আচার্য শঙ্কর প্রণােদিত গীতার সম্বন্ধভাষ্য-১২
ভগবান নারায়ণ তিনি তাঁর অংশে দেবকী আর বসুদেবের সন্তান রূপে আবির্ভূত হলেন। কেন তিনি অবতার হয়ে আবির্ভূত হলেন, বলছেন 'ভৌমস্য ব্ৰহ্মণো ব্রাহ্মণত্বস্য চাভিরক্ষণার্থং ভৌমস্য' মানে এই পৃথিবীতে, শুধু একটা অঞ্চলের জন্য নয়, শুধু মথুরা বৃন্দাবনের জন্য নয়, সারা বিশ্বের যত ব্রাহ্মণ আছেন তাঁদের ব্রাহ্মণত্ব কে রক্ষা করার জন্য অবতীর্ণ হন। যদিও পুরাণে বলা হয় শ্রীরাম চন্দ্র ত্রেতা যুগের অবতার শ্রীরাম চন্দ্র দ্বাপর যুগের অবতার ইত্যাদি কিন্তু আসলে অবতার অবতীর্ণ হওয়া মানে সত্যযুগ। সত্যযুগ মানেই ব্রাহ্মণের ব্রাহ্মণত্ব রক্ষা। এখানে ব্রাহ্মণ মানে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় বর্ণের কথা বলছেন না। অবতারের একটাই কাজ যেটা আচার্য বলছেন 'ভৌমস্য' সারাবিশ্বে যে ব্রাহ্মণ আছে তার ব্রাহ্মণত্ব রক্ষা করা। ব্রাহ্মণের বৈশিষ্ট্য কি? ব্রাহ্মণের বৈশিষ্ট্য একটি জ্ঞান আর বৈরাগ্য। যে ব্রাহ্মণের মধ্যে জ্ঞান নেই বৈরাগ্য নেই সেই ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণ নয়। জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ কে নিয়ে বলা হচ্ছে না। এখানে বলছেন না যে ব্রাহ্মণদের রক্ষা করার জন্য, বলছেন ব্রাহ্মণের ব্রাহ্মণত্বের রক্ষা। ব্রাহ্মণত্বের রক্ষা মানেই সত্যযুগ। ব্রাহ্মণত্বের রক্ষা মানেই জ্ঞান বৈরাগ্যের রক্ষা। ঠাকুর বলছেন- যদি দেখি পণ্ডিতের মধ্যে বিবেক বৈরাগ্য আছে তখন তার কথা শুনি। আর যদি না থাকে, শকুন তো অনেক উপরে ওঠে কিন্তু নজর ভাগাড়ের দিকে। যে পণ্ডিতের মন কামিনী-কাঞ্চনে পড়ে আছে কামিনী-কাঞ্চনে মন পড়ে থাকা মানেই ভাগাড়ের দিকে নজর সেই পণ্ডিত আর কিসের পণ্ডিত, ভগবানের একটাই কাজ, ধর্ম সংস্থাপন করা। ধর্ম সংস্থাপন কিভাবে করবেন? ব্রাহ্মণের ব্রাহ্মণত্ব রক্ষার দ্বারা। একজন ক্ষত্রিয়ের ব্রাহ্মণত্ব কি, একজন ক্ষত্রিয় যখন কাউকে অস্ত্র শিক্ষা দিচ্ছেন তিনি তখন ব্রাহ্মণের কাজই করছেন। একজন বৈশ্যের ব্রাহ্মণত্ব কি? ব্যবসা সংক্রান্ত কাজ কর্ম শেখান। ইণ্ডিয়ান ইনস্টিউট অফ ম্যানেজমেন্টে যাঁরা অধ্যাপনা করছেন তাঁরা বৈশ্যদের মধ্যে ব্রাহ্মণ। আর ব্রাহ্মণের ব্রাহ্মণত্ব শুধু জ্ঞান আর বৈরাগ্য।
গীতা শাস্ত্রে কিভাবে ভগবানের অবতীর্ণ হওয়া দেখান হয়েছে, ভগবান নারায়ণ যাঁর নাম বিষ্ণু সেই বিষ্ণুর অংশ থেকে 'কৃষ্ণঃ কিল্ সম্বভূবঃ' আচার্যের এটাই বিশেষত্ব, শ্রীকৃষ্ণের যে জন্ম, তাঁর যে লীলা এগুলো কে আচার্য একেবারে খাঁটি সত্য বলে নিচ্ছেন না। বলছেন 'কিল্ সম্বভূবঃ কিল্' মানে লোক মুখে শোনা যায় দেবকী আর বসুদেবের বাড়িতে শ্রীকৃষ্ণ জন্ম নিয়েছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ কে, বিষ্ণুর অংশে তিনি অবতার হয়ে অবতীর্ণ হয়েছেন। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের ব্যাপারে ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণ দিতে হবে। সে এক বিরাট প্রক্রিয়া, সেইজন্য আচার্য বলছেন এই রকম শোনা যায়, তাতে কোন অসুবিধা নেই। আচার্যের মূল বক্তব্য গীতার দর্শন কিন্তু গীতার দর্শন দিয়েছেন শ্রীকৃষ্ণ। তাই শ্রীকৃষ্ণ কে জানতে ইচ্ছে হওয়াটা স্বাভাবিক। আচার্য তাই বলে দিলেন তিনি দেবকী ও বসুদেবের সন্তান। শ্রীকৃষ্ণের বিশেষত্ব কোথায়, ভগবানের বিশেষ শক্তি তাঁর মধ্যে কাজ করছে। কিসের জন্য কাজ করেছেন ব্রাহ্মণের ব্রাহ্মণত্ব রক্ষার জন্য। এইটাই অবতার তত্ত্বের সারাংশ যেটা আচার্য তাঁর ভাষ্যে রেখে দিলেন।
আচার্য একদিকে শ্রীকৃষ্ণকে মানুষ রূপে বলছেন, আবার বলছেন তিনি ভগবান বিষ্ণুর অংশে অবতার আর তার সাথে বলছেন শ্রীকৃষ্ণের কি কাজ-ব্রাহ্মণের ব্রাহ্মণত্ব রক্ষা করা। সারা জীবন যিনি হাজার হাজার মিথ্যা কথা বলে গেলেন, চালাকি ছল-চাতুরী করে গেলেন কত লোককে হত্যা করলেন করালেন মারও খেয়ে গেলেন গোপীদের সঙ্গে লীলা করে গেলেন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে গেলেন, যার জন্য তাঁর নাম হল রণছোড় তাঁর নামে আচার্য বলছেন শ্রীকৃষ্ণের কাজ হল ব্রাহ্মণের ব্রাহ্মণত্ব রক্ষা করা। এই কথা বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের শ্রীকৃষ্ণের ভক্তরা বলছেন না, যিনি গোঁড়া যুক্তিবাদী তিনি বলছেন, সারা বিশ্বের ব্রাহ্মণের ব্রাহ্মণত্ব রক্ষা করার জন্য শ্রীকৃষ্ণের আগমন। এই আপাত বিরোধী বক্তব্যকে যেদিন কেউ মিলিয়ে দিতে পারবেন সেদিন তাঁর কাছে অবতার তত্ত্ব স্পষ্ট হয়ে যাবে।
ক্রমশঃ
কোন মন্তব্য নেই