ধর্ম কি?
ধর্ম একটি বিচার। যার জন্য বেশ কয়েকটি জিনিষের দরকার। প্রথম দরকার ধর্মকে একটা জীবন দর্শন দিতে হবে, জীবনের সত্যটা কি বলতে হবে। কোন পথে চলতে চলতে একদিন সেই সত্যে পৌঁছাতে পারবে, সেটাও বলতে হবে। যেমন বেদান্ত বলছে সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম। দর্শন শুধু আমাকে তত্ত্বটা জানিয়ে দিচ্ছে, সত্যটা কি বলে দিচ্ছে। সেই তত্ত্বে পৌঁছানোর পথ-
প্রথম পথ হল বিচার, আমাকে বিচার করে করে এগোতে হবে।
দ্বিতীয় পথ হল অর্চনা, উপাচার। আমি যদি অর্চনা, পূজা উপাচার করি তাহলে এই উপাচার পদ্ধতি আমাকে সেই সত্যে পৌছে দেবে যেখানে বিচার করে পৌছানো যাচ্ছে।
তৃতীয় পথ, সামাজিক যে আচার আচরণ বিধি পালন করার কথা ধর্মশাস্ত্র বলে দিয়েছে শুধু সেগুলোকে পালন করেও আমি সেই সত্যে পৌঁছে যেতে পারি।
আর চতুর্থ হল, পুরাণের ভগবানের লীলা কথা এবং অন্যান্য শাস্ত্রে ভগবানকে নিয়ে যে কথা কাহিনী আছে তার অনুচিন্তন করেও আমি সেই সত্যে পৌঁছে যেতে পারি।
বিজ্ঞানকেই যাঁরা ধর্ম বলে বিশ্বাস করেন তাঁরা খুব হলে বলবেন এনার্জিই শেষ কথা। কিন্তু তারপর এণার্জির পর কি আছে বলতে পারবেন না। এণার্জিই শেষ কথা খুব ভালো। এবার ওখানে পৌঁছানোর জন্য আমার আচার, উপাচার আর আমার সামাজিক আচরণ বিধি কি হবে, যা পালন করে আমি ওই এণার্জি লেভেলে পৌঁছাতে পারবো ? এসব প্রশ্নের কোন উত্তর বিজ্ঞানের কাছে নেই।
আমাদের মনে হতে পারে সব কটি পথই একটি থেকে আরেকটি সম্পুর্ণ আলাদা। আসলে তা নয়, সব পথই একে অপরের সাথে মিলে মিশে রয়েছে, তবে বিশেষ একটি শাস্ত্র বিশেষ একটি পথের উপর বেশী জোর দিয়েছে। যেমন উপিনষদ ও বেদান্ত বিচারের উপর বেশী জোর দিচ্ছে। কিন্তু উপিনষদেও কথা-কাহিনী পাওয়া যাবে, উপনিষদও বলছে ধ্যান কিভাবে করবে, হাল্কা কোথাও কোথাও এক আধটা উপাচারের কথাও বলছে, যেমন বৃহদারণ্যক উপিনষদে পঞ্চযজ্ঞের কথা আছে। হিন্দু ধর্মের বেশীর ভাগ উপাচার তন্ত্র থেকে এসেছে, আবার পুরাণ থেকেও অনেক উপাচার এসেছে। কিন্তু সেখানেও লক্ষ্য কি, সামাজিক আচরণ বিধি কেমন হবে বলে দিচ্ছে। মনুস্মৃতিতেও আমরা দর্শনের অনেক তত্ত্ব পাই, উপাচারের কথা পাই কিন্তু মূল জোরটা দেওয়া হয়েছে মানুষের আচরণ বিধির উপর।
ঋষিদের মত ছিল যে, ধর্মের চারটি অঙ্গ- (১) দর্শন, ২) পুরাণ ৩) তন্ত্র বা পূজা উপাচার ও ৪) স্মৃতি।) এই চারটে যদি ঠিক ঠিক অধ্যয়ন করা যায় তাহলে সনাতন হিন্দু ধর্মকে পূর্ণাঙ্গ রুপে জানা যাবে। আর জীবন-যাপনের অঙ্গ হিসাবে কেউ যদি কোন একটা মতকে অবলম্বন করে সমগ্র জীবন অতিবাহিত করে তাহাতেও সে একই ফল পাবে। হিউয়েন সাং চীনের খুব বিরাট পণ্ডিত লোক ছিলেন। তিনি ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মে’র বিচার মার্গে´র সাধক। ভারতে এসে তিনি পণ্ডিতদের সাথে আলোচনা করছেন, বিচার করছেন। একবার অযোধ্যার কাছে ডাকাতরা তাঁকে বন্দী করেছে। ডাকাতরা তাঁকে কটে ফেলবে বলে ঠিক করে নিয়েছে তখন তিনি ডাকাতদের বলছেন তোমরা আমার যা কিছু সব নিয়ে নাও, আমাকে প্রাণে মেরো না’। কিন্তু ডাকাতরা ছাড়বে না। তখন তিনি বললেন ‘আমাকে তো তোমরা মেরেই ফেলবে ঠিক করেছ। কিন্তু মরার আগে আমাকে একটু ধ্যান করতে দাও। তখন তিনি ধ্যানে বসে ভগবান বুদ্ধের মৈত্রী ভাবের উপর ধ্যান করতে লাগলেন। এটাই ভক্তিমার্গের সাধনা। ধ্যানে বসার কিছুক্ষণ পর এমন ঝড় উঠেছে যে, সবারই প্রাণ বেরিয় যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। ডাকাতরা তখন ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করছে লোকটি কে? যখন শুনল উনি একজন সাধু, তখন সবাই ক্ষমা চেয়ে তাঁকে ছেড়ে দিল। হিউয়েন সাং এর এই ঘটনাকে মজা করে পরে লেখা হল, যে লোকটি সারা জীবন জ্ঞানমার্গের সাধনা করে গেলেন, শুধু যুক্তি তর্ক বিচার নিয়েই জীবন কাটিয়ে দিলেন, কিন্তু মৃত্যু যখন শিয়রে এসে ধাক্কা মারল তখন শরণাগতি, মানে ভক্তির আশ্রয় নিলেন। মূল কথা হল জ্ঞান যেখানে নিয়ে যায়, ভক্তিও সেখানেই নিয়ে যায়। যিনি জ্ঞানী তিনি দেখেন আত্মাই সব কিছু হয়েছেন আর ভক্ত দেখেন ঈশ্বরই সব হয়েছেন।
উপরোক্ত আলোচ্য অংশটি স্বামী সমর্পণানন্দের শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ অনুধ্যায় এর উপর কোর্স থেকে সংকলিত
#কৃষ্ণকমল।
কোন মন্তব্য নেই