sanatansangbed

Introduction of SANATAN dharma scriptures

আধ্যাত্মিক তত্ত্বকে মূর্ত করার জন্যই মূর্তি-

জগন্নাথ দেব
(রথযাত্রার কৃষ্ণময় প্রীতি শুভেচ্ছা)
আমরা মনে করি- দেবদেবীর মূর্তি দর্শন করতে পারলেই সাধনার শেষ অথবা জীবনের চরিতার্থতা লাভ হয়। আচার্য'রা বলেন, মূর্তিদর্শন হলেই ঈশ্বরলাভ অথবা মুক্তি হয় না। উহা ঈশ্বর-লাভ বা মুক্তির পথে বিশেষ অনুকূল গুরুকৃপামাত্র। যে বস্তু মূর্তিরূপে প্রকাশ পায়, তাঁকে জানতে হবে, তার স্বরূপ বুঝতে হবে। অবশ্য এই যে জানা বা বুঝা তাও তাঁরই কৃপায় হয়ে থাকে। ঈশ্বর লাভ হলে-সাধক-হৃদয়ে ঈশ্বরধর্ম কিছু না কিছু অবশ্যই প্রকাশিত হয়।
সর্বদেবতার শরীর থেকে সমান উদ্ভূত যে তেজোরাশি, সেটাই বিশ্বময় বিরাটমূর্তিতে পরিণত হয়। এবং বিশ্বই যে পরমেশ্বরের মূর্তি, এটা উপলব্ধি করতে পারি। ভক্ত প্রবর অর্জুন ভগবানের এই বিশ্বরূপ দেখেই সমস্ত সংশয়ের পরপারে চলে গিয়েছিলেন। মায়াবচ্ছিন্ন চিদাভাসই বলুন, হিরণ্যগর্ভই বলুন, কিংবা মহাত্মাই বলুন, তাতে কিছু ক্ষতি বৃদ্ধি নেই; আসল কথা-ঐ সৰ্বেন্দ্ৰিয় ধর্ম সমন্বিত স্বরূপটির আবির্ভাব যতদিন না হয়-ততদিন জড়ত্বজ্ঞান অপনীত হয় না, হৃদয়ের গ্রন্থিভেদ হয় না, সংশয় বিদূরিত হয় না। এই কথাটি ভালভাবে বুঝানোর জন্যই সাধনায় মুর্তির বিভিন্ন অবয়ব স্থাপন ও বর্ণনা করা হয়।
শ্রীপুরুষোত্তম-ক্ষেত্রে যে দারুময় জগন্নাথমুর্তি প্রতিষ্ঠিত আছে, উহাও এই সৰ্ব ইন্দ্ৰিয় বিবর্জিত সৰ্বেন্দ্ৰিয় ধর্মের স্থূল প্রতিবিম্বমাত্র। কোনও ইন্দ্রিয় নেই, অথচ সকল ইন্দ্রিয়েরই ধর্ম আছে, এমন একটা দুরাধগম্য ভাবকে স্থূলে দেখাতে হলে, উহা হাত-পা বিহীন জগন্নাথ মুর্তি ব্যতীত অন্য কোনওভাবে অভিব্যক্ত করা যায় না। কি সুন্দর! সৎ চিৎ আনন্দস্বরূপ দারুময় জগন্নাথ সুভদ্রা ও বলরাম মূর্তি। হাত পা চোখ কান প্রভৃতির আভাসমাত্র আছে, অথচ উহার একটা অবয়বও নেই! ধন্য তিনি, যিনি এঁর প্রতিষ্ঠাতা। বিশাল মায়াজলধির তীরে- “অপাণিপাদো জবনো গ্রহীতা পশত্যচক্ষুঃ স শৃণোত্যকর্ণঃ" পুরুষোত্তম বিরাজমান। বর্ণধর্ম, আশ্ৰমধর্ম সেখানে বিলুপ্ত। সকলেই সমান-একরস। সমত্বের সমীপে বর্ণভেদ জাতিভেদ তিরোহিত! পূজা নেই, অর্চনা নেই, শুধু দর্শন-আর ভোগ! শুধু দর্শন-আর ভোগ! অতীন্দ্রিয় বস্তুকে এইভাবে ইন্দ্রিয়ভোগ্য করার উপায়- এই ভারতে যত বেশী, তত বুঝি আর কোনও দেশে নেই। এই দেশের ঋষি'রা, এ দেশের সাধক পুরুষ'রা সেই বাক্যমনের অতীত বস্তুকে কত ভাল বাসতেন, কেমন ঘনীভূত প্রেমে সেই পরম পুরুষের সাথে আবদ্ধ থাকতেন, তার একটু প্রমাণ- এ দেশের তীর্থ, এ দেশের বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি, এ দেশের গৃহদেবতা। অতীন্দ্রিয় প্রেম কত ঘন হলে- আত্মহারা হয়, জড় হয়ে যায়, স্থূলে অভিব্যক্তি লাভ করে, তা আমরা ধারণাই করতে পারি না। যতদিন স্থূল দেহ আছে, ততদিন স্থূলের অতীত বস্তুর প্রতি যতই আমরা আসক্তিযুক্ত হই না কেন, স্থূল যে আমাদের একান্ত প্রিয়, তা আর বলে দিতে হয় না। আমরা যে অত্যধিক মাত্রায় স্থূলত্ব প্রিয়, আমাদের দেহই তার প্রকৃষ্ট-প্রমাণ। সুতরাং আমরা আমাদের প্রিয়তমকে ঠিক আমাদেরই মত স্থূলে এনে আদর করব, সেবা করব, ভোগ করব, এটা কত স্বাভাবিক। কত সুন্দর। এ তত্ত্ব চিন্তা করতে গেলেও বিস্ময়ে, আনন্দে অভিভূত হতে হয়।
যারা তীর্থ, দেবমূর্তি প্রভৃতিকে অজ্ঞান-কল্পিত ও স্বার্থপর ব্রাহ্মণগণের অর্থোপার্জনের কৌশলমাত্র বলে উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করেন, তারা একবার ধীরভাবে এ তত্ত্ব চিন্তা করে দেখবেন। ঐ সকলের মধ্যে অজ্ঞান, ভ্রান্তি এবং প্রবঞ্চনা যে মোটেই নেই-এ কথা বলতে পারি না; কিন্তু একটা মহাসত্যজ্ঞান ও ঘনীভূত প্রেম যে ভারতবাসীর মজ্জাগত সংস্কার, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তীর্থ এবং দেবমূর্তি সমস্ত'ই উহার সমুজ্জ্বল প্রমাণ।
হর ত্বং পাপানাং বিততিমপরাং যাদবপতে। 
অহো! দীননাথং নিহিতমচলং নিশ্চিতপদং 
জগন্নাথঃ স্বামী নয়নপথগামী ভবতু মে॥
হে সুরপতে! তুমি আমার এই অসার সংসার হরণ কর, হে যাদব পতে! তুমি আমার অশেষ পাপভার ও হরণ কর। যিনি দীন ও অনাথ জনে নিশ্চয় চরণ সমৰ্পণ করেন, সেই এই প্ৰভু জগন্নাথ দেব আমার নয়নপথগামী হোন।
তথ্যসূত্র- সাধন সমর, মূর্তি তত্ত্ব, ভারতের দেবদেবী
নিবেদনে- সনাতন সংবেদ। 
শ্রীকৃষ্ণকমল(মিন্টু) 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.