বিদ্যা পরীক্ষা
তৃতীয় পরিচ্ছেদ।
ধীরে ধীরে কুরুবালকেরা গুরু দ্রোণের কাছে দিব্য ও মানুষ বিবিধ অস্ত্র বিদ্যা শিখলেন। বহু দেশ দেশান্তর থেকে অনেকানেক রাজকুমার, দ্রোণের কাছে অস্ত্রবিদ্যা শেখার জন্য আসতে লাগলেন। সূতপুত্র কর্ণের সাথে এই সময় দুর্যোধনের পরিচয়। কর্ণ অর্জুনের সাথে স্পর্ধা করে দুর্যোধনের সাহায্য পাণ্ডবদেরকে নানাভাবে অবমাননা করতে লাগল। কিন্তু সমাগত সমস্ত শিষ্যদের মধ্যে অর্জুন ভূজবলে, উদ্যোগ ও ধনুর্বেদ শিক্ষায় গুরু দ্রোণের সমকক্ষ হয়ে উঠলেন। ভীম ও দুর্যোধন গদাযুদ্ধে বিশেষ পারদর্শিতা লাভ করল, নকুল ও সহদেব অসি চর্যায় কুশলী হলেন কিন্তু যুধিষ্ঠির কেবল উৎকৃষ্ট রথী হলেন। দুরাত্মা ধার্তরাষ্টেরা বলাধিক ভীমসেন ও কৃতবিদ্য অর্জুনকে দেখে ঈর্ষাপরায়ন হল।
বালকেদের বিদ্যা অর্জন শেষ হল, দ্রোণাচার্য এদের পরীক্ষা করবেন, স্থির করলেন। কুমারদের অগোচরে শিল্পীকে দিয়ে একটি কৃত্রিম নীলপাখার পাখি নির্মাণ করালেন। ভাসপক্ষীকে একটি গাছের প্রথম শাখায় বেঁধে দিলেন। প্রথমেই সর্বজ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরের পরীক্ষা। আচার্য প্রথমে যুধিষ্ঠিরকে ঐ পাখী লক্ষ্য করতে বললেন। আর সমবেত সমস্ত রাজকুমারদেরকে বললেন, “তােমরা সকলে শীঘ্র শরাসনে শর সন্ধান করে আমার আদেশের অপেক্ষা করতে থাক, আমি তােমাদেরকে একে একে নিয়ােগ করছি। আমার কথা শেষ হতে না হতেই ঐ লক্ষ্যকে শিরচ্ছেদ করতে হবে। দ্রোণ প্রথমে যুধিষ্ঠিরকে আদেশ করলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন- গাছের চূড়াদেশে রাখা ঐ শকুনকে নিরীক্ষণ কর? হ্যাঁ দেখছি, ধর্মপুত্র এই উত্তর দিলেন।
দ্রোণ- ধর্মপুত্র তুমি এই গাছকে, আমাকে বা তোমার ভাইদের কি দেখছ ? উত্তর দিলেন- উপরে পাখি এবং নিচেতে তােমারে দেখি আর সহােদরদের। দ্রোণ অসন্তুষ্ট হলেন, হাত থেকে ধনুঃশর কেড়ে নিয়ে ঠেলা মেরে সরিয়ে দিলেন। শত ভাই দুর্যোধন ভীমসেন প্রভৃতি সকলেই এভাবে নিন্দিত হলেন। গুরু তখন হাসিমুখে অর্জুনকে ধনুঃশর দিলেন। অর্জুন লক্ষ্য স্থির করল, আচার্য জিজ্ঞাসা করলেন, কি দেখছ ?
“অর্জুন বলেন আমি অন্য নাহি দেখি।
বৃক্ষমধ্যে সবে দেখিবারে পাই পাখী।”
আচার্য প্রীত হলেন। আবার জিজ্ঞাসা করলেন, শকুনকে ভালোভাবে নিরীক্ষণ করছ? “না, কেবল মাথাটি দেখছি।” দ্রোণ আরও সন্তুষ্ট হলেন। এভাবে লক্ষ্য স্থির না হলে কি ভগবানের সখা হওয়া যায়, না ধর্ম বৃক্ষের কাণ্ড হওয়া যায় ?
দ্রোণ- “লক্ষ্য ভেদ কর” এই কথা উচ্চারণ করতে, না করতে অর্জুনের শরে পাখিটির মাথা আলাদা হয়ে মাটিতে পড়ল। গুরু অর্জুনকে বহুবিধ সম্মান করলেন, আর “ক্রোধে দুর্যোধন ভাভে মরণ সমান।”
আর একদিন ভাগীরথীর জলে দ্রোণ স্নান করছেন, বালকেরা স্নান আহ্নিক শেষ করে উপরে দাঁড়িয়ে আছে। এক কুমীর দ্রোণের উরুতে কামড়ে ধরল। দ্রোণ নিজেই আত্মরক্ষা করতে পারতেন, কিন্তু পরিক্ষার জন্য শিষ্যদের তাকে উদ্ধারে আদেশ দিলেন- “আমাকে কুমীর গিলে ফেলছে, তােমরা পরিত্রাণ কর।” অন্যান্য রাজকুমারেরা কর্তব্যবিমূঢ় হয়ে মুর্তির মত দাড়িয়ে রইল। অর্জুন আদেশ পাওয়া মাত্র পাঁচটি বাণে জলের কুমীরকে প্রহার করলেন। কুমীর মারা গেল। দ্রোণ শিষ্যদের মধ্যে অর্জুনকে প্রধান বিবেচনা করে ব্ৰহ্মাশিরা নামক অস্ত্র প্রদান করলেন এবং বললেন, বৎস! মনুষ্যলােকে তােমার তুলনায় ধনুর্ধর আর কেউই জন্মাবে না। ভীম ও অর্জুন উভয়েই দুর্যোধনের ভীতির কারণ হয়ে উঠল।
বালকদের শিক্ষা শেষ হয়েছে, দ্রোণ ধৃতরাষ্ট্রকে জানালেন, আপনার পুত্ররা ও পাণ্ডুপুত্ররা সকলে বিদ্যা লাভ করেছে, এখন কৃপ, সােমদত্ত, বাহ্লিক, ভীষ্ম, ব্যাস ও বিদুর এদের সামনে নিজ নিজ অন্ত্র শিক্ষার পরিচয় প্রদান করবে। আপনার অনুমতির অপেক্ষা; অনুমতি মিলল। দ্রোণাচার্য সমতল ভূমিতে রঙ্গভূমির সীমা পরিমাণ করলেন। ঐ স্থানটি গাছপালা লতাপাতা বিহীন, পরিস্কার এবং স্থানে স্থানে ধর্ণা ও জলাশয়ে অতীব রমণীয় হল। তখন দ্রোণ শুভ নক্ষত্র যােগ সম্পন্ন তিথি বিশেষে বীরসমাজে ঘোষনা প্রচার করলেন এবং ঐ স্থানটিতে পূজা অর্চনা করলেন। রাজ শিল্পিরা রঙ্গভূমি মধ্যে শাস্ত্রানুসারে অস্ত্রশস্ত্র পরিপূর্ণ এক এক দর্শনাগার এবং স্ত্রীলােকদের জন্য সুরম্য গৃহ সকল নির্মাণ করল। পুরবাসিরা অতি উন্নত মঞ্চ ও মহামূল্য পালকি সকল প্রস্তুত ও সুসজ্জিত করতে লাগল। নির্দিষ্ট দিনে সকলে রঙ্গভূমিতে উপস্থিত হলেন। বালকেরা সকলেই নিজ নিজ বিদ্যা প্রদর্শন করল। দুর্যোধন ও ভীম গদাযুদ্ধ করল। উভয়ের প্রচণ্ড ক্রোধ সম্ভাবনা দেখে পিতার অনুমতিতে অশ্বত্থামা উভয়কে নিরস্ত করলেন। সর্বশেষে অর্জুন অদ্ভুত শস্ত্র বিদ্যা প্রকাশ করলেন। দর্শকেরা পুনঃ পুনঃ একবাক্যে অর্জুনকে লক্ষ্য করে জয়ধ্বনি দিয়ে উঠল। পুত্রের প্রশংসা শুনে পুত্র বৎসলা পৃথার হৃদয় সিক্ত হতে লাগল।
বিদ্যা পরিক্ষায় অর্জুন সর্বশ্রেষ্ঠ হলেন। প্রথম থেকেই ভীম ও অর্জুন দুর্যোধনের চক্ষুশূল। ধীরে ধীরে বিদ্বেষ ভাব আরও পরিপুষ্ট হতে চলল। যখন সকলে রঙ্গভূমিতে অর্জুনকে ধন্য ধন্য করছিল, সেই সময় সূতপুত্র কর্ণ বিস্তীর্ণ রঙ্গস্থানে প্রবেশ করলেন।
কর্ণের সাজসজ্জা, বড়ই সুন্দর। শান্ত চোখ, শােভামান মুখমণ্ডল কুণ্ডলে অলংকৃত, অঙ্গে সহজাত কবচ, কটিদেশে খড়গ। কান উন্নত, কর্ণ সর্বাঙ্গসুন্দর। কর্ণ কুন্তীর অবিবাহিত পুত্র।
কর্ণ বঙ্গভূমিতে প্রবেশ করে, অর্জুনের মত বিদ্যা দেখাল। দুর্যোধন অমনি কর্ণের সাথে বন্ধুত্ব করল, বলল, আজ থেকেই তুমি আমার বন্ধু, এখন আমার সাথে বিষয় ভােগ বাসনা পূর্ণ কর, পরে বিপক্ষ পক্ষের মাথায় পদাপর্ণ করে সুখে কালাতিপাত করও। অর্জুন হতে আর ভয় নেই মনে ভেবে দুর্যোধন আনন্দে উৎফুল হল।
কর্ণ অর্জুনকে যুদ্ধের জন্য আহবান করল। অর্জুন অনাগত ব্যক্তির সাথে দ্বন্দ্ব করতে প্রস্তুত নন বললেন-
“অনাহত কর দ্বন্দ্ব আসিয়া সভায়।
ইহার উচিত ফল পাইবে ত্বরায়।।
নাহি জিজ্ঞাসিতে যেবা বলয়ে বচন।
আসিয়া আপনি খায় বিনা নিমন্ত্ৰণ।।
ধোর নরকেতে গতি পায় সেইজন।
সেই গতি মমস্থানে পাইবি এখন।।”
“নাহি জিজ্ঞাসিতে যেবা বলয়ে বচন” ইত্যাদি উপদেশটি বহুমূল্য বটে, এটি অভ্যাসের উপযুক্ত। তথাপি কর্ণ বহু কথা বলছেন। তখন অর্জুন আচার্যের অনুমতি পেয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন।
সেই রঙ্গভূমিতে দুইটি দল হল, কিন্তু কৃপ কর্ণের পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন। কর্ণ সূতপুত্র বলে রাজপুত্রের সাথে যুদ্ধে অনধিকারী। যুদ্ধ বন্ধ হয়ে গেল। ভীমসেন কর্ণকে বহু কুটুক্তি করলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে একটা গােলযােগ লেগে গেল, লোকে নানা কথা বলতে লাগল।
“কেহ বলে ভেদাভেদ হৈল ভ্রাতৃগণ।
কেহ বলে দ্বন্দ্বে আর নাই প্রয়োজন।”
যাহোক যুদ্ধ থেমে গেল। দুর্যোধন নির্ভয় হল, যুধিষ্ঠির ভীত হলেন। যুধিষ্ঠির ভাবলেন-
“কর্ণ সম বীর আর নাহি যে সংসারে
এই ভয় সদা জাগে ধর্ম্মের অন্তরে।”
যুধিষ্ঠির কর্ণকে যদি সহােদর বলে জানতে পারতেন, বলা যায় না, তবে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ কেমন হত।
দুর্যোধন অধর্ম বৃক্ষ, তার ছায়া তার দলের সকলকেই স্পর্শ করেছে কিন্তু কর্ণ সেই অধর্ম গাছের গোঁড়া। তার রণদক্ষতাকে আশ্রয় করেই অধর্মের প্রসার হয়েছিল। কর্ণ সমরাগ্নির প্রধান উদ্দীপক। দুর্যোধনের দক্ষিন হাত; কুপরামর্শের মূল ভিত্তি।
বালকদের অস্ত্র পরিক্ষা শেষ হল। দ্রোণাচার্য গুরুদক্ষিণা প্রার্থনা করলেন। দ্রোণ বাল্য সখা দ্রুপদ কর্তৃক অবমানিত হয়ে কুরুকুলে গুরুত্ব স্বীকার করেছিলেন। এখন কুরু পাণ্ডবের সাহায্যে দ্রুপদ রাজাকে পরাস্ত করলেন। চর্মণ্বতী নদী পর্যন্ত দক্ষিণ পাঞ্চাল দ্রোণের অধিকার ভুক্ত হল। দ্রোণ, অহিচ্ছত্রা নগরীর রাজা হলেন। অর্জুন দ্রুপদকে পরাস্ত করে অহিচ্ছত্রাপুরী দ্রোণকে দান করলেন।
ব্রহ্মশক্তি যে ক্ষত্রবলের সাহায্যে বাইরে জগতে অধিক কার্যকরী হয়, ব্যাসদেব এখানে তাই বুঝিয়ে দিলেন। দ্রুপদ রাজা নিজেকে হীনবল দেখে ব্ৰহ্মবলে পুত্রলাভ করার বাসনায় পৃথিবী পর্যটন করতে লাগলেন। দ্রুপদ যজ্ঞে দ্রোণ সংহারের জন্য যে পুত্র জন্মে তার নাম ধৃষ্টদ্যুম্ন। ঐ যজ্ঞ থেকে সংসার নারীজাতির তিলক স্বরূপ যে কন্যা উৎপন্ন হয়, তার নাম যাজ্ঞসেনী বা দ্রৌপদী।
কৌরব ও পাণ্ডবদের বিদ্যা পরীক্ষা পর্ব সমাপ্ত।
নিবেদনে-সনাতন সংবেদ
কোন মন্তব্য নেই