ঋগ্বেদ সংহিতা ভূমিকা-১৪(বেদ-বিভাগ)
বেদ বিভাগ সম্বন্ধে নানা মত প্রচলিত আছে। এক বেদ তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে ‘ত্রয়ী’ নামে পরিচিত হয়েছিল, এবং বেদব্যাস কর্ত্তৃক উহা ঋক্, যজুঃ, সাম, অথর্ব্ব চার বিভাগে বিভক্ত হয়েছিল,- এ বিষয়ে আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। এক শ্রেণীর পণ্ডিতগণ বেদকে আর এক ভাবে তিন ভাগে বিভক্ত করেন। তাঁদের মতে-
(১) ক্৯প্ত ও কল্প্য ভেদে বেদ দ্বিবিধ;
(২) কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড ভেদে দ্বিবিধ;
(৩) মন্ত্র ও ব্রাহ্মণভেদে দ্বিবিধ।
এ হিসাবে তিন ভাগের মধ্যে ছয় বিভাগ পরিকল্পিত হয়। প্রথম বিভাগের অন্তর্গত ক্৯প্ত ও কল্প্য বলতে কি বুঝা যায়? “যা-তু প্রত্যক্ষতঃ প্রতিপদ্যতে সা ক্৯প্ত।” যা প্রত্যক্ষ বলে প্রতিপন্ন হয়, তাই ক্৯প্ত। যে স্তবস্তুতি অক্ষয়-রচিত অর্থাৎ লেখা হয়েছে, তারই নাম-ক্৯প্ত শ্রুতি; কেন-না, সেগুলি প্রত্যক্ষ হয়ে থাকে। ঋক, যজুঃ, সাম, অথর্ব্ব- এই চতুর্ব্বেদ গ্রন্থাকারে নিবদ্ধ। ইহা ক্৯প্ত শ্রুতির অন্তর্গত। ক্৯প্ত শ্রুতি গ্রন্থভেদে চার প্রকার এবং মন্ত্রভেদে তিন প্রকার। গ্রন্থ-ঋগ্বেদ, যজুর্ব্বেদ, সামবেদ, অথর্ব্ববেদ; আর মন্ত্র-ঋকমন্ত্র, যজুর্ম্মন্ত্র ও সামমন্ত্র। ঐরূপ ক্৯প্ত শ্রুতি ব্যতীত আর এক প্রকারের শ্রুতির বিষয় বলা হয়ে থাকে। যা কিছু সত্য সংসারে আছে, যা কিছু সৎকর্ম সংসারে সম্ভবপর, সেগুলি চিরকাল অপরিবর্ত্তিত ভাবে বিদ্যমান রয়েছে। সে সকল নিত্য-সত্য ঐ চতুর্ব্বেদের অন্তর্ভুক্ত না হলেও সেগুলিও বেদ মধ্যে গণ্য। সেই সকলের নাম-কল্প্য-শ্রুতি। বেদ অনন্ত বলে যাঁরা বিশ্বাস করেন, ঐ চতুর্ব্বেদের মধ্যে যাঁরা বেদকে সীমাবদ্ধ করতে প্রস্তুত নন, তাঁরাই কল্প্য-শ্রুতির পরিপোষক। তাঁদের নাম-অনন্তবাদী। তাঁরা বলে থাকেন,- “যা তু স্মৃতিসদাচারাভ্যাং অনুমীয়তে সা কল্প্য-শ্রুতিঃ।” স্মৃতি আর সদাচার দ্বারা যা অনুমান করা যায়, তাকেই কল্প্যশ্রুতি বলে। দেশভেদে, সমাজভেদে, অবস্থাভেদে বিবিধ সদাচার প্রচলিত আছে। সেই সকল সদাচারকে কল্প্যশ্রুতির অন্তর্ভুক্ত হিসাবে গণ্য করা হয়। লোকপাবন মহর্ষিগণ সমাজের শৃঙ্খলা-রক্ষার জন্য বহু বিধি-নিষেধ নিয়ম প্রবর্তন করে গেছেন। সে সকল জন হিতকর বিধান পরম্পরা কল্প্যশ্রুতি মধ্যে গণ্য হয়। দ্বিতীয় বিভাগ-কর্ম্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড নিয়ে। যাগযজ্ঞের উপযোগী চতুর্ব্বেদ ও ব্রাহ্মণ সমূহ কর্মকাণ্ডের অন্তর্গত; এবং উপনিষদ জ্ঞানকাণ্ডের পর্য্যায়ভূক্ত। যাতে কর্মের উপদেশ পাওয়া যায়, তাই কর্ম্মকাণ্ড; আর যা কেবল জ্ঞান উন্মেষকর, তাই জ্ঞানকাণ্ড অন্তর্ভুক্ত। তৃতীয় বিভাগ- মন্ত্র ও ব্রাহ্মণ নিয়ে। “মননাৎ মন্ত্র”; অর্থাৎ যা দ্বারা ইষ্টবস্তুর মনন বা স্মরণ করিয়ে দেয়, তাই মন্ত্র। দেব আদির উপাসনার উপযোগী যে বাক্য বা পদ, তাকেই মন্ত্র বলে। “অগ্নিমীলে পুরোহিতং” ইত্যাদি যে ঋক্, উহা উপাসনা-মূলক; সুতরাং মন্ত্র-মধ্যে গণ্য। ব্রাহ্মণ-মন্ত্র-সকলের ব্যাখ্যা-মূলক। যজ্ঞের বিনিয়োগ অর্থাৎ প্রয়োগ বা অর্পণ, ব্রাহ্মণ শিক্ষা দেয়। বেদের ব্রাহ্মণভাগ দ্বিবিধ;- (১)বিধিবাদ ও (২) অর্থবাদ। বিধিভাগ অজ্ঞাত বিষয় সম্বন্ধে জানান দেয়, অপ্রবৃত্ত অননুষ্ঠিত কর্মে প্রবৃত্ত করে। স্তুতিবাদেরই নামান্তর-অর্থবাদ। যে অংশ স্তবস্তুতিমূলক, তাই অর্থবাদের অন্তর্নিবিষ্ট। এই সকল আলোচনায় প্রতিপন্ন হয়,-ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষৎ প্রভৃতি নিয়ে বেদ সম্পূর্ণ। উপনিষদ আদিও বেদের অন্তর্ভুক্ত।
ক্রমশ-
নিবেদনে- সনাতন সংবেদ।
নিবেদনে- সনাতন সংবেদ।
কোন মন্তব্য নেই