sanatansangbed

Introduction of SANATAN dharma scriptures

ঋগ্বেদ সংহিতা ভূমিকা-১২(বেদে সাম্য-ভাব)

বেদে সাম্য-ভাব
বেদ-তত্ত্ব যে অতি জটিল, বেদের স্বরূপ বুঝতে গেলে যে তদ্বিষয়ক অনেক আলোচনার আবশ্যক হয়, উপরে-উক্ত ষড়ঙ্গ আদির প্রসঙ্গ অনুধাবন করলে তা হৃদগম্য হতে পারে। সকল জ্ঞানে জ্ঞানী হতে পারলে, সাহিত্য-ইতিহাস-বিজ্ঞান-দর্শন ভূলোকের দ্যুলোকের সকল তত্ত্ব অধিগত হলে, তবে বেদ অধ্যয়নে সফল-কাম হওয়া যায়। বেদপাঠে যে বহু প্রতিবন্ধক বিষয় প্রচার করা হয়, বেদপাঠে-প্রয়োজনীয় অধিকারী অনধিকারী প্রসঙ্গে যে গভীর কূটতত্ত্ব উঠানো-হয়, তার কারণ আর অন্য কিছুই নয়। তার একমাত্র কারণ-অপব্যবহারের আশঙ্কা। যে জন যে সামগ্রীর মর্ম গ্রহণ করতে অক্ষম, তাকে সে সামগ্রী প্রদান করে কি ফল আছে? দুগ্ধপোষ্য শিশু মণি-মাণিক্য পেলে গলাধঃকরণ করতে প্রয়াস পায়। সে জানে না, সে বোঝে না-সে মণিমাণিক্য কি জন্য সমাদৃত হয়। অজ্ঞান শিশু বহু-মূল্য রত্ন প্রাপ্ত হলেও অবহেলায় দূরে নিক্ষেপ করতে পারে। বেদমর্ম বুঝতে যাদের সামর্থ্য নেই, পরন্তু যাঁরা বেদমার্গে অগ্রসর হওয়ার সামান্য সামর্থ্যটুকু পর্য্যন্ত লাভ করতে পারে নাই, তাদের কে বেদ অধ্যয়নে বিরত করাই বিধেয়। কেন-না, হিতে বিপরীত ফল ফলতে পারে। অমৃতের অথবা বিষের ব্যবহার যারা না জানে, তাদের নিকট দুই সামগ্রী দুই বিপরীত ফলই প্রদান করে থাকে। যাঁরা বলেন, ব্রাহ্মণগণ স্বার্থপর ছিলেন বলেই, আপনাদের মধ্যে জ্ঞানের আলোক আবদ্ধ রাখবেন বলেই, বেদ অধ্যয়নে আপামর সাধারণ সকলকে অধিকার দেন নাই; তাঁদের বিভ্রান্ত বলে ঘোষণা করতে পারি। এ বিষয়ে বেদবিৎ জৈনিক মনস্বীর উক্তি উদ্ধৃত করছি। তাতেই বুঝতে পারব, ব্রাহ্মণ-গণ কেন সাম্যবাদী ছিলেন, জগজ্জনের হিতের জন্য সমভাবে তাঁরা কিরকম প্রয়াস পেতেন। সে উক্তি- “আধুনিক সভ্যগণ যে সাম্যভাবের পক্ষপাতী- যে সাম্যভাবের অভাব দেখিয়ে তাঁরা ব্রাহ্মণ্য-ধর্মের প্রতি দোষারোপ করতে বন্ধপরিকর-যে সাম্যভাবের ব্যত্যয় ঘোষণার ফলে বহুতর শূদ্র বংশধর আজ ব্রাহ্মণ গণকে মূল শত্রুভাবে দেখে থাকেন; সেই সামরূপ অতুল্য রত্ন বৈদিককালে এই ব্রাহ্মণগণ কর্ত্তৃক কিরকম বিমুক্তকন্ঠে বিগীত হত, তার পক্ষে অথর্ব্ব-সংহিতার উনবিংশ কাণ্ডের সপ্তম অনুবাকের অষ্টম সূক্তের প্রথম মন্ত্র’ই যথেষ্ট নিদর্শন। যথা,-
প্রিয়ং মা কৃণূ দেবেষু প্রিয়ং রাজসু মা কৃণু।
প্রিয়ং সর্ব্বস্য পশ্যতঃ উত শূদ্র উতার্য্যে॥
অর্থ, ‘হে জগদীশ্বর! দেবদলের মধ্যেই প্রিয়বিধান করিও না, রাজন্যবর্গেই যেন তোমার প্রীতি আবদ্ধ না থাকে; প্রত্যুত সকলের প্রতিই সমভাবে প্রীতিদৃষ্টি কর-কি শূদ্রজাতিতে, কি আর্য্যজাতিতে। এমন স্থান-সমূহে ‘দেব’ শব্দে তপোবিদ্যা প্রভাবে দীপ্তিশালী ব্রহ্মণ্য অনুরক্ত ব্রাহ্মণ অর্থাৎ জ্ঞানী বুঝায়, রাজ শব্দে সামান্য ভূস্বামী প্রভৃতি সম্রাট পর্য্যন্ত ধনী এবং আর্য্য শব্দে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য এই ত্রিবিধ মাননীয় জাতি বুঝায়; আর শূদ্র শব্দে দাস ও দস্যু এই দ্বিবিধ জাতি বুঝতে হবে। সেকালে ম্লেচ্ছ যবন প্রভৃতি দস্যুরাই প্রকারভেদে ছিল। আর্য্যমতে মানবজাতি এই পঞ্চবিধ শ্রেণীতে বিভক্ত বলেই ‘পঞ্চজন’ শব্দটিও মনুষ্য শব্দের পর্য্যায় রূপে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। উপরে-প্রদর্শিত মন্ত্রটি আলোচিত হলে ইহা অনবগত থাকে না যে, প্রাচীন কালের অর্থাৎ বৈদিককালের ব্রাহ্মণগণ কদাপি কিছু মাত্র স্বার্থপর ছিলেন না;-এ জগতে, কেবল জ্ঞানীর বা ব্রহ্মণ-জাতিরই প্রিয়কার্য্য সংসাধিত হোক, অথবা কেবল বলী ও ধনী বা ক্ষত্রিয় বৈশ্যেরই প্রিয় হোক, কিম্বা একমাত্র আর্য্য-জাতিরই মঙ্গল হোক,-তাঁদের এরকম প্রার্থনা ছিল না; প্রত্যুত সাম্যমন্ত্রে দীক্ষিত, মহাসভ্য সেই ব্রাহ্মণগণের এক সময়ে এই প্রার্থনা ছিল যে,- কি জ্ঞানী কি অজ্ঞান কি বলী, কি দুর্ব্বল, কি ধনী কি নির্ধন, কি আর্য্য, কি অনার্য্য-মানুষ-মাত্রের প্রিয় অর্থাৎ অভীষ্ট সংসিদ্ধি হোক। অতঃপর বিবেচনা করা আবশ্যক, এরকম বচনগুলি যাঁদের হৃদয়-কন্দর হতে প্রকাশ পেয়েছে এবং যে সমাজে চিরদিন মন্ত্ররূপে সমাদৃত হয়ে আসছে, সেই মহাত্মদেরকে এবং সেই সমাজকে স্বার্থপর ও বিজাতি-সমুচ্ছেদক বলে নির্ণয় করা কতদূর সঙ্গত? (১২৯৯ সালের ৩০এ ফাল্গুনের অনুসন্ধানে পণ্ডিত প্রবর সত্যব্রত সামশ্রমী মহাশয়ের লেখা প্রবদ্ধ থেকে) ঋগ্বেদের মন্ত্রেও এই সাম্যভাবের বিকাশ দেখতে পাই। সেখানে মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি প্রার্থনা করছেন-হে জগজ্জন! তোমরা অভিন্ন-হৃদয় হয়ে কার্য্যক্ষেত্রে প্রবেশ কর, তোমাদের বাক্য অবিরোধ ও অভিন্ন হোক, তোমাদের মন অবিরোধে পরম জ্ঞান লাভ করুক; সমান মন্ত্র, সমান মন, সমান সমিতি, সমান চিত্ত হয়ে তোমরা কার্য্য কর; তোমাদের আকূতি (মনোভাব-আশা আকাঙ্ক্ষা) এক হোক, হৃদয় এক হোক, অন্তর এক হোক; আর তোমাদের সেই একত্ব প্রভাবে তোমাদের সাহিত্য সুশোভন হয়ে উঠুক। পরম সাম্যভাব- মূলক ঋগ্বেদের(দশম মণ্ডল দ্রষ্টব্য) সেই মন্ত্র নিম্নে উদ্ধৃত করছি; যথা,- 
“সংগচ্ছধ্বং সংবদধ্বং সং বো মনাংসিজানতাং।
দেবাভাগং যথাপূর্ব্বে সংজানানাহউপাসতে॥
সমানো মন্ত্রঃ সমিতিঃ সমানী সমানং মনঃ সহচিত্তমেষাং।
সমানং মন্ত্রমভিমন্ত্রয়েবঃ সমানে নবোহবিষা জুহোমি॥
সমানীবহয়াকূতিঃ সমানাহৃদয়ানিবঃ।
সমানমস্তু বো মনোয়থাবঃ সুহাসতি॥”
জ্ঞান কখনও কার ও একায়ত্ত হবার নয়। জ্ঞান-স্বরূপ বেদ কখনও তদ্রুপ বাণী ঘোষণা করে না। সকলই সমান হোক সকলেই সমান জ্ঞানে জ্ঞানী হোক, সকলেই জ্ঞানময়ের দিব্য প্রভাব দর্শন করুক, ভগবানের এই অভিপ্রায়। কিন্তু একটা শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে, একটা ক্রমবিকাশের ধারা বেয়ে, সকলকে অভ্যুদয়ের পথে অগ্রসর হতে হবে। জন্মগ্রহণ করা মাত্র একেবারেই কেউ বাক্‌-শক্তি, চলন শক্তি ও পূর্ণজ্ঞান লাভ করে না। স্তরে স্তরে, সিঁড়ি পর সিঁড়ি অতিক্রম করেই, জ্ঞান-রাজ্যে প্রবেশ করতে হবে। এটাই বিশ্ববিধাতার বিধান বৈচিত্র্য। তিনি সমান ব্যবস্থা রেখেছেন-সকলের জন্য; তিনি সাম্যভাবের বিধান করেছেন-সকলের পক্ষে; তিনি সমভাবে কৃপাপরায়ণ আছেন-সকলের প্রতিই। কিন্তু তাঁর বিধান এই যে, সকলকে একটি নির্দ্দিষ্ট নিয়মের মধ্য দিয়ে  চলতে হবে। সে নিয়ম অতিক্রম করার সাধ্য কারও নেই। সে নিয়ম অনুসারে চলেই জড় অজড় হবে, অচেতন চেতন হবে, মনুষ্যতর প্রাণী মনুষ্যত্ব পাবে, মানুষ দেবত্ব লাভ করতে সমর্থ হবে। বেদ-বিষয়ে অভিজ্ঞতা লাভ করতে হলে, সেরকম একটি নিয়মের মধ্য দিয়েই অগ্রসর হতে হবে। আর এই নিয়ম-সমূহে পরিচালিত হতে হতেই বেদ-রূপ পরম-জ্ঞান অধিগত হয়ে আসবে।
ক্রমশ- 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.