।ঋষি অপর একটি মন্ত্রে অগ্নিকে উদ্দেশ করে বলেছেন,
"ত্রয়স্ত্রিংশমাবহ।" ঋগ্বেদ ১/৪৫/২
অর্থ- হে অগ্নি, তুমি তেত্রিশজন দেবতাকে এখানে নিয়ে এস।
অথর্ববেদেও ত্রয়স্ত্রিংশৎ দেবতার উল্লেখ আছে। তেত্রিশসংখ্যক দেবতাকে তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছেঃ-
যে দেবা দিব্যেকাদশ স্থঃ তে দেবাসো হরিরিদং যুযধ্বম্।।
যে দেবা আন্তরিক্ষ একাদশ স্থ তে দেবাসো হবিরিদং যুযধ্বম।।
যে দেবাঃ পৃথিব্যাং একাদশ স্থ তে দেবাসো হবিরিদং যুযধ্বম্ ।।
অথর্ববেদ - ১৯/৪/২৭/১১-১৩
-যে দেবগণ দ্যুলোক(স্বর্গে)একাদশ সংখ্যক তাঁরা এই হবি গ্রহণ করুন। যে দেবগণ অন্তরীক্ষ (আকাশ) একাদশ তাঁরা এই হবি গ্রহণ করুন। যে দেবগণ পৃথিবীতে একাদশ তাঁরা এই হবি গ্রহণ করুন।ঋগ্বেদের পূর্বোদ্ধৃত মন্ত্রটিতে (১/১৩৯/১১) ও দেবগণকে স্বর্গবাসী, মর্তবাসী ও অন্তরীক্ষবাসী- এই তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে। তৈত্তিরীয় সংহিতাতে(তৈঃ সংহিতা ১/৪/১০/১) ও স্বর্গ অন্তরীক্ষ ও পৃথিবীতে স্থিত মোট তেত্রিশজন দেবতার উল্লেখ আছে। তেত্রিশ সংখ্যক দেবতার বিবরণ প্রসঙ্গে ঐতরেয় ব্রাহ্মণ বলেন, "অষ্টৌ রসবঃ, একাদশ রুদ্রা, দ্বাদশ আদিত্যাঃ প্রজাপতিশ্চ বষট্কাবশ্চ।" ঐতঃ ব্রাঃ- ১/১০
-আটজন বসু, একাদশ রুদ্রা, দ্বাদশ আদিত্য, প্রজাপতি এবং বষট্কার মিলে তেত্রিশ দেবতা। বৃহদারণ্যকোপনিষদে তেত্রিশ সংখ্যক দেবতার তালিকায় বষট্কার স্থলে ইন্দ্র আসন পেয়েছেন, "ত্রয়স্ত্রিংশত্ত্বের দেবা ইতি। কতমে তে ত্রয়স্ত্রিংশদিত্যষ্টৌ বসব একাদশ রুদ্রা দ্বাদশাদিত্যাস্ত একত্রিংশদিন্দ্রশ্চৈব প্রজাপতিশ্চ ত্রয়স্ত্রিংশাবিতি।"- বৃহঃ উপঃ-৩/৯/২ (শাকল্য জিজ্ঞাসা করিলেন -ভাল)সেই তেত্রিশটি দেবতাই বা কে কে ?-(যাজ্ঞবল্ক্য বলিলেন,)অষ্টবসু, একাদশ রুদ্রম দ্বাদশ আদিত্য-এই একত্রিশ, আর ইন্দ্র ও প্রজাপতি দুই মিলিত হইয়া তেত্রিশ হইল।- শতপথ ব্রাহ্মণে (৪/৫/৭/২) অষ্টবসু, একাদশ রুদ্র, দ্বাদশ আদিত্য, দৌস্ ও পৃথিবী নিয়ে তেত্রিশ দেবতা। ঐতরেয়-ব্রাহ্মণানুসারে(২/১৮) একাদশ প্রয়াজ দেবতা, একাদশ অনুযাজ দেবতা এবং একাদশ উপযাজ দেবতা দ্বারা গঠিত দেবতার সংখ্যা তেত্রিশ।
উপরের বিবরণ থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, বৈদিক ঋষিদের বিশ্বাস অনুয়ায়ী দেবতার সংখ্যা ত্রয়স্ত্রিংশৎ। কিন্তু দেবতার নাম গণনা করলে দেখা যাবে যে প্রকৃত সংখ্যা তেত্রিশের অনেক বেশী। পূর্বোদ্ধৃত একটি ঋকে (১/৩৪/১১)তেত্রিশ দেবতার অতিরিক্ত হিসাবে অগ্নির নাম পাই। আর একটি ঋকে অষ্টবসু, দ্বাদশ আদিত্য ও একাদশ রুদ্র ছাড়াও অগ্নি, ইন্দ্র, বরুণ, বিষ্ণু উষা ও সুর্যের একত্র অবস্থানের কথা বলা হয়েছেঃ
অগ্নিনেন্দ্রেণ বরুণেন বিষ্ণূনাদিত্যৈ রুদ্রৈর্বসুভিঃ সচাভুবা।
সযোষসা উষস্য সুর্যেণ চ সোমং পিবতমশ্বিনা।।
-ঋগ্বেদ ৮/৩৫/১
অর্থ- হে অশ্বিদ্বয়! তোমরা অগ্নি, ইন্দ্র, বরুণ, বিষ্ণু, আদিত্যগণ, রুদ্রগণ ও বসুগণের সহিত একত্রে এবং উষা ও সূর্যের সহিত মিলিত হইয়া সোমপান কর।কোন কোন স্থলে উল্লিখিত দেবতার সংখ্যা তেত্রিশশত উলচল্লিশঃ
ত্রীনি শতা ত্রী সহস্রাণ্যগ্নিং ত্রিংশচ্চ দেবা নব চাসপর্যন্।।
-ঋগ্বেদ ৩/৯/৯
অর্থ- তিন সহস্র তিনশত ত্রিংশৎ ও নব সংখ্যক দেবগণ আগ্নিকে পূজা করিয়াছেন।শুক্ল যজুর্বেদের বাজসনেয়ী সংহিতায় (৩৩/৭) এই মন্ত্রটি উদ্ধৃত হয়েছে। সুতরাং যুজুর্বেদের মতেও ৩৩৩৯ জন দেবতা আছেন। সায়নাচার্য মনে করেন যে দেবতার সংখ্যা প্রকৃতপক্ষে তেত্রিশ, ৩৩৩৯ সংখ্যা দেবতাদের মহিমাপ্রকাশক মাত্র।
বাজসনেয়ী সংহিতার একস্থানে বসু, রুদ্র এবং আদিত্যগণ ছাড়াও কয়েকজন দেবতার একত্র উল্লেখ আছেঃ "অগ্নির্দেবতা! রাতো দেবতা! সূর্যো দেবতা! চন্দ্রমা দেবতা! বসবো দেবতা! রুদ্র দেবতা! আদিত্য দেবতা! মরুতো দেবতা! বিশ্বো-দেবা দেবতা! বৃহস্পতির্দেবতা! ইন্দ্রো দেবতা! বরুণো দেবতা।" শুক্লযজু- ১৪/২০
বৈদিক দেবতাগণ সংখ্যার হিসাবে যতই হোন না কেন, এ কথা নিশ্চিত বলা চলে যে, বৈদিক আর্যগণ বহু দেবতার উপাসনা করতেন। অনেক অনেক পণ্ডিতের মতে ঋগ্বেদে বহুদেবতার উপাসনা ক্রমে ক্রমে একেশ্বরের ধারণায় পর্যবসিত হয়। দশম মণ্ডলের পুরুষসুক্তেই সর্বপ্রথম একেশ্বরের ধারণা স্পষ্ট হয়ে ওঠে! অধ্যাপক ম্যাক্ডোনেল বৈদিক দেবতাদের সম্পর্কে লিখেছেন, "this is concarned with the worship of gods that are largely personifications of the powers of nature the hymns are mainly incovations of these gods and are meant to accompany the oblations of the firs sacrifice of melted butter, It is thus essentially a polithistic religion, which assumes a pantheistic colourning only in a few of its latest hymns"- Vedic Reader, Prof A macdonell, page 18দশম মণ্ডলের পুরুষ সুক্তেসর্ব্ব্যাপী বিরাট পুরুষের বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছেঃ
সহস্রশীর্ষা পুরুষঃ সহস্রাক্ষঃ সহস্রপাৎ।
স ভূমিং বিশ্বতো বৃত্বত্যতিষ্ঠদ্দশাঙ্গুলম্।।
পুরুষ এবেদং সর্বং যদ্ভুতং যচ্চ ভব্যম।
উতামৃতত্বস্যেশানো যদন্নেনাতিরোহতি।।
এতাবানস্য মহিমা তো জ্যাযাংশ্চ পুরুষঃ।
পাদোহস্য বিশ্বা ভূতানি ত্রিপাদস্যামৃতং দিবি।
ঋগ্বেদে ১০/৯০/১-৩
- পুরুষ সহস্র মস্তক, সহস্র চক্ষু ও সহস্র পদ বিশিষ্ট। তিনি সমস্ত পৃথিবীকে ব্যাপ্ত করে দশাঙ্গুলি পরিমিত হয়ে বিরাজমান। ভূত এবং ভবিষ্যৎ সবই সেই পুরুষ। যেহেতু তিনি অন্নেব(যজ্ঞ অথবা কর্মের)দ্বারা সব কিছু অতিক্রম করেন, এতএব তিনি অমৃতদেব ইশ্বর(কর্তা)। এ সবই তাঁর মহিমা। তিনি এই সকল অপেক্ষাও বৃহত্তর, বিশ্বভুবনে তাঁর একটি মাত্র পাদ-দ্যুলোকে অমৃতরূপী তাঁর তিন পাদ।এই সুক্তের বিরাট পুরুষের সঙ্গে গীতার পরম পুরুষ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ বর্ণনায় অর্জুন বলেছেন-
অনাদিমধ্যান্তমনন্তবীর্যম্
অনন্তবাহুং শশিসূর্যনেত্রম্।
পশ্যামি ত্বাং দীপ্তহুতাশবক্ত্রং
স্বতেজসা বিশ্বমিদং তপন্তম্ ॥১১/১৯॥
দ্যাবাপৃথিব্যোরিদমন্তরং হি
ব্যাপ্তং ত্বয়ৈকেন দিশশ্চ সর্বাঃ।
দৃষ্ট্বাদ্ভুতং রূপমুগ্রং তবেদং
লোকত্রয়ং প্রব্যথিতং মহাত্মন্ ॥১১/২০॥
-উৎপত্তি, স্থিতি ও লয়রহিত, অনন্ত বীর্যসম্পন্ন, অনন্ত বাহুযুক্ত, চন্দ্র সূর্যরূপী দুই নেত্রবিশিষ্ট, জ্বলন্ত অগ্নিময় মুখসমন্বিত স্বীয় তেজের দ্বারা বিশ্বভুবন সন্তাপনকারী তোমাকে দেখছি। তুমিই দ্যাবাপৃথিবীর মধ্যভাগ (অন্তরীক্ষ লোক)এবং দিক্সকল ব্যাপ্ত করে বিরাজমান।উপনিষদের ব্রহ্মের সঙ্গে ঋগ্বেদের সহস্রশীর্ষা পুরুষ ও ভগবদ্গীতার শ্রীকৃষ্ণের কোন তফাৎ নেই। উপনিষদ্ ব্রহ্ম সম্পর্কে বলেছেনঃ
অগ্নিমূর্খা চক্ষূসী চন্দ্রসূর্যৌ
দিশঃ স্তোত্রে বাগ্বিতাশ্চ বেদাঃ।
বায়ুঃ প্রাণো হৃদয়ং বিশ্বমস্য
পদ্ভ্যাং পৃথিবী হ্যেষ সর্বভূতান্তরাত্মা।।
-মুণ্ডকোপনিষৎ- ২/১/৪
-যাঁহার মস্তক দ্যুলোক, চক্ষু, চন্দ্র ও সূর্য, কর্ম দিক্সমূহ, বাক্য প্রকটিত বেদসমূহ, প্রাণ বায়ু, অন্তঃকরণ নিখিল জগৎ এবং যাঁহার পদ হইতে পৃথিবী জাত হয়, তিনিই সমুদয় স্থুল মহাভূতের অন্তরাত্মা।
সর্বতঃ পানিপাদন্তং সর্বতোহক্ষিশিরোমূখম্।
সর্বতঃ শ্রুতিমল্লোকে সর্বমাবৃত্য তিষ্ঠতি।।
-শ্বেতাশ্বতরোপনিষৎ -৩/১৬
অর্থ- তাঁর হাত পা সকল দিকে প্রসারিত, তাঁর মুখ এবং মস্তক সর্বত্র বর্তমান, তাঁর কর্মও সর্বত্র-তিনি সব কিছুই ব্যাপ্ত করে বিরাজমান।ঋগ্বেদের পুরুষ এবং উপনিষদের ব্রহ্ম স্বরূপতঃ অভিন্ন। উপনিষদের ব্রহ্মতও্বই ঋগ্বেদে আত্মপ্রকাশ করেছে। দশম মণ্ডলের আবার একটি সুক্তে বিশ্বকর্মার মহিমা-কীর্তন প্রসঙ্গে বলা বলেছেঃ
বিশ্বতশ্চক্ষুরূত বিশ্বতোমুখো বিশ্বতো বাহুরুতবিশ্বতস্পাৎ।
সং বাহুভ্যাং ধমতি সং পতত্রৈর্দ্যাবাভূমী জনযন্ দেব একঃ।।
-ঋগ্বেদ ১০/৮১/২
- সেই এক দেবতা, -সর্বব্যাপী তাঁর চক্ষু, বিশ্বময় তাঁর মুখ,-সর্বময় তাঁর হাত এবং পা, -তিনি বাহুদ্বারা স্বর্গকে সম্যক্অরূপে স্থাপন করে, পদদ্বারা স্বর্গ-মর্ত্য সৃষ্টি করে এক অদ্বিতিয়রূপে বিরাজ করছেন।দশম মণ্ডলেই হিরণ্যগর্ভস্তুতি আছে। হিরণ্যগর্ভ্যও বিশ্বস্রষ্টা পালয়িতা আদি দেব।
হিরণ্যগর্ভঃ সমবর্ততাগ্রে ভূতস্যাগ্রে জাতঃ পতিবেক আসীৎ।
স দাধার পৃথিবীং কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম।
-ঋগ্বেদ ১০/১২১/১
অর্থ- সর্বপ্রথমে কেবল হিরণ্যগর্ভই বিদ্যমান ছিলেন। তিনি জাতমাত্রই সর্বভূতের অধীশ্বর হইলেন। তিনি পৃথিবী ও আকাশকে স্বস্থানে স্থাপিত করিলেন। কোন্ দেবতাকে হবি দ্বারা পূজা করিব।আচার্য সায়ন 'ক' শব্দের অর্থ করেছেন 'প্রজাপতি' -বিশ্বস্রষ্টা। হিরণ্যগর্ভ প্রজাপতি, বিশ্বকর্মা এবং বিরাটপুরুষের অভিন্নতা স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়। হিরণ্যগর্ভ পুরুষ বিশ্বকর্মা- বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা- সৃষ্টির আদিতেও বর্তমান এবং সর্বময় পরিব্যাপ্ত। তিনিই সর্বব্যাপী ব্রহ্ম-'সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম'। বেদের বহুদেবতা যে তিনি ছাড়া আর কিছু নয়, ে সত্য একেবারে দিবালোকের মত স্পষ্ট। দশম মণ্ডলেই একটি ঋকে বলা হয়েছে,- "সুপর্ণং বিপ্রা করয়ো বচোভিবেকং সন্তং বহুধা কল্পয়ন্তি।" (ঋগ্বেদ- ১০/১১৪/২৫) -পক্ষী একই আছেন, বুদ্ধিমান পণ্ডিতগণ তাঁহাকে কল্পনাপূর্বক অনেক প্রকার বর্ণনা করেন।
এই এক পক্ষী অবশ্যই প্রজাপতি বা বিশ্বকর্মা অথবা পুরুষ-উপনিষদ ব্রহ্ম।
দশম মণ্ডলের একটি সুক্ত দেবীসুক্ত নামে সুপ্রসিদ্ধ। সুক্তটিতে অম্ভৃণ ঋষির কন্যা বাক্ নিজেকে সকল দেবতার সঙ্গে এবং বিশ্বভূবনের সঙ্গে একাত্মতার অনুভবে ঘোষনা করেছেনঃ
অহং রুদ্রেভির্বসুভিশ্চবাম্যহমাদিত্যৈরুত বিশ্বদেবৈঃ।
অহং মিত্রাবরুণোভা বিভর্ম্যহমিন্দ্রাগ্নী অহমশ্বিনোভা।।
অহং সোমমাহনসং বিভর্ম্যহং ত্বষ্টাবমুত পূষণং ভগম্।
-ঋগ্বেদ-১০/১২৫/১-২
-আমিই একাদশ রুদ্র ও অষ্টবসুরূপে বিচরণ করি। আমি দ্বাদশ আদিত্য ও সমস্ত দেবতা(অথবা বিশ্বসংজ্ঞক দেবগণরূপে) বিচরণ করি। আমি মিত্র ও বরুণ এই উভয় দেবকে ধারণ করিতেছি। আমি ইন্দ্র ও অগ্নি এবং অশ্বিনীকুমার নামক দুই দেবকে ধারণ করিতেছি। শত্রুদিগের সংহারকর্তা চন্দ্রকে (অভিষোতব্য সোমকে) আমি ধারণ করিতেছি।ঋষিকবি বাকের এই আত্মানুভূতি ব্রহ্মানুভূতির সমতুল্য। সাধনার দ্বারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আত্মাস্বরূপ এক ঈশ্বরের সাক্ষাৎকার তাঁর অন্তরে ঘটেছে বলেই তিনি বিশ্বদেবের সঙ্গে একাত্মা বোধ করেছেন। উপনিষদের ঋষিও ব্রহ্মানুভূতির ফলে অনুরূপভাবে ঘোষণা করেছিলেন,-
বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তমাদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ।
-শ্বেতাশ্বতর -৩/৮
আমি জেনেছি তাঁহারে মহান্ত পুরুষ যিনি আঁধারের পারে জ্যোতির্ময়।- নৈবেদ্য- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ।সর্বভূতে বিশ্বাত্মার উপলব্ধিই ব্রহ্মোপলব্ধি। উপনিষদের ঋষির কন্ঠে ঘোষিত হয়েছেঃ
যস্তু সর্বানি ভূতানি আত্মন্যোবানুপশ্যতি।
সর্বভূতেষূ চাত্মানং ততো ন বিজুগুপ্সতে।
-ঈশোপনিষৎ -৬
অর্থ- যিনি সর্বভূতকে আত্মাতে এবং আত্মাকেও সর্বভূতে দর্শন করেন, সেই সর্বাত্মার দর্শনের ফলে (কাহাকেও)ঘৃণা করেন না।শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাতেও ভগবান এই কথারই প্রতিধ্বনি করেছেনঃ
সর্বভূস্থমাত্মানং সর্বভূতানি চাত্মনি।
ঈক্ষতে যোগযুক্তাত্মা সর্বত্র সমদর্শনঃ।।
গীতা-৬/২৯
যোগসমাহিতচিত্ত সমদর্শী পুরুষ সর্বভূতে নিজেকে এবং নিজের মধ্যে সর্বভূতকে প্রত্যক্ষ করে থাকেন।সর্বভূতে আত্মাসাক্ষাৎকার ঘটেছিল যে ঋষিকবির, তিনি যে একেশ্বরে বিশ্বাসী, সে কথা বলাই বাহুল্য। বহু দেবতায় বিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও একেশ্বরবাদের স্ফূর্তি ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে সম্যক্ভাবে ঘটেছিল, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।
কিন্তু পণ্ডিদের মতে ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলটি অন্যান্য মণ্ডলের তুলনায় পরবর্তী-কালের রচনা। Dr. A.B keith লিখেছেন, "The tenth book alsodisplays both in metrioal form and linguistic details, signs of more recent origin than the bulk of the collection" -Cambridge history of india, vol 1, page 77
ডঃ বি কে. ঘোষ লিখেছেন, "That the tenth Mandala is later in origin than the first nine is, however, perfectly cartain from the evidence of the language"- Vedic Age, page227
ঋগ্বেদের বঙ্গানুবাদে মনীষী রমেশ চন্দ্র দত্ত লিখেছেন, "ঋগ্বেদের নবম মণ্ডলের সহিত যেরূপ সামবেদের সম্পর্ক সেইরূপ ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের সহিত অথর্ববেদের সম্পর্ক। অথর্ববেদের অনেকগুলি সুক্ত এই দশম মণ্ডল হইতে লওয়া। দশম মণ্ডল ঋগ্বেদ রচনাকালের শেষ অংশে রচিত হইয়াছে, তাহা বিবেচনা করিবার অনেক কারণ আছে, তাহা আমরা ক্রমশঃ নির্দেশ করিব।- ঋগ্বদে সংহিতা- বঙ্গানুবাদ, ২য়, পৃঃ ১৩৯৪
রমেশচন্দ্র পুরুষসুক্ত সম্পর্কে লিখেছেন, "ঋগ্বেদ রচনাকালের অনেক পরে এই অংশ রচিত হইয়া প্রক্ষিপ্ত হইয়াছে, তাহার সন্দেহ নাই।"(ঋগ্বেদের বঙ্গানুবাদ-২য়) বিশ্বকর্মা সম্পর্কিত ৮১ সংখ্যক সূক্তটিকেও রমেশচন্দ্র পরবর্তীকালে রচিত বলে স্থির করেছেন। তিনি হিরণ্যগর্ভ সুক্তটিকে "অপেক্ষাকৃত আধুনিক" বলে রায় দিয়েছিলেন।
দেশী বিদেশী পণ্ডিতগণের এই অভিমত স্বীকার করে নিলেও একথা সত্য যে, ঋগ্বেদের যে কোন অংশ বৈদিক বা সংস্কৃত ভিন্তারনিৎস(Winternitz)alfred ludwingo এর একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করে সমর্থন করেছেন। উদ্ধৃতিটি নিন্মরূপঃ
"The Rigveda pre-supposes nothing of that which we know in Indian literature, while on the other hand, the whole of indian literature and the whole of indian life presuppose the veda."- A history of indian literature vol 1, p 1, page 52.
ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে একেশ্বরের ধারনা ও অনুভূতি সুস্পষ্ট এবং সুতীব্র, একথা সত্য। কিন্তু এই বিশেষ অনুভব কেবলমাত্র দশম মণ্ডলেই সীমাবদ্ধ থাকে নি। অন্যান্য মণ্ডলে পুরুকুৎসপুত্র ত্রসদস্যু রাজা ঋষিকবি বাকের মতই আত্মোপলব্ধির কথা ঘোষণা করেছেনঃ
অহং রাজা বরুণো মহ্যং অন্যসূর্যাণি প্রথমা ধারয়ন্ত।
ক্রতু সচন্তে বরুণস্য দেবা রাজাসি কৃষ্টেরুপমস্য রুব্রেঃ।।
অহমিদ্রো বরুণস্তে মহিত্বোর্বী গভীরে রজসী সুমেকে।
অষ্টেব বিশ্বভুবনানি বিদ্বান্ৎসমৈবয়ং রোদসী ধারয়ং চ।।- ঋগ্বেদ - ৪/৪২/২-৩
অর্থ- আমিই রাজা বরুণ, আমার জন্যই দেবগণ সেই প্রসিদ্ধ অসুর-বিঘাতক শক্তি ধারণ করেন। আমি সকলের ঈশ্বর। আমি ইন্দ্র, আমি বরুণ, মহং বিস্তীর্ণ দুরবগাহ সুরুপবিশিষ্ট দ্যাবাপৃথিবী(রজসী) আমিই। সকলই পরিজ্ঞাত হয়ে আমিই প্রজাপতির মত বিশ্বভুবন প্রেরণ করি এবং দ্যাবাপৃথিবী ধারণ করে থাকি।
উক্ত মন্ডলেই ঋষি বামদেব বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আত্মস্বরূপ উপলব্ধি করেছেন।
তিনিও বলেছেনঃ
অহং মনুবভবং সূর্যশ্চাহং কক্ষীর্বা ঋষিবস্মি বিপ্রঃ।
অহং কুৎসমার্জুনেয়ংন্যৃঞ্জেহহং কবিরুশনা পশ্যতামা।।
অহং ভূমিমদদামার্যাযাহং বৃষ্টিং দাশুষে মর্ত্যায়।
অহং অপো অনয়ং বাবশানো মগ্ন দেবাসো অনুকেতমাযন্।
অহং পুরো মন্দশানো ব্যৈবং নাকন্নবতীঃ শম্ববস্য।
শততং বেশ্যং সর্বতাতা দিবোদাসমতিথিগ্বং যদাবম্।।
ঋগ্বেদ ৪/২৬/১-৩
অর্থ- আমি মনু(প্রজাপতি), আমি সর্বপ্রেরক সূর্য, মেধাবী কক্ষীবান্ নামক ঋষিও আমি, আর্জুনীপুত্র কুৎস নামক ঋষিকে আমিই প্রসাধিত করি। উশনা নামক ক্রান্তদর্শী(ত্রিকালজ্ঞ)ঋষিও আমি। হে জনগন, উত্তমরূপে সিত্যদ্রষ্টা আমাকে দেখ। আমি আর্যমানবকে ভূমি দান করেছি। হবিদান-কারী মনুষ্যকে আমিই বৃষ্টিদান করি। আমিই শব্দকারী জলসমূহকে সর্বস্থানে প্রেরণ করি। দেবতারা আমার সংস্কার বহন করেন। আমিই ইন্দ্ররূপে সোমপানে মত্ত হয়ে নয়শত নিরাননব্বই বার শম্বর নামক অসুরের পুর ধ্বংস করেছি, দিবোদাসের প্রবেশযোগ্য করেছি শতসংখ্যক পুর।
ঋষি বামদেবের এই উপলব্ধি ব্রহ্মজ্ঞানের চূড়ান্ত। যে ঈশ্বর সর্বনিয়ন্তা অথচ সর্বময় ঋষি বামদেব ত্রসদস্যু এবং বাকের আত্মজ্ঞানে তারই প্রকাশ ঘটেছে। সকল দেবতা যে এক ও অদ্বিতীয় ঈশ্বরের ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ-এই সত্য ঋগ্বেদের ঋষি প্রথম মণ্ডলেই ঘোষণা করেছিলেনঃ-
ইন্দ্রং মিত্রং বরুণমগ্নিমাহুরথো দিব্যঃ সুপর্নো গরুত্মান্।
একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্ত্যগ্নিং যমং মাতরিশ্বানমাহুঃ।।
-ঋগ্বেদ ১/১৬৪/৪৬
অর্থ- এক সৎ বস্তুকেই ইন্দ্র, মিত্র, বরুণ, অগ্নি পক্ষযুক্ত সুপর্ণ(পক্ষীম-সূর্য্য) অগ্নি, যম মাতরিশ্বা প্রভৃতি বহুনামে বিপ্রগণ অভিহিত করে থাকেন।ঋগ্বেদের অপর একটি মন্ত্রে পারিঃ "একং বা ইদং বিবভূব সর্বম্"(ঋগ্বেদ ৮/৫২/২) -এই একই সকল রূপ ধারণ করেছেন। তৃতীয় মণ্ডলের ৫৫নং সুক্তে প্রতি ঋকের শেষে আছেঃ- "মহদ্দেবানামসুবত্বমেকম্।"- তুমিই মহৎ দেবগণের একমাত্র প্রাণস্বরুপ। অসুর শব্দের অর্থ প্রাণদাতা। ঋগ্বদের অনেক দেবতাকেই অসুর বলা হয়েছে। এই বাক্যটীর অনুবাদে maxmuller লিখেছেন, "The great divinity of the gods is one." Muir লিখেছেন, "The divine power of the gods is unique" শুক্লযজুর্বেদো একেশ্বরের তত্ত্ব উদাত্ত কণ্ঠে উচ্চারিত করেছেন,- "এতসৈব স বিসৃষ্টিবেষ উহ্যেব সর্বে দেবাঃ।"- এই সবই তাঁর সৃষ্টি, তিনিই সকল দেবতা। অর্থবেদের ঋষিও বহুদেবতার মধ্যে এক সর্বব্যাপী ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করে বলেছেন,- "তদগ্নিবাহ তদু সোম আহ বৃহস্পতিঃ সবিতা তদিন্দ্রঃ।"- তাঁকেই অগ্নি বলা হয়, তাঁকেই সোম বলা হয়, তিনিই বৃহস্পতি সবিতা, তিনিই ইন্দ্র।
বৈদিক ঋষিগণ বহুদেবতার উপাসক হওয়া সত্ত্বেও মূলতঃ ছিলেন একেশ্বরবাদী। কেবল ঋগ্বদের দশম মণ্ডলে নয়, কেবল উপনিষদে নয়্ সমগ্র বৈদিক সংহিতায়, ব্রাহ্মণে, উপনিষদে-সর্বত্রই একেশ্বরে বিশ্বাস প্রকটিত। একই ঈশ্বর রূপগুণভেদে ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রকাশিত হন, এ বিশ্বাস আর্যসভ্যতা ও সংস্কৃতির মর্মকথা। একেরই বহুরূপে প্রকাশ অথবা বহুত্বের মধ্যেই একের অস্ত্বিত্বের অনুভূতি ভারতীয় সংস্কৃতির চিরন্তন বৈশিষ্ট্য। বৈদিক দেবতার এই বৈশিষ্ট্য প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য পণ্ডিত ভারতীয় দেবতত্ত্বের স্বরূপটি যথাযথাভাবে উপলব্ধি করেছেন, এ কথা সত্য।
Sir Charles Eliot বৈদিক দেবতাদের একত্বনুভব সম্পর্কে সুন্দরভাবে বিশ্লেষণ করেছেনঃ- "The Gods are frequently thought of as joined in couples, triads or larger companies and early worship probably showed the beginnings
হিন্দুদের দেবদেবী উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ এ বেদের একেশ্বরত্ব নিয়ে হংসনারায়ণের তথ্যমূলক বক্তব্য সমাপ্ত।
নিবেদনে- স্বস্তিক সভা
কোন মন্তব্য নেই