sanatansangbed

Introduction of SANATAN dharma scriptures

পুরাণধর্মী শাস্ত্রের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য

পুরাণের প্রথম শর্তই হল পুরাণকে ভক্তিমার্গ হতে হবে। স্বাভাবিক ভাবেই তাই জ্ঞানমার্গীদের জন্য পুরাণ নয়। জ্ঞানীরা পুরাণের কথা মানবেই না, কারণ তারা ভগবানের কোন সাকার রূপকে স্বীকারই করে না। ভক্তের ভগবান সব সময়ই সগুণ সাকার, তার সাধনার পথ শরণাগতি। প্রথম হল, ভক্তিমার্গে ভক্ত যেখানে পৌঁছায় জ্ঞানমার্গে জ্ঞানীও সেখানে পৌঁছায়। দ্বিতীয় ভক্তের ভগবান সগুণ সাকার। তৃতীয়, সেই কারণেই ভক্ত শরণাগত হন। চতুর্থ, শরণাগত এবং শরণদাতার কাহিনীই পুরাণ। ইতিহাস পুরাণেও একই জিনিষ কিন্তু পুরাণের মত ইতিহাসে শরণাগতীর উপর এতটা জোর দেওয়া হয়নি। বাল্মীকি রামায়ণ থেকে যখনই অধ্যাত্ম রামায়ণে যাবো তখনই সেখানে পদে পদে শরণাগতির কথাই পাওয়া যাবে, যেখানে দেবতারা ভগবান বিষ্ণুর শরণাগত হচ্ছেন, বিশ্বামিত্র ভগবানের শরণাগত হচ্ছেন, ঋষিরা ভগবানের শরণাগত হচ্ছেন, রাক্ষসরাও ভগবানের শরণাগত। শরণাগত, শরণদাতা আর শরণাগতি এই তিনটিকে মিলিয়ে যে কাহিনী তৈরী হয় সেটাই মিথকের রূপ নিয়ে নেয়। এই কারণে বাল্মীকি রামায়ণকে পুরাণের মধ্যে গণ্য করা যায় না। অন্য দিকে অধ্যাত্ম রামায়ণ পুরোপুরি পুরাণধর্মী। উপনিষদ যে কথা বলেছে, গীতা যে কথা বলছে, ভাগবতও কিন্তু সেই একই কথা বলছে, কিন্তু তিনটেই দর্শনধর্মী আর পুরাণধর্মী পৃথক শাস্ত্র রূপে গণ্য হচ্ছে। যদিও আমরা বলছি, যাঁরা শরণাগত হয়েছিলেন, যাঁর শরণাগত হয়েছিলেন আর যে পথে শরণাগত হয়েছিলেন এই তিনটেকে মিলিয়ে যে কাহিণী সেটাই আস্তে আস্তে পুরাণের রূপ নেয়, কিন্তু পুরাণের ঠিক ঠিক পরিভাষা আলাদা, যেটা একটু পরেই আমাদের আলোচনাতে আসবে। তবে যে কোন ধর্মে যে মিথক তৈরি হয় সেটা ঠিক এভাবেই তৈরি হয়। 

আগেকার দিনে সমাজে একমাত্র যাঁরা বিদ্বান ও জ্ঞানী ব্রাহ্মণ ছিলেন তাঁরাই শুধু বেদ উপনিষদ চর্চা করতেন বেদেও প্রচুর পৌরাণিক কাহিনী থাকলেও বেদের ব্রাহ্মণরা পুরাণের দ্বারস্থ হতেন না। বর্তমান ভারতের জনসংখ্যার মাত্র দশ শতাংশেরও কম ব্রাহ্মণ, এই দশ শতাংশ ব্রাহ্মণদের মধ্যে আবার মুষ্টিমেয় কয়েকজনই জ্ঞানী বিদ্বজন ব্রাহ্মণ। এই মুষ্টিমেয় কয়েকজন ব্রাহ্মণ ছাড়া ভারতের বাকী সবাই পুরাণধর্মী শাস্ত্রের অনুগামী। এদের ধর্মই হল পুরাণ। আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগেও ভারতে পুরাণধর্মী শাস্ত্রের এত প্রভাব ছিল যে মুসলমান নেতাদের মনেও ভয় ঢুকে গিয়েছিল। তারা দেখল, যেভাবে হিন্দু ধর্ম সব কিছুকেই ভগবানের বিগ্রহ বানিয়ে দিয়ে পূজা করে, কদিন পর দেখা যাবে আল্লাকেও এরা একটা কোন বিগ্রহ বানিয়ে নিয়েছে আর মহম্মদকে একজন অবতার রূপে দাঁড় করিয়ে দিয়ে মুসলমান ধর্মকে হিন্দু ধর্মেরই একটা অঙ্গ তৈরী করে দিয়েছে। যার জন্য পরবর্তি কালে মুসলমানরা নিজেদের হিন্দুদের থেকে আলাদা প্রমাণ করার জন্য দেওবান্দ থেকে নানা রকমের ফতোয় দিতে শুরু করল। এমনিতেই প্রচার ও বিস্তারে পুরাণ ভারতে এত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল যে, মনে হত পুরাণ মানেই হিন্দু ধর্ম আর হিন্দু ধর্ম মানেই পুরাণ। তার কারণ, হিন্দুদের পুরাণধর্মী শাস্ত্র যে কোন ধর্মের যে কোন কাহিনী, যে কোন দেবতা, যে কোন বিগ্রহকে নিজের মধ্যে আত্মসাৎ করে নেওয়ার ক্ষমতা ধরে। বলে, ভারতের গরু যা পায় সব খেয়ে নেয়, কাগজ পেলে কাগজ খেয়ে নেয়, কাপড় পড়ে থাকলে সেটাও খেয়ে নেয়, আবর্জনা থাকলে সেটাও খেয়ে নিয়ে দুধ তৈরী করে বার করে দেয়। বলা হয় হিন্দু ধর্মও ঠিক সেই রকম, বিশ্বের যত রকম ধর্ম আছে সব কটাকে হিন্দু ধর্ম গিলে নিজের মত আত্মসাৎ করে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে। আগামীকাল যদি জানা যায় মঙ্গল গ্রহে মানুষ আছে, তাদের একটা বিচিত্র ধর্ম আছে যেটা কল্পনার বাইরে, ওই ধর্মটাকে যদি ভারতে নিয়ে ফেলে দেওয়া হয় তাহলে দুদিন পর ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে একটা নতুন কিছু বার করে দেবে। এই আত্মীকরণটা সম্ভব হচ্ছে একমাত্র পুরাণের সৌজন্যে। 
যদিও নতুন করে আর পুরাণ লেখা হচ্ছে না, কিন্তু এখন পর্যন্ত পুরাণের যত কাহিনী বা পুরাণ কথা আমাদের সামনে আছে, বিশেষ করে ভাগবত পুরাণ প্রথম যখনই লেখা হয়ে থাকুক কিন্তু বর্তমানে আমরা যে অবস্থায় পাচ্ছি সেটা পণ্ডিতদের মতে অষ্টম শতাব্দীতে শেষ রুপ পেয়েছে। ইতিহাসবিদরা নানা রকম যুক্তিতর্ক দিয়ে এই দিনকাল গুলো খুঁজে বার করেন। ভাগবত পুরাণের পরবর্তি পুরাণ গুলো আরও পরের দিকে রচিত হয়েছে। ভবিষ্যৎ পুরাণে মুসলিম রাজাদের বর্ণনা ও পাওয়া যায়, যেখানে বলা হচ্ছে ভারতে এই এই মুসলমানরা রাজত্ব করবে। এতদূর ভবিষ্যৎ দৃষ্টিতো কারুর তখন থাকার কথা নয়, নিশ্চয়ই তাঁরা মুসলমানদের রাজত্ব দেখেছিলেন। সমস্ত পুরাণের শেষ সংস্করণ মোটামুটি ষোড়শ বা সপ্তদশ শতাব্দিতে এসে করা হয়েছে। এখন ছাপাখানা এসে গেছে, নিজের থেকে পাতা যোগ করে দেওয়াটা বন্ধ হয়ে গেছে। 
পুরাণ হল ঠিক ঠিক জনগণের ধর্ম। বেদ-উপনিষদের ধর্ম মুষ্টিমাত্র কয়েকজন অধিকারীর জন্য নির্দিষ্ট ছিল। মুষ্টিমাত্র কয়েকজনের জন্য ছিল বলেই হিন্দু ধর্ম এখনও তার স্বকীয়তাকে ধরে রেখে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে। স্বামিজী এক জায়গায় বলেছেন- যে ধর্মের নিজস্ব কোন শাস্ত্র গ্রন্থ আছে সেই ধর্মই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে, বাকী ধর্মগুলো হারিয়ে যাবে। এই ধর্মগুলি হল- জহুদি, পার্সি যা কিনা পরের দিকে খ্রীশ্চান আর মুসলমানদের সঙ্গে মিশে যায় এবং হিন্দুধর্ম। এই ধর্মগুলো নিজেদের গ্রন্থকে ঠিক ঠিক ভাবে ধরে রেখেছে। ধর্মগ্রন্থের আরেকটি শর্ত হল, এর একটি শব্দেরও যেন পরিবর্তন না হয়। যদি কয়েকজন পণ্ডিত মিলে কোন ধর্মগ্রন্থে দশটা পাতা যোগ করে দেয় বা দশটি পাতা সরিয়ে দেয় তাহলে ঐ ধর্ম আর টিকে থাকতে পারবে না। ছোটখাটো অনেক ধর্ম উঠেছে, কিছু দিন থেকেছে পরে একটা সময় হারিয়ে গেছে, তার কারণ তাদের নিজস্ব কোন ধর্মগ্রন্থ ছিল না। 
বেদের পরে ভারতে দুটো ধর্মের আবির্ভাব হয়েছিল- জৈনধর্ম আর বৌদ্ধধর্ম। এদের মধ্যে জৈনধর্ম একটা বিশেষ গোষ্টির মধ্যে আবদ্ধ থেকে গেল। কারণ এমন এমন কঠোর তপস্যার কথা জৈনধর্মে বলা হয়েছে যেগুলো সাধারণ মানুষের পক্ষে পালন করা অসম্ভব ছিল। তবে জৈনরা নিজের ধর্মের প্রতি অত্যন্ত নিষ্ঠাবান এবং গোঁড়। জৈনদের প্রচুর আচার বিধি আবার হিন্দুদের সাথে এমন ভাবে মিলে মিশে গেছে যে মাঝে মাঝে দুটোকে আলাদা করা খুব কঠিন হয়ে যায়। অন্য দিকে জৈনরা অহিংসা ব্রত অনুশীলন করার জন্য অনেক ধরণের কাজ করে না, কৃষিকাজ করবে না, সৈন্য বাহিনীতে কাজ করবে না। সেইজন্য তারা একমাত্র ব্যবসাবাণিজ্যের পেশাকেই অবলম্বন করে জীবন ধারণ করে। অহিংসাব্রত, নিরামিশ খাওয়া এই জিনিষগুলো জৈনদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ অনুশীলন। যার জন্য জৈনধর্ম কোন দিন সাধারণের কর্ম হতে পারলো না। 
অন্য দিকে বৌদ্ধধর্ম রাতারাতি সাধারণের ধর্ম হয়ে গিয়েছিল। ভগবান বুদ্ধের তিনশ বছর পর সম্রাট অশোকের আবির্ভাবের সময় সারা ভারতে বৌদ্ধ ধর্ম ব্যাপক ভাবে প্রসার লাভ করেছিল। বৌদ্ধধর্মের এই প্রসার ও জনপ্রিয়তার স্থায়িত্ব সম্রাট হর্ষবর্ধন পর্যন্ত বজায় ছিল। প্রায় হাজার বছর যাবৎ বৌদ্ধধর্মের প্রভাব ভারতকে গ্রাস করে রেখেছিল। বৌদ্ধধর্মের কিছু কিছু দুর্বলতার মধ্যে প্রধান দুর্বলতা ছিল বৌদ্ধধর্ম পুরোপুরি সন্ন্যাসীদের, সাধারণ মানুষের জন্য নয়। সাধারণ মানুষ জানে একটু তুলসী পাতা, মহাপ্রসাদ খেয়ে, গঙ্গাজল পান করে মন্দিরে গিয়ে ঠাকুর প্রণাম করেই আমার সব ধর্ম পালন হয়ে যাবে আর আমিও শান্তি পেয়ে যাব, কে বাবা অত ত্যাগ বৈরাগ্য আর শাস্ত্রের যুক্তি বিচার করতে যাবে! শান্তি যদি চাও তো অত শাস্ত্র পাঠের কোন প্রয়োজন নেই, শুধু এই ভাবে ধর্মাচরণ করে যাও তাতেই শান্তি পাবে। সাধারণ মানুষ এটাই চায়। অনেকে বলবেন- ঠাকুরও তো এই কথা বলছেন। ঠাকুর গল্প করছেন, একজন পণ্ডিতকে মাঝি নৌকা করে পার করে দিচ্ছে। পণ্ডিত মাঝিকে জিজ্ঞেস করছে ‘কি গো! তোমর শাস্ত্র-টাস্ত্র পড়া আছে? ষড়দর্শন কিছু পড়া আছে?’ ষড়দর্শন কিছু পড়া আছে? মাঝী বলছে ‘না ঠাকুর আমার কিছুই পড়া নেই। ‘তাহলে তো তোমার এই জীবনটা বৃথাই গেল’। কিছু পরে প্রচণ্ড ঝড় উঠেছে। মাঝি তখন পণ্ডিতকে জিজ্ঞাস করছে ‘ঠাকুরমশাই! আপনি আপনি সাঁতার জানেন তো?' 'আমি তো সাঁতার জানি না। ;তাহলে তো আপনার পুরো জীবনটাই গেল'। কিন্তু ঠাকুর সাঁতার জানার কথা যেটা বলছেন এখানে তিনি আধ্যাত্মিকতার কথা বলছেন। তোমাদের শাস্ত্রজ্ঞান থাকতে পারে কিন্তু তুমি আধ্যাত্মিকতার ব্যাপারে কতটা জেনেছ সেটা নিয়েই ঠাকুর বলছেন, গঙ্গাজল পান করা, তুলসী পাতা খাওয়া নিয়ে বলছেন না। এগুলো ধর্মই,কেউ অস্বীকার করবে না। কিন্তু এই ধর্ম পণ্ডিতের শাস্ত্রজ্ঞান থেকে অনেক নিকৃষ্ট। মাঝি ঠিকই বলছে, তোমরা পুরো জীবনটাই গেল। কিন্তু যারা তুলসী পাতা খেয়ে আর গঙ্গাজল পান করে, খিচুড়ি ভোগ খেয়ে দিন কাটাচ্ছে তারা ঐ পণ্ডিতের থেকে আরও অধম। রাস্তার কুকুর তো কত অনন্দে আছে, এখান থেকে ওখান থেকে কত রকম খাওয়ার পেয়ে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে পাড়ার ছেলেরা আবার আদর করে খাওয়াচ্ছে। কত আনন্দে আছে। আমরা কি এই আনন্দ নিয়ে জীবন কাটাতে চাইব? কখনই নয়। পুপুলার রিলিজিয়ান মানেই তাই, পুপুলার রিলিজিয়ানে বলবে তুমি তুলসীপাতা খেয়ে যাও আর গঙ্গাজল পান করে যাও, তাতেই শান্তি, কোন শাস্ত্র পাঠ করতে হবে না, কোন বিচার করতে হবে না। 
বৌদ্ধ ধর্ম একদিকে হয়ে গেল পপুলার রিলিজিয়ান, কিন্তু পপুলার রিলিজিয়ান হওয়ার উপকরণ বৌদ্ধ ধর্মে ছিল না। ভগবান বুদ্ধ গৃহস্থদের জন্যও অনেক কিছু বলে দিলেন, গৃহস্থকেও চিন্তন মনন করতে হবে, তাদের চেতনাকে সব সময় জাগ্রত রাখতে হবে। কিন্তু গৃহস্থ এত চিন্তন মনন করবে কিভাবে! তার মাথায় তো আগে থাকতেই দশ মন চিন্তাতে ভরে আছে। চিন্তন মনন যদি করতে পারতো তাহলে তো উপনিষদই ছিল, উপনিষদের দর্শনকে ধারণা করতে পারছে না বলেই তো তারা বৌদ্ধ ধর্মের দিকে ঝুঁকল। ভগবান বুদ্ধকে যখন যোখের সামনে পেয়ে গেল সবাই তার অনুগামী হয়ে গেল। যখন মুসলমান ফকির বাবারা ভারতে এলেন তখন অনেক হিন্দুরা শিষ্য হয়ে গেল। রাজনিষ, সাঁইবাবাদের আবার অনেক মুসলমান শিষ্যও আছে। এর কারণ হল ভারতের মানুষ যখনই কোন সাধুবাবাকে কাছে পেয়ে যায় তখনই তারা মনে করে আমার জীবনের সমস্যা সমাধানের সহজ পথ ইনিই বলে দিতে পারবেন। কিন্তু সেই দিক থেকে দেখতে গেলে ভগবানের বুদ্ধের পথ সহজ পথ ছিল না। 
বৌদ্ধ ধর্ম পরবর্তি কালে যখন মানুষের জন্য সহজ পথ দেওয়া শুরু করল, তখনই বৌদ্ধ ধর্মের পতন শুরু করল। ওরা প্রথমেই খুলে দিল তন্ত্র সাধনার রাস্তা। বৌদ্ধ ধর্মের তন্ত্র সাধনায় মহানির্বাণ তন্ত্রের কোন কিছু ছিল না। বৌদ্ধ মতের তন্ত্রে শুধু নোংরামি আর ব্যাভিচার। বৌদ্ধ ধর্ম প্রথমে যেটা ভুল করল তা হল অধিকারী বিচার না করে সবার জন্য সন্ন্যাসের বাস্তা খুলে দিল। নিজের ছেলেকে কোন রকমে সন্ন্যাস করে দিলেই তো বৈরাগ্য এসে যাবে না। তার ভেতরে ভোগ বাসনা গিজ্‌ গিজ্‌ করছে। এদের কারুরই সেই ধরণের কোন শাস্ত্র অধ্যয়ন নেই, চিন্তন মনন নেই। কিছু দিন যেতে না যেতেই এরাই হয়ে গেল গুরু। এরা এবার শিষ্যদের বাড়ি বাড়ি মাংস-ভাত খেয়ে বেড়াতে শুরু করল আর তন্ত্রের নামে অনাচার চালিয়ে যেতে আরম্ভ করল। এইভাবে ভারত থেকে বৌদ্ধ ধর্ম শেষ হয়ে গেল। বৌদ্ধ ধর্মের দুটো রুপ একটা মূল ধর্ম আরেকটি প্রচলিত ধর্ম। হিন্দু ধর্মেও মূল ধর্ম ও প্রচলিত ধর্ম আছে, হিন্দু ধর্মের মূল হল উপনিষদ। সব ধর্মের মূল ধর্ম কিন্তু এক। কিন্তু সব ধর্মের মধ্যে তফাৎ হয়ে যায় প্রচলিত ধর্মে এসে। ঠাকুর যখন বলছেন সব ধর্মই এক জায়গায় নিয়ে যায় তখন ঠাকুর প্রচলিত ধর্ম নিয়ে বলছেন না, তিনি মূল ধর্মের ব্যাপারেই বলছেন। স্বামীজী বলছেন- আমাদের সবারই পুরাণের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা দরকার, কারণ পুরাণ আমাদের হিন্দু ধর্মের সারমর্মকে, হিন্দু ধর্মের আগে পেছনে যা কিছু আছে সব কিছুকে সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরেছে। কেউ যদি ভাগবত পুরাণ প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত নিষ্ঠা নিয়ে অধ্যয়ন করেন তাহলে তিনি হিন্দু ধর্মের সারটা জেনে যাবেন। ঠাকুর কয়েকটি ধর্মগ্রন্থ খুব মন দিয়ে শুনেছিলেন, যার মধ্যে ভাগবত, অধ্যাত্ম রামায়ণ, মহানির্বাণতন্ত্র এই গ্রন্থগুলো ছিল। এই বইগুলোর বাইরে তিনি বেদান্তের উপর কিছু কিছু বই যেমন মুক্তি ও তার উপায়, জীবনমুক্তি বিবেক, অষ্টাবক্র সংহিতা এই বইগুলোও শুনতেন। এর ধরণের কিছু কিছু বই ঠাকুরের ঘরেই থাকত। 
বৌদ্ধ ধর্মের প্রচলিত ধর্ম ভারতকে যে অধঃপতনের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, পুরাণ সেই পতন থেকে ভারতকে রক্ষা করেছিল। শুধু রক্ষা করেই পুরাণ তার দায়ীত্ব শেষ করে দেয়নি, সাথে সাথে সাধারণ মানুষের জন্য অতি সুন্দর একটা প্রাণবন্ত কার্যকরী ধর্ম দিয়ে দিল, যে ধর্মের মধ্যে সমগ্র হিন্দু ধর্মের সারকে স্থাপন করে দেওয়া হয়েছে। জনপ্রিয় ধর্ম হয়েও পুরাণ সুকৌশলে মানুষের কাছে ধর্মের সার তত্ত্বকে পৌঁছে দেওয়ার কাজে সফল হয়েছিল। ছোট্ট ধর্মগ্রন্থ হিসাবে গীতা জনপ্রিয় হতে পারে, কিন্তু গীতার অর্থ ও ভাবকে সাধারণের পক্ষে বোঝা ও ধারণা করা অত্যন্ত দুরুহ। একদিকে খুব উচ্চ আধ্যাত্মিক তত্ত্ব আবার অন্য দিকে এই তত্ত্বকেই কথা ও কাহিনীর মাধ্যমে খুব সহজ প্রচলিত প্রথায় অথচ এক উন্নত কাব্যিক শৈলীতে পরিবেশন করার মুন্সিয়ানা পুরাণ ছাড়া বিশ্বের আর কোন ধর্মগ্রন্থ দেখাতে পারেনি। সাধারণ মানুষ তত্ত্ব কথা সরাসরি শুনতে চায় না, তাদেরও দোষ দেওয়া যায় না, কারণ তত্ত্ব কথা শোনা আর ধারণা করার জন্য চাই বিশেষ ভাবে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত উন্নত মস্তিষ্ক। 
মেঘনাদবধ কাব্যকে কি আমরা পুরাণ বলতে পারি? সবাই স্বীকার করবেন মেঘনাদবধ কাব্য খুবই উচ্চমানের সাহিত্য আর কাব্যিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ। কিন্তু আধ্যাত্মিক ভাব ও তত্ত্বের অনুপস্থিতির জন্য পুরাণের মত সন্মান মেঘনাদবধ কাব্য কোন দিন পাবে না। পুরাণে যে শুধু কাহিনী আর উচ্চ আধ্যাত্মিক তত্ত্বই আছে তা নয়, পুরাণে সব কিছুই আছে। পুরাণে উপাচার, সামাজিক আচার আচরণ বিধির কথা সবটাই মিলে মিশে রয়েছে। স্বামীজী এক জায়গায় বলছেন, ভারতের জনগন যা কিছু কর্ম করে তার সব কর্মই বেদের কর্মকাণ্ড থেকে এসেছে, কিন্তু তারা কেউ বেদের কর্মকণ্ডকে অনুসরণ করে না, বেশীর ভাগ লোকই যে কোন কর্ম করার সময় অনুসরণ করে পুরাণ আর তন্ত্রকে। ঠাকুরও বলছেন কলিতে বেদ মত চলে না। কারণ বেদ মতে কর্মকাণ্ড করতে গেলে যে উপকরণের প্রয়োজন সেগুলো এখন আর কেউ জোগাড়ই করতে পারবে না, কর্মকাণ্ডের বিচিত্র নিয়মাবলীও কেউ পালন করতে পারবে না। এখনও কিছু কিছু ব্রাহ্মণরা যে টুকটাক বেদের কর্মকাণ্ড করেন সেখানেও দেখা যায় তাঁরা কর্মকাণ্ডের বাইরে গিয়ে এমন কিছু কিছু উপাচার পালন করছেন, যে উপাচার গুলো তাঁরা বেদ মতে করছেন না, তন্ত্র মতে বা পুরাণ মতেই করছেন। পুরাণের তাই এত বেশী সন্মান। স্বামীজীও বলছেন, ভারতের আজ যে ধর্ম, আমরা যা কিছু ধর্মীয় চিন্তা-ভাবনা করি সবই পুরাণ মতে। 
এটা ঠিক যে মহাভারত হিন্দু ধর্মকে একটা মজবুত ভিত্তি দিয়েছে কিন্তু ইন্দু ধর্মের আচার উপাচারের ক্ষেত্রে মহাভারতের অবদান খুবই সামান্য। আবার মহাভারতের কাহিনী বেশীর ভাগই ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গীতে পরিবেশিত হওয়ার ফলে ইতিহাসের প্রাধান্যটা বেশী এসে গেছে। কিন্তু পুরাণে ঐতিহাসিকতার কোন স্থান নেই। যার জন্য মহাভারতে ঈশ্বরীয় ভক্তি শ্রদ্ধার ভাবটা কম পাওয়া যাবে আর পুরাণ পাঠকদের মধ্যে ইশ্বরের প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধার ভাবটাই জেগে উঠে। 
'পুরাণ' শব্দের আক্ষরিক অর্থ হল যে জিনিস পুরনো হয়েও নতুনের মত তাকেই পুরাণ বলা হয়। পুরাণের কাহিণীগুলোকেই পুরাণ বলা হয়, এই কাহিণীগুলো অনেক পুরনো কিন্তু এখনও শুনলে নতুনের মত মনে হয়, তাই এর নাম পুরাণ। পুরাণের কাহিনী যতই পাঠ করা হোক না কেন বা শ্রবণ করা হোক না কেন কখনই একঘেঁইয়েমি আসবে না। পুরাণের এটি একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যে কোন উপন্যাস একবার পড়ার পর দ্বিতীয়বারও পড়তে খারাপ লাগবে না, কিন্তু তৃতীয়বার পড়তে আর ইচ্ছে করবে না। কিন্তু পুরাণের কাহিণী যত বারই শোনা হোক না কেন কখনই ক্লান্তি আসবে না। ভারতে অগণিত গৃহস্থের ঘরে ঘরে বংশ পরস্পরায় নিত্য রামচরিত মানস, ভাগবত পাঠ হয়েই চলেছে, কখনই কারুর মনে কোন ক্লান্তি আসে না। পুরাণ বা আধ্যাত্মিকতার সাথে অন্যান্য সাধারণ সাহিত্যের এটাই তফাৎ। জাগতিক ভাব অর্থাৎ সাংসারিক ভাব যে সাহিত্যের মধ্যে থাকবে সেই সাহিত্য একবারের বেশী পড়লেই ক্লান্তি আসবে কিন্তু আধ্যাত্মিক রচনা অর্থাৎ পুরাণ কথা মানুষকে কখনই একঘেঁইয়েমি দেবে না। 
পুরাণ দুটি ভাগে বিভক্ত, একটা হল পুরাণ অন্যটি উপপূরাণ। অনেক সময় দুটোকে এক সাথে মিলিয়ে মহাপুরাণও বলা হয়। পুরাণের সংখ্যা আঠারোটি। এই আঠারোটিকে কেন পুরাণ বা উপপূরাণ বলা হবে যদি কেউ প্রশ্ন করে তাহলে এর উত্তর নেই। এই বিষয়ে আমরা পরে বিশদ আলোচনা করব। 
পুরাণের পৌরাণিক কাহিনীগুলো প্রত্যেক হিন্দুর রক্তের মধ্যে মিশে গেছে। ঈশ্বর, দেবতা, দিব্য জিনিষ বলতে যা কিছু বোঝায় সবই আমরা পুরাণ থেকেই পাই। যখন বলছি নারায়ণই ভগবান তখন এই ধারণাটি পুরাণ থেকেই নেওয়া হচ্ছে। যখন সাধারণ দেবতার কথা বলছি তখন তাও পুরাণ থেকে নিয়েই বলছি। দৈবী পুরুষ এবং অবতারের ধারণা পুরাণ থেকেই এসেছে। মহাভারতেও আমরা দেবতার কথা পাই, বিষ্ণুর কথাও এসেছে, হাল্কা দূর্গার উল্লেখও আছে, কিন্তু মহাভারত পড়লে বোঝা যায় এর মধ্যে কিছু কিছু কথা যেন পরের দিকে প্রক্ষিপ্ত করা হয়েছে। কিন্তু পুরাণ পুরোপুরি নিজেকে ভগবান, দেবতা, দৈবী, অবতার, উপাচার আর আচারের মধ্যে নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়েছে। তবে একটি মাত্র পুরাণ থেকেই সব কিছু আসছে না, কারণ পুরাণ আঠারোটি আর উপপুরাণও আঠারোটি, মোট ছত্রিশটা পুরাণ গ্রন্থে হিন্দু ধর্মের যাবতীয় যা কিছু আছে সব কিছুকে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। আঠারোটি, পুরাণ মিলিয়ে মোট সাড়ে পাঁচ লক্ষ শ্লোক। মহাভারতের শ্লোক সংখ্যা এক লক্ষ, তাতেই গীতা প্রেসকে ছটি খণ্ডে প্রকাশ করতে হয়েছে। ষাট খানা ঐ রকম যদি খণ্ড থাকে তবেই পুরাণের সব কিছু এক জায়গায় করা যাবে। 
"আমাদের সব কটি পুরাণের পেছনে একটা সত্য আছে আর তার সাথে একটা আধ্যাত্মিক তত্ত্ব আছে। কিছু সত্য আর কিছু আধ্যাত্মিক তত্ত্বকে কেন্দ্র করে চারিদিকে একটা কাহিনীর আবরণ তৈরী করে দেওয়া হয়েছে। যেমন আম গাছের কাছে তার ফলের বিশেষ কোন গুরুত্ব নেই, কিন্তু আমাদের কাছে ফলটা গুরুত্ব আর আম গাছের কাছে বীজটা গুরুত্ব। বীজটা যাতে ছড়াতে পারে তার জন্য বীজের উপরে পুরু শাঁস ও শক্ত চামড়া দিয়ে মুড়ে দেওয়া হয়েছে। পাখি, মানুষ আমের শাঁসটাই চাইছে। তারা আমটাকে পেড়ে নিয়ে দূরে চলে যাবে, সার অংশটা খাওয়ার পর বীজটাকে ফেলে দেবে, সেখান থেকে আবার একটা গাছ দাঁড়িয়ে যাবে। প্রত্যেক প্রজাতি এভাবেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। সেইজন্য ফলের বীজটার উপর চামড়া আর শাঁস দিয়ে খুব সুন্দর ভাবে আচ্ছাদিত করে দেয়া। আমাদের উপনিষদের কোন চামড়া আর শাঁস নেই, শুধু বীজটুকুই আছে। আমড়া যেমন পুরোটাই বীজ, উপরের দিকে হাল্কা একটু চামড়া। আবার অনেক বীজ আছে যার বীজের অংশটুকু খুব সামান্য আর পুরোটাই শাঁস। পুরাণ হল শাঁসযুক্ত বীজ। বীজটা যাতে ভালো করে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে পারে তার জন্য বীজের উপরে ভালো করে শাঁস দিয়ে দেওয়া হয়েছে। পুরাণের এটি একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
এর আগে আমরা আলোচনা করেছিলাম শরণাগত, শরণাগতী আর শরণদাতা এই তিনটেকে কেন্দ্র করে যে শাস্ত্র আলোচনা করে সেটাই পুরাণ। জ্ঞানমার্গ যেখানে নিয়ে যায় ভক্তিমার্গ সেখানেই নিয়ে যায়, গীতায় ভগবান একই কথা বলছেন- যৎ সাংখ্যৈ প্রাপ্যতে স্থানং তদযোগৈরপি গম্যতে। জ্ঞান যেখানে নিয়ে যাচ্ছে ভক্তিতে সেখানেই নিয়ে যাচ্ছে, তাহলে তো জ্ঞান আর ভক্তির কোন তফাৎ রইল না। কিন্তু না, একটা জায়গায় তফাৎ আছে। তফাৎ হল শরণাগতিতে। শরণাগতি ভাবের জন্য দুজনকে দরকার, একজন হলেন যিনি শরণাগত হচ্ছেন আর দ্বিতীয় জন যাঁর কাছে শরণ নেওয়া হচ্ছে। অন্যান্য যত শাস্ত্র আছে তাতে শরণাগত, শরণাগতি আর শরণদাতা এই তিনটির আলোচনা কম থাকে, যেমন উপনিষদ, এখানে শরণাগতির কোন ব্যাপারই নেই। যোগও শরণাগতির কোন ব্যাপার নেই। কিন্তু পুরাণ পুরোপুরি এই তিনটেকে কেন্দ্র করে এগিয়ে গেছে। এগুলো আমরা এর আগে আলোচনা করে নিয়েছি। 
পুরাণের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা দিক হল, যেটা এর আগে আমরা হাল্কা একটু আলোচনা করেছি, কোথাও একটা সত্য রয়েছে, সেটাকে কেন্দ্র করে একটা মিথ্‌ দাঁড় করানো। এই যে মিথ্‌ যাকে আমরা মাইথলজি বলছি, অনেক সময় একে মিথকও বলা হয়, এটাই পুরাণের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটা দিক। বাল্মীকি রামায়ণ আর মহাভারত হল ঠিক ঠিক কাব্যিক বর্ণনা, এই দুটোতে আমরা মিথ্‌ পাই না। যেমন কালিদাস একটি নারী চরিত্রের বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি নারীর সৌন্দর্য্যকে এমন একটা রূপ দিয়ে দাঁড় করাচ্ছেন, যে সৌন্দর্য আমার কোথাও খুঁজে পাবো না, কিন্তু তাকে আমরা মিথ্‌ বলতে পারবো না, তখন তা একটি কাব্যিক বর্ণনা হয়ে যাবে। মাইথলজিতে সাধারণ মানুষের কল্পনাকে পুরোপুরি ছাড়িয়ে যায়। মানুষের সৌন্দর্য্য বোধের একটা ধারণা আছে, সেই মানুষই নিজে চিন্তা ভাবনা করছে, কল্পনার জগতে বিচরণ করছে, আর এভাবেই সে তখন তার শরীরের কোন অঙ্গকে সরিয়ে দিবে, তার মানবীয় গুণকে বাদ দিয়ে দেবে অথচ কোথাও একটা মানব বা মানবীর আকার থেকে যাবে, তখনই তা মিথ্‌ হয়ে যাবে, তখন সেই মানবী হয়ে যাবে অস্পরা। যখনই অস্পরা হয়ে গেলে তখনই তা মাইথলজিতে চলে গেল, কারণ অপ্সরার মধ্যে সাধারণ নারীর সৌন্দর্য থাকল না। আবার ভীম, অর্জুন এই ধরণের অনেক চরিত্র আছে যাদের মধ্যে অনেক রকম গুণ ও ক্ষমতা দিয়ে দেওয়া হয়েছে, বীর, রণকৌশলে নিপুণ ইত্যাদি তখনও এই চরিত্রগুলো মাইথলিজিতে যাবে না, কাব্যিক বর্ণনার মধ্যেই থেকে যাবে। কিন্তু যখন মা দুর্গা, মা চামুণ্ডা যিনি হুঙ্কারেই লক্ষ লক্ষ দৈত্য দানব নাশ করে দিচ্ছেন তখন এটাই মাইথলজির পর্যায় চলে যাচ্ছে। বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাসে যবে থেকে সাহিত্য রচনা শুরু হয়েছে তার আগে থেকেই মানুষের মধ্যে মাইথলজির উপাদান রয়েছে। তাই প্রাচীন কাল থেকে সাহিত্যে কিছুটা কাব্যিক কিছুটা মিথ্‌ মিশিয়ে কাহিনী তৈরী হয়ে আসছে। 
পুরাণের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হল পুরাণের কাহিনীতে অতিপ্রাকৃতি চরিত্রের প্রচুর সমাবেশ থাকবে। দেবী, দেবতা, অসুর, ভগবানের কথা যদি কোন সাহিত্যে না থাকে অথচ পৌরাণিক ভাব-ধারাকে বজায় রাখছে, তাহলে সেটাকে পুরাণ না বলে অন্য নামে বলা হবে। ছোটবেলা এমরা অনেকেই সিগুরেলার কাহিনী পড়েছি। সিগুরেলাকে পুরোপুরি কাব্যিক বর্ণনা বলা যাবে না, আবার এর মধ্যে মাইথলজির অনেক উপাদান পাওয়া যাবে। এই ধরণের কাহিনী আমাদের ঈশ্বরের পথে নিয়ে যাবে না বা তাতে ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গ কিছু নেই, সেইজন্য এই কাহিনীগুলিকে বলা হয় কল্প কাহিনী। 
বর্তমান যুগের নিউরো বিজ্ঞানীরা বলছেন মানুষের মস্তিষ্ক এমন ভাবে গঠন করা হয়েছে যে স্বাভাবিক ভাবেই মানুষের মধ্যে মিথসের দিকে একটা প্রবণতা থাকে। কার্ল জুঙ নামে একজন বিখ্যাত মনস্তাত্ত্বিক দার্শনিক ছিলেন। তিনি প্রথমের দিকে যদিও ফ্রয়েডের অনুগামী ছিলেন কিন্তু পরবর্তি কালে তিনি যখন দেখলেন ফ্রয়েডের থিয়োরী গুলো খুব অসঙ্গতি আর গোলমালে ভরা, তখন তিনি সেখান থেকে সরে এলেন। এরপর তিনি নানান রকম থিয়োরী বার করলেন, যার মধ্যে ওনার বিখ্যাত একটা থিয়োরী হল 'থিয়োরী অফ্‌ মিথ্‌'। এই থিয়োরি অনুয়ায়ী কার্ল জুঙের সিদ্ধান্ত হল, প্রত্যেক মানুষের জীবনে কিছু না কিছু মিথ্‌ থাকবে। বেদান্তের দৃষ্টিতে যদি আমাকে প্রশ্ন করা হয়, তুমি নিজেকে কি মনে কর? তখন আমি বলব, আমি হলাম দেহ, মন, বুদ্ধি, ইন্দ্রিয় বিশিষ্ট একটি ব্যক্তি। কার্ল জুঙের থিয়োরি অনুয়ায়ী, এটাই তোমার মিথ্‌। তুমি যে দেহ বা তুমি যে মন, তুমি যে বুদ্ধি বা এই সব কটির সমন্বয়ে যে তোমার একটা নিজস্ব ব্যক্তিত্ব তৈরী হচ্ছে, আর তুমি যে এই ব্যক্তিত্বকে নিয়ে চিন্তা করছ, এটাই তোমার নিজস্ব মিথ্‌। ঠিক তেমনি 'ভারতের মত দেশ হয় না' এই ধারণাকে আশ্রয় করে যারা কাজ করে যাচ্ছে তারাও একটি মিথ্‌ অনুসরণ করছে। আন্না হাজারে বলছেন অনশন করে দেশ থেকে দুর্নীতি দূর করতে হবে, এখানেও একটা মিথের ভূমিকা কাজ করছে। কার্ল জুঙ বলছেন, যে মানুষের জীবনে যত বেশী মিথ্‌ থাকবে সেই মানুষ তত মহৎ। অথচ আমাদের ধারণা পুরো উল্টো, আমরা বলছি পুরাণের যত সব আজগুবি গপ্পো, সব মিথ্‌, তা পুরাণকে ফেলে দাও। কিন্তু কখনই পুরাণকে ফেলে দেওয়া যাবে না, এর অন্য একটা মূল্যবান দিক আছে। 
যে মানুষের জীবনে যত বেশী মিথ্‌ সেই মানুষ তত মহৎ, এই থিয়োরীকে আমরা অন্য দৃষ্টীকোণ দিয়ে আলোচনা করছি। স্বামীজী এক জায়গায় বলছেন-  যে মানুষ একটা আদর্শ পালন করতে গিয়ে যেখানে দশটা ভুল করে, সেখানে আদর্শহীন মানুষ একশটা ভুল করবে। আমি যখন একটা আদর্শকে সামনে রেখে এগোব তখন আমার হয়তো দশবার পদস্থলন হতে পারে, লোক হাসবে, বলবে 'এই তো আদর্শ পালন করতে পারলো না'। কিন্তু যার কোন আদর্শই নেই সে যে কোথায় ছিটকে পড়বে, পরে কোথাও তাকে আর খুঁজেই পাওয়া যাবে না। পাশ্চাত্য জাতির কাছে মিথ্‌ একটাই, কি করে মিষ্টি কথা বলে নিজের কাজ হাসিল করা যাবে আর টাকা বানানো যাবে। কিন্তু সেই প্রাচীন কাল থেকে ভারতীয়দের মনোভাব সম্পূর্ণ এর বিপরীত। কোন আদি অনন্ত কাল থেকে ভারতের ঘরে ঘরে রামায়ণ ও মহাভারত বংশ পরস্পরায় পাঠ হয়ে চলেছে। তারই ফলশ্রুতিতে ভারতীয় মঙ্কতায় একটা বিশেষ প্রতিফলন দেখা যায়। ভারতীয়রা মনে করে আমাকে শ্রীরামচন্দ্রের মত হতে হবে, আমাকে হনুমানের মত ভক্ত হতে হবে। স্বামীজী ভারতীয় নারীদের উদ্দেশ্যে বলছেন- তোমার আদর্শ সীতা, সাবিত্রী, দময়ন্তী। সীতাও মিথ্‌, সাবিত্রীও মিথ্‌ আর দময়ন্তীও মিথ্‌। এখন যাঁরা উইমেনস লিডে আছেন তাঁরা বলবেন ফেলে দাও সীতা, সাবিত্রী, দময়ন্তী, আমাদের মুক্তি চাই, নারী স্বাধীনতা চাই। নাও মুক্তি কেউ বাধা দিতে যাবে না, আজ বিয়ে করে কালই দিভোর্স দিয়ে দাও। তুমি বিয়ে করে একই স্বামীকে নিয়ে সারা জীবন কাটাবে, নাকি বছরে বছরে বিয়ে করে কালই ডিভোর্স দিয়ে দাও। তুমি বিয়ে করে একই স্বামীকে নিয়ে সারা জীবন কাটাবে, নাকি বছরে বছরে বিয়ে করবে আর ডিভোর্স দেবে সেটা তোমার ব্যাপার, কেউ বাধা দেবে না। তখন বলবে এটাই ইদানিং সমাজের চেহারা। এখানে ভালো-মন্দের বিচার করা হচ্ছে না। এখানে বলা হচ্ছে তুমি যেমনটি বেছে নেবে সেই অনুসারে তোমার জীবনের পরিকাঠামোটা পাল্টে যাবে। তুমি বলছ নারীমুক্তি চাই, তার জন্য নারী আন্দোলন চাই, এটাও একটা মিথ্‌। যখন তুমি বলছ সীতা, সাবিত্রী, দময়ন্তী তোমার আদর্শ তখন এটাও একটা মিথ্‌। কোন্‌ মিথ্‌ তুমি অনুসরণ করবে সেটা তুমি ঠিক করো। যে মিথ্‌ তুমি বেছে নেবে সেই অনুসারে তোমার জীবনে ঘাত-প্রতিঘাতও সেই ভাবে আসবে যাবে। 
আধ্যাত্মিক পুরুষদের কাছে সাধারণ মানুষ নানা রকমের প্রশ্ন নিয়ে হাজির হত। জগৎ কোথা থেকে এসেছে? জগৎ কোথায় যাবে? আমি কোথা থেকে এলাম? আমি কোথায় যাব? ঋষিরা যখন সাধারণ মানুষের বোধগম্য করে এই সব প্রশ্নের ব্যাখ্যা দিতে পারতেন না তখনই তাঁরা মিথ্‌ তৈরী করে তাদের মানসিকতার উপযোগী করে এমন ভাবে একটা ব্যখ্যা দিয়ে দিতেন, তাতেই সাধারণ মানুষের মনের চাহিদা পূরণ হয়ে যেত। যেমন সৃষ্টির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হল, ব্রহ্মার যখন জন্ম হল তিনি ভাবতে শুরু করলেন আমি কেন জন্ম নিলাম, আমি কোথায় আছি, আমি কেনই বা আছি। তখন তিনি দেখলেন আমার জীবনের একটা কোন উদ্দেশ্য আছে। যারই জন্ম হয় তারই একটা উদ্দেশ্য থাকে। ব্রহ্মা তখন বুঝলেন আমাকে সৃষ্টি করতে হবে। তাহলে সৃষ্টি করা যাক। সৃষ্টি কিভাবে হল? তখন তিনি ধ্যানে বসে গেলেন। ধ্যানে তিনি আদেশ পেলেন এর আগের কল্পে সৃষ্টি যেভাবে হয়েছিল, সেই একই ভাবে সৃষ্টি করতে হবে। ব্রহ্মা সব বুঝে নিয়ে এবার সৃষ্টির কার্যে নেমে পড়লেন। সৃষ্টির ব্যাপারে এটাই একটা মিথ্‌ তৈরী হয়ে গেল। 
সৃষ্টির ব্যাপারে বৈজ্ঞানিক মিথ্‌ হল, অনেক কোটি বছর আগে বিগ ব্যাঙ হয়েছিল সেখান থেকে এই সৃষ্টি চলছে। আমাদের ধর্মীয় মিথ্‌ হল ব্রহ্মা সব কিছু সৃষ্টি করেছেন। এবার মানুষ কোনটা বিশ্বাস করবে! বিজ্ঞানীরা কিছু দিন আগে বললেন চাঁদকে আমরা যত পুরনো ভাবেছিলাম তত পুরনো নয়, চাঁদ খুবই শিশু। তাহলে এত দিন চাঁদের জন্ম নিয়ে বিজ্ঞানীরা যেটা বলে এসেছিল সেটা বৈজ্ঞানিক মিথ্‌। আর আগামীকাল বিজ্ঞানীরা যে এই মতকে পাল্টাবে না তার কোন নিশ্চয়তা নেই, সবটাই তো মিথ্‌এর উপর দিয়ে চলছে। শুধু কয়েকটা ব্যাপারে যেখানে নিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে সেখানে আর ভুল হয় না। কিন্তু নিশ্চিত হবেটা কিভাবে? তার জন্য ওই জায়গাতে তার থাকা আবশ্যক। আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে আপনার বাবার নাম কি? আমি বললাম আমার বাবার নাম শ্রীযুক্ত অমুক। কিন্তু সেটাও তো মিথ্‌। আপনার মা মিথ্যে বলছেন না তার কি গ্যারান্টি আছে। সব কিছুই মিথ্‌। নিজের ইন্দ্রিয়ের দ্বারা যেটা অনুভব করছি তার বাইরে সবটাই মিথ্‌। কিন্তু আমরা মানতে চাই না। কার বুকের পাটা আছে যে বলতে যাবে, আমার মা বলেছে উনি আমার বাবা কিন্তু আমি জানি না। আমরা সবাই জন্মদিন খুব ধুমধাম করে পালন করি, কিন্তু এটাও তো জনশ্রুতি। এখন আপনি প্রত্যেক ব্যাপারে ডিএনএ পরীক্ষা করতে থাকুন। কিন্তু ডিএনএ পরীক্ষাতে বাবা-মা ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু জন্ম তারিখ তো জানা যাবে না। 
বেদান্ত ঠিক এই কথাই বলে আসছে। তোমার এই জীবন যেটা দেখছ এটাই মিথ্‌। তুমি যে ভাবছ, তুমি শরীর, তুমি মন, তুমি বুদ্ধি এটাই মিথ্‌। যতক্ষণ ইন্দ্রিয় দিয়ে না জানছ তখন সবটাই মিথ্‌। একমাত্র ভগবানই হলেন সেই বস্তু যাঁকে জানা যায় না। যদিও ইন্দ্রিয় দিয়ে তাঁকে জানা যায় না, কিন্তু অপরোক্ষানুভূতি দিয়ে ভগবানকে জানা যায়। তুমি যখন ধ্যানে বসবে তখন তুমি তোমার ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে নিয়েই ধ্যানের গভীরে এগোবে। মনকে যত তুমি বশে নিয়ে আসতে থাকবে তত তুমি তাঁকে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর দেখতে থাকবে। একটা জায়গায় গিয়ে তোমার মন থেমে যাবে। কিন্তু থামার আগে মন তোমাকে একটা অনুভূতি করিয়ে দেবে। সারাদিন কাজ করার পর রাত্রিতে মানুষ যখন শয়ন করে তখন গভীর নিদ্রায় যাবার আগে একবার ঘুমের মধ্যে ঢুকে পড়ে আবার সেই ঘুমের জায়গা থেকে বেরিয়ে আসে। ঘুমের মধ্যে একবার ঢুকছে আবার বেরিয়ে আসছে, বলে এখানে নাকি খুব আনন্দের আভাস পাওয়া যায়। ভাসতে ভাসতে একবার ঘুমের মধ্যে ঢুকছে আবার ভাসতে ভাসতে ঘুম থেকে বেরিয়ে আসছে, এইভাবে আসল ঘুমে ঢুকে পড়ে। আবার যখন সকালে ঘুম ভাঙে তখন এই একই প্রক্রিয়ার পুনারবৃত্তি হতে থাকে। সমাধিতে যাওয়ার আগে ঠিক এই অবস্থা চলে, এই সমাধিতে ঢুকছে। কোথায় ঢুকছে? যেখানে মনের নাশ হয়ে যায়। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে আবার সেখান থেকে বেরিয়ে আসে, মন যেন একটু থেকে গেছে। সুষুপ্তিতে যেমন হয়, সুষুপ্তি আসে স্বপ্নের পরে। কিন্তু সুষুপ্তিতে যাওয়ার আগে স্বপ্ন আর সুষুপ্তির মধ্যে বাচ খেলা চলতে থাকে। তারপর যখন পুরোপুরি সুষুপ্তিতে চলে যায় তখন তার আর কোন হুশ থেকে না। সমাধিতেও ঠিক তাই হয়, তার কোন হুঁশ থাকে না। কিন্তু এই যে একবার করে যাচ্ছে একবার করে আসছে, হয়তো মূহুর্তের জন্য এই জিনিষগুলো চলছে কিন্তু মনের ওই ছাপটা থেকে যায়। তাই বলছেন মানুষ যখন সমাধি অবস্থায় যেটা উপলব্ধি করে তখন বলে এই উপলব্ধিটাই একমাত্র সত্য। এর বাইরে এত দিন যা কিছু করে এসেছি সবটাই মিথ্‌। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে পঞ্চাশ ধরণের প্রশ্ন থাকে। বাড়িতে বাচ্চাদের প্রশ্নের শেষ নেই, মা গ্লাশটা বাঁ দিকে কেন রাখেন? আমি যদি ডান দিকে গ্লাশটা রাখি তাতে কি অসুবিধা হবে? কিন্তু এই প্রশ্নই যখন ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে করবে তখন মা কোথা থেকে উত্তর দেবে! জগৎ কে করেছে? ভগবান করেছেন। ভগবানকে কে সৃষ্টি করেছেন? মা হয়তো বলল সুপার ভগবান করেছেন। কিন্তু মা এইভাবে কত দূর ঠেলে নিয়ে যাবে! 
কোন শিশু যদি তার মাকে প্রশ্ন করে খাওয়ার আগে কেন স্নান করতে হবে, খাওয়ার পরে স্নান করলে কি ক্ষতি? মা হয়তো অত কিছু বোঝে না, মা তখন বলে একটা চড় লাগালে বুঝতে পারবি খাওয়ার আগে কেন স্নান করতে বলা হয়। একটা কোম্পানীতে গ্রুপ ইনসিওরেন্স চালু করার কথা হয়েছে। কোম্পানীর একজন কর্মচারী কিছুতেই সই করবে না। একজন যদি সই না করে তাহলে এই স্কিম কোম্পানীতে চালু করা যাবে না। এমডির কাছে যখন ফাইল গেছে, তখন দেখলেন একজনই শুধু সই করেনি। তিনি সেই কর্মচারীকে ডেকে পাঠালেন। ঘরে ঢুকতেই এমডি সরাসরি তাকে বলে দিলেন, এক্ষুণি সই কর তা নাহলে আজকেই তোমার চাকরী চলে যাবে। লোকটি সঙ্গে সঙ্গে সই করে দিল। এমডির চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসার পর বাকি কর্মচারীরা জিজ্ঞেস করছে, ভাই! এত দিন তুমি সই করছিলে না কেন? লোকটি বলছে, এত পরিষ্কার ভাবে ব্যাপারটা আমাকে কেউ বোঝাতে পারেনি। কিন্তু সবাইকে তো এইভাবে বোঝানো সম্ভব নয়। 
ইসলামে একটা খুব নামকরা মিথ্‌ আছে। মাউন্ট হীরাতে মহম্মদ যখন ধ্যান করছিলেন তখন গ্যাব্রিয়াল এসে মহম্মদকে হীরক নামে ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে উড়িয়ে আল্লাহর কাছে নিয়ে গেলেন। আকবর বাদশা তিনি নিজে মুসলমান, ইসলামের সব কিছুই মানতেন কিন্তু মহম্মদকে ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে উড়িয়ে আল্লার কাছে নিয়ে যাওয়াকে কিছুতেই মানতে চাইতেন না। এতো খুবই স্বভাবিক, ঘোড়া তো ওড়ার জন্য নয়, ঘোড়ার কাজ হল মাটিতে দৌড়ান। ঘোড়া যদি উড়িয়ে আল্লার কাছে মহম্মদকে নিয়ে যায় তাহলে তা তো ঘোড়া নাম না হয়ে অন্য সেই রকম কিছু নাম হবে যেটা উড়তে পারে। সাইকেলেরও চাকা আছে এরোপ্লেনেরও চাকা আছে, কিন্তু সাইকেল তো আর উড়ে যায় না, চাকা নিয়ে যখন উড়ে যায় তখন সেটাকে আমরা এরোপ্লেন বলছি সাইকেল কখনই বলছি না, সেই রকম ঘোড়া না বলে অন্য কিছু বলুন। এখন ঘোড়া না বলে অন্য কিছু বললে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারবে না। মহম্মদ যে আল্লার কাছে তিরিশ দিন ধরে গেছেন, সেটা সাধারণ মানুষ কি করে বুঝবে! একটা কিছু তো বলতে হবে। সাধারণ মানুষ ঘোড়া চেনে, উট চেনে, গাধা চেনে। এখন ঘোড়াই কেন বাছা হল? এই জায়গাতেই মাইথলজির ভূমিকা। সব কিছুর ব্যাখ্যা থাকবে না, একটা কিছু বেছে নিতে হবে, তাই ঘোড়াকেই বেছে নেওয়া হয়েছে। এবার ঘোড়ার রঙ দিতে হবে। মহম্মদ আল্লার কাছে যাচ্ছেন তাই লাল রঙ, কালো রঙ তো চলবে না, কারণ লাল আর কালো রঙ সব সময় অশুভের প্রতীক। তাই ধবধবে সাদা ঘোড়া হতে হবে। মহম্মদ কি রঙের পোশাক পড়েছিলেন? তিনিও ধবধবে সাদা বস্ত্র পরিধাণ করেছিলেন। কারণ সাদা শুদ্ধতার প্রতীক। মাইথলজি তৈরী হয়ে গেল। সৃজনশীল কবি বা সাহিত্যিকদের যদি বুদ্ধি ও প্রতিভা তাহকে তাহলে তাঁরা চলতে ফিরতে সব জিনিষকে ডান দিক বাম দিক করে দিতে পারেন। এতে মানুষের মনের নানা রকম সংশয় জিজ্ঞাসা শান্ত হয়ে যায়।  
আমাদের খুব নামকরা মাইথলজি হল পুরীর জগন্নাথ দেবের দারুমুর্তি, বলা হয় বিশ্বকর্মা এই মূর্তি তৈরী করেছিলেন। সত্যি কি বিশ্বকর্মা বানিয়ে ছিলেন কিনা কে জানে! আর বিশ্বকর্মা বলে আদৌ কোন দেবতা আছেন কিনা আমরা কি বলব! এখন আমি যদি বলি বিশ্বকর্মা বলে কিছু নেই। কিন্তু বিশ্বকর্ম বলে কোন দেবতা নেই বলার আগে আমাকে প্রমাণ করে দেখাতে হবে যে বিশ্বকর্মা বলে কেউ নেই। আমি কি ভালো করে খতিয়ে দেখেছি বিশ্বকর্মা বলে কেউ নেই, আমি ব্রহ্মাণ্ড ঘুরে, সব অন্দরমহল ঘুরে ঘুরে দেখেছি স্বর্গ বলে কিছু নেই? যেমন ‘হ্যাঁ’র প্রমাণ আছে তেমন ‘না’ এরও প্রমাণ আছে। গণিত শাস্ত্রে ‘না’র প্রমাণকে প্রচণ্ড গুরুত্ব দেওয়া হয়। শুধু না বলে দিলেই গণিতজ্ঞ মানবেন না। তাঁর জন্য আপনাকে নেগেট করতে হবে। আমি বললাম এটা বোতল নয়, কারণ আমি দেখছি পিরামিডের যে সংখ্যা সেই অনুয়ায়ী এর সাথে খাপ খাচ্ছে না। আপনি একটি জিনিষ দেখননি, তাই বলে সেই জিনিষটি নেই বলে প্রমাণিত করা যাবে না। আপনি বলছেন আপনার যে যুক্তি তাঁর সাথে এটা মিলছে না। কিন্তু আপনার যুক্তিই যে চূড়ান্ত যুক্তি হবে তা তো হতে পারে না। 
ভারতের একশ কুড়ি কোটি জনসংখ্যার মধ্যে পঞ্চাশ লক্ষও মানুষ পাওয়া যাবে না যারা ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে ঠিক ঠিক সচেতন। কিন্তু এই বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ কি নিয়ে থাকবে! এদের পুরাণ ছাড়া আর কোন অবলম্বন নেই। এই কারণেই ভারতে পুরাণ এত জনপ্রিয়। আঠারোটি পুরাণে যা কিছু মাল-মশলা আছে এই দিয়েই পুরো ভারতের মানসিক চাহিদার পুরণ হয়ে যাচ্ছে। পৌরাণিক ভাবধারা যে ভারতেরি আছে তা নয়, বিশ্বের যেখানে ধর্ম আছে সেখানেই পৌরাণিক ভাবধারা যে ভারত্তেই আছে তা নয়, বিশ্বের যেখানে যেখানে ধর্ম আছে সেখানেই পৌরাণিক ভাবধারা থাকতে বাধ্য, আর এই ভাবধারা দিয়েই তাদের ধর্ম ও সংস্কৃতির সব কিছু পুষ্টিলাভ করছে। এমনকি যে বৌদ্ধ ধর্ম নিজেকে খুব যুক্তিবাদী বলে, তাদেরও এত মাইথলজি আছে যে ভাবলে অবাক হয়ে যেতে হয়। সাক্ষাৎ ভগবান বুদ্ধের জীবনকে নিয়ে কত যে মাইথলজি তোইরী হয়েছে ভাবাই যায় না, তিনি এখানে এই অলৌকিক কাজ করেছিলেন, সেখানে এই চমৎকারী দেখিয়েছিলেন। ভগবান বুদ্ধের যখন জন্ম হল তখন নাকি সাদা হাতি করে ইন্দ্র এসেছিলেন ইত্যাদি। কারণ মানুষ মিথ্‌ ছাড়া বাঁচতেই পারে না, আর যারা ধর্মজীবন পালন করছেন তাদের পক্ষে তো মিথ্‌ ছাড়া বাঁচা অসম্ভব। 
অনেকের মত বিদেশীরা যে অর্থে মিথ্‌ বলে আমাদের পুরাণ সেই অর্থে মিথ্‌ নয়। এই যে একেবারেই ভুল বলছেন তা নয়। সাহিত্য, শিল্প নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন তাঁরা বলেন সাহিত্য ও শিল্পে অনেক ধরণের শৈলী আছে। যেমন পিকাসো, ভ্যান গগ্‌ বা লিওনার্দো দা ভিঞ্চির মত যত বিখ্যাত শিল্পী আছেন তাঁদের প্রত্যেকের সৃষ্টিতেই নিজস্ব একটা শৈলী আছে। মজার ব্যাপারে হল প্রথম দিকে সাহেবরা ভারতে এসে অজন্তা ইলেরা এবং অন্যান্য মন্দির গাত্রে যত চারুকলা ও পাথরের মুর্তি ছিল তাঁর খুব নিন্দা করতে শুরু করল। যেন এগুলো কোন শিল্পকর্মের মধ্যেই গণ্য করা যায় না। এই নিয়ে পরে অনেক গবেষণাদির পর পাশ্চাত্যের অনেক শিল্পীর বক্তব্য হল ভারতের শিল্প কলাই প্রকৃত চারুশিল্প। এক সময় পাশ্চাত্য Realistic Art এর খুব চল হয়েছি, Realistic Art মানে একটি মানুষকে যেমনটি দেখতে ঠিক তেমনটি তার ছবি আঁকা হল, এরপর বিচার হবে ছিবিটি কত ভালো হয়েছে। ভারতে কখনই এই জিনিষকে আর্ট বলা হত না। ভারতের কিছু শিল্পী আবার Realistic Art কেই কদর করে গেছেন। স্বামীজী Realistic Art একেবারেই পছন্দ করতেন না, তাঁর মতে এটা কোন আর্টই নয়।
তাহলে চারুকলা বলতে আমরা কোন শিল্প কে বলব? কোন মানুষ বা দেব-দেবীর মুর্তি বা ছবি যখন তৈরী করা হয় তখন তার মধ্যে যে বৈশিষ্ট্যটুকু আছে সেটাকে তুলে নিয়ে ছবি বা ভাস্কর্য শিল্পের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়। যেমন যখন নারীর চোখের সৌন্দর্যের কথা বলা হয় তখন নারীর চোখকে হরিণের চোখের সাথে তুলনা করে বলা হয় তার হরিণের মত চোখ। কোন শিল্পী যখন নারীর চোখের এই সৌন্দর্যকে ছবি বা মুর্তির মধ্যে ফুটিয়ে এমন একটা ভাবকে তুলে ধরেন যা কিনা বাস্তবে ওই চোখ কোন নারীর মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমাদের যত দেব-দেবীর রূপের মাধুর্যকে মুর্তি বা ছবিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ওই রূপ কোন মানুষের মধ্যে পাওয়া যাবে না। দেব-দেবীর মুর্তি বা ছবির মধ্যে যে রূপ আমরা পাই, সেই রূপটা হল সৌন্দর্যের একটা আদর্শ প্রতীক। পুরাণ হল ঠিক তাই। মানব জীবনের দৈনন্দীন স্বাভাবিক ঘটনাগুলোকে নিয়ে যে সাহিত্য রচিত হয় সেই সাহিত্য পাঠক একবার পড়ে নেওয়ার পর ডাস্টবিনে ফেলে দেবে। উপনিষদে ঠিক একই সমস্যা হয়, যদিও এখানে সত্যকে অন্য দিক দিয়ে দেখান হয়। আধ্যাত্মিক সত্যগুলো যেমনটি আছে ঠিক তেমনটি উপনিষদে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই সত্যগুলোর উপর তাঁরা যে একটু রঙ চড়াবেন, এদিকটা একটু বাড়িয়ে দেবেন, ওই দিকটা একটু টেনে ছোট করে দেবেন, এই জিনিষগুলো তাঁরা কোথাও এতটুকু কিছু করেননি। ইতিহাস যেমন অনেকরই পছন্দের নয়। কিন্তু সেই ইতিহাসকে যখন কাহিনীর পর কাহিনী সাজিয়ে বলা হয় তখন সবাই সেটাই খুব আগ্রহ সহকারে পাঠ করে।
উপনিষদ বা গীতাতে ঠিক একই সমস্যা হয়। সামাজিক, ব্যক্তি ও পরিবারের স্বাভাবিক ঘটনা যেমনটি আছে তেমনটি ভাবে উপস্থাপনার দ্বারা কখনই সাহিত্য সৃষ্টি হয় না। সাহিত্য না হয়ে সেটা হয়ে যায় একটা পাঠ্য। ঠিক তেমনি উপনিষদ বা গীতা হল আধ্যাত্মিক জগতের পাঠ্য পুস্তক, যে রকমটি আছে ঠিক সেই রকমটি দিয়ে দেওয়া হল। এর মধ্যে জাগতিক উপাদান না থাকার জন্য এবং চিন্তন জগতের ক্ষেত্রে অত্যন্ত উচ্চমানের হওয়ার জন্য সাধারণ মানুষ গীতা উপনিষদের থেকে দূরে দূরেই থেকে গেছে। গীতা উপনিষদের গভীর তত্ত্বকে ধারণা করার জন্য চাই মননশীল মস্তিষ্ক এবং ধ্যানমুখী ও কর্মময় জীবনের সমন্বয়। সাধারণ মানুষের কাছে আধ্যাত্মিক সত্যকে তাহলে কিভাবে নিয়ে যাওয়া যাবে? তখন আমাদের ঋষিরা আধ্যাত্মিক এই সত্যগুলোকে নিয়ে মিথস তৈরী করলেন। আধ্যাত্মিক সত্যের সাথে তাঁরা কোথাও আপোষ না করে আর্টের মাধ্যমে সেই সত্যকে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে গেলেন। আর্টের মাধ্যমে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁদের মিথস তৈরী করতে হচ্ছে, আর মিথস যখন তৈরী করলেন তখন তার মধ্যে কাব্যের যত ধরণের রসবোধ হতে পারে, বীরত্বের রস, সৌন্দর্যের রস, ভয়ের রস, ঘৃণার রস, ক্রোধাত্মক রস, এই রসগুলোকে নিয়ে একটা ব্যক্তির মধ্যে স্থাপন করে সেই রসকে তত দূর ঠেলতে থাকলেন যত দূর পর্যন্ত মানুষ গ্রহণ করতে পারবে। এইভাবে ঠেলার পর তার উপর আধ্যাত্মিক তত্ত্বের পোশাক চাপিয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে তুলে দিলেন।
যেমন আধ্যাত্মিক সত্য বলছে জ্ঞান ও বৈরাগ্য না থাকলে ঈশ্বরের প্রতি ভক্তির উদয় হবে না। ভাগবতের আলোচনার প্রথমেই আমরা একটা কাহিনী পাই যেখানে এই সত্যটাকেই একটা সুন্দর কাহিনীর মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে। ভক্তিকে একটি নারীর মূর্ত রূপ দিয়ে দেওয়া হল, আর তাঁকে দুটি সন্তানও দিয়ে দেওয়া হল, এদের নাম জ্ঞান আর বৈরাগ্য। কলিযুগের মানুষ যেখানে ঈশ্বরের প্রতিই বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে সেখানে তাদের ভক্তি আসবে কোথা থেকে। তাই দেখান হচ্ছে ভক্তি যুবতী মেয়ে অথচ তার সন্তান দুটি ঘাটের মড়ার মত পড়ে আছে। ভক্তি সন্তানের জন্য কেঁদেই চলছে, নারদ এসে সব শোনার পর ভক্তিকে বললেন আমি তোমার ঘাটের মড়া এই দুটি সন্তানকে সতেজ করে দেব। এরপর নারদ এদের বেদ বেদান্তের কথা বলতে শুরু করেছেন, কিন্তু কিছু প্রতিক্রিয়া হল না। পরে সনৎকুমার এসে নারদকে বললেন কিছু না শুনিয়ে এদের তুমি ভাগবত শোনাও। এই জায়গাতেই পুরাণের মূল সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। নারদ বলছেন ভাগবতে তো শুধু সেই কথাই আছে বেদ, বেদান্ত আর গীতাতে যা আছে, আমি সেই কথাই এদের শুনিয়েছি কিন্তু তাতেও তো কিছুই হল না। সনৎকুমার তখন বললেন তুমি ঠিকই বলেছ ভাগবতে যা আছে, বেদ, বেদান্ত ও গীতাতেও একই কথা আছে, কিন্তু ভাগবতে শ্রীকৃষ্ণের কথা আছে, শ্রীকৃষ্ণের কথা মানে ভক্তির কথা, শ্রীকৃষ্ণের ভক্তির কথা শুনলেই এরা আবার হারানো বল ফিরে পাবে। এখানে মূল কথা হল, পুরাণের যা বক্তব্য ঠিক সেই একই বক্তব্য বেদ-বেদান্তেও পাওয়া যাবে। কিন্তু পুরাণে এসে বক্তব্যের পরিবেশনটা পদ্ধতিগত ভাবে পাল্টে যাবে। এটাই মিথ। সাধারণ মানুষ মিথ খুব মন দিয়ে শোনে। কিন্তু এটা অত্যন্ত পরিতাপের যে, পুরাণের আধ্যাত্মিক সত্যগুলোকে নিয়ে ভাগবত কথাকাররা কখনই আলোচনা করেন না, তাঁরা কাহিনীর উপর বেশী জোর দেন। যেমন রাসলীলা পাঠের সময় গোপীদের বর্ণনাই শুধু করে যাবেন। স্বামীজী মজা করে বলছেন, এই বোষ্টমগুলো খুব করে মালপো খায় আর হজম করার জন্য খুব করে নাচতে থাকে। দ্বিতীয় মজা করে বলছেন, কীর্তন করতে করতে যে চোখের জল বেরোয় আসলে তখন নিজেদের স্ত্রীদের কথা মনে করে চোখের জল বেরোতে থাকে। স্বামীজী এই ধরণের আবেগকে কতটা অপছন্দ করতেন এগুলো তারই নমুনা। সাধারণ মানুষের এটাই সমস্যা। যখন তারা ভাগবতে শ্রীকৃষ্ণের নানা রকম লীলাকথা শুনছে তখন তার অন্তর্নিহিত আধ্যাত্মিক তত্ত্বের প্রতি মন না গিয়ে তাদের অপূৰ্ণ কামনা-বাসনার দিকে মনটা চলে যাচ্ছে। অথচ যত পুরাণ আছে সব পুরাণের উদ্দেশ্য হল সহজ সরল কাহিনীর মাধ্যমে আধ্যাত্মিক গৃঢ় তত্ত্বগুলোকে সাধারণ মানুষের মাথার মধ্যে বসিয়ে দেওয়া।
ফরাসী শিল্পী রোঁদা এক সময় ভারতে এসেছিলেন। রোঁদাকে ভারতের লোক খুব বেশী জানতো না। একবার চেন্নাইয়ের একটি সংগ্রহশালায় ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ একটা নটরাজের মুর্তির দিকে তাঁর দৃষ্টি চলে যায়। তিনি ওই নটরাজের মুর্তির সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতেই তিনি একটা ভাবের অবস্থায় চলে যান। তারপর দেখা গেলে তিনি ঠিক নটরাজের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন। একজন সাহেব নটরাজের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। এই দৃশ্য দেখে সংগ্রহশালায় যত দর্শক এসেছিল সবাই তার চারপাশে ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়েছে। হৈ চৈ শুনে ওখানকার কিউরেটার, যিনি একজন বৃটিশ নাগরিক ছিলেন, দৌড়ে এসে রোঁদাকে ওখান থেকে বার করে নিয়ে এসে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন। পরে তিনি দেখেন – আরো ইনি তো রোঁদা, পৃথিবীর বিখ্যাত শিল্পী। পরে রোঁদা নিজের একটি লেখাতে নটরাজ মুর্তি সম্বন্ধে বলছেন This is the best sculpture in the world । ভাস্কর্য বলতে কি বোঝায় নটরাজ হল তাই। নটরাজের শিল্পের উপর যত প্রবন্ধ লেখা হয়েছে। অন্য কোন ভাস্কর্যের উপর তা হয়নি। একটা গভীর ভাবকে কিভাবে ভাস্কর্যের মাধ্যমে ফুটিয়ে রূপটাকেই দেখে ছেড়ে দেয়। এইভাবে একটা শিল্পকে হৃদয়ঙ্গম করা যায় না। সেইজন্য পুরাণাদি পাঠ করে তার অন্তর্নিহিত আধ্যাত্মিক সত্যকে ধারণা করা খুব কঠিন কাজ। কাহিনীর মাধ্যমে পুরাণ কি আধ্যাত্মিক সত্যকে বলতে চাইছে। যতক্ষণ না ধরতে পারা যাবে ততক্ষণ পুরাণ পাঠের কোন সার্থকতা থাকবে না।
পুরাণ রচয়িতারা যে কাহিনীগুলো রচনা করেছিলেন, সেই কাহিনীগুলো আগে থাকতেই সমাজে প্রচলিত ছিল। প্রচলিত কাহিনীর যে চরিত্রগুলোকে তাঁরা সামনে পেলেন, সে যে অবস্থাতেই পেয়ে থাকুন, ভালো মন্দ যাই হোক, সেখানে তাঁদের কল্পনাকে এমনভাবে প্রয়োগ করলেন যে দেখা গেল। যাকে ভালো করবেন তাকে সব ভালো জিনিষগুলো উজার করে ঢেলে দিলেন আর যাকে খারাপ করতে চাইলেন তার মধ্যে যত খারাপ গুণ হতে পারে সব খারাপ গুণ ঢেলে দিলেন। ধরুন শ্রীরামচন্দ্র বা শ্রীকৃষ্ণ কোন একটা চরিত্র ছিল, পুরাণ রচয়িতারা এখন তাঁর মধ্যে যত রকমের ভালো গুণের কল্পনা করা যেতে পারে সব ঢেলে দিয়ে গেছেন। ঠিক তেমনি কংস বা রাবণের মত চরিত্রের ক্ষেত্রে খারাপ গুণ যা কিছু কল্পনা করা যেতে পারে তার সব কিছু ঢেলে গেছেন। এটাই হচ্ছে পুরাণের বিশেষত্ব।
ইতিহাস মূলক শাস্ত্র বাল্মীকি রামায়ণে রাবণের চরিত্রে যেমন অনেক দুর্গুণের উল্লেখ করা হয়েছে, সাথে সাথে রাবণের অনেক ভালো গুণের বর্ণনা করতে বালীকি কার্পণ্য করেননি। পুরাণে এই জিনিষ কখনই দেখা যাবে না। এখানে ভিলেন ভিলেনই, ভিলেনের মধ্যে ভালো গুণ কিছু থাকতেই পারেনা। মানবিক চরিত্রের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে সাদা কালো মেশানো, কিন্তু পুরাণে সব চরিত্রই হয় পুরো সাদা নয়তো পুরো কালো, হয় তুমি বিরাট, নয়তো তুমি বরবাদ। সেইজন্য পুরাণকে কখনই পূর্ণাঙ্গ সাহিত্য বলা যেতে পারে না। এই কারণে যাঁদের একটু বিদ্যা বুদ্ধি আছে তাঁরা পৌরাণিক চরিত্রগুলোকে অত আক্ষরিক ভাবে নেন না। অন্য দিকে সাধারণ মানুষের এত তুলনাত্মমূলক বিচার করার ক্ষমতা নেই। সাধারণ মানুষের মন স্থূল চিন্তা জগতেই ঘোরাফেরা করে। সাধারণ মনকে যখন কিছু বলা হয় তখন কোন দাগ কাটে না, সেইজন্য জোর গুতো মারতে হয়। গুতো মারাটা কি রকম? হয় তাকে পুরোটা সাদা করে দিয়ে বলো নয়তো পুরোটাই কালো করে দিয়ে বলো। তখন সে মনে করবে। হ্যাঁ এইবারে একটা কিছু হচ্ছে কিন্তু যদি সাদা-কালো মিশিয়ে বলে দেওয়া হয় তখন সেটাকে বুঝতে যে বিচার বুদ্ধি দরকার সেই ক্ষমতাই তার নেই। এই কারণে প্রায়ই অনেকে প্রশ্ন করে – আচ্ছা রাম কেন সীতাকে বনে পাঠিয়েছিলেন? রামচন্দ্র বালিকে কেন লুকিয়ে বধ করলেন? কারণ সাধারণ মানুষ মানতেই চায় না যে মানুষের চরিত্র সব সময় সাদা-কালোতে মেশানো থাকে। পুরাণে শ্রীরামচন্দ্রকে ভগবান রূপে দেখানো হয়েছে, ভগবানের কোন দোষ থাকতে পারে সাধারণ মানুষ মানতেই চাইবে না। এই কারণে পুরাণের কাহিনী জনসাধারণের মধ্যে এত জনপ্রিয়।
পুরাণের আরেকটি গুরুত্বপূৰ্ণ বৈশিষ্ট্য হল, প্রকৃতির বিভিন্ন ঘটনাকে নিয়ে পুরাণ তার কাহিনীগুলোকে দাঁড় করিয়েছে। যেমন আকাশে বিদ্যুৎ চমকায়। বিজ্ঞানের সুবাদে আজ আমরা জানি বিদ্যুৎ কেন চমকায়। কিন্তু তখন বিজ্ঞানের এত কিছু কেউ জানতেন না, বিদ্যুতের এই ঘটনাকে তাঁরা দেবতা, ভগবান, স্বর্গের সাথে জুড়ে দিয়ে কল্পনার জালবুনে একটা কাহিনীকে দাঁড় করিয়ে মানুষের মনকে ধর্ম ও ঈশ্বরের দিকে ঠেলে দিলেন। আলোচনার শুরুতেই আমরা উল্লেখ করেছি। যখন কোন ঘটনাকে ভগবানের সঙ্গে বা দেবতার সঙ্গে জুড়ে দিয়ে কাহিনীর মাধ্যমে মানুষকে আধ্যাত্মিক রূপ দেওয়া হয় তখনই সেই কাহিনীকে বলা হয়। পুরাণ বা mythology। পৌরাণিক কাহিনীর মধ্যে যদি আধ্যাত্মিকতা, দেবতা ও ঈশ্বরের মেলবন্ধন না থাকে তাহলে সেই কাহিনীকে কল্প-কাহিনী বা রূপকথার গল্প বলা হবে। সংস্কৃত সাহিত্যে বিক্ৰমাদিত্যের বেতালপঞ্চবিংশতির কাহিনীতে অনেক অপ্রাকৃতিক জগতের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু সবই ভূতে-প্ৰেত এইসব নিয়ে, এগুলো সবই কল্প-কাহিনী। কিন্তু যখনই ইন্দ্র, বরুণ, অগ্নি দেবতাদের নিয়ে অপ্রাকৃতিক ঘটনাগুলিকে একটা কাহিনীর আকারে রূপ দিয়ে মানুষকে ধর্মের দিকে নিয়ে যাবে তখনই সেই কাহিনীকে পৌরাণিক কাহিনী আখ্যা দেওয়া হবে। বহুল সমাদৃত ধর্ম তখনই হবে যখন দর্শনের সাথে পৌরাণিক কাহিনীর সমাবেশ হবে, যে ধর্ম শুধু মাত্র দর্শনের কথাই বলে সেই ধর্মের জনপ্রিয়তা কখনই হয় না। হিন্দু ধর্মের এটি একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। কিন্তু বেদের সময় থেকেই দর্শন আর পুরাণকে সম্পূর্ণ আলাদা করে রাখা হয়েছিল। সেই থেকে উপনিষদ আর বেদান্তকে ধর্মের প্রধান অঙ্গ রূপে দেখা হত, যেখানে হিন্দুধর্মের মূল দর্শন সুরক্ষিত ছিল। উপনিষদই হল হিন্দুধর্মের মূল দর্শন, আর পুরাণ থেকে উপনিষদকে অনেক দূরেই রাখা হয়েছিল। কিন্তু দর্শনকে যখন পৌরাণিক কাহিনীর মধ্যে নিয়ে আসা হল তখনই সেই ধর্ম বেশি জনপ্রিয়তা পেয়ে গেল। দর্শন যদি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত হয় তাহলে পুরাণ হিন্দী সিনেমার ক্লাসিক গান। তবে এটাই আশ্চর্যের যে, পৃথিবীর সব ধর্মই এখন জনপ্রিয় ধর্মের পর্যায়ে চলে গেছে, একমাত্র হিন্দুধর্ম ছাড়া। অন্যান্য ধর্মের মূল ধর্মগ্রন্থ পৌরাণিক কাহিনীর সাথে মিশে গেছে, আর যে মুহুর্তে ধর্মের সারাতত্ত্বকে পুরাণের সাথে মিশিয়ে দেওয়া হবে তখনই সেই ধর্মের জনসমাদর প্রচণ্ড ভাবে বেড়ে যাবে। স্বামীজীও বলছেন বেদান্তের সামনে দাঁড়াতে পারে এমন কোন ধর্মগ্রন্থ আজ পর্যন্ত কোন ধর্মেই পাওয়া যাবে না, খ্ৰীশ্চান, এমনকি বৌদ্ধধর্মও বেদান্ত উপনিষদের সামনে দাঁড়াতে পারবে না। এটা বলার এই উদ্দেশ্য নয় যে খ্ৰীশ্চন বা বৌদ্ধ ধর্ম যা বলছে উপনিষদ অন্য কথা বলছে, সবাই একই কথা বলছে, কিন্তু উপনিষদের উপস্থাপনার শৈলী, তার বক্তব্যের বলিষ্ঠতার কথাই এখানে বলা হচ্ছে।
পুরাণের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল কোন পুরাণেই তার অধ্যায়ের মাঝখানে কেউ কিছু সংযোজন করবেন। না। পাশ্চাত্য পণ্ডিতরা এই ব্যাপারে ভারতীয় পণ্ডিতদের সততার খুব প্রশংসা করেন। তাঁরা যখনই পুরাণে কোন নতুন কিছু সংযোজন করতেন সব সময়ই হয় শুরুতে নয়তো একেবারে শেষে করতেন। অনেক মনে করেন সূতরাই পুরাণে অনেক কিছু সংযোজন করে গেছেন। কিন্তু এই মতটা ঠিক নয়। সংযোজনের এই কাজটা তাঁরাই করতেন যাঁদের অগাধ পাণ্ডিত্যের সাথে সাহিত্যিক প্রতিভা ছিল আর তাঁর কাছে পুরাণের একটি পাণ্ডুলিপিও থাকা চাই।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.