sanatansangbed

Introduction of SANATAN dharma scriptures

আচার্য শঙ্কর প্রণােদিত গীতার সম্বন্ধভাষ্য-১০

গীতার চতুর্থ অধ্যায়েও ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে এই কথা বলবেন, 'স কালেনেহ মহতা যোগ নষ্টঃ পরন্তপ' আমি তোমাকে যে যোগের কথা বললাম এই যোগ কালের নিয়মে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। অনেকদিন ধরে একটা জিনিষ কে যখন অনুশীলন করতে থাকা হয় ধীরে ধীরে সেটা নষ্ট হয়ে যায়। ধর্ম ও অধর্মের দ্বারা চাপা পড়ে যায়। অধর্ম মানেই কাম। কাম মানে এখানে যে কোন ধরণের কামনা-বাসনা। কামনার ধর্ম হল বিবেক ও বিজ্ঞান কে চাপা দিয়ে দেওয়া। অন্যদিক থেকে বলা হয়, সেই শুদ্ধ সচ্চিদানন্দই আছেন, ঈশ্বর ছাড়া কিছু নেই। কিন্তু সেই শুদ্ধ সচ্চিদানন্দের উপর একটা মায়ার আবরণ পড়ে যায়। এই মায়ার আবরণকে সংস্কৃতে বলে অবিদ্যা। অবিদ্যা আবার কামনা-বাসনার জন্ম দেয়। অবিদ্যা যেখানে থাকবে সেখানে কামনা বাসনা ও থাকবে মোদ্দা কথা। হল অবিদ্যা মানেই কামনা-বাসনা। কামনা যখন জন্ম নেয় তখন সেখানে অপূর্ণতার ভাব এসে যায়। যার মধ্যে অপূর্ণতার ভাব আসবে সে নিজেকে পূর্ণ করতে চাইবে। নিজেকে পূর্ণ করতে চাইলে তাকে কর্ম করতে হবে। যত কর্ম করতে থাকবে তত অবিদ্যা ও বাড়তে থাকবে। যার অবিদ্যা যত বেশী তার কামনা তত বেশী হবে। যত কামনা বেশী হবে তত বেশী বেশী কাজ করবে। যত বেশী কাজ করতে থাকবে তত অবিদ্যা ও বাড়তে থাকবে। এটাকেই বলে ভিসাস সাইকেল, এই ভিসাস সাইকেল থেকে কিছুতেই বেড়িয়ে আসা যায় না। আচার্য এটাকেই বলছেন 'কামোদ্ভবাৎ হীয়মানবিবেকবিজ্ঞান' কামের জন্য বিবেক-বিজ্ঞান হীয়মান হয়ে গেল। বিবেক বিজ্ঞান চাপা পড়ে গেলে অজ্ঞান এসে যাবে। অজ্ঞান এসে গেলেই কামনা এসে যাবে কামনা চরিতার্থ করার জন্য কাজ করতে হবে। কাজ করলে আবার অজ্ঞান এসে যাবে, এইভাবে পর পর চলতেই থাকবে।
সেমেটিক ধর্মে এই অবিদ্যাকেই বলে Original Sin. আদম আর ঈভ ছিল স্বর্গে। ভগবান তাদের স্বর্গের বৃক্ষের ফল খেতে নিষেধ করেছিলেন। এই ফলটাই হল অজ্ঞান ফল। কিন্তু আদম আর ঈভের মনে হল, একবার খেয়ে দেখিই না কি হয়। যখন অজ্ঞান ফল খেয়ে নিল তখন আদমের প্রথম বোধ হল আমি পুরুষ সে নারী। উপনিষদেও আছে যখন শুদ্ধ সচ্চিদানন্দ ব্রহ্মের ইচ্ছা হল সৃষ্টি করব তখন তার প্রথম বোধ হল অহম্ অস্মি আমি আছি এই আমি বোধটা এসে গেল। বাইবেলেও বলছে আদমের বোধ হল আমি পুরুষ আর সে নারী। ভগবান যখন আদমের সম্মুখে হাজির হয়েছেন তখন তো তাদের পুরুষ নারী বোধ হয়ে গেছে ভগবানকে দেখেই গাছের পাতা ছাল দিয়ে নিজেদের শরীরকে আচ্ছাদন করতে চাইল। ভগবান খুব রেগে গেলেন, তোমরা নিশ্চয়ই এই বৃক্ষের ফল খেয়েছ তোমাদের তো নারী-পুরুষ বোধ হওয়ার কথা নয়। তার মানে যিনি অবিভক্ত, অভেদ তাঁর মধ্যে ভেদ জ্ঞান এসে গেছে। যেখানে পুরুষ-নারীর ভেদ নেই সেখানে কি আছে, যা আছে সেটা মুখে বলা যাবে না। এরপর ভগবান আদম আর ঈভ কে স্বর্গ থেকে চ্যুত করে দিলেন। এটাই খ্রীশ্চানদের কাছে আদি পাপ। আমাদের কাছে Original Sin বলে কিছু নেই। ভগবান এদের নিষেধ করেছিলেন এই বৃক্ষের ফল খেতে। ঈশ্বরের আদেশ পালন না করার জন্য তাদের পাপ হয়েছে সে পাপের জন্য তাদের স্বর্গ থেকে নিষ্কাশিত করে দেওয়া হল। মুসলমানরা আবার বলবে গফ্‌লা, একটা ভুল হয়ে গেছে। হিন্দুদের কাছে পাপ বলে কিছু নেই গফলা বলেও কিছু নেই। হিন্দুরা বলবে অবিদ্যাই সবকিছুর মূলে। অবিদ্যার কাজই হল যেটা আছে সেটা কে ঢাকা দিয়ে অন্য একটা কিছু দেখিয়ে দেওয়া। আর যেটা নেই সেটা কে সামনে নিয়ে আসবে। ম্যাজিকে ও তো তাই হয়। জাদুকর একটা কলম কে দেখিয়ে ঢাকা দিয়ে দিল, তারপর ঢাকনটা খুলে দিতেই সেখান থেকে বেরিয়ে এলো একটা পায়রা। সেইজন্য অনেকে মায়ার সাথে ম্যাজিক কে এক করে ফেলে। কিন্তু জিনিষটা এক নয়। মায়া মানে অবিদ্যা সচ্চিদানন্দের মধ্যে অবিদ্যার আবরণ এসে গেছে যার জন্য তাঁর মধ্যে কাম এসে গেছে। কি কাম, আমি এক আমি বহু হব। আমি এক আমি বহু হব-এটাই অজ্ঞান,এটাই অবিদ্যা। এটাকেই মুসলমানেরা বলে গাফলা, খ্রীশ্চানরা বলে Original Sin. 
ইচ্ছা মানেই কাম, আমি এক আমি বহু হব এটাই কাম। বহু হতে গেলে সৃষ্টির কাজ করতে হবে, কামনা থেকে কর্ম এসে গেল। এক থেকে বহু হয়ে গেল। বহু হয়ে গেলে এদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। যেমনি খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা হল তেমনি অবিদ্যা ও বেড়ে গেল। এরপর গুটি পোকার মত নিজের চারিদিকে অবিদ্যার জাল বুনতেই থাকে, চাইলেও আর সেখান থেকে নিজেকে বের করে আনতে পারেনা।
মানুষের মধ্যে বিবেক বিজ্ঞান চাপা পড়ে যাওয়া মানেই অধর্মের বৃদ্ধি হওয়া। আর বিবেক বিজ্ঞান যার জাগ্রত, মানে তার ধর্মটাও জাগ্রত। লড়াই মূলতঃ ধর্ম আর অধর্মের মধ্যে। যদি কেউ প্রশ্ন করে ধর্ম ও অধর্ম কি এর একটাই উত্তর বিবেক বিজ্ঞান জাগ্রত মানেই ধর্ম আর বিবেক বিজ্ঞান চাপা থাকা মানেই অধর্ম। কখন বিবেক-বিজ্ঞান বেশী থাকে কখন বিবেক-বিজ্ঞান কম থাকে। এখন চারদিকে তাকালে দেখা যাবে, যে যা পারছে তাই করে যাচ্ছে। তার মানে বিবেক বিজ্ঞান চাপা পড়ে গেছে আর তার ফলে অধর্মের জোর বেড়ে গেছে। ভগবান ধর্ম করেছিলেন জগতঃ স্থিতিকারণ। এখন ধর্মটা চাপা পড়ে গেছে আর অধর্মের রমরমা। তাহলে জগতের কি অবস্থা হবে, জগতের স্থিতি নষ্ট হয়ে অনবস্থায় চলে যাবে। চারিদিকে তাকিয়ে দেখুন একটা পিওন থেকে শুরু করে উপর মহল পর্যন্ত সবাই ঘুষ নিচ্ছে সবাই চুরি করছে। 
মহাপুরুষরা বলছেন সাধু কামিনী কাঞ্চন থেকে সব সময় দূরে থাকবে। সাধুর ষোল আনা ত্যাগ দেখে গৃহস্থ এক আনা ত্যাগ করতে সাহস পাবে। কিন্তু এখন বাবাজীদের কাছে কামিনী-কাঞ্চন ছাড়া আর কিছু নেই। যাঁর কাজ হল ধর্মের রক্ষা করা, সেই রক্ষকই এখন কামিনী কাঞ্চনের মধ্যে নিমগ্ন হয়ে আছে। ধর্মটা একেবারে ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।
ধর্মের এই অবস্থা হলে ভগবান তখন কি করেন, 'স আদিকর্তা' সেই আদিকর্তা যিনি তিনি তখন ধর্মকে রক্ষা করার জন্য অবতীর্ণ হন। আদি কর্তা কে, আদি কর্তা ব্রহ্মা নন, ব্রহ্মার পেছনে যিনি প্রকৃতি তিনিও আদি কর্তা নন। আদি কর্তা হলেন ঈশ্বর। ঈশ্বর থেকেই সৃষ্টি হয়। এই আদি কর্তা যিনি তাঁর একটি নাম নারায়ণ। আদি কর্তার যে কোন নাম হতে পারে, এই রকম তাঁর আরেকটি নাম নারায়ণ বা বিষ্ণু 'নারায়ণাখ্যোবিষ্ণুঃ' যিনি বিষ্ণু তাঁরই একটা নাম নারায়ণ। নার মানে জল যিনি জলে বাস করেন। ভগবান আদি জল, যেটা কে কারণ সলিল বলা হয়, সেই কারণ সলিলের উপর শয়ন করে আছেন বলে তাঁর নাম নারায়ণ। নারায়ণ শব্দের আরেকটা অর্থ হতে পারে, নরঃ অয়ন অর্থাৎ মানুষের মধ্যে আয়ন মানে অন্তর্যামী রূপে বিরাজ করে আছেন বলে তাঁর নাম নারায়ণ। নারায়ণ একটা generic নাম বিশেষ, যেমন গড একটা generic নাম, অর্থাৎ ব্যাপক অর্থে নারায়ণ নাম। কিন্তু যখন নির্দিষ্ট একটা নাম হবে তখন তাঁকে বিষ্ণু বলবে। বিষ্ণু নামটা ভগবানের specific নাম। ঈশ্বর হল ব্যাপক অর্থে আর দেবতা হল বিশেষ নাম, যদিও ঈশ্বর আর দেবতা বা নারায়ণ আর বিষ্ণুর মধ্যে কোন তফাৎ নেই। কিন্তু মুসলমানরা দেবতাকে আল্লা বা ঈশ্বর বলবে না। সংস্কৃতে যত শব্দ আছে সব শব্দেরই একটা ধাতু থাকবে। বিষ্ণু শব্দের ধাতু হল বি বিমানে সব কিছু আচ্ছাদন করা যিনি পুরোটাই ছেয়ে আছেন। বিষ্ণু মানে যিনি সবকিছু কে আচ্ছাদন করে আছেন। ঈশ্বর মানেও তাই ঈশ্ ধাতু থেকে ঈশ্বর শব্দ এসেছে। ঈ মানে শাসন করা। যিনি সবাই কে শাসন করেন তিনি হলেন ঈশ্বর। আবার অনেক জায়গায় বলে বিষ্‌ মানে ভেতরে ঢুকে যাওয়া। অন্তর্যামী রূপে ভগবান সমস্ত প্রাণীর মধ্যে ঢুকে আছেন বলে তাঁর নাম বিষ্ণু। আবার যখন ঈশ্বর রূপে সমগ্র বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডকে নিয়মের মধ্যে চালনা করছেন তখন সেই ঈশ্বরকেই বলছেন বিষ্ণু। ঈশ্বরের এটাই খুব বিচিত্র বৈশিষ্ট্য, আমার আপনার সবার এবং সমস্ত প্রাণীর মধ্যে অন্তর্যামী রূপে চালনা করছেন তিনিও ঈশ্বর আবার বাইরেও যিনি পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে চালনা করছেন তিনিও ঈশ্বর, দুটো সেই একই ঈশ্বর। এই জায়গাতে এসে অন্যান্য মতের সাথে বিরোধ লাগে। খ্রিষ্টান ধর্ম ইসলাম ধর্ম এবং মাধ্বাচার্যের দ্বৈতবাদীরা কখনই এটা মানবে না যে, যিনি ভগবান তিনিই আমাদের ভেতরে অন্তর্যামী রূপে আছেন। অন্তর্যামীর রূপে যিনি ভগবান আর বাইরে যিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড চালাচ্ছেন এঁরা দুজন যে সেই একই ভগবান এই মতকে তারা মানবে না। তারা বলবে পূর্ণ আর অংশ। ঈশ্বর যিনি তিনি পূর্ণ আর আমার আপনার ভেতরে যিনি অন্তর্যামী তিনি অংশ।
ক্রমশঃ

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.