আর্যধর্মের বিবর্তন
আর্যধর্ম মূলতঃ একেশ্বরবাদী হওয়া সত্ত্বেও এক ঈশ্বরের ভিন্ন ভিন্ন গুণক্রিয়া অনুসারে পরিকল্পিত বহু দেবদেবীর উপাসনা বৈদিক যুগ থেকেই ভারতবর্ষ প্রচলিত। দেবতার চরিত্রের যেমন পরিবর্তন ঘটেছে যুগে যুগে, -তেমনি দেব উপাসনার পদ্ধতিরও পরিবর্তন ঘটেছে। বৈদিক যুগে অগ্নিকে দেবতার মুখ এবং দূতরূপে গ্রহণ করে দেবগণের প্রতিনিধি প্রজ্জ্বলিত যজ্ঞাগ্নিতে বিভিন্ন দেবতার উদ্দেশ্যে হবি (ঘৃত, পিষ্টক, পায়স, পশুর বপা, মাংস প্রভৃতি) অর্পণ করা হোত। এই যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠান নিছক কুসংস্কার ছিল না। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নিত্যনৈমিত্তিক বিস্ময়কর কার্যাবলী একটি বিরাট যজ্ঞরূপে প্রতিভাত হয়েছিল ঋষিদের মনে। বিশ্বের অত্যাশ্চর্য সৃজন ক্রিয়া একটি এখণ্ড যজ্ঞকর্ম ভিন্ন কিছুই নয়। এই অখণ্ডযজ্ঞক্রিয়ার মধ্য দিয়েই চলেছে সৃষ্টিস্থিতিলয়ের অবিচ্ছিন্ন গতি। এই যজ্ঞের অধিষ্ঠাতা যজ্ঞেশ্বর এক অদ্বিতীয় ইশ্বর। আর্যদের যাগকর্ম বিশ্বযজ্ঞের প্রতীক। যজ্ঞেশ্বকে তৃপ্ত করার জন্য পার্থিব যজ্ঞের অনুষ্ঠান।
দেবতাদের তুষ্ট করার সঙ্গে সঙ্গে আত্মজ্ঞানলাভের সাধনাও প্রচলিত ছিল। আত্মা তথা ঈশ্বরের স্বরূপ উপলব্ধি করেছিলেন বামদেব, পুরুকুৎস, ইন্দ্র, বাক্ প্রভৃতি ঋষিগণ। পরবর্তীকালে আর্যদেব ঈশ্বরোপাসনায় যজ্ঞানুষ্ঠান অপেক্ষা আত্মস্বরূপ উপলব্ধি অধিকতর গুরুত্ব লাভ করেছে। বহু দেবতার পরিবর্তে এক ঈশ্বরের সর্বময় অস্তিত্বের অনুভব উপনিষদের ঋষিদের ধর্মচর্যার প্রধান বিষয় হয়েছে। তবে যজ্ঞানুষ্ঠান একেবারে অপ্রচলিত কখনও হয় নি। পৌরাণিক যুগে আবার বহুদেবতার উপাসনা বহুত্ততা লাভ করেছে। নিরাকার সর্বময় ব্রহ্মের ধারনা সর্বসাধারণের পক্ষে সম্ভবপর না হওয়ায় এক ঈশ্বরের বিভিন্ন গুণ কর্মের প্রকাশ লক্ষ্য করে বহু দেবতার পরিকল্পনা হয়েছে। বৈদিক দেবতারা অনেক রূপ পরিবর্তন করে পৌরাণিক যুগে আবির্ভূত হয়েছেন নব কায়া নিয়ে, অনেক প্রাচীন দেবতার উপাসনা বিলুপ্ত হয়েছে, আবার অনেক নূতন নূতন দেবতারও আবির্ভাব হয়েছে।
দেব-উপাসনার রীতি-প্রকৃতিও পরিবর্তিত হয়েছে। পৌরাণিক যুগের দেব-পূজায় বৈদিক যজ্ঞ এবং ব্রহ্মচিন্তা পরিবর্তিত আকারে স্বীকৃতি পেয়েছে। এই যুগে দেবতাকে প্রত্যক্ষগোচর করে তোলার জন্য প্রস্তরময়ী অথবা মৃন্ময়ী প্রতিমা নির্মাণ করে পূজার আয়োজন জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। পূজাবিধিতে দশোপচার, পঞ্চোপচার অথবা ষোড়শোপচারে দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করার রীতি প্রচিলিত হয়েছে। এই পূজা-ক্রমে মানবিক প্রয়োজনানুরূপ দ্রব্যাদি দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদন করার ব্যবথা। আসল, পাদ্য, অর্ঘ্য, মধুপর্ক, আচমনীয়, স্নানীয়, বস্ত্র নৈবেদ্যাদি নিবেদনের মধ্যে দেবতাকে মাবিকরূপে গ্রহণ করার প্রবণতা স্পষ্ট। ভগবদ্গীতাতেই দেখা যায় যে- পুষ্প, ফল, জল প্রভৃতি দেবোদ্দেশে উৎসর্গিত হোত। শ্রীভগবান বলেছেন-
পত্রং পুষ্পং ফলং তোয়ং যো মে ভক্ত্যা প্রযচ্ছতি।
তদহং ভক্ত্যুপহৃতমশ্নামি প্রযতাত্মনঃ।। ৯/২৬
-পত্র(তুলসী), পুষ্প, ফল, জল যে ভক্তিভরে আমাকে প্রদান করে, আমি সেই ভক্তের ভক্তির উপহার গ্রহণ করি। দেবতার রূপ কল্পনায় এবং দেবতার সঙ্গে পিতা-মাতার সম্পর্ক স্থাপনে দেবতাকে মানবিক সীমার মধ্যে আবদ্ধ করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয়েছে। কর্ম জ্ঞানের স্থান গ্রহণ করেছে ভক্তি।এই পূজাবিধির অন্যতম অঙ্গ ধ্যান,- দেবতার রূপ ও স্বরুপ-চিন্তন এবং দেবতার নাম বা বীজমন্ত্র জপ। ধ্যানকালে দেবতার সঙ্গে পূজক বা সাধকের একাত্মতার ভাবনা প্রয়োজন। জপকালে অনন্যমনা হয়ে দেবতায় চিত্ত নিবেশ। ধ্যানে উপনিষদের ব্রহ্মচিন্তা নবরূপ পেয়েছে, আর জপে এসেছে চিত্তের একাগ্রতা। অথচ বারণ চমস(কোশাকুশী) সহযোগে দেবপূজা, প্রাণায় স্বাদা ইত্যাদি পঞ্চমন্ত্রে পঞ্চপ্রাণের আহুতি প্রদান যাগ-যজ্ঞেরই সংক্ষিপ্ত রূপ নয় কি? যজ্ঞে অগ্নিতে প্রদত্ত ঘৃতের স্থলাভিষিক্ত সর্বজীবের প্রাণভূত-কারারূপ সলিল বা জল। আবার প্রতিমা পূজায় হোম বা যজ্ঞ অপরিহার্য অঙ্গ। এই হোম-যাগও বৈদিক যাগযজ্ঞ থেকেই আগত। হোমযাগে বৈদিক মন্ত্রাদি পাঠ করা হয়। বিষ্ণু বা বিষ্ণূর রূপভেদ ছাড়া অন্যান্য দেবতার পূজায় বিশ্বষতঃ শক্তিপূজায় পশুবলির রীতি আছে। যুপকাষ্ঠে পশুবলিদানের প্রথাও বৈদিক কর্মকাণ্ড থেকেই আগত। যাগক্রিয়া ও স্বরূপধ্যান ছাড়া দেবপূজায় আরও কিছু প্রক্রিয়া বর্তমান যেগুলি এসেছে তান্ত্রিক সাধন পদ্ধতি থেকে। তান্ত্রিক সাধনার উৎস বেদ হলেও তন্ত্রসাধনার ক্রিয়া প্রক্রিয়া রীতি নীতি বৈদিক ধর্মচর্যা থেকে পৃথক পথ অনুসরণ করেছে। প্রাণায়াম, ভূতশুদ্ধি, প্রাণপ্রতিষ্ঠা, বীজমন্ত্র জপ প্রভৃতি তান্ত্রিক সাধনার অঙ্গীভূত হলেও যে কোন দেবার্চনার ক্ষেত্রে অবশ্যকর্তব্যরূপে গৃহীত হয়েছে। এইভাবে বৈদিক দেবার্চনা ক্রমবিবর্তনের পথে উপনিষদের আত্মচিন্তন ও তান্ত্রিক রীতির সঙ্গে অন্বিত হয়ে এবং মানবিক প্রয়োজনবোধ সম্পৃত্ত হয়ে একটি সহজতর পদ্ধতিতে পরিণত হয়েছে।
ভারতীয় ধর্মচর্যার যেমন একটি বিব্বর্তনধারা প্রত্যক্ষগম্য তেমনি ভারতীয় দেবতাদেরও একটি ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস সুস্পষ্ট। বেদ থেকে উপনিষদ উপনিষদ থেকে পূরাণ-পূরাণ থেকে লৌকিক রীতিতে একই দেবচরিত্রের কত পরিবর্তন কত রূপান্তর ঘটেছে তার বিবরণ যেমন কৌতহলোদ্দীপক তেমনি চমকপ্রদ। এককালে প্রধান দেবতা পরবর্তীকালে হয়েছেন অপ্রধান। কত দেবতার ঘটেছে বিলুপ্তি, আবার কত কত নতুন দেবতার হয়েছে আবির্ভাব। একদা প্রাধান্যহীন দেবতার হয়েছে উচ্চতর মহিমায় অধিষ্ঠান, আবার কোন কোন মহাপ্রতাপশালী দেবতা গৌরব হারিয়ে কোন প্রকারে অস্তিত্ব নিয়ে টিকে আছেন। আর্যেতর সংস্কৃতি থেকে কত দেবতা এসেছেন হিন্দুদেবসভায়, কত দেবতা এসেছেন পুরাণতন্ত্র এমন কি বৌদ্ধতন্ত্রের মধ্য দিয়ে আধুনিক হিন্দু দেবতার মিছিলে। এইভাবে ঋগ্বেদের তেত্রিশ দেবতা হলেন তেত্রিশ কোটি।
এক সময়ে ইন্দ্র ও অগ্নি ছিলেন দেবসমাজের সর্বোচ্চ স্থানে - পরে তাঁদের চরিত্রের পরিবর্তন ঘটেছে, আধুনিককালে তাঁরা নামে মাত্র জীবিত অথবা ভিন্নরূপে প্রতিভাত। অথচ বেদে বিষ্ণু অপ্রধান হয়েও পুরাণে এবং পুরাণোত্তর হিন্দু সমাজে অন্যতম প্রধান দেবতা। রুদ্র রুদ্রত্ব হারিয়ে হলেন শিব। শক্তি দেবতার অস্তিত্বের সুষ্পষ্ট চিত্রের অভাব বেদে থাকলেও পুরাণে ও তন্ত্রে বহু বিচিত্র রূপে তাঁর প্রকাশ, আধুনিককালেও তাঁর প্রভাব অপ্রতিহত। দেবতাদের এই উন্থানপতন ও জন্মান্তরের ইতিবৃত্ত অত্যন্ত কৌতুহলোদ্দীপক। দেবতাদের এই চমকপ্রদ বিবরণের ইঙ্গিত ঋগ্বেদেই আছে। ঋষি ছোট-বড়, যুবক-বৃদ্ধ সকল দেবতাদের প্রণাম জানাতে গিয়ে বলেছেন।
নমো মহদ্ভ্যো নমো অর্ভকেভ্যো
নমো যুবভ্যো নম আশিনেভ্যঃ।
-প্রসিদ্ধ(মহৎ) দেবগণকে আমি প্রণাম করিতেছি, নব প্রসিদ্ধিসম্পন্ন দেবগণকে আমি প্রণাম করিতেছি, লুপ্তগৌরব বৃদ্ধগণকে আমি প্রণাম করিতেছি। ঋগ্বেদ- ১/২৭/১৩
ঋক্টির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে সায়নাচার্য লিখেছেন, "মহদ্ভ্যঃ গুণৈবধিকা, অর্ভকাগুণৈঃ শূন্যাঃ যুবানঃ তরুণাঃ আশিনা বয়সা ব্যাপ্তা বৃদ্ধাঃ- (অর্থাৎ) মহৎ দেব অর্থে অধিকগুণসম্পন্ন দেবতা, অর্ভক শব্দের অর্থ গুণশূন্য, যুবা অর্থে তরুণদেবতা আশিন শব্দের অর্থ বয়োবৃদ্ধ দেবতা।
ঋগ্বেদের সময়েই দেবতাদের শ্রেণীভিভাগের যে ইঙ্গিত এখানে পাতি তা আজ পর্যন্ত সমস্ত হিন্দুদেবতাদের বিবর্তনের ইতিহাস। পুরাণে বিভিন্ন দেবতা সম্পর্কে বহুতর উপাখ্যান বর্ণিত হয়েছে। এই সকল উপাখ্যান অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রূপক এবং এগুলির মূল অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বৈদিক যুগ পর্যন্ত প্রসারিত। অনেক পৌরাণিক উপাখ্যানেরই জন্ম হয়েছিল ব্রাহ্মণের যুগে। এইগুলি পূরাণে পল্লবিত হয়েছে। এই উপাখ্যানগুলির বিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কান্বিত।
মহাযোগী শ্রীঅরবিন্দ যজ্ঞক্রিয়াকে প্রতীক রূপেই গ্রহণ করেছেন।- it is not the sacrificial Frire that is capable of these functions, nor can it be any material flame or principle of physical heat and light yet throughout the symbol of the sarificial fire is maintained it is evident that we are in thae presence of a mystic symbolism to which the fire, the sacrifice the priest are only out-word figures of a deeper teaching and yet figures which it was thought necessary to maintain and to hold constantly in front. - on the veda, page-74
শ্রীঅরবিন্দ বৈদিক যজ্ঞানুষ্ঠানকে ঐশ্বরিক চেতনালাভের উপায়রূপে গ্রহণ করেছেন। যজ্ঞাগ্নি প্রজ্জ্বলন তাঁর নিকট দৈব প্রেরণাপ্রজ্জলের রূপক-kinding of the divine flame.- on the veda, page-279
বৈদিক অগ্নি উপাসনা কালক্রমে বহুদেবতার উপাসনায় পর্যবসিত হয়েছে। কালক্রমে যজ্ঞানুষ্ঠান জটিল, প্রাণহীন ও দুর্বোধ্য হয়ে পড়েছিল বলে মনে হয়। যাগযজ্ঞের মাধ্যমে দেবতাদের কৃপালাভ ছিল সেকালের আর্যদের লক্ষ্য। ঋগ্বেদে যজ্ঞানুষ্ঠানের মধ্যে দেবতার কৃপালাভ এবং যজ্ঞকারীর ঐহিক ও পারত্রিক কল্যাণ কামনা নিহিত ছিল। পরে দেবতার মূর্তি যজ্ঞের স্থান গ্রহণ করলো। বিচিত্র পথে গড়ে উঠলো বিভিন্ন দেবতার মূর্তি পরিকল্পনা। পুরাতন যুগের দেবতারা প্রাধান্য হারিয়ে কেউ গেলেন লুপ্ত হয়ে কেউ বা নামে মাত্র জীবিত রইলেন। পুরাণের যুগে প্রধান হলেন ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর-আরো পরে প্রাধান্য পেলেন বিষ্ণু ও শিব আর শক্তিদেবতা দুর্গা-কালী।
হিন্দুদের দেবদেবী সংকলনে-স্বস্তিক সভা।
কোন মন্তব্য নেই