sanatansangbed

Introduction of SANATAN dharma scriptures

আচার্য শঙ্কর প্রণােদিত গীতার সম্বন্ধভাষ্য-১১

যিনি নারায়ণ যিনি ঈশ্বর, অর্থাৎ যে সচ্চিদানন্দ ব্রহ্মের কথা বলা হয়েছিল এবং তাঁর উপর যে মায়ার আবরণ এসে গিয়েছিল তখন তিনিই হলেন ঈশ্বর। ব্রহ্মের উপর মায়ার আবরণ যখন এসে যায় তখন তাঁকেই বলা হয় ঈশ্বর, সেই ঈশ্বরকে বলা হয় নারায়ণ, সেই নারায়ণেরই একটা নাম বিষ্ণু। এখানে আচার্য বলছেন যিনি বিষ্ণু তিনি অবতারত্ব গ্রহণ করেন। যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনিই মালিক তিনি এবার অবতার হলেন। কেন অবতার হলেন ধর্মটা চাপা পড়ে গিয়েছিল, ধর্ম চাপা পড়া মানে বিবেক-বিজ্ঞান চাপা পড়ে যাওয়া। তার মানে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ সব বেড়ে গেছে। তাই অধর্ম ও বেড়ে গেছে। এই জিনিষটাকেই পরে আচার্য মূল গীতার ভাষ্যে যেখানে 'যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত' বলা হবে সেখানে আরও বিস্তৃত ভাবে বলবেন। ধর্ম দুই প্রকার, প্রবৃত্তি লক্ষণ আর নিবৃত্তি লক্ষণ। নিবৃত্তি লক্ষণের মূল হল জ্ঞান আর বৈরাগ্য। এই জ্ঞান বৈরাগ্য যখন দমে যায় তখন কাম-ক্রোধ-লোভাদি বেড়ে যায়, তার সাথে অধর্ম মাথা তুলে দাঁড়িয়ে সবার উপরে ছড়ি ঘোরায়। অধর্মের এই বাড় বাড়ন্ত ডানাটাকে কেটে সব কিছু আবার ঠিক করতে ভগবানকে অবতার হয়ে আসতে হয়। তিনি এসে কি করবেন, যার জন্য অধর্মটা বড্ড বেশী চাড়া দিয়েছে হয় তার মাথাটা কেটে উড়িয়ে দেবেন, যেমন শ্রীরামচন্দ্র রাবণের মাথা কেটে দিলেন। আর যখন সেই রকম কেউ না থাকে যাকে শেষ করতে হবে, তখন তিনি সবাই কে একটা পথ দেখিয়ে দেবেন। যেমন বিভিন্ন মহাপুরুষরা, যারা কারোর নাশ করলেন না, কিন্তু নিজে সাধনা করে সবাইকে দেখিয়ে দিলেন জীবন এই ভাবেই চালাতে হবে। কপিল মুনি, দত্তাত্রেয় এনারাও তাই করেছিলেন, তাঁরাও একটা সাধনা করে দেখিয়ে দিলেন এই যুগে এটাই পথ। অবতাররা যখন আসেন তখন তাঁরা দুই রকমের আসেন। প্রথমটায় তাঁরা যে জায়গাটা অধর্মের উৎস সেটাকেই শেকড় শুদ্বু উপড়ে শেষ করে দেন। আর দ্বিতীয় সেই রকম কোন specific উৎস না থাকলেও চারিদিকে অরাজকতা, অধর্ম ছড়িয়ে আছে তখন তিনি সেই অধর্মের মাঝখানে এসে বিরাট একটা তপস্যা করে সাধারণ লোকের সামনে আদর্শ স্থাপন করে দেখিয়ে দেন এটাই পথ। যখন তপস্যা দিয়ে আদর্শ স্থাপন করেন তখন তাঁর মধ্যে সত্ত্ব গুণের প্রকাশ বেশী থাকে। আর যখন তিনি অধর্মের উৎসকে নাশ করতে নেমে পড়েন তখন তাঁকে রজোগুণ ও তমোগুণ অবলম্বন করতে হয়। কূর্মাবতারে যেমন তাঁকে তমোগুণের আশ্রয় নিতে হয়েছিল, নৃসিংহ অবতারে তিনি শক্তির তমোগুণের আশ্রয় নিয়েছিলেন হিরণ্যকশিপুকে নাশ করার জন্য। আবার শ্রীরামচন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ণ অবতারে তিনি রজোগুণ অবলম্বন করেছিলেন। সেই ভগবানই আবার যখন কপিল মুনি, রামকৃষ্ণ, চৈতন্য মহাপ্রভু হয়ে এসেছিলেন তখন একেবারে শুদ্ধ সত্ত্বগুণে নিজেকে ঢেকে রেখেছিলেন।
তিনি যখন অবতার হয়ে আসেন তখন তিনি বিষ্ণুর অংশ থেকে আসেন। এটা ভাগবতের একটা মত। আচার্য সব শাস্ত্রই জানতেন বলে তিনি এখানে ভাগবতের এই মতটা দিয়ে দিলেন। ভাগবতের মতে অবতারের আবার শ্রেণীবিভাগ আছে যেমন অংশ অবতার, কলা অবতার আর পূর্ণ অবতার। কলা মানে, চন্দ্রের যেমন ষোলটি কলা হয়, ষোল কলার এক কলা, দুই কলা এইরকম করে ভগবান বিষ্ণু অবতার হয়ে আসেন। আর অংশ মানে ছোট বড় যে কোন অংশ হতে পারে, নিরানব্বই শতাংশ হলেও অংশ আর একটু হলেও অংশ। অংশ মানে কোথাও কম আবার কোথাও বেশী হতে পারে। এগুলো কে খুব একটা আক্ষরিক অর্থে নিতে নেই এগুলো শব্দের খেলা মাত্র। এখানে আচার্য বলছেন 'দেবক্যাং বসুদেবাৎ অংশেন' দেবকী আর বসুদেবের গৃহে বিষ্ণুর অংশে জন্ম নিলেন।
আমরা যখন বলি শ্রীকৃষ্ণ ভগবান, শ্রীরামচন্দ্র ভগবান, তখন আমরা ঠিকই বলি ভুল কিছু বলছি না। কিন্তু বুঝতে গেলে এটাকে অন্য ভাবে বলে বুঝতে হয়। তখন বলতে হয় যিনি রাম/কৃষ্ণ তিনি ভগবান নন, যিনি ভগবান তিনিই রাম/কৃষ্ণ হয়েছেন। দুটো কথার মধ্যে বিরাট পার্থক্য আছে। রাম/কৃষ্ণ যদি ভগবান হন তাহলে রাম/কৃষ্ণের জন্ম হল, রাম/কৃষ্ণ মারা গেলেন। তাহলে যে ভগবানের জন্ম হয় মৃত্যু হয় সেই ভগবান কিসের ভগবান। তাই বলতে হয়, যিনি ভগবান তিনি ওই দেহকে আশ্রয় করে লীলা করলেন। শ্রীকৃষ্ণ তাহলে কে, তিনি দেবকী আর বসুদেবের সন্তান। তাহলে ওই দেহের মধ্যে কে আছেন, তাঁর দেহের মধ্যে ভগবান বিষ্ণু আছেন। ভগবান বিষ্ণু যদি ওই দেহের মধ্যে থাকেন তাহলে বাকি জায়গায় কি আছে, আর ভগবান যিনি তিনি যদি শ্রীকৃষ্ণের শরীরের মধ্যে ঢুকে যান তাহলে ভগবানের জায়গাটা ফাঁকা হয়ে যাবে, তখন তো জগতে গোলমাল লেগে যাবে। তাই বলছেন 'অংশেন' ভগবান এক সাথে হাজার জায়গায় থাকতে পারেন। আগে এগুলো ভালো উপমা দিয়ে বোঝান যেত না কিন্তু যায়- তোমার কাছে একটা ইমেইল এসেছে। সেই ইমেইলটা তোমার মেইল আইডিতে রেখে দিয়ে তার দশটা কপি করে দশ জায়গায় পাঠিয়ে দিলে। এগুলো উপমা মাত্র। আমাদের সমস্যা হয় আমরা ভগবানের ব্যাপারে যখন একটা কিছু ধারণা বা বোঝার চেষ্টা করি তখন অতি সাধারণ লোকের মতই বোঝার চেষ্টা করি। ভগবানকেও আমরা নিজেদের মত সাধারণ মনে করি। কিন্তু তা নয় গীতাতে পরে আসবে যেখানে ভগবান বলবেন, 'জন্ম কর্ম চ মে দিব্যং' আমার জন্মটাও দিব্য আমার কর্মটাও দিব্য। দিব্য মানে এখানে মানুষের কোন ব্যাপার নেই মানুষের ব্যাপারে হলে সব গোলমাল পাকিয়ে যাবে। এই কারণেই গীতাকে এত কঠিন শাস্ত্র বলা হয়। জিনিষটা দিব্য কিন্তু আমরা সেটাকে মানুষের বুদ্ধি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছি বলেই আমাদের বুঝতে এত সমস্যা হয়ে যায়।
ক্রমশঃ

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.