sanatansangbed

Introduction of SANATAN dharma scriptures

ঋগ্বেদ সংহিতা ভূমিকা-০৬

২। বেদের প্রামাণ্য বিষয়ে বিতর্ক ও মীমাংসা।

বেদ বাক্যের প্রামাণ্য বিষয়ে দর্শন রচনাকারদের মস্তিষ্ক নানাভাবে আলোড়িত হয়েছে। মহর্ষি গৌতম ন্যায়-দর্শনে পূর্বপক্ষ ও উত্তরপক্ষ রূপে সে সন্দেহের নিরসন করে গেছেন। গৌতম সূত্রে পূর্বপক্ষ রূপে বেদের প্রামাণ্য বিষয়ে সন্দেহ উপস্থাপন করা হয়েছে,- “তদপ্রামাণ্যমনৃতব্যাঘাত পুনরুক্তদোষেভ্যঃ।” অর্থাৎ, বেদ যে অপ্রমাণ, তার কারণ, উহাতে অসত্য অর্থাৎ মিথ্যাবাদ, ব্যাঘাত এবং পুনরুক্তি দোষ আছে। বেদবাক্য যে অসত্য, তার নিদর্শন-স্বরূপ টীকাকারেরা বলেন যে, বেদে লেখা আছে, পুত্রেষ্টি যাগ করলে পুত্রসন্তান লাভ হবে; কিন্তু কার্য্যতঃ সর্বত্র তার সাফল্য দেখা যায় না; সুতরাং বেদবাক্য মিথ্যা বলে প্রতিপন্ন হয়। বেদ বাক্য যে ব্যাঘ্যাতমূলক, তার দৃষ্টান্তস্থানে উল্লেখ করা হয় যে, বেদের কোথাও বলা আছে- উদয় কালে হোম করবে, কোথাও বলা হয়েছে,- অনুদয় কালে হোম করবে; এবং তাতে এক কালের প্রসঙ্গে অন্যকালের নিন্দাও দেখতে পাওয়া যায়। সুতরাং ব্যাঘাত দোষ ঘটছে। এমন আরও দেখা যায়, পরব্রহ্ম সম্বন্ধে ও শ্রুতিবাক্যের ঐক্য নেই। শ্রুতিতেও কোথাও আছে,- “একমেবাদ্বিতীয়ং ব্রহ্ম”, আবার কোথাও আছে, “দ্বে ব্রহ্মণী বেদিতব্যে পরঞ্চাপমেব চ।” অর্থাৎ, একটিতে অদ্বৈতবাদ, অপরটিতে দ্বৈতবাদ বিঘোষিত হয়েছে। পুনরুক্তির তো কথাই নেই। একই কথা বেদে পুনঃ পুনঃ উক্ত হয়েছে। এভাবে পূর্ব্বপক্ষ ঘোষণা করে, মহর্ষি গৌতম নিজেই তা খণ্ডন করেছেন। বেদবাক্য যে মিথ্যা নয়, তারসম্বন্ধে তিনি বলছেন,- “ন কর্ম্মকর্ত্তৃসাধনবৈগুণ্যাৎ।” তাঁর মতে, তিনটি কারণে বৈদিক কর্মে ফল লাভ হয় না। প্রথমতঃ কর্মকর্তা অনধিকারী; দ্বিতীয়ত, মন্ত্রের উচ্চারণে দোষ; তৃতীয়তঃ, বিধিবিহিত কর্ম অনুষ্ঠান। এই তিনটিই অভীষ্ট ফলে অন্তরায়-সাধক। উপযুক্ত কর্ম না করলে ফলের আশা কিভাবে করা যেতে পারে? সুতরাং বেদবাক্য মিথ্যা নয়; কর্মকারীর কর্মদোষেই কর্ম অনুষ্ঠান পণ্ড হয়ে থাকে। কালাকাল ঘটিত ব্যাঘাত দোষ বিষয়ে গৌতমের উত্তর,- উদয় ও অনুদয় উভয় কালই হোম আদির পক্ষে প্রশস্ত বটে; কিন্তু এককালে সঙ্কল্প করে, অন্যকালে কর্তব্য করলে অভীষ্ট লাভে বিঘ্ন ঘটতে পারে। মন্ত্রের এটাই উদ্দেশ্য। ব্রহ্ম সম্পর্কেও ‘তিনি এক’ ‘তিনি দুই’ এই যে অদ্বৈত ও দ্বৈতবাদ দেখা যায়, তারও কারণ, -জীবের জ্ঞান বৈগুণ্য। জীবের যখন অজ্ঞান অবস্থা, জীব যখন আত্মা-পরমাত্মার অভেদভাব বুঝতে পারে না; তখন আপনাকে ও ব্রহ্মকে দুই বলে মনে করে। যখন তার তত্ত্ব-জ্ঞান উপস্থিত হয়, সে তখন সর্ব্বত্রই ব্রহ্ম ভাব উপলব্ধি করে। জীবের সেই অবস্থাদ্বয় বুঝানোর জন্যই দ্বৈতাদ্বৈতবাদ প্রসঙ্গ। 
বেদের প্রামাণিক বিষয়ে এতে ব্যাঘাত ঘটার কি আছে? পুনরুক্তি সম্বন্ধে গৌতম বলেছেন- প্রয়োজন বুঝানোর জন্য যে বাক্য বার বার উচ্চারিত হয়, তা কদাচ পুনরুক্তি দোষ মধ্যে গণ্য হতে পারে না। পাছে ভ্রান্তি বশে জীব কর্তব্য ভ্রষ্ট হয়, তাই তাকে উদ্বোধিত করার জন্য বেদে কোনও কোনও বিষয় একাধিকবার উল্লেখ করা হয়েছে। উহা জীবের মঙ্গলার্থ-প্রযুক্ত, সুতরাং উহা পুনরুক্তি-দোষ-দুষ্ট নয়। যা আবশ্যক বা যা একান্ত করণীয়, সে সম্বন্ধে একাধিক বার উপদেশ দেওয়া হলে, সে উপদেশ হৃদয়ে বদ্ধমূল হতে পারে এবং তার দ্বারা সফলতা আনয়ন করে। সেই উদ্দেশ্যেই এক এক উপদেশ বার বার প্রদত্ত হয়েছে। তাকে দোষ বলা যায় না। 

বেদের প্রামাণ্য ও নিত্যত্ব বিষয়ে-

অসত্য, ব্যাঘাত, পুনরুক্তি-ত্রিবিধ দোষ খণ্ডন করে গৌতম নিজমত স্থাপন করেছেন। তিনি বলেছেন- “মন্ত্রায়ুর্ব্বেদবৎ চ তৎপ্রামাণ্যং আপ্তপ্রাম্যাণ্যাৎ।” অর্থাৎ, প্রণেতার উপদেশ যথার্থ বলেই আয়ুর্ব্বেদ-শাস্ত্র প্রমাণ মধ্যে গণ্য হয়। তেমনি বেদকর্তা যথার্থবাদী বলে বেদের বাক্য প্রামাণ্য বলতে হয়। এ বিষয়ে বৃত্তিকারের উক্তি পাঠ করলে, বিষয়টি পরিস্কার হতে পারে। 
“আপ্তস্য বেদকর্ত্তুঃ প্রামাণ্যাৎ যথার্থোপদেশকত্বাৎ বেদস্য তদুক্তত্বমর্থাৎলব্ধং। তেন হেতুনা বেদস্য প্রামাণ্যমনুমেয়ং। তত্র দৃষ্টান্তমাহ। মন্ত্রো বিষাদিনাশকঃ। আয়ুর্ব্বেদভাগশ্চ বেদস্য এব। তত্র সংবাদেন প্রামাণ্যগ্রহাৎ তদৃষ্টান্তেন বেদত্বাবচ্ছেদেন প্রামাণ্যমনুমেয়ং।”
যথার্থ উপদেশ প্রদত্ত হয়েছে, সত্যবাণী বিঘোষিত আছে, এজন্য বেদবাক্য প্রমাণরূপে পরিগৃহীত হয়ে থাকে। মন্ত্র-বিষ আদি নাশক; আয়ুর্ব্বেদ-বেদেরই অন্তর্গত। আয়ুর্ব্বেদ-শাস্ত্রের ফল প্রত্যক্ষ সম্যক দেখা যায়। সুতরাং আয়ুর্ব্বেদ প্রমাণ মধ্যে পরিগণিত। বেদও তেমনি প্রমাণ। বেদকে যে নিত্য ও প্রমাণ বলা হয়, তার আরও কারণ এই যে, বেদে অতীত অনাগত মন্বন্তর সম্প্রদায় অভ্যাস ও প্রয়োগ অবিচ্ছিন্ন আছে। বেদের উপদেশ যথার্থ। বহুকাল প্রচারিত হেতু বেদের নিত্যত্ব এবং এতে সত্যবাক্য আছে বলেই তা প্রামাণ্য। এ বিষয়ে বৃত্তিকার বাচস্পতি মিশ্রের উক্তি; যথা,- 
“মন্বন্তরযুগান্তরেষু চ অতীতানাগতেষু সম্প্রদায়াভ্যাসপ্রয়োগাবিচ্ছেদো বেদানাং নিত্যত্বং।
আপ্তপ্রামাণ্যাৎ চ প্রামাণ্যং। লৌকিকেষু শব্দেষু চৈতৎ সমানং।”
এভাবে ন্যায়দর্শন বেদের প্রামাণ্য স্থাপন করে গেছেন। মীমাংসকেরা বেদের নিত্যত্ব ও প্রামাণ্য বিষয়ে আরও একটি যুক্তির অবতারণা করেন। অনেক সময় বিতর্ক উঠে থাকে, -শব্দের সাথে অর্থের একটি কল্পিত সম্বন্ধ আছে। সে সম্বন্ধ সঙ্কেতাত্মক, অর্থাৎ বোধ্য-বোধক ভাবমূলক। কল্পিত সেই সম্বন্ধ নিয়েই শব্দ ব্যবহৃত হয়। কল্পিত সেই সম্বন্ধ যে অনেক সময় ভ্রান্তিমূলক হয়, ঝিনুকে রূপার জ্ঞানই তার প্রমাণ। শব্দে যখন সত্যের অপলাপ অসম্ভব নয়, তখন বেদবাক্য-সকল কল্পনা সঙ্কেতাত্মক শব্দ বলে নিরর্থক ও অপ্রামাণ্য হতে পারে। এভাবে পূর্বপক্ষ স্থাপন করে, মীমাংসকগণ খণ্ডনের জন্য একটি সূত্রের অবতারণা করেছেন। এ সম্বন্ধে মীমাংসা দর্শনের একটি সূত্র ও তার ভাষ্য নিচে তুলে ধরা গেল; যথা- 
ঔৎপত্তিকস্তু শব্দস্য অর্থেন সহ সম্বন্ধস্তস্য জ্ঞানমুপদেশঃ
অব্যতিরেকশ্চ অর্থে অনুপলব্ধে তৎপ্রমাণং বাদরায়ণস্য।
শব্দের ও অর্থের সম্বন্ধ অর্থাৎ বোধ্য-বোধক ভাব স্বাভাবিক ও অনিত্য। তাতে যে অস্বাভাবিকতা বা অনিত্যতা সূচিত হয়, তা বিভ্রম বা অজ্ঞানতানিবদ্ধন। ঝিনুকে রূপার জ্ঞান বিভ্রমেরই পরিচায়ক। ঝিনুক শব্দে ও রূপা শব্দে যে অর্থ উপলব্ধ হয়, সে শব্দের অর্থ অবিকৃতই আছে;  ভ্রান্তি তার অর্থ-বৈপরীত্য ঘটেছে মাত্র। এ ভাবে বিচার করলে, শব্দ ও তার অর্থ নিত্য ও স্বাভাবিক বলেই প্রতিপন্ন হয়। বেদবাক্য প্রকৃত ধর্মজ্ঞান শিক্ষা দেয়। বেদবাক্য- প্রত্যক্ষ আদি প্রমাণ নিরপেক্ষ অজ্ঞাত বিষয়ের অভ্রান্ত উপদেশ প্রদান করে। সুতরাং বেদ নিত্য ও প্রামাণ্য। 

প্রামাণ্যে অন্যান্য সংশয়-

বেদের প্রামাণ্য ও অপ্রামাণ্য বিষয়ে আরও যে সকল বিচার-বিতর্ক উপস্থিত হয়, তারও কতকগুলি উল্লেখ করছি। প্রমাণের দুইটি লক্ষণ সাধারণতঃ বলা হয়। যার দ্বারা সম্যক্‌ অনুভব সাধন হয়, অর্থাৎ যা ভ্রমশূন্য পূর্ণজ্ঞানের প্রকাশক, তাই প্রমাণ। প্রমাণের এই এক লক্ষণ। আর এক লক্ষণ- যা অনধিগত বা অজ্ঞাত বিষয় জ্ঞাপন করে, তাকেই প্রমাণ বলা হয়। প্রমাণ-সম্বন্ধে এই দুই লক্ষণ, দুই সম্প্রদায় কর্তৃক নির্দ্দিষ্ট হয়ে থাকে। পূর্বপক্ষ রূপে নৈয়ায়িকগণ বেদে ঐ দুই লক্ষণেরই অভাব ঘোষণা করেন। কতকগুলি বেদমন্ত্র বোধগম্য হয় না। যা বোধগম্যই নয়, তাতে আর কি জ্ঞান উন্মেষ সম্ভপর? মন্ত্রে আছে- (১) “সৃণ্যেব জর্ভরী তুর্ফরী তু”, (২) “অম্যকসাৎ ইন্দ্রঋষ্টিঃ”, (৩) “যাদৃশ্মিন্ধায়ি তমপস্যয়াবিদদ্‌”, (৪) “আপান্তমন্যুস্তৃপলপ্রভর্ম্মা”, ইত্যাদি। এ সকলের অর্থ পরিগ্রহ হয় না। যার অর্থবোধ হয় না, তার প্রামাণ্য কিভাবে স্বীকার করা যেতে পারে? একটি মন্ত্র আছে, -“অধঃস্বিদাসীদুপরিস্বিদাসীৎ”; অর্থাৎ- উপরে কি নীচে? মন্ত্রে এই ভাব ব্যক্ত থাকলেও, উহা স্থাণূ-সম্বন্ধে কি পুরুষ সম্বন্ধে প্রযুক্ত হয়েছে, তাতে সন্দেহ আসে। সুতরাং ঐ মন্ত্র প্রমাণ-স্বরূপ গ্রহণ করতে পারা যায় না। আবার অনেক স্থানে অচেতন পদার্থকে চেতনের ন্যায় সম্বোধন করা হয়েছে; যথা- (১) “ওষধে ত্রায়স্বৈনম্‌”; অর্থাৎ হে ওষধে! একে উদ্ধার কর; (২) “স্বধিতে মৈনং হিংসীঃ” অর্থাৎ হে ক্ষুর! এর প্রতি হিংসা করবে না; (৩) “শৃণোত গ্রাবাণ” অর্থাৎ হে পাষাণগণ তোমরা শ্রবণ কর; (৪) “আপ উন্দস্তু” অর্থাৎ হে জল! মস্তকের ক্লেদ দূর কর; (৫) “শুভিকে শির আরোহ শোভয়ন্তী মুখং মম” অর্থাৎ হে শুভিকে(টোপর)! আমার মুখের শোভা বর্ধন করতে মস্তকে আরোহণ কর। এই সকল স্থানে অচেতন পদার্থকে চেতন পদার্থ রূপে সম্বোধন করায়, মন্ত্রসমূহ অপ্রামাণ্য প্রতিপন্ন হয়। কোথাও ‘দুই চন্দ্র’ (দ্বৌ চন্দ্রমসৌ), কোথাও রুদ্র এক-দ্বিতীয় নাই (এক এব রুদ্রো ন দ্বিতীয়োহবতহস্থ) কোথাও হাজার হাজার রুদ্র পৃথিবীতে আধিপত্য করছেন (সহস্রাণি সহস্রশো যে রুদ্রা অধিভূম্যাম); এমন উক্তি আছে। এই সকল পরস্পর বিরুদ্ধ বাক্য প্রমাণ পক্ষে বিশেষ বিঘ্ন উপস্থিত করে। যদি কেউ বলেন,- “আমি যাবজ্জীবন মৌন আছি;” তাঁর সে বাক্য যেমন তাঁর মৌনতার বিঘ্ন-সাধক, ঐ সকল পরস্পর বিরুদ্ধ ভাবদ্যোতক মন্ত্রসকলও সেরূপ প্রমাণের ব্যাঘাত ঘটিয়ে থাকে। অতএব, বেদবাক্য প্রামাণ্য নহে। 

সকল সংশয় নিরসনে।

পূর্ব্বোক্ত সংশয়-প্রশ্ন-সমূহের উত্তর মীমাংসক-সম্প্রদায়গণ প্রদান করে গেছেন। পূর্বপক্ষরূপে প্রশ্নগুলি উত্থাপন করে, উত্তরপক্ষরূপে তাঁরা যে তার উত্তরদান করেছেন, তারই আভাষ এখন প্রদান করা যাচ্ছে। যে সকল মন্ত্রের অর্থ হয় না বলেই বেদ বিরোধীগণ নির্দ্দেশ করেন, সেই সকল মন্ত্রের অর্থ যাস্কের “নিরুক্ত” গ্রন্থে বুঝানো হয়েছে। যাঁরা তা অবগত নন, তাঁরাই ঐ সকল মন্ত্রের উল্লেখ দেখে বেদের প্রামাণ্য পক্ষে দোষ প্রদর্শন করেন। এই উপলক্ষ্যে মীমাংসকদের একটি সূত্র দেখা যায়। সূত্রটি এই; “সতঃ পরমবিজ্ঞানম,।” অর্থাৎ পরম জ্ঞান লাভ হলেই, বিদ্যমান পদার্থের স্বরূপ উপলব্ধ হয়; অজ্ঞ জন অজ্ঞানতা নিবন্ধন সে জ্ঞান লাভ করতে পারে না। ‘জর্ভরী তুর্ফরী তু’ শব্দের অর্থ পালনকর্ত্তা সংহারকর্ত্তা। ‘জর্ভরী তুর্ফরী’ অশ্বিদ্বয়কে বুঝানো হয়ে থাকে। ঐ কারণেই সূক্তটির নাম আশ্বিন সূক্ত। অন্ধব্যক্তিরা যে বিশাল স্তম্ভ পর্য্যন্তও দৃষ্টি করতে সমর্থ নয়, সে দোষ স্তম্ভের নয়, সে দোষ অন্ধেরই। কেউ অর্থ বুঝল না বলে, বেদবাক্য যে অর্থহীন হবে, তার কোনই হেতু নির্দ্ধারণ করতে পারা যায় না। “অধঃস্বিদাসীৎ” ইতি মন্ত্রের অর্থ-পরবর্তী মন্ত্র পাঠ করলে উপলব্ধ হয়। ঐ অংশের স্থূল অর্থ- উপরে বা নীচে। উহা পরম পুরুষকে লক্ষ্য করে প্রযুক্ত হয়েছে। এতে উর্দ্ধে ও অধঃদেশে সর্ব্বত্র তাঁর বিদ্যমানতা প্রকাশ পেয়েছে। ওষধি, ক্ষুর, পাষাণ প্রভৃতিকে সম্বোধন করে যে সকল্প মন্ত্র উক্ত হয়েছে, তার সমুদায়ে জড় বা অচেতন পদার্থকে লক্ষ্য করা হয় নি; পরন্তু এদের অধিষ্ঠাত্রী দেবতাগণের উদ্দেশেই ঐ সকল মন্ত্র প্রযুক্ত হয়েছে। ঐ সকল মন্ত্র তন্ময়ত্ব ভাব জ্ঞাপক। বিশ্বেশ্বরের বিশ্বরূপে বিরাজমানতাই এর লক্ষ্য। যদি কেউ আপন স্বর্গীয় পিতৃদেবের প্রতিমূর্ত্তি চিত্রপট লক্ষ্য করে ভক্তিভরে প্রণাম করেন, সে প্রণাম কখনই চিত্রপটের উদ্দেশে নয়; সে প্রণাম, তাঁর পূজ্যপাদ পিতার উদ্দেশেই বিহিত হয়। সেরূপ ওষধি, পাষাণ বা ক্ষুর প্রভৃতির সম্বোধনে যে সকল মন্ত্র দেখতে পাই, তাদের অধিষ্ঠানভূত বিশ্বপাতাই সেই সকল মন্ত্রের লক্ষ্য। উত্তর-মীমাংসায় মহর্ষি বাদরায়ণ “অভিমানিব্যপদেশস্তু” এই সূত্রে এই সংশয়ের নিরসন করে গেছেন। সাধারণ-দৃষ্টিতে দুইটি মন্ত্র পরস্পর বিরুদ্ধ ভাবাপন্ন বলে বোধ হলেও, একটু সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখলে সে ভাব দূর হতে পারে। শব্দের ও বাক্যের অর্থ দুইরূপ দৃষ্ট হয়। এক অর্থ- লৌকিক; অপর অর্থ-ব্যবহারিক। পিতা ও মাতা এই দুই শব্দের সাধারণ অর্থ সকলেই অবগত আছেন। এই দুই শব্দে পালনকর্ত্তা পিতা এবং স্নেহময়ী জননী অর্থাৎ পুরুষ ও নারী স্বতন্ত্রভাবে দুই জনকে বুঝিয়ে থাকে। কিন্তু আবার এমনও দেখা যায়, ঐ দুই শব্দ একই উদ্দেশ্যে একই ব্যক্তির প্রতি প্রযুক্ত হয়েছে। লোকে সাধারণতঃ আপন উত্তমর্ণকে ও ভূস্বামীকে “আপনি আমার মা-বাপ” বলে সম্বোধন করে থাকে। সে ক্ষেত্রে আমরা ‘মা-বাপ’(মাতা-পিতা) শব্দদ্বয়ের লৌকিক অর্থ স্ত্রী ও পুরুষ-রূপে পরিকল্পিত হলেও, ঐরূপ ক্ষেত্রে সম্বধিত ব্যক্তিতে পিতার পালকতা ও মাতার স্নেহ-মমতা একাধারে বিদ্যমান আছে, ইহাই বুঝতে হবে। সেরূপ, “এক রুদ্র দ্বিতীয় নাই’ এবং ‘সহস্র সহস্র রুদ্র আধিপত্য করছেন’ এবম্বিধ বিপরীত ভাবসম্পন্ন মন্ত্রে কখনই বেদ-প্রামাণ্যে বিঘ্ন ঘটতেছে না। কেন না, ঐ অংশের সূক্ষ্ম অর্থ এই যে, সেই যে ব্রহ্ম-যিনি রুদ্ররূপে সম্পূজিত হন, তিনি এক হয়েও বহু এবং বহু হয়েও এক। যোগ প্রভাবে মানুষ বহুরূপ, ধারণ করতে সমর্থ হয়। সেখানে একে যেমন বহুত্বের প্রকাশ অসম্ভব হয় না, এ ক্ষেত্রে সেরূপ বিবেচনাও করা যেতে পারে। অতএব, তাঁহাকে কখনও একরূপে, কখনও বহুরূপে পরিচিত করায়, বেদপ্রামাণ্যে কোনই দোষ ঘটে না। 
চলবে---------------------------
নিবেদনে- সনাতন সংবেদ 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.