মানবজীবনে পিতা, মাতা ও গুরুর স্থান
মা, বাবা ও গুরু মানব জীবনের গুরুত্ববহ ও অপরিহার্য। মহাভারতে যুধিষ্ঠির পিতামহ ভীষ্মকে জিজ্ঞেস করছেন- “হে পিতামহ! ধর্মের পথ বিরাট দীর্ঘ আর এর শাখা-প্রশাখা অনন্ত, ধর্মের এত কিছু মানুষ কি করে মাথায় ধরে রাখবে আর পালনই বা করবে কি করে? তাই সংক্ষেপে ধর্মের কথা কিছু বলুন যাতে খুব সহজ ভাবে ধর্মের অনুশীলন করা যায়। তখন ভীষ্ম বলছেন- খুব সংক্ষেপে যদি ধর্মের কথা বলতে হয় তাহলে মা, বাবা আর গুরু এই তিনজনের যদি পূজা করা হয় তাতেই প্রধান ধর্ম পালন করা হয়ে যায়। তিনটে লোক – স্বর্গ, মর্ত ও পাতাল। মা, বাবা আর গুরু এই তিনজন হলেন এই তিনটে লোক, এই তিন জনের বাইরে আর কিছু নেই। তুমি যে লোকই জয় করতে চাও, এঁদেরকে দিয়েই তুমি জয় পেয়ে যাবে। এই ত্রিবিধ গুরুই তিন আশ্রম, এই ত্রিবিধ গুরুই তিন বেদ এবং এই ত্রিবিধ গুরুই তিন অগ্নি। পুরানে গণেশ আর কার্তিকের কাহিনীর মাধ্যমে ঠিক এই জিনিষটাই বর্ণনা করা হয়েছে। কার্তিক আর গণেশকে বলা হল যে আগে এই তিনটে লোক ধুরে আসতে পারবে তাঁকে এই হার উপহার দেওয়া হবে। কার্তিক তার ময়ূরে করে বেরিয়ে পড়ল তিনটে লোক ঘুরে আসতে। গণেশ তার ইঁদুরের পিঠে চেপে মাকে একবার প্রদক্ষিণ করে এসে বলল, আমার তিনলোক পরিভ্রমণ করা হয়ে গেল। মা, বাবা আর গুরু তিনটি লোক, আর এঁরাই হচ্ছেন তিনটে আশ্রম – ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য ও বাণপ্রস্থ। এঁদের পূজা করলে তিনটে আশ্রমের ফল এমনিই পাওয়া যায়। তিনটে বেদ – ঋক্, সাম্ ও যজু। মা, বাবা আর গুরুই এই তিনটে বেদ। বেদে যে তিন ধরণের অগ্নির কথা বলা হয়েছে মা, বাবা ও গুরুই এই তিনটে অগ্নি। বেদে অনেক রকমের অগ্নির ব্যবহারের কথা বলা হয়, এর মধ্যে পঞ্চাগ্নি, অগ্নিত্রয়, যেমন গৃহস্থদের তিনটে আগুনের ব্যবহার করতে হত এবং আরও নানা সংখ্যার অগ্নির কথা আছে। মূল কথা হল এই জগতে যা কিছু শ্রেষ্ঠ আছে, এই তিনজনের যদি সেবা করা যায় তাহলেই শ্রেষ্ঠ সব কিছু এসে যায়। সেইজন্য হে যুধিষ্ঠির এই তিনজনের প্রতি সব সময় শ্রদ্ধা সম্মান বজায় রেখে চলবে। যুধিষ্ঠিরের তখন বাবা ছিলেন না কিন্তু মা আর গুরু ছিলেন। তুমি এই দুজনকে সব সময় সেবা করে যাবে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যখন যুধিষ্ঠিরের উপর রেগে গিয়ে অর্জুন তলোয়ার বার করেছে দাদাকে কেটে ফেলবে বলে তখন শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন ‘অর্জুন তুমি মনে হয় কোন দিন গুরুজনদের সেবা করনি, তা নাহলে এইভাবে তিড়িং করে লাফিয়ে দাদাকে কাটবার জন্য তলোয়ার বার করতে যেতে না।' গুরুজনকে যদি খুব শ্রদ্ধা না কর তবে তুমি শেষ, এই হচ্ছে ধর্মের খুব সংক্ষিপ্ত পরিভাষা। ভীষ্ম বলছেন, যারা এই তিনজনকে সম্মান করে দিল জেনে নাও তারা এই তিনটে লোককে সম্মান দিয়ে দিল। এই তিনজনকে যে অনাদর ও অসম্মান করে দিল তার যত শুভকর্ম করা আছে সব নিষ্ফল হয়ে যেতে বাধ্য। সন্ন্যাসীও যদি মাকে অনাদর করে সংসার ছেড়ে বেরিয়ে আসে সেই সন্ন্যাসীরও কিন্তু নানা ঝামেলার মধ্যে পড়তে হবে। শঙ্করাচার্যও তাই সন্ন্যাস নেওয়ার আগে মাকে বলেই দিয়েছিলেন তুমি অনুমতি না দিলে আমি কখনই সন্ন্যাস নেব না। মা বাবাকে কখনই অনাদর করবে না। মা-বাবার সঙ্গে মনোমালিন্য, ঝগড়া হতেই পারে কিন্তু অনাদর পুরো আলাদা ব্যাপার, ঝগড়া আর অনাদর এক নয়। ভীষ্ম নিজের ব্যাপারে বলছেন, হে যুধিষ্ঠির আমি যত শুভকর্ম করতাম তার ফল সব সময় আমি আমার মা বাবার নামে অর্পণ করে দিতাম। এই অর্পণ করে দেওয়ার ফলে আমার সব পূণ্য হাজার গুণ বেড়ে গেছে।
এইজন্যই ভীষ্ম এত মহৎ। যুধিষ্ঠির ভীমকে এক সময় বলছিল সব কর্ম ভগবানকে অর্পণ করলে হাজার গুণ ফল পাবে, পাপ কর্মও যদি দিয়ে দাও তাহলে তার ফলও হাজার গুণ হবে। এটা অবশ্য মজা করে বলা, আসলে তা হয় না। যখন শুভ আর অশুভ কর্ম সবটাই ভগবানকে অর্পণ করে দেওয়া হয় তখন সেটা নিষ্কাম কর্ম হয়ে যায়।
ভীষ্ম বলছেন- দশ জন শ্রোত্রিয় থেকে একজন আচার্য শ্রেষ্ঠ। শ্রোত্রিয় মানে বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ, যিনি বেদ জানেন। বিদ্যা গুরু দশজন আচার্যের সমান। বাবা দশ উপাধ্যায় মানে বিদ্যা গুরুর সমান। মা দশটি বাবার সমান। এখানে বলছেন যে পৃথিবী সব থেকে সম্মানের পাত্র, মা সম্মানে সেই পৃথিবীর থেকেও উঁচু। আমাদের পরম্পারতে বলা হয়ে আসছে নাস্তি মাতৃসম গুরু, মায়ের মত আর গুরু হয় না। পরের শ্লোকেই ভীষ্ম বলছেন- এর আগে পরম্পরার কথা বলে ভীষ্ম এবার নিজের মত বলছেন 'তবে কি জান আমার মতে গুরুর স্থান মা-বাবার থেকে অনেক উপরে। কারণ মা-বাবা শুধু এই পার্থিব শরীরটা আমাকে দিয়েছেন কিন্তু গুরু দিব্য, অজর ও অমর শরীর দেন।' তার মানে গুরু যখন আমাকে আধ্যাত্মিক পথ দেখিয়ে দিলেন তখন আমার একটা নতুন শরীরের জন্ম হচ্ছে যে শরীরটা দিব্য, অজর ও অমর। তাই গুরুর স্থান সব সময়ই সবার থেকে উপরে। ভারতের মুসলমানরা বলে দিয়েছেন আমরা বন্দে মাতরম্ গান করব না। এর যুক্তি দেখাতে গিয়ে মুসলমানরা বলছেন আমরা মাকে শ্রদ্ধা করি কিন্তু মাকে পূজো করিনা, আমরা পূজো একমাত্র আল্লাকেই করি। এখানে ভীষ্মের মতের কিছুটা আভাস পাওয়া যায়, মা-বাবা আমাকে পার্থিব শরীর দিয়েছেন। এরজন্য তাঁদের পূজো করার কি আছে। যদিও মুসলমানদের মতের সঙ্গে অনেকেই এক মত নন। ভীষ্মের মতে ভগবানকে যেমন পূজো করা হচ্ছে তেমনি গুরুও একই পূজো পাওয়ার যোগ্য, কারণ তিনি আমাকে দিব্য, অজর ও অমর শরীর দিচ্ছেন। তাই গুরুর স্থান অনেক উঁচুতে।
মহাভারতের এই ধারণা গুলো অনেকবার ঘুরে ঘুরে আসবে। এই কারণেই মহাভারতের কথা খুব মন দিয়ে বারবার শুনতে বলা হয়। বাইবেল, কোরানের সব কথা হল ঋষির কথা, যদিও বলা হয় ভগবান বলেছেন, কিন্তু আমরা এগুলোকে ঋষি-বাক্য রূপেই দেখব। যখন কোন ধর্মগ্রন্থে একজন মাত্র ঋষির কথা চলতে থাকবে তখন সেটা একদেশী ও একঘেঁয়ে হয়ে যাবে, যখন দশ জন ঋষির কথা হবে তখন তার মধ্যে অনেক ধরণের চিন্তা ভাবনার সমাবেশ পাওয়া যাবে। ভীষ্ম এটাই বলছেন, পরম্পরাতে বলা হয়ে আসছে মায়ের মত গুরু হয় না, মা-বাবার স্থান অনেক উঁচুতে। ঠিকই বলা হচ্ছে, এখানে কোন সন্দেহ নেই। বলেই আবার বলছেন মা-বাবার এই স্থান সাধারণ জীবনের জন্য ঠিকই বলা হচ্ছে কিন্তু আধ্যাত্মিক জীবনে নয়। আধ্যাত্মিক জীবনে যিনি গুরু তিনিই শ্রেষ্ঠ। গুরুর কথা বলার পর বলছেন, যখন গুরুকে পূজা, শ্রদ্ধা, সম্মান করে প্রসন্ন করা হয় তখন দেবতা ঋষি এরা সবাই খুশী হন। এই হল সংক্ষেপে ধর্ম পালনের মূল কথা। তবে জেনে রেখো মা-বাবা যে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, সেই সন্তান বড় হয়ে যদি বৃদ্ধ মা-বাবার দেখাশোনা না করে তাহলে এর মত পাপাত্মা আর কেউ হতে পারে না।
মহাভারত/স্বামী সমর্পণানন্দজীর ভাষ্য/
সংকলনে- শ্রীকৃষ্ণকমল (মিন্টু)
খুব সুন্দর উপমা
উত্তরমুছুন