ঋগ্বেদ সংহিতা(ভূমিকা-০৪)
বেদের স্বরূপ ও বিভাগ
সর্বভূত আত্মা ব্রহ্মের সম্বন্ধে একটি শ্রুতি দিয়ে উদ্ধৃত করা যায়, সেই শ্রুতির মর্ম অনুধাবন করে দেখলে, বেদ-বিষয়ে একটি বিশেষ আভাষ পাওয়া যেতে পারে। শাস্ত্রগ্রন্থ প্রভৃতির সাথে বেদের যে কি সম্বন্ধ, তার দ্বারা বিশেষভাবে উপলব্ধ হতে পারে। ব্রহ্ম-স্বরূপ সম্বন্ধে সেই শ্রুতি বলছেন ;যথা-
অগ্নির্যথৈকো ভুবনং প্রবিষ্টো রূপং রূপং প্রতিরূপো বভূব।
একস্তথা সর্ব্বভূতান্তরাত্মা রূপং রূপং প্রতিরূপো বহিশ্চ॥
বায়ুর্যথৈকো ভূবনং প্রবিষ্টো রূপং রূপং প্রতিরূপো বভূব।
একস্তথা সর্ব্বভূতান্তরাত্মা রূপং প্রতিরূপো বহিশ্চ॥
( কঠ উপনিষদ, ২/২/৯)
অর্থাৎ, যেমন এক অগ্নি জগতে প্রবিষ্ট হয়ে নানারূপে প্রকাশিত হয়েছে, তদ্রূপ সেই সর্বভূতের অন্তরাত্মা এক ব্রহ্ম নানারূপে প্রকাশিত হচ্ছেন, আবার তিনি জগতের বাইরেও আছেন।
উপমার ভাষায় আমাদের শাস্ত্রগ্রন্থ সমূহের সাথে সম্বন্ধ-বিষয়ে বেদ এভাবেই সম্বন্ধ সম্পন্ন। একই অগ্নি যেমন প্রতি পদার্থে প্রবিষ্ট হয়ে সেই সেই পদার্থের প্রতিরূপ প্রাপ্ত হন; অনন্ত শাস্ত্র-সমুদ্রের মধ্যে বেদ সেভাবে ওতঃপ্রোতঃ ভাবে বিরাজমান রয়েছে। অন্য কথায়, বেদ-রূপ আকর হতেই শাস্ত্ররত্ন-সমূহ সমুদ্ভূত হয়েছে। বেদ-এক ও অদ্বিতীয়। কালক্রমে শাস্ত্র আকারে বেদ প্রথমে ত্রিধা বিভক্ত হয়; সে কারণে বেদের এক নাম ‘ত্রয়ী’। পরিশেষে শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসদেব চারভাগে বিভক্ত করে বেদব্যাস নামে অভিহিত হন। যুগ-ধর্মের সুবিধার জন্য তিনি চারভাগে বেদ বিভক্ত করেছিলেন, ইহাই সাধারণতঃ প্রকাশ। যখন বেদের নাম ছিল ‘ত্রয়ী’; তখন ঋক্, সাম, যজু এই তিন বিভাগে উহা বিভক্ত হোত। ঋক্ ভাগে পদ্য, সাম ভাগে গীত, এবং যজুঃ ভাগে গদ্য বিন্যস্ত ছিল। যজ্ঞকর্মে সুবিধার জন্য বেদ চারভাগে বিভক্ত হয়। তখন যজ্ঞবিধিতে প্রয়োজনীয় অংশ ভিন্ন অন্য অংশ অথর্ব্ববেদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। যজ্ঞে অপ্রয়োজন, সুতরাং অথর্ব্ব,- এই হেতুই উহার অথর্ব্ব নাম হয়েছিল। কেউ আবার বলেন- অথর্ব্ব ঋষি যজ্ঞে সুবিধার জন্য যজ্ঞে অব্যবহার্য্য সূক্তগুলিকে স্বতন্ত্রভাবে রক্ষা করেছিলেন বলে, ঋষির নাম অনুসারে ঐ অংশের নাম অথর্ব্ব-বেদ হয়েছিল। ফলতঃ একই বেদ যে চারভাগে বিভক্ত হয়, এবং ক্রমশঃ এর শাখা-প্রশাখা-রূপ শাস্ত্র-সমূহের অভ্যুদয় ঘটে, সেবিষয়ে মতবিরোধ নেই। এক হতে বহু, কাণ্ড হতে শাখা-প্রশাখা। একই অগ্নি যেমন আধার-ভেদে ভিন্ন রূপে ভিন্ন নামে অবহিত হন; একই বেদ সেই প্রকার বিভিন্ন আকারে ও বিভিন্ন নামে সংসারে বিস্তৃত হয়ে আছেন। শাস্ত্র-সমুদ্র মন্থন করলে সেই রত্নই উত্থিত হয়-যার নাম ‘বেদ’। সকল শাস্ত্রের, সকল জ্ঞানের, সকল ধর্মের যা সারভূত; তাকেই ‘বেদ’ বলে। সকল সমাজের, সকল লোকের, সকল জীবের যা প্রাণ স্বরূপ; তাকেই ‘বেদ’ বলা হয়।
চলবে-নিবেদনে- সনাতন সংবেদ।
কোন মন্তব্য নেই