ঋগ্বেদ সংহিতা ভূমিকা-০৫
বেদ বিষয়ে দর্শন-শাস্ত্র।
[বেদ বিষয়ক বিতর্ক দর্শন শাস্ত্রে; -শব্দের নিত্যত্ব বিষয়ে নৈয়ায়িকদের আপত্তি;- মীমাংসক কর্তৃক সেই আপত্তির খণ্ডন;- মীমাংসাদর্শনে বেদের নিত্যত্ব বিষয়ে যুক্তি; -বেদের প্রামাণ্য-বিষয়ে গৌতমের পূর্বপক্ষ রূপে বিতর্ক ও উত্তরপক্ষ রূপে উত্তর; -বেদের প্রামাণ্য বিষয়ে পূর্বপক্ষ রূপে অপরাপর বিতর্ক এবং উত্তরপক্ষ রূপে তার উত্তর; বেদের অপৌরুষত্ব সম্বন্ধে বিতর্ক ও মীমাংসা;- বেদ বিষয়ে সাংখ্য, বৈশেষিক ও বেদান্ত আদির মত।]
বেদ বিষয়ক বিতর্ক
সকল শাস্ত্রেই বেদ বিষয়ে আলোচনা দেখা যায়। বেদ যে নিত্য, বেদ যে অপৌরুষেয়, বেদ যে অনাদি, এ সম্বন্ধে বিচার-বিতর্কের অবধি নেই। ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষৎ, দর্শন, পুরাণ-সর্বত্রই বেদ-বিষয়ক আলোচনা আছে। সে সম্বন্ধে দর্শন-শাস্ত্রের বিচার ও মীমাংসা, জ্ঞানার্থি মাত্রই কৌতুহল উদ্দীপক। সুতরাং অন্যান্য শাস্ত্রে বেদের বিষয় কিভাবে আলোচিত হয়েছে, তা উল্লেখের পূর্বে, বেদ বিষয়ে দর্শন শাস্ত্রের গবেষণার আভাষ তুলে ধরা গেল। বিচারে পূর্বপক্ষ ও উত্তরপক্ষ রূপে বেদ প্রতিবাদ দ্বারা মীমাংসা হয়ে থাকে। এক সম্প্রদায়ের দার্শনিকেরা বেদের অপৌরুষেয়ত্ব বা নিত্যত্ব স্বীকার করেন না; এবং সেই পক্ষেই যুক্তিজাল বিস্তার করে থাকেন। অপর সম্প্রদায়ের দার্শনিকেরা প্রথমোক্ত সপ্রদায়ের যুক্তি-পরম্পরাকে পূর্বপক্ষরূপে পরিগ্রহণ করে, উত্তরপক্ষ রূপে তার উত্তর দিয়ে গেছেন। এ সম্বন্ধে নৈয়ায়িকদের ও মীমাংসকদের বিচার-প্রণালী বিশেষভাবে প্রণিধানের বিষয়।
১। বেদ নিত্য কি না-তার বিষয়ে বিতর্ক ও মীমাংসা।
শব্দের নিত্যত্ব বিষয়ে আপত্তি।
নৈয়ায়িকরা বলেন, ‘শব্দ কখনও নিত্য হতে পারে না। বেদ যখন শব্দসমষ্টি, তখন এর নিত্যত্বে বিঘ্ন ঘটছে। এই সম্বন্ধে নৈয়ায়িকদের ছয়টি প্রসিদ্ধ সূত্র দেখতে পাওয়া যায়। প্রথম,-“কর্ম্ম একে তত্র দর্শনাৎ।” অর্থাৎ, যত্নদ্বারা শব্দ উচ্চারিত হয়। যা চেষ্টা সাপেক্ষ, তাই কর্ম। কর্ম ধ্বংসশীল, সুতরাং শব্দও অনিত্য। দ্বিতীয়, “অস্থানাৎ” অর্থাৎ, উৎপত্তি মাত্র শব্দ নষ্ট হয়; শব্দ অস্থায়ী; সুতরাং শব্দে নিত্যত্ব সম্ভব নয়। তৃতীয়,- “করোতি শব্দাৎ” অর্থাৎ, শব্দ করে থাকে অর্থাৎ লোকে শব্দের সৃষ্টিকর্তা। যা করা হয়(লোকে তৈরি করে), তা কখনই নিত্য হতে পারে না। চতুর্থ,- “সত্ত্বান্তরে যৌগপদ্যাৎ” অর্থাৎ, শব্দ একই সময় নিকটস্থ এবং দূরস্থ বহু ব্যক্তি শুনতে পায়। সুতরাং শব্দ এক ও নিত্য হতে পারে না। পঞ্চম,- “প্রকৃতিবিকৃত্যোশ্চ” অর্থাৎ, প্রকৃতি প্রত্যয় হেতু শব্দ রূপান্তরিত হয়ে থাকে; যার রূপান্তর বা বিকৃতি ঘটে, তাকে কখনই নিত্য বলা যেতে পারে না। ষষ্ঠ,- “বৃদ্ধিশ্চ কর্ত্তৃভূম্নাস্য” অর্থাৎ, একই শব্দ একাধিক ব্যক্তি উচ্চারণ করলে, একাধিক বার সেই শব্দ উচ্চারিত হতে পারে। শব্দকর্ত্তার সংখ্যার হ্রাস-বৃদ্ধি হেতু শব্দেরও হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে থাকে। যা হ্রাসবৃদ্ধিশীল, তা নিত্য হতে পারে না। এরূপে নৈয়ায়িকেরা বেদের নিত্যত্ব-বিষয়ে প্রতিবাদ উত্থাপন করে থাকেন।
পূর্বোক্ত আপত্তির খণ্ডন-
মীমাংসকগণ ঐরূপ আপত্তির খণ্ডন করে গেছেন। পূর্বপক্ষরূপে ঐ সকল আপত্তি উত্থাপন করে, মীমাংসা দর্শনের নিন্মলিখিত সূত্র পঞ্চকে তাদের নিরসন করা হয়েছে।
প্রথমে,- “স্বতঃ পরমদর্শনং বিষয়ানাগমাৎ” অর্থাৎ, শব্দ উচ্চারিত হলেও শব্দকারীর সাথে এর সম্বন্ধ থাকে না। পরন্তু যে শব্দে যে জ্ঞান, তা সমভাবেই বিদ্যমান থাকে। সুতরাং শব্দ অনিত্য নয়, নিত্য। ‘রাম’ এই শব্দ শ্রুতিগোচর হলে, ঐ শব্দের একটি জ্ঞান থেকে যায়; পূর্বে ঐ শব্দ যেমন শুনেছি, তার সাথে এর অভিন্নতা সূচিত হয়। সুতরাং, শব্দের নিত্য ও একত্ব অনুভবসিদ্ধ। দ্বিতীয়,-“প্রয়োগস্য পরমং” অর্থাৎ ‘শব্দ করে’ এর তাৎপর্য্য- শব্দের নির্মাণ নয়, শব্দের উচ্চারণ মাত্র। তৃতীয়,-“আদিত্যবৎ যৌগপদ্যং” অর্থাৎ সূর্য্য যেমন নিকটস্থ ও দূরস্থ সকল ব্যক্তির পরিদৃশ্যমান, অথচ তিনি যেমন এক ভিন্ন দ্বিতীয় নহেন, শব্দও সেরূপ বহু ব্যক্তির কর্ণে ধ্বনিত হলেও এক ভিন্ন দ্বিতীয় হয় না। চতুর্থ,- “বর্ণান্তরমবিকারঃ” অর্থাৎ প্রকৃতি প্রত্যয় সহযোগে বর্ণের পরিবর্ত্তনে বর্ণের বিকার হয় না; বর্ণান্তরে বর্ণের অবস্থিতি ঘটে মাত্র। যেমন, ‘ই’ কার স্থানে ‘য’ কার হলে, বর্ণান্তর আদেশ হয় বটে; কিন্তু ‘ই’ কারের কোনও অসদ্ভাব ঘটে না। পঞ্চম,- “নাদবৃদ্ধিঃ পরা” অর্থাৎ, একই শব্দ বহুবার উচ্চারিত হলে ধ্বনি মাত্র বৃদ্ধি হয়; শব্দ বা শব্দ কথিত বস্তুর বৃদ্ধি ঘটে না। পুনঃ পুনঃ গো-শব্দ উচ্চারিত হলে, নাদ বা কোলাহল বৃদ্ধি হয় বটে; কিন্তু বস্তুপক্ষে কোনরূপ সংখ্যাধিক্য হয় না। সুতরাং শব্দের নিত্যত্ব অবিসম্বাদিত।
পূর্বোক্ত বিষয়ে অন্যান্য যুক্তি-
মীমাংসা দর্শন শব্দের নিত্যত্ব প্রমাণের জন্য আরও কতগুলি যুক্তি নির্দেশ করেছেন। তারই পাঁচটি যুক্তি এখানে তুলে ধরা হল।
প্রথম- “নিত্যস্তু স্যাৎ দর্শনস্য পরার্থত্বাৎ” অর্থাৎ, যখন উচ্চারণ মাত্র শব্দের অর্থ পরিগ্রহ হয়, শব্দ বিনষ্ট হয় না, তখন শব্দকে নিত্য বলাই সঙ্গত। শব্দ যদি নিত্য না হোত, শব্দের যদি অর্থবোধ কেউ না করতে পারত, তাহলে শব্দ উচ্চারণ মাত্রেই ধ্বংসপ্রাপ্ত সুতরাং অনিত্য বলে অভিহিত হতে পারত। শব্দের স্থিতি মানলেই নিত্যত্ব স্বীকার করতে হয়। দ্বিতীয়- “সর্বত্র যৌগপদ্যাৎ” অর্থাৎ, ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি শব্দের একরকম অর্থ পরিগ্রহ করতে পারেন; সমভাবে অভ্রান্তরূপে ভিন্ন ভিন্ন জনের অর্থবোধ ঘটে; এই জন্যই শব্দ নিত্য ও এক। তৃতীয়,- “সংখ্যাভাবাৎ” অর্থাৎ, শব্দের ক্ষয় বৃদ্ধি নেই। বার বার উচ্চারণ হলেও শব্দ একই থাকে। চতুর্থ- “অনপেক্ষত্বাৎ” অর্থাৎ, শব্দ বিনষ্ট হওয়ার কোনও হেতুবাদ দেখা যায় না। সুতরাং শব্দ অনিত্য নয়-নিত্য। পঞ্চম- “লিঙ্গদর্শনাচ্চ” বেদ আদি শাস্ত্রে শব্দকে নিত্য বলে চিহ্নিত করা হয়েছে বলে, শব্দের নিত্যত্ব স্বীকার করতে হয়। শ্রুতি যাকে নিত্য বলে ঘোষণা করেছেন, শাস্ত্র যার নিত্যত্ব অঙ্গীকার করেন, তাই নিত্য। সুতরাং শব্দ মূলাধার ‘বেদ’ নিত্য বলে সপ্রমাণ হয়। শব্দের নিত্যত্ব সম্বন্ধে আরও বিবিধ বিতর্ক উত্থিত হয়। বেদে “ববরঃ প্রাবাহণিরকাময়ত” ইত্যাদি মন্ত্র আছে। কেউ কেউ এর অর্থ এভাবে নিষ্পন্ন করেন যে, ববর নামক কোনও মনুষ্য প্রাবাহণি বায়ুকে কামনা করেছিল। এমন অর্থের ফলে, সেই অনিত্য ববরের পরবর্ত্তী কালে বেদমন্ত্র রচিত হয়েছিল, প্রতিবাদকারী এরূপ প্রতিপন্ন করেন। তাহলে, বেদের নিত্যত্ব স্বতঃই অপ্রমাণিত হচ্ছে। কিন্তু মীমাংসকগণ এ সংশয়ের নিরসন করে গেছেন। অনিত্য দর্শনরূপ উক্ত আশঙ্কার উত্তরে তাঁরা সূত্র করে গেছেন, “পরন্তু শ্রুতিসামান্যমাত্রম”; অর্থাৎ, ববর আদি শব্দ দ্বারা কোনও মনুষ্যকে বুঝায় না, পরন্তু উহা ধ্বনিমাত্র; অর্থাৎ, ববর ধ্বনি বিশিষ্ট প্রবহমাণ বায়ুকে ঐস্থানে লক্ষ্য করা হয়েছে। বায়ুপ্রবাহের অনিত্যত্ব কে প্রচার করবে? সুতরাং এসকল সংশয়-প্রশ্নেও বিঘ্ন ঘটতে পারে না। বেদের নিত্য অনিত্য প্রশ্ন মীমাংসা প্রসঙ্গে আর একটি গুরুতর তর্ক উঠে থাকে। বেদে ইন্দ্র মরুৎ আদিত্য রুদ্র প্রভৃতির নাম দেখা যায়। কারও উৎপত্তি না হলে তার নাম হবে কি প্রকারে? মনে করুন, দেবদত্তের পুত্রের নাম যজ্ঞদত্ত; পুত্রের উৎপত্তি হয়েছিল বলেই তার নামকরণ হয়। সুতরাং ইন্দ্র আদি দেবগণের উৎপত্তি স্বীকার করতে হয়। উৎপত্তি স্বীকার করলে, অনিত্যত্ব অস্বীকার করা যায় না। এই সকল অনিত্য দেবাদির নাম যখন বেদে দেখা যায়, তখন বেদ কেন না অনিত্য হবে? এই প্রশ্নের উত্তরে মীমাংসকেরা বলেন, নিত্য ও অনিত্য দুই ভাবেই দেবগণের অধিষ্ঠান সপ্রমাণ হয়। তাঁরা যখন দেহধারণ করেন, তখন তাঁদের কে অনিত্য বলতে পারি। যা আকৃতি অবয়ব বিশিষ্ট, তা অবশ্যই বিনাশশীল। কিন্তু যখন ইন্দ্র আদি দেব-বিষয়ক স্মৃতি বা জ্ঞানে প্রকাশ পায়, তখন তার নিত্যত্ব স্বীকার করতে হয়। পদার্থ ও পদার্থ বিষয়ক জ্ঞানে স্বাতন্ত্র্য আছে। পদার্থ ধ্বংসশীল; কিন্তু তদ্বিষয়ক জ্ঞান অবিনাশী-নিত্য। ‘রাম’ বলে সম্বোধন করলাম; এটা ব্যক্তিবিশেষকে বুঝাল; রাম নামধারী কোনও ব্যক্তি সামনে আসলেন। সে ব্যক্তি নশ্বর, সে ব্যক্তি ধ্বংসশীল। কিন্তু সেই ‘রাম’ ধ্বংস হওয়ার পূর্বে ও পরে, তাঁর বিষয়ে একটি জ্ঞান আমাদের হৃদয়ে বদ্ধমূল থাকে। সে জ্ঞান তিনি যেমন রূপবান গুণবান বুদ্ধিমান ছিলেন, তাঁর কেমন আকৃতি প্রকৃতি ছিল ইত্যাদি। ব্যক্তি ‘রাম’ ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও তাঁর সম্বন্ধে সেই সে জ্ঞান, তা ধ্বংস হয় না। এই হিসাবে রাম ধ্বংস প্রাপ্ত হলেও রাম নাম অবিনাশী নিত্য। বেদে যে ইন্দ্র আদি দেবতার নাম উল্লেখ দেখতে পাই, তা ইন্দ্র আদি দেব-বিষয়ক জ্ঞান। সুতরাং তা নিত্য হবে না কেন? অতএব বেদের নিত্যত্ব অবিসংবাদিত।
চলবে-
নিবেদনে- সনাতন সংবেদ।
কোন মন্তব্য নেই