sanatansangbed

Introduction of SANATAN dharma scriptures

আচার্য শঙ্কর প্রণােদিত গীতার সম্বন্ধভাষ্য-০৯

গতপর্বে আমরা জেনেছি, জ্ঞানীর ভেতরের লক্ষণ। বাইরে তাঁর পূর্ণ বৈরাগ্য, জগতের কোন কিছুর প্রতি তাঁর আসক্তি নেই। এ প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ- 
এক বেদান্তী ছিলেন, যিনি মুখে সব সময় বেদান্তের বড় বড় বুলি আওড়াতেন আর অন্য দিকে লম্পট গিরি করে বেড়াতেন। মহাপুরুষ তাকে একদিন বলছেন - তুমি একদিকে বলে বেড়াও জগৎ মিথ্যা আর অন্যদিকে এসব কি করে বেড়াচ্ছ, সেই লোকটি বলছে কেন, জগৎ যখন মিথ্যা তখন এগুলো ও তো মিথ্যা। মহা পুরুষ বলছেন- তোমার এই বেদান্ত জ্ঞানে নিন্দনীয়। এর অর্থ হল, তুমি একদিকে বলবে আমি পূর্ণ জ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত আর যেখানে তোমার বৈরাগ্য দেখানোর কথা সেখানে তুমি বলছ এটা মিথ্যা।
আমি তোমাকে পূর্ণ বৈরাগ্যে দেখতে চাই, কিসে পূর্ণ বৈরাগ্য, কামিনী-কাঞ্চনে। যেখানেই দেখা যাবে কামিনী-কাঞ্চনে সামান্য তম আসক্তি আছে তার মানে সেখানে জ্ঞান ও শূন্য। একটু দুর্বলতা আছে কিন্তু জ্ঞান আছে। এটা কখনই হয় না। জ্ঞান একটু কম আছে বলা মানে জ্ঞান শূন্য। জ্ঞানের ব্যাপারে হয় পূর্ণ জ্ঞান আছে তা না হলে একটুও জ্ঞান নেই। যদি পূর্ণ জ্ঞান থাকে তাহলে একশ ভাগ বৈরাগ্য ও থাকবে। যদি পূর্ণ জ্ঞান না থাকে তাহলে বৈরাগ্যের তারতম্য থাকবে, কারোর বেশী বৈরাগ্য থাকতে পারে, কারোর কম বৈরাগ্য থাকতে পারে। যদি বলে আমার বৈরাগ্য মোটামুটি হয়ে গেছে একটু বাকী আছে তার মানে তার জ্ঞান এখনও হয়নি। যাঁর জ্ঞান হবে তাঁর পূর্ণ বৈরাগ্য হবে। নিবৃত্তি লক্ষণ ধর্মের লক্ষণ হল পূর্ণ জ্ঞান ও পূর্ণ বৈরাগ্য। এখনও আমি পাঁচ রকম জিনিষের প্রতি ছুটে যাচ্ছি আমাকে পাঁচটা জিনিষ জানতে হবে তাহলে বুঝতে হবে আমার এখনও অনেক গোলমাল আছে। তারপরে বলছেন- 
দ্বিবিধো হি বেদোক্ত ধর্মঃ, প্রবৃত্তিলক্ষণো নিবৃত্তিলক্ষণশ্চং জগতঃ স্থিতি কারণম্। প্রাণিনাং সাক্ষাদ্যুদয়-নিঃশ্রেয়সহেতুঃর্যঃ স ধর্মো ব্রাহ্মণাদ্যৈবর্ণিভিরাশ্রমিভিশ্চ শ্ৰেয়োর্থিভিষ্ঠীয়মানঃ। দীর্ঘেণ কালেন অনুষ্ঠাতৃণাং কামোদ্ভবৎ হীয়মানবিবেকবিজ্ঞানহেতুকেন অধর্মেণ অভিভূয়মানে ধর্মে প্রবর্ধমানে চ অধর্মে জগতঃ স্থিতিং পরিপিপালয়িষুঃ স আদিকর্তা নারায়ণাখ্যো বিষ্ণুভৌমস্য ব্ৰহ্মণো ব্রাহ্মণত্বস্য চাভিরক্ষণার্থং দেবক্যাং বসুদেবাৎ অংশেন কৃষ্ণঃ কিল্‌ সম্বভূব। ব্রাহ্মণত্বস্য হি রক্ষণেন রক্ষিতঃ স্যদ্বৈদিকো ধর্মঃ তদধীনত্বাৎ বর্ণাশ্রমভেদনাম্।

'দ্বিবিধোহি বেদোক্ত ধর্মঃ প্রবৃত্তিলক্ষণো নিবৃত্তিলক্ষণশ্চং জগতঃ স্থিতি কারণম্‌'- এই বাক্যটি গীতাতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বেদে পরিষ্কার দুটি ধর্মের কথা বলা হয়েছে - প্রথমটি প্রবৃত্তি লক্ষণ ধর্ম আর দ্বিতীয়টি নিবৃত্তি লক্ষণ ধর্ম। প্রবৃত্তি লক্ষণ ধর্ম মানে কাজকর্ম ক্রিয়া কর্ম করা। বেদে যে এত রকম যজ্ঞের কথা বলা হয়েছে নানা রকমের দান, এখন যেমন সেবা কার্যের কথা বলা হচ্ছে এগুলো সবই প্রবৃত্তি লক্ষণ ধর্ম। আর দ্বিতীয় যে ধর্মের কথা বলা হয়েছে নিবৃত্তি লক্ষণ ধর্ম, মানে পূর্ণ জ্ঞান আর পূর্ণ বৈরাগ্য, সে আর গৃহে থাকবে না, ঘুরে বেড়াবে। একটা গৃহস্থের ধর্ম আরেকটি সন্ন্যাসীর ধর্ম। সন্ন্যাসী মানে এখানে শুধু গেরুয়া ধারী সন্ন্যাসীদের কথা বলা হচ্ছে না যিনি নিবৃত্তি লক্ষণ ধর্মে আছেন তাঁর কোন কিছুর চাহিদা থাকবে না। তিনি পূর্ণজ্ঞান আর পূর্ণবৈরাগ্যে প্রতিষ্ঠিত।
ধর্ম কাকে বলে, ধর্মের কি লক্ষণ, আচার্যের মতে ধর্ম হল জগতঃ স্থিতি কারণ প্রথম লক্ষণ হল জগতের স্থিতির কারণ। ধর্মের কাজ হল জগতের স্থিতি রক্ষা করা। যে ধর্ম অন্য ধর্মের লোকেদের বোমা মেরে খুন করে যাচ্ছে এতে জগতের স্থিতি রক্ষা হচ্ছে না, তার মানে সেই ধর্মকে ধর্ম বলা যায় না। হিন্দুধর্ম দাঁড়িয়ে আছে জগতের স্থিতির কারণের উপর। যদি কোথাও একটু জগতের স্থিতি বিঘ্ন হয় আর সেটা যদি ধর্মের কারণে হয়ে থাকে, তাহলে সেই ধর্ম কখনই ধর্ম নয়। এটাই হিন্দুদের ধর্মের পরিভাষা। 
ধর্মের দ্বিতীয় লক্ষণ হল 'প্রাণিনাংসাক্ষাৎ অভ্যুদয়' প্রাণী মাত্ররেই উন্নতি। তার মানে পশু পাখি নির্বিচারে হত্যা করে তার মাংস খাওয়ার অনুমতি কখনই হিন্দু ধর্ম দেবে না। প্রাণী মানে এখানে সমস্ত রকমের প্রাণীর কথাই বলা হচ্ছে। মেয়ের বিয়ের ভোজে লোক খাওয়ানোর জন্য একশটা মুরগী কেটে, অনেকগুলো ছাগল কেটে তার মাংস খাওয়ানো, এগুলো আমাদের ধর্ম কখনই অনুমতি দেবে না। আবার একজন লোক অন্য লোকদের পিষে দিনে দিনে বড়লোক হয়ে যাচ্ছে এটাকেও ধর্ম কখন অনুমতি দেবে না। ধর্মের কাজই হল প্রাণী মাত্রেরই অভ্যুদয় করা। যদি দেখা যায় ধর্ম পালন করে মানুষ আরও গরীব হয়ে যাচ্ছে তাহলে বুঝতে হবে সেই ধর্মে কিছু গোলমাল আছে তা না হলে সেই ধর্মকে ধর্ম বলে জানার মধ্যে কোথাও গোলমাল আছে। ধর্ম কখনই কোন ধরণের শোষণ করবে না। যে ধর্ম পালন করে মানুষ যে অবস্থায় আছে সেই অবস্থা থেকে আরও উপরের দিকে উঠে যায়, সেটাই ঠিক ঠিক ধর্ম।
ধর্মের তৃতীয় লক্ষণ হল নিঃশ্রেয়স হেতু নিঃশ্রেয়স মানে মুক্তি। সব থেকে যেটা শ্রেষ্ঠ যেটা শেষ কথা সেটাই নিঃশ্রেয়স। মহাপুরুষরা বার বার বলেছেন মানব জীবনের উদ্দেশ্য হল ঈশ্বর দর্শন, এরও মানে সেই নিঃশ্রেয়স। ধর্মের এই তিনটে কাজ। ব্যক্তি স্তরে ধর্ম সমস্ত প্রাণী কে উন্নতির দিকে নিয়ে যাবে আর মানুষ কে মুক্তির দিকে নিয়ে যাবে আর সামাজিক স্তরে স্থিতিশীলতা দেবে। এই তিনটে কাজ যদি না হয় তাহলে সেটা কখনই পূর্ণ ধর্ম হবে না। এটাই জগৎ স্থিতি। যে কোন ধর্মের কাজই হল এই তিনটে – সাংসারিক উন্নতি, আধ্যাত্মিক মুক্তির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া আর সমাজের স্থিতিশীলতা রক্ষা করা। এই তিনটে কাজ যদি না হয় এর কোন একটা যদি কম হয় তাহলে সেই ধর্মে গোলমাল থাকতে বাধ্য।
বেদ যে কত উচ্চমানের এক দর্শনচিন্তা করা যায় না। বেদের জন্ম আমাদের দেশেই অথচ এখন এই দেশের কি দুরবস্থা একের পর এক আইন হয়ে যাচ্ছে কিন্তু দেশটা দিন দিন দুর্নীতি আর অরাজকতায় ডুবে যাচ্ছে। মানুষ এত উচ্চ ধর্ম পালন করেও দেশের এই হাল কেন হয়েছে, সেটাই আচার্য বলছেন– 'দীর্ঘেকালেন অনুষ্ঠাতৃণাং' অনেকদিন ধরে এই ধর্ম পালন করতে করতে ধর্মের মধ্যে একটা গ্লানি জন্মায় এবং ধর্ম নীচের দিকে চলে যায়। কেন এই রকম হয়, 'কামোদ্ভবাৎ' যারা এই ধর্মের পালন করছে তাদের মনের মধ্যে অনেক কামনা বাসনা ঢুকে যায়। কারণ জপ ধ্যান যদিও করে যাচ্ছে কিন্তু নিবৃত্তি লক্ষণ ধর্মে প্রতিষ্ঠিত নয় পূর্ণজ্ঞান বৈরাগ্যে প্রতিষ্ঠিত নয়। যার জন্য সেবা কার্য যেটা প্রবৃত্তি লক্ষণ ধর্ম তাতে ডুবে আছে। সেবা কাজের জন্য একটা গাড়ির দরকার কিছু ব্যাংক ব্যালেন্স দরকার, এগুলো জোগাড় করতে গিয়ে নিজের মধ্যেও কামনা বাসনা জন্ম নিচ্ছে। এগুলো যে কেউ জেনে বুঝে করছে তা নয়, এটা প্রকৃতির নিয়মে হয়ে যায়। প্রবৃত্তি লক্ষণ ধর্মে সব সময় পড়ে থাকলে প্রকৃতির নিয়মে একটা সময়ে কাম বাসনার উদয় হবে। এইভাবেই অনেক উচ্চ আদর্শ নীচের দিকে নেমে আসে।
ক্রমশঃ
নিবেদনে- সনাতন সংবেদ। 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.