sanatansangbed

Introduction of SANATAN dharma scriptures

পুরাণের পাঁচটি লক্ষণ

পাঁচটি লক্ষণ দিয়ে নির্ধারিত হয় এই শাস্ত্রগুলো পুরাণ আর এই শাস্ত্রগুলো পুরাণ নয়। অমরকোষ নামে একটা সংস্কৃতের অভিধান আছে, যেখানে পুরাণের পাঁচটি লক্ষণের কথা বলা হয়েছে। যে কোন পুরাণের পাঁচটি লক্ষণ থাকতে হবে। 
প্রথম লক্ষণ সর্গ- প্রত্যেকটি পুরাণে মূল সৃষ্টি কিভাবে হয়েছে তার বর্ণনা থাকবে। মূল সৃষ্টি বলতে বোঝায়। ভগবান বিষ্ণু বা ব্রহ্মা কিভাবে সব কিছু সৃষ্টি করলেন। 
দ্বিতীয় লক্ষণ প্রতিসর্গ- সৃষ্টির সংহার কিভাবে হয়। সব পুরাণেই এই সংহারের বর্ণনা থাকবে। 
তৃতীয় লক্ষণ মন্বন্তর– একটা মূল সৃষ্টি আছে, এই মূল সৃষ্টির মধ্যে আবার কোথাও কোথাও ছোট ছোট সৃষ্টি হচ্ছে। আবার সংহার হচ্ছে। যেমন মানুষ একশ বছর পর্যন্ত বাঁচে। ঠিক তেমনি মানুষের একশ বছরে দেবতাদের একটি দিন। দেবতাদের একটি রাতও সেই হিসাবে মানুষের একশ বছর। এইভাবে দেবতারা একশ বছর বাঁচবে। দেবতাদের এই একশ বছরে ব্রহ্মার একটা দিন। ব্রহ্মা তাঁর একটা দিনে সারা দিন কাজ করে রাত্ৰিবেলা ঘুমিয়ে পড়েন, তখন দেবতা, মানুষ থেকে শুরু করে সব জীবের লয় হয়ে যায়। এই লয় হওয়াটা একটা ছোট্ট সংহার। এইভাবে ব্রহ্মা একশ বছর বেঁচে থাকার পর একটা মূল সংহার হয়ে যায়। এখানে দুই ধরণের লয় হচ্ছে, একটা সাময়িক লয় আরেকটা চূড়ান্ত লয়। সমস্ত পুরাণে এই দুটো লয়ের বর্ণনা থাকবে। ব্রহ্মা যখন প্রত্যেক দিন ঘুম থেকে একবার করে জাগ্রত হচ্ছেন, তার কিছু দিন পর একজন মনু এসে সৃষ্টির সব কিছুর দায়ীত্ব গ্রহণ করেন। বলা হয় সৃষ্টির একটি সাময়িক চক্রে একজন মনু হলেন সৃষ্টির ঠিক ঠিক রাজা। এইভাবে একটা মূল সৃষ্টিতে নাকি চৌদ্দজন মনু হন। প্রত্যেক মনুকে নিয়ে যে কাহিনী তৈরী হয়েছে সেই কাহিনীকে বলা হয় মন্বন্তর। আমার এখন অষ্টম মন্বন্তরে আছি। এরপর আরও ছটি মন্বন্তর বাকি আছে, এরপর সৃষ্টির মূল সংহার হয়ে যাবে। এনাদের সব হিসাব করা আছে এত দিন পরে সংহার হবে, তারপর আবার এত দিন পর থেকে আবার সৃষ্টি শুরু হবে।
কি ভাবে এর হিসাব করা হয়। আমাদের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। ছেলে বাপের জন্মের কথা কি করে বলবে, কারণ বাবার জন্মের পর ছেলের জন্ম হয়েছে। সেইজন্য বেদের নাসদীয়সূক্তে ঋষি বলছেন কো অদ্ধঃ বেদা, তখন দেবতাদের জন্ম হয়নি, ঋষিদের জন্ম হয়নি তাহলে মানুষ কি করে বলবে কবে থেকে সৃষ্টি হয়েছে। শঙ্করাচার্য তাঁর গীতাভাষ্যে বলছেন, তোমার তখন জন্মই হয়নি তুমি কি করে জানবে সৃষ্টির আগে কি ছিল, সৃষ্টি কবে শুরু হল। সেইজন্য কি করতে বলছেন? পুরাণে যখন একবার যেটা বলে দেওয়া হয়েছে ওটাকে মেনে নাও, এরপর আর বেশী চিন্তা করে মাথা খারাপ করতে যেও না। এনারা দেখছেন মানুষ যখন রাত্ৰিবেলা রোজ ঘুমিয়ে পড়ে তখন সেদিনের সব কিছু যেন শেষ হয়ে গেল। পরের দিন যখন আবার ঘুম থেকে উঠছে তখন আবার নতুন করে যেন সব শুরু হল। ঠিক তেমনি ব্রহ্মা যখন ঘুমিয়ে পড়লেন তখন পুরো প্রকৃতিও যেন নিদ্রায় চলে গেল। কিছু দিন আগে সৃষ্টির উপর গবেষণালব্ধ একটি বিজ্ঞানের বইতে বলছে সৃষ্টির ব্যাপারে পৌরাণিক সময়গুলো যেভাবে বর্ণনা করা হয়েছে কোথায় যেন সেই সময়গুলো হিসাবে মিলে যাচ্ছে। অবশ্য বিজ্ঞানীদের কথায় বিশ্বাস রাখা যায় না, আজকে যেটা ওরা বলবে। আগামীকাল আরেকটা থিয়োরী এনে আগের থিয়োরিটাকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেবে। তবে সৃষ্টির ব্যাপারে হিন্দুদের এত থিয়োরী রয়েছে যে, বিজ্ঞানীরা যত রকম থিয়োরীই নিয়ে আসুন না কেন, সব কটিই পুরাণের কোন না কোন একটা থিয়োরীর সাথে মিলে যাবে। আগামীকাল যদি বিজ্ঞান বলে দেয় সৃষ্টি বলে আদৌ কিছু নেই, তখন আমাদের পণ্ডিতরা বলবেন মাণ্ডুক্যকারিকাতে পাঁচ হাজার বছর আগেই এই কথা বলে দেওয়া হয়েছে।
হিন্দুরা একটাই বিজ্ঞানীদের থিয়োরী মানবে না, সেটা হল বিজ্ঞানীরা বলছেন সৃষ্টি যেটা হয়েছে সেটা চিরন্তন। কিছু দিন আগে বিজ্ঞানে Steady and Stay নামে একটা থিয়োরী এসেছিল, তাতে বলছে এই সৃষ্টি চলতেই থাকবে, কোন দিন এর নাশ হবে না। আইনস্টানেরও একটা নিজস্ব মত ছিল যেখানে তিনি বলছেন, এই সৃষ্টি ভগবানের কিনা, তাই এর নাশ হতে পারে না, সৃষ্টি সব সময় steady । হিন্দুরা এই মত কখনই গ্রহণ করবে না। হিন্দুরা বলবে যার জন্ম আছে তার মৃত্যু অবশ্যই হবে। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি যখন হয়েছে, তখন এর লয় হবেই। হিন্দুদের সৃষ্টির লয়কে যদি মেনে নেওয়া হয়, এরপর যে যা থিয়োরী নিয়ে আসুক সব হিন্দুদের কাছে আগে থাকতেই আছে। শুধু সৃষ্টিকে চিরন্তন হিন্দুরা কখনই মানবে না।
মন্বন্তর হল পিরিয়ডিক্যাল সৃষ্টি আর তার লয়। মনে করুন এই ব্রহ্মাণ্ডের বাইরে থেকে একজন এই সৃষ্টিকে পর্যবেক্ষণ করছেন। তিনি দেখছেন ব্রহ্মার একটা দিন শেষ হয়ে রাত্রি এল, তারপর হঠাৎ দেখলেন ব্রহ্মা রাত্রিবেলা ঘুমিয়ে পড়তেই পুরো সৃষ্টিটা তাঁর মধ্যে বিলীন হয়ে গেল। আবার ব্রহ্মার একটা রাত অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পর যখন তিনি ঘুম থেকে উঠলেন তখন দেখছেন আবার সৃষ্টিটা জেগে উঠল। গীতায় অষ্টম অধ্যায়ে ভগবান periodic creationএর ঠিক এই ধারণাটা নিয়ে এসেছেন – ভূতগ্ৰামঃ সা এবায়ং ভূত্বা ভূত্বা প্রলীয়তে। আর ব্রহ্মার যখন একশ বছর হয়ে যাবে তখন মূল প্ৰলয় হয়ে যাবে। তারপরে আবার ব্রহ্মা কবে আসবেন সেটা আর পুরাণ বলছে না। মানুষের বছর হিসাবে ব্রহ্মার আয়ু হল তিরিশ সংখ্যার পর তেরোটা শূন্য বসালে যত সংখ্যা হবে তত বছর (৩০,০০,০০,০০,০০,০০,০০০)। এটা গেল মন্বন্তর।
চতুর্থ লক্ষণ- বংশ। ভারতে দুটো খুব নামকরা বংশ প্রাচীন কাল থেকে চলে আসছে। এই দুটো বংশকে প্রধান বংশ বলে মনে করা হয় – সূর্যবংশ ও চন্দ্রবংশ। সূর্যবংশের খুব নামকরা ব্যক্তিত্ব হলেন শ্রীরামচন্দ্র আর চন্দ্রবংশের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব হলেন শ্রীকৃষ্ণ। এখানে ছোট বড় কিছু নেই, দুটো বংশেরই নিজস্ব কতকগুলো ধারা আছে। পুরাণ এই দুটো বংশের বর্ণনা করে। বাল্মীকি রামায়ণে সূর্যবংশেরই বেশী বর্ণনা করা হয়েছে, অন্য দিকে মহাভারতে চন্দ্রবংশের আলোচনা বেশী করা হলেও সূর্যবংশেরও কিছু বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু পুরাণে পুরো তালিকা দেওয়া আছে, ব্রহ্মা থেকে কিভাবে কিভাবে সৃষ্টি হয়ে হয়ে কোন জায়গায় এসে সূর্যবংশ আর চন্দ্রবংশ আলাদা হয়ে গেল। কিভাবে চন্দ্র ও বুধের মিলন হল, তারপর সেখান থেকে কিভাবে সৃষ্টি এগোল এসবের বিশাল বর্ণনা করা হয়েছে। যে কোন পুরাণকে এই দুটো বংশের তালিকা দিতে হবে।
পঞ্চম লক্ষণ- বংশানুচরিত। পুরাণে কিছু কিছু ঐতিহাসিক চরিত্রের বর্ণনা থাকবে। যেমন রাজা পরীক্ষিৎ, রাজা পরীক্ষিৎকে আমরা কখনই পৌরাণিক চরিত্র বলতে পারি না। অর্জুন, ভীম, যুধিষ্ঠির এনারাও ঐতিহাসিক চরিত্র। হিন্দুরা কখনই এদের পৌরাণিক চরিত্র বলবে না, এনারা হলেন একেবারে রক্তমাংসের মানুষ। পুরাণে এই ধরণের কিছু চরিত্রের বর্ণনা পাওয়া যায়। প্র্যজিপ্টর নামে নামকরা একজন ইতিহাসবিদ পুরাণকে আধার করে একটা লেখাতে তিনি পুরো তালিকা তৈরী করে দেখিয়েছেন কোন ঘটনা কবে হয়েছে, যেমন রাম-রাবণের যুদ্ধ কবে হয়েছে, মহাভারতের যুদ্ধ কবে হয়েছে। ঐতিহাসিক ঘটনা গুলিকে একবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। পঞ্চাশ কি একশ বছর আগেকার ইতিহাসবিদরা পুরাণের এই ঘটনাগুলোকে মানতেন না। কিন্তু বর্তমান কালের ইতিহাসবিদরা পুরাণকে পুরোপুরি না নিলেও একেবারে উড়িয়েও দেন না। যখন দেখেন পুরাণের এই ঘটনা ইতিহাসের সাথে মিলে যাচ্ছে তখন সেই ঘটনাকে স্বীকার করে নিচ্ছেন। যদি না মেলে তখন খতিয়ে দেখেন কেন মিলছে না। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবকে ওনারা মানছেন না। কিন্তু পুরাণের ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোকে ওনারা মানবেন।
পুরাণ বংশ নিয়ে আলোচনা করতে করতে একেবারে চলে যাবে মাইথলজিতে, যেখানে আর কোন ঐতিহাসিক উপাদান খুঁজে পাওয়া যাবে না। আবার সেখান থেকে নামিয়ে এমন জায়গায় নিয়ে যাবে যেখানে শুধু ঐতিহাসিক ঘটনা ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যাবে না। যেমন ধরুন আমি কোন ভাবে খুব বিখ্যাত কোন ব্যক্তিত্ব হয়ে গেলাম। এবার কেউ হয়তো আমার জীবনী লিখতে বসেছে। আমার জীবনী লিখতে তার কোন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। শুরুতে আমার বংশের কথা লিখতে গিয়ে হয়তো আমার বাবা-মা পর্যন্ত যাবে, তা নাহলে খুব জোর আমার ঠাকুর্দা পর্যন্ত যাবে। আর আমার বংশে অনেক পুরুষ আগে যদি কেউ বিখ্যাত হয়ে থাকেন, তখন না হয়। সেখান থেকে লেখা শুরু হবে। এটাই যখন পুরাণে রূপান্তরিত হবে তখন শুরু করতে হবে ভগবান থেকে। ব্রহ্মা যখন সৃষ্টি করলেন, তখন তিনি মন থেকে এই সৃষ্টি করলেন। সেই সৃষ্টি থেকে অমুক ঋষির জন্ম হল, সেই ঋষি থেকে অমুক বংশের সৃষ্টি হল, সেই হয়ে হয়ে নিয়ে এনে ফেলবে আমার জন্ম কিভাবে হল। সেইজন্য কোথায় যে বংশ শুরু হচ্ছে। আবার কোথা থেকে যে বংশানুচরিত শুরু হচ্ছে দুটোকে আলাদা করে ধরা খুব মুশকিল হয়ে যায়। আমার অস্তিত্বকে আমি দেখছি, আমার বাবা-মার কথা, আমার দাদুঠাকুরমার কথা সেটাও সত্য। কিন্তু এইভাবে টেনে কিছু দূর যাবার পর হারিয়ে যেতে বাধ্য। কিন্তু এখন যারা আছে তাদের সবারই আট থেকে দশ হাজার প্রজন্ম আছে, এটাও সত্য। ঠেলতে ঠেলতে যদি কেউ আট হাজার প্রজন্ম পর্যন্ত পৌঁছে যান। তখন তাঁরা হয়তো কেউ খুব উন্নত ছিলেন বা উন্নত নাও হতে পারেন। শ্রীরামচন্দ্রের পর লব-কুশ হয়েছেন, কিন্তু লব-কুশের পর কারা এসেছিলেন তার কোন বিবরণ নেই। তাঁদেরই মধ্যে পরে হয়তো ক্ষত্ৰিয় বংশে খুব বিখ্যাত হয়েছিলেন। এগুলো বলা খুব মুশকিল। কিন্তু পুরাণ যখন লিখবে তখন পুরো বংশ আর বংশানুচরিতকে মিলিয়ে লিখবে। মূল বংশানুচরিত অর্থাৎ আসল চরিত্রগুলোকে নিয়ে আসা হবে কিন্তু তার সাথে তাঁর বংশটাও বলে দেবে। হয়তো বংশের কিছুই জানেন না। কিন্তু এই বংশের ধারাগুলোকে তাঁরা আগে থাকতেই যে পৌরাণিক গাঁথা সমাজে মানুষের মুখে মুখে চলে আসছিল, সেইখান থেকে এর উপাদানগুলোকে নিয়ে আসেন। কাহিনীর শুরু হবে একেবারে ব্রহ্মা যখন সৃষ্টি করেছিলেন সেইখান থেকে। এটি পুরাণের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বাল্মীকি রামায়ণে এত কিছুর বর্ণনা দেওয়া হয় না, মহাভারতে যদিও এই ধরণের কিছু কিছু বর্ণনা পাওয়া যাবে কিন্তু পুরাণের মত এত বিশদ বর্ণনা আর কোথাও নেই।
নিবেদনে- সনাতন সংবেদ। 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.