sanatansangbed

Introduction of SANATAN dharma scriptures

আচার্য শঙ্কর প্রণােদিত গীতার সম্বন্ধভাষ্য-৮

যখনই যারা প্রবৃত্তি লক্ষণ ধর্ম পালন করছে তাদের মধ্যেও নিবৃত্তি লেগেই থাকবে। আমি যখন একটা কাজ করছি সেই কাজটা হয়ে যাওয়ার পর আমি আরেকটা কাজে হাত দিলাম। এখানে একটা কাজের থেকে নিবৃত্তি হয়ে আরেকটা কাজে প্রবৃত্তি হয়ে গেল। কিন্তু নিবৃত্তি লক্ষণ ধর্মের বৈশিষ্ট্যই হল পুরোপুরি নিবৃত্তি, এখানে প্রবৃত্তির কিছুই থাকবে না। কোন কিছুর প্রতি আকাঙ্ক্ষা থাকবে না, কোন কাজ করবে না আর মন সর্বদা ঈশ্বরে সংলগ্ন, ঈশ্বর ছাড়া এখানে আর কিছু নেই। আমি তাহলে বলতে পারি, ঈশ্বরে যেমনটা বসিয়ে রেখেছে সেটাও তো প্রবৃত্তি হয়ে গেল। এখানে এসেই বেদান্ত অন্যান্য ধর্ম থেকে পুরো আলাদা হয়ে যায়। যদি ঈশ্বর আমার বাইরের কোন বস্তু হতেন তাহলে ঈশ্বরে মন কে বসিয়ে রাখাটাও প্রবৃত্তি হবে। কিন্তু আমিই যদি সেই ঈশ্বর হই তখন সেখানে প্রবৃত্তি কি করে হবে। আমি সবার কাছে যেতে পারি, আমার মার কাছে বাবার কাছে বন্ধুর কাছে যেতে পারি কিন্তু আমি কি কখন নিজের কাছে যেতে পারি, যে নিজের মধ্যেই আছে সে নিজের কাছে কি করে যাবে, যার এই বোধ হয়ে গেছে আমি ঈশ্বরতেই আছি আমি ঈশ্বরের সঙ্গে এক তখন সে এই বোধেই অবস্থিত হয়ে যায়। আমাদের মত সাধারণরা মনে করি দেবতা মন্দিরে আছেন, তাহলে চল মন্দিরে দেবতার কাছে যাই তখন এটা প্রবৃত্তি লক্ষণ ধর্ম হয়ে গেল। বেদান্ত পরম্পরাতে দুটি সাধনার কথা বলা হয়, একটা 'নেতি নেতি', আরেকটি 'ইতি ইতি'। তবে 'ইতি ইতি' সাধনার মধ্যে পড়ে না 'নেতি নেতিটা'ই সাধনার মধ্যে পড়ে। 'নেতি নেতি' মানে বিচার করে করে বলা এটা আত্মা নয়, এটা ঈশ্বর নয়, এটা ব্রহ্ম নয়। যেটা আত্মা নয় তৎক্ষণাৎ সেটা কে ত্যাগ করে দেওয়া। সাধারণ মানুষ সাধনা করার সময় মনে করে আমি এই দেহ আমি আমার মন আমার ইন্দ্রিয় আর ঈশ্বর আমার বাইরে আছেন। ঈশ্বর কে ধরে আমার ভেতরে বা সামনে নিয়ে আসতে হবে। এই ধরণের সাধনা সব সময় প্রবৃত্তি লক্ষণ হবে। সন্ন্যাসী জানেন আমি শুদ্ধ আত্মা, আমার এই শরীর বাইরে থেকে এসেছে আমার মন বাইরে থেকে এসেছে আমার স্ত্রী-পুত্র সব বাইরে থেকে এসেছে। যেগুলো বাইরে থেকে এসেছে সেগুলোকে ঝেটিয়ে বার করে দিতে হবে। যারা ভক্ত যারা কর্মকাণ্ডাদি করছে তারা তাই একটা জিনিষকে পাওয়ার চেষ্টা করে, মানে ঈশ্বরকে পাওয়ার চেষ্টা করছে। সন্ন্যাসীরা সংসারকে ত্যাগ করার চেষ্টা করে। নেতি নেতি সাধনা হিন্দুধর্ম ছাড়া বিশ্বের আর কোন ধর্মে পাওয়া যাবে না।
আমি আছি এটা তো সত্য। আমি যদি না থাকি তাহলে জগৎ আছে কি না আমি কি করে জানব, প্রশ্ন হল এই আমিটা কে? যখন আমি মনে করছি আমি শরীর, মন, তখন স্বাভাবিক ভাবেই আমার অনেক কিছু পাওয়ার ইচ্ছা থাকবে। কিন্তু আমি যখন মনে করছি আমি সেই পূর্ণ ব্রহ্ম আমি ঈশ্বরের সঙ্গে এক তখন মনে হবে বাকি জিনিষ গুলো বাইরে থেকে আমার মধ্যে ঢুকেছে এগুলো কে তাড়াতে হবে। তাড়িয়ে দেওয়া মানে সত্যি সত্যি মেরে তাড়িয়ে দেওয়া নয়, সব কিছুতে অনাসক্তি ভাব। অনাসক্তি ভাব অবলম্বন করার পরেই সব কিছু শেষ হয়ে যাবে না। এরপরও যত ভেতরে যেতে থাকবে তত দেখা যাবে মনের নানা রকম অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে তখন সেটাকেও ত্যাগ করে দিচ্ছে। সবটাই যদি ত্যাগ করে দেয় তাহলে কি থাকবে, এই জায়গাতেই বেদান্ত আর বৌদ্ধ ধর্মের মধ্যে তফাৎ হয়ে যায়। বৌদ্ধ ধর্ম বলবে সব কিছু ছেড়ে দেওয়ার পর শূন্যই হয়ে যাবে। অনন্ত থেকে অনন্ত বাদ দিলে শূন্য। বেদান্ত বলবে অনন্ত থেকে অনন্ত বাদ দিলে অনন্তই থাকবে। তাহলে তখন কি থাকবে, যা আছে তাই থাকবে। ঈশ্বরই আছেন ঈশ্বরই থাকবেন। ঈশ্বরের উপর যে এত কিছু আরোপ করে রাখা হয়েছে শীতের সময় আমরা যেমন ঠাণ্ডা থেকে বাঁচার জন্য শরীরে এক গাদা পোশাক চাপাই। নেতি নেতি যেটা যাকে নিবৃত্তি লক্ষণ বলছেন এর অর্থ হল এই আরোপিত জিনিষ গুলো সব খুলে ফেলে দেওয়া। প্রবৃত্তি লক্ষণ ধর্ম মানে আমার মধ্যে অভাব বোধ আছে আমার অভাব আছে বলে স্ত্রী পুত্রদের জুটিয়েছি অভাব আছে বলে ঘরবাড়ি জোগাড় করেছি অভাব আছে তাই এবার ঈশ্বরকেও জোগাড় করতে হবে। তাহলে এগুলো কি ভুল, একেবারেই ভুল নয়। আচার্য শঙ্কর শুধু বলছেন, এই দুটি পথ। কিছু লোকের স্বাভাবিক প্রবণতাই হল প্রবৃত্তি লক্ষণ। কিন্তু যার প্রবণতা নিবৃত্তি লক্ষণে সে বুঝে গেছে আমার স্বভাবই হল শুদ্ধ সচ্চিদানন্দ কিন্তু কিছু আবর্জনা ভেতরে ঢুকে গেছে। পেট খালি হলে খিদে পায়, তখন পেট পূরণের জন্য খাবার ভেতরে ঢোকাই। কিন্তু স্নানের সময় শরীরের আবর্জনা জল ঢেলে পরিষ্কার করে দিই। স্নান করা যা সাধনা করা ঠিক তাই। যখন স্নান করি তখন মনে করি জল এনে জলটা গায়ে ঢালছি কিন্তু না - স্নান করা মানে শরীরের যে গরমটা জমে ছিল সেটাকে ঠাণ্ডা করা আর শরীরের যে নোংরা জমে ছিল সেগুলো কে বার করা। সাধনা মানেই সংসারের যে আবর্জনা জমেছে সেটাকে সরানো। এই সরানোর জন্য দুটো পথ আছে। একটা হল, এই গ্লাসে যেমন জল আছে আমি চাইছি গ্লাসে দুধ ঢালব। এখন গ্লাসে দুধ ঢেলে যাচ্ছি ঢালতে ঢালতে একটা সময় গ্লাসের সব জল বেরিয়ে গিয়ে একমাত্র দুধই থাকবে। বোতলে জল ভরার সময় জল ঢক্ ঢক্ করে ভরছে সাথে সাথে বোতলের ভেতরের বাতাসটা বেরিয়ে গেল-এটাই প্রবৃত্তি লক্ষণ ধর্ম। আর নিবৃত্তি লক্ষণ ধর্ম মানে স্নানের উদ্দেশ্য যেমন শরীরের ময়লাটা ত্যাগ করা। একটা হল ভরা আরেকটা হল ত্যাগ করা। নিবৃত্তি লক্ষণে বলছে আমি যা ছিলাম তাই আছি। কিন্তু বাস্তবে এদের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না। কারণ প্রবৃত্তি লক্ষণে ঠিক ঠিক শেষ কথা ঈশ্বরই আছেন, যা কিছু হয়েছে সব ঈশ্বরই হয়েছেন। ঈশ্বর ছাড়া আর কিছু নেই। নিবৃত্তি লক্ষণ যাঁরা পালন করেন তাঁরা দেখেন আত্মাই সব কিছু হয়েছেন। যখন বলছেন আত্মাই সব কিছু হয়েছেন তখন সেই পথ কে বলছেন জ্ঞান মার্গ। ভক্ত দেখেন ঈশ্বরই সব হয়েছেন, এটাই প্রবৃত্তি লক্ষণ। 
ক্রমশঃ
নিবেদনে- সনাতন সংবেদ। 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.