ঋগ্বেদ সংহিতা ভূমিকা-১০(কল্প, ব্যাকরণ প্রভৃতি)
কল্প, ব্যাকরণ প্রভৃতি।
শিক্ষার পর কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত ও ছন্দ প্রভৃতির প্রসঙ্গ উত্থাপন করা যাচ্ছে। আপস্তম্ব, বৌধায়ন, আশ্বলায়ন প্রভৃতি ঋষিগণের প্রণীত সূত্র-সমূহ কল্প-গ্রন্থ নামে অভিহিত হয়। এতে যাগ-প্রয়োগ-বিধি কল্পিত আছে। এজন্যে এর নাম-কল্প-গ্রন্থ। কিরকম প্রণালী-তে যজ্ঞ আরম্ভ হবে, কোন মন্ত্র কখন উচ্চারণ করতে হবে, যজ্ঞের কোন কার্য্য, ঋত্বিক হোতা বা পুরোহিত, কে কি ভাবে সম্পন্ন করবেন;- কল্পসূত্রে তারই উপদেশ দেওয়া হয়েছে। বেদ-রূপ দেহের হস্ত-স্থানীয় বলেই কল্প-সূত্রের মাহাত্ম্য পরিকীর্ত্তিত হয়। ব্যাকরণ কে বেদের মুখ স্বরূপ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ব্যাকরণ ভিন্ন বেদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করবে, সাধ্য কি? ব্যাকরণ ভিন্ন অর্থ-নিষ্কাষণ সম্ভপর নয়। অর্থ-জ্ঞান না হলে, বেদ অধ্যয়ন বৃথা, ক্রিয়াকর্ম পণ্ড। বেদের স্বরূপ জানতে হলে, বেদ কি তা বুঝতে হলে, ব্যাকরণ-জ্ঞান প্রথম প্রয়োজন। সে ব্যাকরণ আবার যে-সে ব্যাকরণ নয়। অধুনা-প্রচলিত ব্যাকরণের মধ্যে পাণিনি, মুগ্ধবোধ, কলাপ প্রভৃতি প্রসিদ্ধ। কিন্তু বৈদিক-সাহিত্যের পরিচয়ের জন্য বিভিন্ন ব্যাকরণ প্রবর্তিত ছিল। ‘প্রতিশাখা’(প্রতিশাখ্য) তাঁদের আদিভূত। প্রত্যেক বেদের প্রত্যেক শাখার ভিন্ন ভিন্ন প্রতিশাখা ছিল। সে সকল এখন বিলুপ্ত প্রায়। এখন মাত্র তিন বেদের তিনটি প্রতিশাখা পাওয়া যায়। ঋগ্বেদের প্রতিশাখা-মহামুনি সনক কর্তৃক প্রবর্তিত হয়েছিল। শুক্ল-যজুর্ব্বেদের প্রতিশাখা কাত্যায়ন প্রণয়ন করেন। কৃষ্ণ-যজুর্ব্বেদের একটি শাখা-প্রবর্ত্তকের মধ্যে বাল্মীকি নাম দেখতে পাই। উচ্চারণ, ছন্দঃ প্রভৃতির প্রসঙ্গ প্রতিশাখায় উত্থাপিত। প্রতিশাখাই প্রকারান্তর বৈদিক ব্যাকরণ। প্রতিশাখা সমূহের অনুসরণে পাণিনি, কাত্যায়ন, বাড়ি, গালব, ভাগুড়ী, পাতঞ্জল, বর্ষ প্রভৃতি বৈয়াকরণ ব্যাকরণ-রচনায় প্রসিদ্ধতা সম্পন্ন হন। তবে তাঁদের ব্যাকরণ অনুসারে পরবর্ত্তি বৈয়াকরণ ব্যাকরণ-রচনায় প্রসিদ্ধ সম্পন্ন হন। তবে তাঁদের ব্যাকরণ অনুসারে পরবর্ত্তি কালে যে ভাষা প্রবর্ত্তিত হয়, সে ভাষা বেদের ভাষা হতে স্বতন্ত্র হয়ে পড়ে। পাণিনি প্রভৃতির পূর্বেও বহু বৈদিক বৈয়াকরণ বিদ্যমান ছিলেন। তাঁদের মধ্যে অপিশালী, কাশ্যপ, গার্গ্যেয়, গালব, শত্রুবর্ম্মণ, ভারদ্বাজ, সাকল্য, সেনাকাশ, স্ফোটায়ন প্রভৃতির নাম অনুসন্ধান করে পাওয়া যায়। বলা হয়, তখন সন্ধি, সুবন্ত, তদ্ধিত প্রভৃতি শিক্ষার জন্য ভিন্ন ভিন্ন গ্রন্থ অনুসন্ধান করতে হত। পাণিনি সেই সমস্ত বিষয় একত্রে সূত্র আকারে নিবদ্ধ করেন। বেদাঙ্গের অপর গ্রন্থের নাম-নিরুক্ত। বৈদিক শব্দের ও বৈদিক-বাক্য সমূহের অর্থ নিরুক্ত গ্রন্থে বিশদীকৃত হয়েছে। অর্থ-বোধের জন্য নিরুক্তকারদের মধ্যে যাস্ক ঋষিই অধুনা প্রসিদ্ধি-সম্পন্ন। স্থৌলাষ্ঠীবী, ঔর্ণবাভ, শাকপূণি প্রভৃতি প্রণীত নিরুক্ত গ্রন্থেরও উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। নিরুক্ত-গ্রন্থকে বেদের শ্রবণ ইন্দ্রিয় বলে পণ্ডিতগণ ঘোষণা করে থাকেন। নিরুক্তের পর ছন্দঃ গ্রন্থ। শিক্ষা বা স্বর-বিজ্ঞানের পর ছন্দঃ-জ্ঞানের উপযোগিতা অনুভূত হয়। ছন্দঃ- গ্রন্থের বীজ-বেদে, অঙ্কুরোদগম-আরণ্যকে, শাখা-প্রশাখা-উপনিষদে। ছন্দঃ-জ্ঞান ভিন্ন, রস-গুণ-দোষ উপলব্ধি হয় না; ছন্দঃ-জ্ঞান ভিন্ন উচ্চারিত শব্দ-সমূহ হৃদয়ে প্রবেশ করে না; তাই ছন্দের প্রাধান্য পরিকীর্ত্তিত হয়। বেদে প্রধানতঃ সাতটি ছন্দের উল্লেখ দেখতে পাই;- গায়ত্রী, উষ্ণিক, অনুষ্টুপ, বৃহতী, পংত্তি, ত্রিষ্টুভ, জগতী। সন্ধ্যাবন্দনায় ব্রাহ্মণ-মাত্রেই এই সকল ছন্দের পরিচয় পেয়ে থাকেন। চব্বিশ অক্ষরে(বা স্বরবর্ণে) তিন চরণে নিবদ্ধ যে ছন্দঃ, তাই গায়ত্রী। উষ্ণিক ছন্দে আটাশটি অক্ষর, অনুষ্টুপে বত্রিশটি, বৃহতীতে ছত্রিশটি, পংক্তিতে চল্লিশটি ছন্দঃ, ত্রিষ্টুভে চুয়াল্লিশটি এবং জগতীতে আটচল্লিশটি অক্ষর আছে। বেদ-ব্যবহৃত এই সাতটি ছন্দঃ ‘দৈবিক ছন্দঃ’ নামে অভিহিত। মহর্ষি কাত্যায়ন তাঁর ‘সর্ব্বানুক্রমনিকা’ গ্রন্থে এই সাতটি দৈবিক ছন্দের উল্লেখ করে গেছেন। পিঙ্গলাচার্য্য প্রভৃতি বিরচিত ছন্দঃ গ্রন্থ এককালে প্রসিদ্ধ সম্পন্ন ছিল। পিঙ্গলাচার্য্যের ছন্দঃ-গ্রন্থ-ছন্দঃ-মঞ্জরী-প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ। পণ্ডিতগণ ঐ গ্রন্থকে বেদের পদস্বরূপ বলে কীর্ত্তন করেছেন। বেদ-ব্যবহৃত ছন্দের নাম-দৈবিক ছন্দঃ; আর বেদের পরবর্ত্তিকালে যে সকল ছন্দঃ বিরচিত হ্য়েছে, তার নাম-লৌকিক ছন্দঃ। মহর্ষি বাল্মীকি লৌকিক ছন্দের প্রবর্ত্তক বলে কথিত হন। ‘মা নিষাদ’ ইত্যাদি লৌকিক ছন্দের আদিভূত। তার পরে সংস্কৃত-সাহিত্যে অধুনা দুই শতাধিক ছন্দঃ প্রচলিত হয়েছে। তন্মধেও পঞ্চাশ প্রকার ছন্দঃ সাধারণতঃ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যাহোক, বেদ অধ্যয়নে ছন্দঃ প্রভৃতির জ্ঞান যে একান্ত আবশ্যক, তা বলাই বাহুল্য। ষষ্ঠ বেদাঙ্গ-জ্যোতিষ। যার দ্বারা সূর্য্য আদি গ্রহের অবস্থান বিষয়ে জ্ঞানলাভ হয়,-গ্রহ আদির গতি-স্থিতি প্রভৃতি বিষয়ে অভিজ্ঞতা জন্মে, তারই নাম-জ্যোতিষ শাস্ত্র। বেদবিহিত যজ্ঞ-কর্ম সম্পন্ন করতে হলে, জ্যোতিষ-শাস্ত্রের জ্ঞানলাভ বিশেষ প্রয়োজন। কোন সময়ে কোন কর্ম আরম্ভ করতে হবে, কোন্ সময়ে কোন্ কর্ম সমাপন করার আবশ্যক, জ্যোতিষ শাস্ত্র সেই জ্ঞান শিক্ষা দেয়। যথা নির্দিষ্ট সময়ে কর্ম আরম্ভ না হলে এবং যথা নির্দিষ্ট সময়ে কর্ম সমাপ্ত না হলে কর্ম পণ্ড হয়ে যায়। তাই জ্যোতিষের এত প্রয়োজন। পরাশর প্রভৃতি ঋষিগণ যজ্ঞের কালাকাল নির্ণয়ের জন্য জ্যোতিষের সূত্র রচনা করে গেছেন। পণ্ডিতগণ জ্যোতিষ শাস্ত্রকে বেদের চক্ষু-স্থানীয় বলে কীর্ত্তন করে থাকেন।
চলবে- সনাতন সংবেদ।
কোন মন্তব্য নেই