ঋগ্বেদ সংহিতা ভূমিকা-১৬(ঋগ্বেদ)
প্রথম-ঋগ্বেদ-সংহিতা। সূক্ত, বর্গ, অধ্যায়, অষ্টক, মণ্ডল, অনুবাক্-প্রধানতঃ এই ছয় ভাগে উহা বিভক্ত হয়ে থাকে। কত গুলি বেদমন্ত্র একত্র সমষ্টিবন্ধ ভাবে অবস্থিত হলে, তাকে সুক্ত বলা হয়। এক এক দেবতার স্তবমূলক একত্র নিবন্ধিত যে ঋক্মন্ত্র, তাই সূক্ত নামে অভিহিত হয়ে থাকে। কোনও কোনও স্থানে একই সূক্তে দুই তিন দেবতারও স্তুতি দেখতে পাওয়া যায়। মহাসূক্ত, ক্ষুদ্রসূক্ত, মধ্যমসূক্ত ভেদে সূক্ত বহুবিধ। দশটির অবিধ ঋক্ একত্র নিবদ্ধ থাকলে তা মহাসূক্ত, পাঁচটি পর্য্যন্ত ঋক্ একত্র থাকলে তা ক্ষুদ্রসূক্ত, পাচটির অধিক অথচ দশটির নিচে মন্ত্র-বিশিষ্ট ঋক্ মধ্যম সূক্ত। মহা-সূক্তের দৃষ্টান্ত-স্বরূপ ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডলের দ্বাদশ, ত্রয়োদশ, চতুর্দ্দশ, পঞ্চদশ, দ্বাবিংশ, ত্রয়োবিংশ, চতুর্ব্বিংশ, পঞ্চবিংশ, ষড়বিংশ, সপ্তবিংশ, ত্রিংশ, একত্রিংশ, দ্বাত্রিংশ ও ত্রয়স্ত্রিংশ প্রভৃতি সূক্ত উল্লেখ করা যেতে পারে। ক্ষুদ্র-সূক্তের দৃষ্টান্ত ঐ প্রথম মণ্ডলের এক ঋক্মূলক নবনবতি সূক্ত, ত্রিঋক্-মূলক অষ্ট নবতি সূক্ত এবং পঞ্চ ঋক্মূলক পঞ্চসপ্ততি, ষড়সপ্ততি, অষ্টসপ্ততি প্রভৃতি সূক্ত নির্দ্দেশ করা যায়। মধ্যমসূক্তের দৃষ্টান্তস্বরূপ প্রথম মণ্ডলের প্রথম, দ্বিতীয়, একাদশ প্রভৃতি সূক্ত উল্লেখযোগ্য। ঋষিসূক্ত, দেবতাসূক্ত, ছন্দঃসূক্ত প্রভৃতি ভেদে ঋক্-সমূহকে আরও এক প্রকার তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়ে থাকে। এক এক সূক্তের প্রবর্ত্তক বলে এক এক ঋষির নাম আছে। যেমন, ঋগ্বেদের প্রথম কয়েকটি সূক্তে মধুচ্ছন্দা ঋষির নাম দেখতে পাই। তিনি ঐ সূক্ত-কয়েকটির প্রবর্ত্তক বলে প্রচারিত আছে। এ ভাবে অর্থাৎ যাঁদের নামে সূক্ত-বিশেষ প্রচারিত, তাঁদের অনুসরণে সূক্তগুলি ঋষিসূক্ত নামে পরিচিত হয়। দেবতা-সূক্ত বলতে দেবতার স্তুতিমূলক সূক্তগুলিকে বুঝিয়ে থাকে। যেমন অগ্নি-দেবতার স্তুতিমূলক সূক্ত-আগ্নেয়-সূক্ত, বায়ু-দেবতার স্তুতিমূলক সূক্ত-বায়বীয় সূক্ত, ইত্যাদি। এভাবে সূক্তের বিচার করলে সূক্তগুলিকে দেবতাসূক্ত বলা যায়। ছন্দঃসূক্ত বলতে, একসূত্রে একছন্দে বিরচিত পর্য্যায়ক্রমে বিন্যস্ত সূক্তকে বুঝিয়ে থাকে। যেমন, গায়ত্রী-ছন্দে প্রথম নয়টি সূক্ত রচিত হয়েছে বলেই, ঐগুলিকে গায়ত্রী-ছন্দ অন্তর্গত ছন্দঃ-সূক্ত বলা হয়। এ হিসাবে, সকল সূক্ত উল্লিখিত ত্রিবিধ সূক্তের(ঋষি-সূক্ত, দেবতা-সূক্ত, ছন্দঃ-সূক্ত) অন্তর্ভূক্ত হতে পারে। দৃষ্টান্ত-স্বরূপ প্রথম মণ্ডলের চতুর্থ হতে নবম সূক্ত উল্লেখ করতে পারি। ঐ সূক্ত-কয়টির প্রবর্ত্তক মধুচ্ছন্দা ঋষি। সুতরাং ঐ কয়েকটি সূক্ত ঋষি-সূক্ত পর্য্যায়ের অন্তর্নিবিষ্ট হল। তার পর, ঐ কয়টি সূক্ত গায়ত্রীছন্দে বিরচিত; সুতরাং উহা ছন্দঃ-সূক্ত মধ্যে গণ্য হল। তৃতীয়তঃ, ঐ কয়েকটি সুক্তে ইন্দ্র-দেবতার স্তুতি আছে; এজন্য উহা দেবতা-সূক্ত হল। ঋগ্বেদের দশটি মণ্ডলে সর্ব্বসমেতে ১৯১+৪৩+৬২+৫৮+৮৭+৭৫+১০৪+১০৩+১১৪+১৯১=১০২৮টি সূক্ত আছে। মহর্ষি সনক প্রণীত ‘বৃহদ্দেবতা’ গ্রন্থে সূক্ত ও তাদের লক্ষণ আদি বিবৃত রয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন সূক্তে ঋষি, দেবতা, ছন্দঃ ও বিনিয়োগ দেখতে পাই। যে ঋষির বাক্য বলে যে মন্ত্র পরিচিত, তিনিই সেই মন্ত্রের ঋষি। যে ছন্দে সূক্ত-সমূহ সাজানো হয়েছে, তাই সেই সূক্তের ছন্দঃ। আর যে যজ্ঞে যে সূক্ত বিনিযুক্ত হয়, তাই সেই সূক্তের বিনিয়োগ। ঋষি, দেবতা, ছন্দঃ। আর যে যজ্ঞে যে সূক্ত বিনিযুক্ত হয়, তাই সেই সূক্তের বিনিয়োগ। ঋষি, দেবতা, ছন্দঃ ও বিনিয়োগ বিষয়ে নিরুক্তকার যেমন সংজ্ঞা নির্দ্দেশ করে গেছেন, তা নিন্মে উদ্ধৃত করা হল; যথা,-
“যস্য বাক্যং স ঋষিঃ। যা তেনোচ্যতে সা দেবতা। যদক্ষরপরিমাণং তচ্ছনঃ। অর্থেপ সব ঋষয়ো দেবতাশ্ছন্দোভিরভ্যধাবন্।”
এখনকার-প্রচলিত সাধারণ গ্রন্থ সমূহে যেভাবে খণ্ড, পরিচ্ছেদ, অধ্যায় প্রভৃতি বিভিন্ন বিভাগ দেখা যায়; ঋগ্বেদ তেমনই মণ্ডল, অনুবাক, বর্গ, সূক্ত প্রভৃতিতে বিভক্ত আছে। বোধ হয়, আধুনিক পরিচ্ছেদ আদি গ্রন্থ-বিভাগের এটাই আদিরূপ। অধ্যায়, বর্গ ও অনুবাক্ প্রভৃতি কি নিয়মে প্রবর্ত্তিত হয়েছিল, তার কোনও বিশেষ লক্ষণ অনুসন্ধান করে পাওয়া যায় না। তবে মণ্ডলের সম্বন্ধে একটি লক্ষণ বলা হয়ে থাকে। তাতে বুঝতে পারি, বহুসংখ্যক ঋষির পরিদৃষ্ট মন্ত্রসমূহ একজন ঋষি কর্ত্তৃক একত্রে সংগৃহীত হয়ে এক একটি মণ্ডলের সৃষ্টি হয়েছিল। মণ্ডলের লক্ষণ; যথা- “তত্তদৃষিদৃষ্টাণাং বহূনাং সূক্তানামেকর্ষিকৃতঃ সংগ্রহো মণ্ডলং”। সৌনক ঋষির সর্ব্ব অনুক্রমণিকা গ্রন্থে প্রকাশ আছে,-ঋগ্বেদের দ্বিতীয় মণ্ডল গৃৎসমদ ঋষি সংগ্রহ করেছিলেন। আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্রে দশ মণ্ডলের সংগ্রহকার ঐরকম দশ জন ঋষির নাম উল্লেখ আছে। যথা,-
“শতর্চিনো মাধ্যমা গৃৎসমদো বিশ্বামিত্রো বামদেবোহত্রির্ভরদ্বাজো
বাসিষ্ঠঃ প্রগাথাঃ পাচ্যমান্যাঃ ক্ষুদ্রসূক্তাঃ মহাসূক্তাশ্চ।”
এই মতে শতর্চ্চি প্রথম মণ্ডল সংগ্রহ করেন; গৃৎসমদ কর্ত্তৃক দ্বিতীয় মণ্ডল, বামদেব কর্ত্তৃক চতুর্থ মণ্ডল, অত্রি কর্ত্তৃক পঞ্চম মণ্ডল, ভরদ্বাজ কর্ত্তৃক ষষ্ঠ মণ্ডল, বশিষ্ঠ কর্ত্তৃক সপ্তম এবং প্রগাথা কর্ত্তৃক অষ্টম মণ্ডল সংগৃহীত হয়। এতদ্ভিন্ন, নবম মণ্ডল পাচ্যমান-ঋষিগণ কর্ত্তৃক এবং দশম মণ্ডল ক্ষুদ্রসূক্তীয় ও মহাসূক্তীয় ঋষিগণ কর্ত্তৃক সঙ্কলিত হয়েছিল। বর্গ শব্দের অর্থ-স্বজাতীয়-সমূহ। এ অর্থ অনুসারে এক এক জাতীয় ঋক্ এক এক বর্গ মধ্যে স্থান পেয়েছে, মনে করা যেতে পারে। অনুবাক্-বিভাগেও এক শ্রেণীর ঋক্কে লক্ষ্য করা হয়ে থাকবে। অধ্যায়-ভাগে এক এক অংশে বিভিন্ন দেবতার স্তব পরিদৃষ্ট হয়। ফলতঃ, ঋষিগণ আপন-আপন কার্য্য সৌকর্ষ্যের জন্য অধ্যায় আদির বিভাগ করে নিয়েছেন। ঋগ্বেদের মণ্ডল সংখ্যা-দশটি; অধ্যায়-সংখ্যা চৌষট্টিটি, বর্গ-সংখ্যা দুই হাজার ছয়টি, অনুবাক-সংখ্যা পঁচাশিটি, সূক্তের সংখ্যা এক হাজার সতেরটি। মণ্ডল, অনুবাক্, সূক্ত প্রভৃতির পরিচয়ের সঙ্গে সঙ্গে ঋগ্বেদের ঋক্-সংখ্যা, প্রতি ঋকের পদসংখ্যা ও শব্দাংশের পরিমাণ নির্দ্দিষ্ট আছে। অধিক কি বলব, প্রতি সূক্তে অকারান্ত, আকারান্ত, ইকারান্ত, নান্ত, সান্ত প্রভৃতি যে সকল পদ আছে, সে সকল পদের পরিচয় ও সংখ্যা কত, শাস্ত্রকারগণ তাও নির্দ্দেশ করে গেছেন। যদিও সকল পদসংখ্যা ও শব্দসংখ্যার মিল এখন পাওয়া যায় না; কিন্তু এক সময়ে যে বেদ তন্ন তন্ন করে আলোচিত হয়েছিল, তা বেশ বুঝতে পারা যায়।
ঋগ্বেদের শাখা সমূহ।
ঋগ্বেদের শাখা বিষয়ে নানা মত প্রচলিত। ঋষি শৌনক প্রণীত প্রতিশাখ্যে ঋগ্বেদের পাঁচটি শাখার নাম জানা যায়। শাকল, বাস্কল, আশ্বলায়ন, সাঙ্খ্যায়ন ও মাণ্ডুক-সেই পাঁচ শাখার নাম। সে মতে প্রকাশ আছে-শাকল ঋষি প্রথমে ঋগ্বেদ-সংহিতা অধ্যয়ন করেন; তারপর বাস্কল আদি ঋষিরা অধ্যয়ন করেছিলেন। শাকল আদি পঞ্চ ঋষি একবেদী এবং ঋগ্বেদীয় ব্রাহ্মণগণের আচার্য্য বলে অভিহিত হন। বিষ্ণূপুরাণ এবং শ্রীমদ্ভাগবত প্রভৃতিতে এ বিষয়ে ভিন্ন মত দেখা যায়। ঐ দুই পুরাণে বর্ণিত আছে,-বেদব্যাস বেদবিভাগ করে পৈলকে ঋগ্বেদ-সংহিতা প্রদান করেছিলেন। বৈশম্পায়নকে যজুর্ব্বেদ-সংহিতা, জৈমিনিকে সামবেদ-সংহিতা এবং সুমন্ত্রকে অথর্ব্ববেদ-সংহিতা শিক্ষা দিয়েছিলেন। পৈল আবার ঋক্-সংহিতাকে দুই ভাগে বিভক্ত করে ইন্দ্রপ্রমতি ও বাস্কলি(বাস্কল) নামক আপন শিষ্যদ্বয়কে তা প্রদান করেন। বৌধ, অগ্নিমাঠার(অগ্নিমিত্র), যাজ্ঞবল্ক্য ও পরাশর নামক বাস্কলির চারজন শিষ্য ছিলেন। বাস্কলি নিজের অধ্যায়ন করা বেদ-সংহিতাকে চার ভাগে বিভক্ত করে সেই চার ভাগ আপনার চার শিষ্যকে শিক্ষা দান করেন। ইন্দ্রপ্রমতি যে সংহিতা অধ্যয়ন করেছিলেন, আপন পুত্র মাণ্ডুকেয়কে তা অধ্যয়ন করান। মাণ্ডুকেয় হতে ক্রমশঃ তাঁর পুত্র সাকল্য এবং শিষ্য বেদমিত্র (মতান্তরে দেবমিত্র) ও সৌভরী প্রভৃতির মধ্যে উহা প্রচারিত হয়। সাকল্য আবার পাঁচখানা সংহিতা সঙ্কলন করে, মুদ্গল, গালব, বাৎস্য, শালীয় ও শিশির নামক পাঁচ জন শিষ্যকে সে বিষয়ে উপদেশ দেন। এইরূপে ঋগ্বেদ-সংহিতা নানাভাবে নানা শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। শাখা-অনুসারে মণ্ডল ও অনুবাক প্রভৃতিরও নাম-পরিবর্তন দেখা যায়। সৌনক মুনির মতে, পূর্বে’ই বলেছি, ঋগ্বেদের শাখা পাঁচটি;-আশ্বলায়নী, সাঙ্খ্যায়নী, শাকলা, বাস্কলা ও মাণ্ডুকা। পঞ্চ ঋষির নাম অনুসারে যে পঞ্চ শাখার নামকরণ হয়েছিল, সে অনুসারে তাহাই প্রতিপন্ন হয়। কোথাও কোথাও আবার একুশটি শাখার উল্লেখ আছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, পাঁচ শাখাও এখন সন্ধান করে পাওয়া যায় না। মাত্র শাকলের শাখাই এখন প্রচলিত আছে, -এটাই বেদ অধ্যায়ীদের বিশ্বাস। বলা হয়, শাকল-শাখার কবিতা-সংখ্যা-১৫,৩৮১টি; এবং বাস্কল-শাখায় ১০,৬২২টি কবিতা ছিল। যাগ-যজ্ঞের নিয়মাবলী এবং ক্রিয়া-প্রণালী বিবৃত করে ঋগ্বেদের দুইটি শাখা প্রণীত হয়। সেই শাখা দুইটি দুই ‘ব্রাহ্মণ’ নামে অভিহিত। সেই দুই ব্রাহ্মণের একটির নাম-ঐতরেয় এবং অপরটির নাম-কৌষিতকী বা সাঙ্খ্যায়ন। মহিদাস ঐতরেয় নামক জনৈক ঋষি ঐতরেয় ব্রাহ্মণের এবং কুষিতক নামক ঋষি কৌষিতকী ব্রাহ্মণের প্রণেতা বলে কথিত আছে। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ-কিছু অংশ গদ্যে এবং কিছু অংশ পদ্যে লেখা। উহা আট পঞ্জিকায় বিভক্ত। তার প্রতি পঞ্জিকায় পাঁচটি করে অধ্যায় আছে এবং তার প্রতি অধ্যায়ে অন্যূন সাতটি করে কাণ্ড আছে। এইরূপ, ঐতরেয় ব্রাহ্মণের কাণ্ড-সংখ্যা-২৮৫টি। কৌষিতকী ব্রাহ্মণে ত্রিশটি অধ্যায় আছে। ব্রাহ্মণ ভিন্ন ঋগ্বেদের আর দুই অংশের বা শাখার বিষয় জানতে পারা যায়। তা আরণ্যক ও উপনিষৎ নামে অভিহিত। ঐতরেয় আরণ্যক এবং ঐতরেয় উপনিষৎ বিশেষ প্রসিদ্ধতা সম্পন্ন। ঐতরেয় উপনিষৎ ‘বহ্বৃচ ব্রাহ্মণ উপনিষৎ’ নামেও অভিহিত হয়। ঐতরেয় আরণ্যকে ঋগ্বেদের প্রত্যেক ঋষির পরিচয় আছে। ঐতরেয় আরণ্যকেই ঋগ্বেদের সূক্ত, পদ, পদাংশ, শব্দ, শব্দাংশ প্রভৃতি দেখতে পাই। প্রচীনকালে ঋগ্বেদ-সম্বন্ধে যে বিশেষ আলোচনা হয়েছিল, এ সকল তারই নিদর্শন।
চলবে-
সনাতন সংবেদ
কোন মন্তব্য নেই