sanatansangbed

Introduction of SANATAN dharma scriptures

আর্যপ্রভা-বেদ-৩

ওঁ তৎসৎ
আর্যপ্রভা 
বেদ-৩

“মানস শিল্পের উদ্দেশ্য নিহিত বীর্যকে প্রকাশ করা। ভারতেতর দেশে এর আভাস মাত্র। অধ্যাত্ম শিল্প-ভারতের আদর্শ। সত্যং শিব সুন্দরং। জ্ঞানকাণ্ড, উপাসনাকাণ্ড ও কর্মকাণ্ড-উদ্দেশ্য। সংহিতা চতুষ্টয়ই চারবেদ। ব্যাসদেব। সরহস্য চতুর্বেদ-শাখা। বাকোবাক্য, ইতিহাস, পুরাণ, বৈদ্যক। শৌনকের চরণব্যুহ। কৌথুমী ও রাণায়ণ। ভেদ বা প্রস্থান। বেদব্যাস উপাধি বহু। পৈল, জৈমিনি, বৈশম্পয়ন, সুমন্ত্র। যাজ্ঞবল্ক্য। বাজসনী, বাজসনেয়। শুক্ল যজুর্বেদ। কৃষ্ণ যজুর্বেদ। ঈশোপনিষৎ। ভৃগু, অথর্বা-আসন। অঙ্গিরা। স্বাহা-অর্থ। যজমান, ঋত্বিক, হোতা, অধ্বর্য্যু। যজ্ঞ-শরীর। উদগাতা। ব্রহ্মা। হোতৃক্রিয়া, উদ্‌গান, ব্রহ্মক্রিয়া। স্বর্গ। নিরুক্ত। বৈয়াকরণের যাজক। প্রজাজ মন্ত্র। বেদ ও তন্ত্র-দ্বিবিধ শ্রুতি। প্রভেদ। ব্রাহ্মণ, আত্মন, শক্তি। ব্রাহ্মণ ও স্ফোটবাদ। Alexandrian School। শক্তি গঠনের মূল ভাব অন্যত্র নেই। দুহিতা। প্রথম হতেই ভারতের আদর্শ। আপ্তবাক্য। মত বা জ্ঞান। ঋষি। বোধে বোধ। ব্রহ্মবিদ্যা ও তার ধারা। শ্রুতিকণ্ঠস্থ বিদ্যা নয়। বেদ, ছন্দকে অতিক্রম করেছেন। কীর্তন। নানা ছন্দ। ছান্দম। মাহেশ্বরী সূত্র। অধ্যয়ন-সংস্কার কার্য্য। পুরুষার্থ। চার রকমে বিদ্যার স্ফুর্তি। প্রথম গানই সামগান। চার রকম শব্দ, ব্রহ্মার চারি বদন। ব্রহ্মযজ্ঞের জুহূ, উপভূত, ধ্রুবা, মেধা, অবভৃথ স্নান, উদ্‌ষন।”

সাধন দ্বারাই সত্যজ্ঞানের উদয় হয়, অনিত্যতার আবরণ অপসারিত হয়, নিত্যতার স্ফূর্তি হয়। শিল্প শব্দটিকে ব্যাপক অর্থে গ্রহণ করলে, জীব মাত্রেই শিল্পী। জোনাকী পোকা আলো দিয়ে আহার অন্বেষণই করুক বা নিজ প্রিয় কে আহবানই করুক, সে তার ভেতরের আকর্ষণী শক্তিকেই কাজে লাগাচ্ছে; মানুষ যখন শিল্প সহায়ে এই নিহিত বীর্য কে সামনে ধরার চেষ্টা না করে মাত্র অনুকরণ করে ও বাইরের রূপটি মাত্র প্রকাশ করে সেটিকে সাধারণ শিল্প বলা যায়। এই রকম সাধারণ শিল্প বা কারুশিল্পও, বর্ণ ও রেখায় নয়ন আনন্দদায়ক হয়, শিল্পীর চেষ্টা থাকে সকলের দৃষ্টিকে আকর্ষণ করার। অনুকরণের বস্তুকে যখন চেনার, বোঝার চেষ্টা হয়, তখন ঐ শিল্পী আর এক ধাপে উঠেন। তাঁর দৃষ্টি প্রসারিত হয়। ভাবের সঙ্গে মিশে গেলে, ভাব আয়ত্তের মধ্যে আসলে, অনুকরণ আর অনুকরণ থাকে না, সেটি বাস্তব হয়ে দাঁডায়। মানসশিল্পের উদ্দেশ্য শিল্প ও শিল্পীকে এক করা, একাত্ম করা, ঐ নিহিত বীর্যকে প্রকাশ করা, ঐ নিদ্রিত ভুজঙ্গকে জাগ্রত করা। ভারতেতর দেশে সর্বত্র আজও ঐ কারুশিল্পের প্রথম দুটি ধাপ শিল্পী অতিক্রম করতে পারেন নি, মানস শিল্পের আভাস মাত্র পেয়ে তাঁরা ক্ষান্ত হয়েছেন। ক্বচিৎ কোথায় কে অতিক্রম করেছেন তার কথা হচ্ছে না। গোড়া থেকেই ভারতের আদর্শ অধ্যাত্মশিল্প। ভারতের শিল্পী সর্বত্র বহুতে একেরই প্রকাশ দেখার জন্য লালায়িত। অধ্যাত্ম শিল্পের রূপই দেখাতে তাই তাঁরা চেষ্টা করেছেন। চিত্রে, ভাস্কর্যে, সঙ্গীতে, সাহিত্যে, জীবনের প্রত্যেক খুঁটিনাটিতে। অন্যত্র, বহুকে পৃথক পৃথক ভাবে বোঝার চেষ্টায়, রূপ ও বিভূতি, মানুষের ভোগ সাধনে, মানুষেরা সুখ সুবিধার জন্য নিয়োজিত। ভারত অন্তরের রূপকে- সত্যং শিবং সুন্দরম’কে ধরে বহুর মধ্যে বিচরণ করেছেন। অন্তরের সুন্দরে তিনি মুগ্ধ, বাইরের রূপ হয়ে গেছে তার কাছে তুচ্ছ তখন, ভুলেছেন তিনি সব, ঐ সুন্দর অন্তর ও বাহিরে সর্বত্র। অন্যত্র, বাহিরের রূপই প্রধান, বহির্জগতের সঙ্গে ব্যবহারে যে ভাব ফুটে ওঠে তারই প্রকাশে শিল্পী যত্নবান। এখন সময় এসেছে ঐ উভয়ের আদান প্রদানের।
অধ্যাত্মশিল্পরূপ সর্ব প্রাচীন সঙ্কলিত শব্দরাশি বেদ, জ্ঞানকাণ্ড, উপাসনাকাণ্ড ও কর্মকাণ্ডে বিভক্ত, জ্ঞানকাণ্ডকে ব্যবহারগম্য করবার জন্যই উপাসনা ও কর্মকাণ্ড। বেদ তিন, কিন্তু অতি বৃহৎ বিধায়, অধ্যয়নের ও অন্যান্য সুবিধার জন্যই ব্যাসদেব দ্বাপরে বেদকে চারভাগে বিভক্ত করেন, প্রত্যেকটির পৃথক নাম দেন। অধিকাংশ ঋক (সাধারণতঃ আহুতির মন্ত্র) যাতে আছে তার নাম ঋক সংহিতা, যে সব ঋক গীত হয় তার নাম সামসংহিতা, গদ্যাংশ একত্র করে নাম হয়েছে যজুঃ সংহিতা; অবশিষ্ট মন্ত্র যাতে আছে তার নাম অথর্ব সংহিতা। অথর্ববেদে যেমন শান্তি, অভিচার আদি মন্ত্র আছে, তেমনি ব্রহ্মতত্ত্বের নিগুঢ় রহস্যও আছে। ব্যবহারিক প্রয়োগ ও প্রকরণ বশে ঋগ্বেদ ও অথর্ববেদের মধ্যে কতকগুলি সাম ও যজুমন্ত্র আছে, সামবেদের মধ্যেও কতকগুলি ঋক ও যজুঃ আছে, যজুর্বেদের মধ্যেও কতকগুলি ঋক ও সাম আছে। মন্ত্রের প্রাধান্য অনুসারে বেদের নামকরণ হয়েছে। বর্তমানে ঐ সংহিতা চতুষ্টয়’ই চতুর্বেদ নামে পরিচিত।
ঋক সংহিতায়  আছে ১০ হাজার মন্ত্র সংখ্যা, অথর্ববেদের কিছু কম ৬ হাজার। মহাভাষ্য (পণ্ডিত রজনীকান্ত বিদ্যারত্ন কর্তৃক অনুবাদিত-উদ্বোধন ১ম বর্ষ দ্রঃ) হতে জানা যায় যে সরহস্য চতুর্বেদ বহু প্রকার; অর্ধ্বয্যুর (যজুর্বেদের) শাখা ১০০, সামবেদের ১০০০ হাজার, বাহ্বচ্য ২১ প্রকার, অথর্বেবেদ ৯ রকম। এ ছাড়া বাকোবাক্য (উক্তি প্রত্যুক্তিরূপ গ্রন্থ), ইতিহাস (পূর্বতন লোকের চরিত্র বর্ণন গ্রন্থ), পুরাণ (প্রাচীন কথা) ও বৈদ্যক (চিকিৎসা শাস্ত্র) শাস্ত্র আছে। বিভিন্ন শাস্ত্রের নামের শেষে বেদ এই শব্দটি যুক্ত আছে। সব গুলির লক্ষ্য এক, যথা- জ্যোতির্বেদ, ধনুর্বেদ ইত্যাদি। পণ্ডিতেরা বলেন যে ঋগ্বেদে প্রক্ষিপ্ত নেই বললেই হয়, তার কারণ ঋগ্বেদের শ্লোক সংখ্যা, প্রতি শ্লোকের পদসংখ্যা, শব্দাংশের পরিমাণ, প্রত্যেক সূক্তে কতগুলি অকারান্ত, ইকারান্তাদি পদ আছে তা সমস্তই নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। পৈল শিষ্য-ইব্দ্রপ্রমতি ও বাস্কল ঋক সংহিতাকে দুভাগ করেন, শেখার সুবিধার জন্য। বাস্কল আবার তাকে চারভাগ করেন ও তাঁর ৪ জন শিষ্যকে শেখান; মাণ্ডুককে শেখান ইন্দ্রপ্রমতি। শৌনক চরণব্যূহ নামে বই লেখেন, তিনি লিখেছেন যে ঋগ্বেদের ৮টি শাখা থাকলেও অধিকাংশ পুর্ণ পাওয়া যায় না, ৫টি শাখা লুপ্ত। সামবেদের উত্তর ও পূর্ব এই দুই শাখার বহু প্রশাখা ছিল, এখন মাত্র দুটি পাওয়া যায়। কৌথুমী ও রাণায়ণ নামে দুইজন ঋষি ছিলেন। বাংলা দেশের অধিকাংশ ব্রাহ্মণ কৌথুমী শাখার অন্তর্গত। অথর্ববেদেরও অনেক অংশ এখন পাওয়া যায় না। ঋগ্ধেদের ৮টি শাখাকে ভেদ বা স্থান বলা হয়।
বেদ বিভাগ করায় ব্যাসদেবের নাম হয় বেদব্যাস, তিনি শ্রীকৃষ্ণের সমসাময়িক। ব্যাসদেব নিজের চার শিষ্যকে বেদ পড়ান; শিষ্যেরা- পৈল-ঋগ্বেদ; জৈমিনী-সামবেদ; বৈশম্পায়ন-যজুর্বেদ, সুমবত্র-অথর্ববেদ। ঐ সব শিষ্যেরা আপন আপন শিষ্যকে পড়ান ও তারা পুনরায় বেদকে নানাভাবে বিভক্ত করায় তাঁরা ও বেদব্যাস নামে পরিচিত হন। যাজ্ঞবল্ক্য নিজগুরু বৈশম্পায়নের কাছে একটি শাখা পান। গুরুর সঙ্গে তাঁর বিশেষ মতভেদ হয়। যাজ্ঞবল্ক্য সে শাখা ত্যাগ করেন, গুরুর কাছে অভিশপ্ত হয়ে চলে যান ও অধীত বিদ্যা ভুলে যান। তিনি কঠোর তপস্যা আরম্ভ করেন। সূর্য্যদেব বাজী(অশ্ব) রূপ ধারণ করে তাঁর বাজ(কেশর) হতে বিদ্যা দান করেন। যাজ্ঞবল্ক্য যা পান তার নাম বাজসনী আর মন্ত্রগুলি বাজসনেয়। এই নতুন শাখার নাম শুক্লযজুর্বেদ; যেটি তিনি ত্যাগ করেছিলেন তার নাম কৃষ্ণ যজুর্বেদ। অধিকাংশ উপনিষদগুলি ব্রাহ্মণভাগের বা মন্ত্রভাগের শেষে আছে, কিন্তু বাজসনেয় সংহিতোপনিষৎ আছে শুক্লা-যজুর্বেদীয় বাজসনেয় সংহিতার শেষে। এই বাজসনেয় সংহিতোপনিষদের মধ্যে ঈশোপনিষৎ কে পণ্ডিতেরা সর্বপ্রথম ও শ্রেষ্ঠস্থান দেন।
ব্রহ্মার এক মানসপুত্র ভৃগু, অথর্বা ঋষি নামে বিদিত। অথর্বার পরে অঙ্গিরা ঋষিত্ব লাভ করেন। অথর্ব হয়ে যায় আসনের নাম, সেই রকম অঙ্গিরাও একটি আসন। যেমন Magistrate একটি আসনের নাম, কোন ব্যক্তি বিশেষের নয়। সেই রকম ২০ জন অথর্বা ও অঙ্গিরার নাম পাওয়া যায়। ঐ ২০ জনের হৃদয়ে বেদ প্রকাশিত হন, এটাই অথর্ববেদ বা অথর্বাঙ্গিরস। এই বেদের ৫টি উপবেদ। সকাম ও নিষ্কাম সাধক সকলের জন্যই সাধনক্রম তাতে আছে। অথর্ববেদের পূর্ব ও উত্তরকাণ্ডের মধ্যে, সায়ন পূর্বকাণ্ডের টীকা করেছেন। উত্তরকাণ্ড এখন দুষ্প্রাপ্য, লুপ্ত না হলেও।
ব্যাপক ভাবে বৈরাগ্যময় জীবনই যজ্ঞ। ত্যাগ কর্মের নাম আহুতি। অগ্নিতে ঐরূপ প্রক্ষেপই আহুতি। স্বাহা উচ্চারণ করে আহুতি দিতে হয়। ব্যাপক ভাব বরাবর আছে। পুরাণে, স্বাহা অগ্নির স্ত্রী। শ্রীশ্রীহরিভক্তিবিলাস গ্রন্থ (গৌড়ীয় বৈষ্ণব) মতে, ‘স্বা শব্দেন চ ক্ষেত্রজ্ঞো হে তি চিৎ প্রকৃতি পরা।’ স্বা= জীবাত্মা-শ্রীমদ্ভগবৎগীতায় এই শব্দের প্রয়োগ আছে। তন্ত্রে, ‘বিশ্বস্য লয়ঃ স্বাহার্ণকে ভবেৎ স্বাহা’- স্বাহা এই বর্ণেই বিশ্ব লয় হয়। যার হিতের জন্য যজ্ঞ করা হত তার নাম যজমান। ঋত্বিক (যাজক) করতেন যজ্ঞ। বড় বড় যজ্ঞে তিনজন ঋত্বিক থাকতেন। ঋগ্বেদী প্রধান যাজক বা হোতাই দেবভাব আহবানকারী, তিনি আহুতি দেন না। যজ্ঞের উপযোগী দ্রব্য হব্য প্রস্তুত করা ও যথাসময়ে হব্য অগ্নিতে প্রক্ষেপ করা ছিল অধ্বর্য্যুর কাজ (অধ্বর= স্বর্গের পথ প্রদর্শক)। বেদি নির্মাণাদিতেই যজ্ঞ-শরীর নির্মিত হয়। যিনি এটা করেন, তিনিই অধ্বর্য্যু। হব্য আদি প্রক্ষেপের সময় যজুর্মন্ত্র বলতে হত, সুতরাং অধ্বর্য্যু ছিলেন যজুর্বেদী ঋত্বিক। বড় বড় ক্রিয়ায় তার সহকারী থাকত। বেদ পাঠে বাণী শুদ্ধ চাই, সুতরাং সুস্পষ্ট উচ্চারণ করতে হত। ঋকমন্ত্র উচ্চৈস্বরে, যজুমন্ত্র নিম্নস্বরে বলতে হয় ও সাম গীত হয়। সাম গানের প্রধান ঋত্বিকই উদগাতা। সর্ববেদীয় ঋত্বিকের ভুল ভ্রান্তি দেখার জন্য বা সংশোধন করার জন্য সর্বোপরি একজন ঋত্বিক থাকতেন, তাকে বলা হত ব্রহ্মা, সুতরাং ব্রহ্মা হতেন ত্রিবেদী। ব্রহ্মার এই পর্যবেক্ষণ অথবা ত্রুটি সংশোধন ক্রিয়ার নাম ব্রহ্মক্রিয়া। হোতৃক্রিয়া ঋক্‌মন্ত্রে, উদগান ক্রিয়া সামমন্ত্রে ও ব্রহ্মক্রিয়া অথর্বমন্ত্রে হত।
স্বর্গ কামনায় অনেক সময়ে যজ্ঞ হত, বলা বাহুল্য বেদের স্বর্গ ও পুরাণের স্বর্গ এক জিনিষ নয়। বেদে স্বর্গ= জ্যোর্তিলোক। নিরুক্ত না পড়লে বৈদিক মন্ত্রের পদবিভাগরীতি, এমন কি বাচনিক অর্থও বোধগম্য হয়  না। তখনকার অর্থ এখন সব সময়ে নেই। উদাহরণ স্বরূপ ঋক্‌ ১/১/৪/২ এ (ঘৃতাচীং এর) ঘৃত=উদক বা জল যাস্ক ও সায়ন মতে। কিন্তু পাশ্চাত্য অর্থ অনুসরণ করে, পণ্ডিত রমেশচন্দ্র দত্ত মহাশয় উদ্ধৃত ঋকের অর্থ করেছেন, পূতদক্ষ মিত্র ও শত্রুনাশক বরুণকে আমরা এসে প্রার্থনা করছি, তারা এসে ঘি দিয়ে আহুতি দিন; যাস্ক ও সায়ন মতে মানে হয় যে তারা উদক প্রেরণারূপ কর্ম সম্পাদন করেন। অর্থাৎ পূতদক্ষ মিত্র ও রিপুনাশক বরুণকে আহ্বান করা হচ্ছে যেন তারা প্রেরণা দেন।
[(পণ্ডিত লক্ষ্মীনারায়ণের নিরুক্ত সম্বন্ধে লেখা দ্রঃ) মিত্র ও বরুণ বেদের দুই দেবতা সুর্যেরই দুই রূপ। সূর্য যখন শিরোভাগে তখন তিনি মিত্র, যখন অধোভাগে তখন বরুণ। এইরকম চন্দ্রের আর একটি নাম গন্ধর্ব ও সুর্যের যে সমুদয় রশ্মি চন্দ্রকে দীপ্তিমান করে তার নাম সুষুম্ন।]
বৈদিক বৈয়াকরণদের মধ্যে যাজক শব্দটির একটি বিশেষ অর্থ ছিল। প্রজাজ মন্ত্র সব বিভক্তি যুক্ত করে ব্যবহার করতে হত ও যিনি বাক্যকে পদানুসারে এবং বর্ণানুসারে ব্যবহার করেন তিনি আত্মিজীন অর্থাৎ যাজক বা যজমান।
বেদের আর একটি নাম শ্রুতি। ঋষি মুখ নিঃসৃত সিদ্ধ বাণীর নাম আপ্তবাক্য; আপ্তবাক্য বেদব্ৎ প্রামাণ্য। শ্রুতি দ্বিবিধ- বেদ ও তন্ত্র (মনু-কুলুকভট্ট)। বেদতত্ত্বে অধিকার মাত্র ত্রিবর্ণের, মানব মাত্রই অধিকার তন্ত্র সাধনায়, এই মাত্র প্রভেদ। উপনিষদের ব্রহ্মণ, আত্মন ও তন্ত্রের শক্তি শব্দগুলির ন্যায় ব্যাপক অর্থের শব্দ কোন ভাষাতে নেই। মোক্ষমূলার সাহেবের মতে, ব্রহ্মণ ও আত্মন শব্দদ্বয় বহু প্রাচীন সংস্কৃত ভাষার প্রাগৃঐতিহাসিক স্তরের, তার মতে, ব্রহ্মণ শব্দের আদি ধাতু জানা না থাকলেও ব্রহ্মণ শব্দের গোড়ার অর্থ=যা স্ফুটীকৃত হয়, ভেঙ্গে পড়ে, তা সে চিন্তার আকারেই হোক, বাক্যের আকারেই হোক অথবা স্বজনী শক্তির আকারেই হোক বা দৈহিক বলের আকারেই হোক।
[(উক্ত সাহেবের The Vedanta Philosophy দ্রঃ)। সাহেব দেখাচ্ছেন যে, বৃহ, বৃধ্‌=বর্দ্ধনার্থ, বৃধ, বদ্ধ= Latın Verbum, Latınaএ ‘ধ’ স্থানে ‘ফ’ বা ‘ব’ উচ্চারিত হয়, তা হলে রুধির= Rufees বা Ruber-ইং, Red, যখন ‘ধ’ স্থানে ইংরাজিতে ‘দ’ হয়, তখন ‘বর্দ্ধ’ = Word। অর্থাৎ ‘ব্রহ্মণ’, ‘Verbum’, ‘Word-সবই ঐ ‘বৃহ’ বা ‘বৃধ্‌’ ধাতু হাতে এসেছে ও একই অর্থ প্রকাশ করে।]
সাহেব আরো বলেছেন যে ব্রহ্মণ শব্দ হতে ক্রমশঃ ভারতীয় আর্যের মধ্যে সর্বপ্রথম আসে bursting forth of the world, বিশ্ব স্ফুটিকৃত হয়েছে-এই ভাব, যার পরিণতি। স্ফোট বাদ- বাক্‌ এর স্ফুট্‌। বহু বহু পরে Alexandrian School এর ভেতর অনুরূপ ভাব প্রস্ফুটিত হয়েছে দেখা যায়। মোক্ষামূলার সাহেব বলেন যে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে, উভয় জাতিই স্বাধীন চিন্তার ফলে একই তত্ত্ব আবিষ্কার করেছেন, কেউ কারও কাছে ঋণী নন। ভারতের বেলায় পাশ্চাত্যের স্বাধীন চিন্তাও সংকুচিত হয়ে যায়! একই তত্ত্ব যে বিভিন্ন দেশে দেখা যেতে পারে না, তা নয়; কিন্তু যে দেশে একটি নতুন চিন্তা ওঠে, সেটি ঐ দেশের আবেষ্টনী ও ভাবধারার ফল, অন্যত্র যদি অনুরূপ ভাবধারার সৃষ্টি হয়, তবেই সে দেশে ঐ রকম মৌলিক চিন্তা দেখা দিতে পারে, যদি বিপরীত ভাবধারা হয়, একই রকম তত্ত্ব আবিষ্কৃত হতে পারে না। যিশুর ভাব যিশুর দেশে ছিল না, কিন্তু তাঁর জীবন গঠিত হয় অন্য এক আবেষ্টনীর মধ্যে, যেখানে তাঁর পরবর্তী জীবনের অনুকূল ভাবধারার সৃষ্টি হয়েছিল। মোক্ষামূলার সাহেব নিজেই প্রমাণ করেছেন যে, Socrates অন্ততঃ একজন ভারতীয়ের সঙ্গে ঈশ্বরতত্ত্ব সম্বন্ধে বাদানুবাদ করেছিলেন, যে ভারতের সঙ্গে গ্রীসের সাক্ষাৎ ও পরোক্ষ সম্বন্ধ (পারসীকদের বা জরথুষ্ট্রবাদীদের মধ্য দিয়ে) স্থাপিত হয়েছিল সক্রেটিসের পূর্বে (Theosophical or Psychological Religion. Lecture III-Maxmuller দ্রঃ), আর ঐ ভাবধারার অর্থাৎ ভারতের ভাবধারার সম্পর্কে আসার পরে Alexandrian School এর উদয় গ্রীসে সম্ভব হয়েছিল। এ বিষয়ে পরে আমরা আরো ভাল করে বুঝতে চেষ্টা করব। Socrates এর জীবন গ্রীসে নতুন প্রাণ এনে দেয়; তিনি ছিলেন আত্মজ্ঞ পুরুষ। দুই বিবাহ সত্ত্বেও তাঁর নিষ্কাম ও নিস্পৃহ জীবন আজও সকলের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করে। গ্রীসে ওরকম ভাব আসে কোথা হতে, যে দেশের শিল্প কলাও (Hellenic Art) কামভাবোদ্দীপক ও আচার বিলাস পঙ্কিল? অধুনা বহু মনীষি সক্রেটিসকে বেদান্তী বলে মনে করেন। সক্রেটিস যে ভাবধারা প্রবর্তন করেছিলেন, গ্রীস তা গ্রহণ করতে পারেনি, ধরে রাখতেও পারেনি! ভারতে শক্তিগঠনের মূল ভাব ব্রহ্মচর্য, তা অন্যত্র কোথায়? ভারতের ভাব অন্যত্র গেছে কিন্তু ভাবকে ধরে রাখতে গেলে ভারত যে উপায় অবলম্বন করেন, অন্যত্র কেউ সে দিক্‌ দিয়ে যান নি। প্রত্যেক নতুন ভাব গ্রহণের পূর্বে ভারতে একটি সংস্কার নিতে হত। অর্থাৎ ভাব গ্রহণে অধিকারী হবার জন্য সাধনার দ্বারা সেই ভাবকে একটি সংস্কারে পরিণত করা হত, যাতে জীবন পবিত্র ভাবে গঠিত হয়। এমন কি, ব্যাকরণ আদি পড়ার পূর্বেও, একটি সংস্কারের মধ্যে দিয়ে যেতে হত। ভাষাতত্ত্বের দিক‌ দিয়ে আর্য আর্য বলে চেচাঁলেই হয় না। ভারতের ন্যায় অনেক জাতিও গরুকে পোষ মানিয়ে গৃহপালিত করেছে, কিন্তু ভারতে যজ্ঞাদিতে দুধ ঘি এর। অপর্যাপ্ত ব্যবহার হত, আর্যেরা দুধের গুণ জানতেন। ভারতে দুহিতাই ঘরে ঘরে গো-দোহন করত, কিন্তু ঈজিপ্টে, গ্রীসে বা রোমে কোথাও গো দোহনের রীতিও ছিল না। ভাব গেছে, আচারও ছিল না আর্যের মত।
গোড়া থেকেই ভারত অতীন্দ্রিয় জ্ঞান লাভকে জীবনের আদর্শ করেছেন। পাশ্চত্য মনীষিরা এটা বুঝতে না পেরে ভারতের ইতিহাসে ভাবসঙ্কট উপস্থিত করেছেন। আপ্ত বাক্য সম্যক্‌দর্শন (সাক্ষাৎকার), অমরত্ব এই শব্দগুলিতে কি বুঝায়? মন্ত্র দ্রষ্টার সিদ্ধান্ত বাক্যই আপ্তবাক্য।
[আপ্নোতি, পাওয়া হওয়া ও হয়ে যাওয়াই-Being and Becoming = সৎ ও সম্ভূতি = লাভ“প্রতিরোধ বিদিতং মতমমৃতত্বং হি বিন্দতে।আত্মনা বিন্দতে বীর্য্যং বিদ্যয়া বিন্দতেহমৃতম্।।” কেন।]
প্রতিরোধবিদতই মত বা জ্ঞান। প্রতিরোধ= বোধে বোধ, প্রত্যেক বোধের (প্রত্যয় বা বুদ্ধিবৃত্তির) বোধ। বোধে বোধই মত, এটাই জ্ঞান, এটাই সাক্ষাৎকার বা সম্যক্‌দর্শন, প্রত্যেক বোধ কেন্দ্রীভূত হয়ে প্রকাশিত হওয়াই সম্যক দর্শন (তৎমত)। এটাই সমস্ত বোধের বা প্রত্যয় সমূহের প্রত্যাগাত্মরূপ বা ব্রহ্মের প্রকাশকরূপ। এই যে আত্মা (জ্ঞান), এর দ্বারাই বীর্যলাভ হয়, অন্য কোন শক্তি বা উপায় দ্বারা মৃত্যুকে জয় করা যায় না, যথার্থ বীর্য লাভ হয় না-আত্মজ্ঞান দ্বারাই মৃত্যু অভিভূত হয়; সুতরাং এই আত্মজ্ঞান রূপ বিদ্যাই অমরত্ব আনায়। মত মানে অনুভূতি লব্ধ জ্ঞান। ঋষি বা মন্ত্রদ্রষ্টার অর্থ ও আমরা বুঝতে পারি এইখানে।
[কৈয়ট বলেন, বুদ্ধি প্রতিভাস= “যদা যদা শব্দ উচ্চাবিস্তদা তদর্থকারা বুদ্ধিরূপজায়তে ইতি প্রবাহ নিত্যত্বাদর্থস্য নিত্যনীত্যর্থঃ’ (মহাভাষ্য)। অর্থাৎ শব্দার্থ বুদ্ধির প্রতিভাসক, যখনই শব্দ উচ্চারিত হয়, তখনই অর্থাকারা বুদ্ধি জন্মায়, এই প্রকার নিত্যতা বশতঃ অর্থের নিত্যতা, সুতরাং অর্থ বোধরূপা বাক্য ও নিত্য। এই নিত্য, জগতের দিক্‌ দিয়ে। ইঙ্গিতেও মনের ভাব প্রকাশ করা যায়, কিন্তু উচ্চ চিন্তার জন্য বর্ণাত্মক ভাষার সাহায্য অত্যাবশ্যক।]
ঐ বোধে বোধ আনার জন্যই সাধকের আর্তি। ভক্তির দিক‌ দিয়ে বাঙ্গালী বৈষ্ণব কবি বোধে বোধ টি প্রস্ফুটিত করেছেন তাঁর আর্তিতে, ‘রূপ লাগি আঁখি ঝুরে, গুণে মন ভোর। প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁদে প্রতি অঙ্গ মোর।’
“যস্মিন সর্ব্বাণিভূতান্যাত্মৈবাভূদ্বিজানতঃ।
তত্র কো মোহঃ কঃ শোক একত্বমনুপশ্যতঃ। (‘ঈশ’)।
যার সমস্ত ভূত জগৎ আত্মাই হয়ে যায় (আত্মাএব অভূত) এবং সর্বভূতে আত্মার অনুদর্শন হওয়ায় ‘এক’ জ্ঞান(বিদ্যার) উদয় হয় (জানেন বা বুঝতে পারেন। -বিজানতা), তাঁর মোহই বা কি শোকই বা কি? এই অবস্থাপ্রাপ্ত মহাজনই আপ্ত, তাই আপ্তবাক্যকে অভ্রান্ত বলা হয়। ঐ বিদ্যার নামই ব্রহ্মবিদ্যা। এই ব্রহ্মবিদ্যার ধারা চলে আসছে ও এসেছে বরাবর গুরুপরম্পরায়, তাই বেদ, শ্রুতি নামে আখ্যাত। মনে রাখতে হবে যে বিদ্যা বা জ্ঞানই চলে আসত, মুখস্থ বা কণ্ঠস্থ বিদ্যা নয়। ভারতে বহু নিরক্ষর মহাপুরুষ জন্মেছেন, এটিও এই সঙ্গে মনে রাখতে হবে।
পাশ্চাত্যরা করেছেন এই খানে ভুল। পাশ্চাত্য বলেন যে, তখন লিপি ছিলনা তাই বেদবিদ্যা চলে এসেছে শুনে শুনে বংশ-পরম্পরায়। তাই বেদের নাম শ্রুতি। শুনে শুনে চলে আসতে পারে গান, হাতেনাতে চলে আসতে পারে বাজনা ও সুরতালের সংযোগে কণ্ঠস্থ হতে পারে। অসংখ্য কবিতা, কিন্তু বর্ণাত্মক ভাষা, অতবড় ভাষাত্মক বেদের শব্দরাশি চলে আসে বংশ পরম্পরায় কেমন করে লিপি বিনা? যদি এই মত সত্য হয়, তাহলে মানতে হবে যে, তখন লিখন প্রণালী না থাকলেও শব্দরাশি শেখান হত ঠিক, তবে শেখাবার রীতি ছিল স্বতন্ত্র, তা হলে স্বীকার করতে হয় যে, তখন এই জাতি অত্যদ্ভূত মেধাবী ছিল, তখন না লিখে পড়ে সব হত সংযমী ও ইন্দ্রিয়জয়ী, আর এখন? এখন লেখা পড়ার এত সরঞ্জাম ও সুবিধা সত্ত্বেও পশুত্ব ঘোচেনা, আমরা ঘরের কথাও ভাবতে অক্ষম। তখন দ্বিজাতির বিবাহই হত না বেদ অধ্যয়ন না করলে, ব্রহ্মচর্য ও গুরুগৃহবাস শেষে ঘরে না ফিরলে মূর্খের সমাজে স্থান হত না। কত সহজে তখন বিদ্যা অবশ্য শিক্ষণীয় রীতিতে পরিণত হয়েছিল! পাশ্চাত্য আরো বলেন যে তখন লিপি না থাকলেও ছিল ছন্দ, কিন্তু ছন্দ থাকলে কি হবে? ছন্দের কোন নিয়ম মেনে ঋষিনামধেয় ব্যক্তিরা চলেন নি, কোন নিয়মের বাঁধ তারা মানেন নি- বেদ যে চাষার গান-ঋষি তো কৃষক ছিলেনই। চাষার গানে যদি এই হয়, যার নমুনা অন্যত্র কোথাও নেই, তখনকার উন্নত শ্রেণীর লোকের বা জ্ঞান ছিল কেমন তাহলে?
অতীন্দ্রিয় বোধকে ভাষায় নানা ভাবে প্রকাশ করতে হলে যে সর্বপ্রকার নিয়মের শৃঙ্খলাকে অতিক্রম করতে হয, এটা অসম্ভব কিসে? বাঙ্গালীর কীর্তন কি স্বরলিপিতে সব ফেলা যায় আজও? এই সে দিনকার কথা, বাঙ্গালী জয়দেবের ‘প্রলয় পয়োধিজলে’ কবিতাটি কি ছন্দের কোন নিয়ম মেনেছে, ছন্দ বিধিকে কি অতিক্রম করে যায়নি? কষ্ট কল্পনা করে পণ্ডিতেরা সমস্ত গানটিকে ভেঙ্গে বিভিন্ন ছন্দে এক রকম করে দেখিয়েছেন।
[(পণ্ডিত চন্দ্রমোহন সংকলিত ‘ছন্দঃসার সংগ্রহ’ দ্রঃ)। ‘প্রলয়- পয়োধিজলে’ কবিতাটি সম্পূর্ণ তুলে তিনি বলছেন যে ওটি কি কোন ছন্দে লেখা? তার পরই বলছেন “The sweetness of its cadence and the regularity of its periods would at once indicate its place there …But where is to be placed?)]
অর্থাৎ সুর মাধুর্য ও তালের কালিক নিয়মের নির্দিষ্টতায় নিশ্চয়ই এটার একটা স্থান নির্দেশ করা যায়, কিন্তু কোথায় এর স্থান দেওয়া যায়? তিনি বলছেন যে ঐ রচনাকে সমবৃত্রম, অর্দ্ধসমম, বিষমম্‌ পর্যায়ে ফেলা যায় না। তা হলে এই একটি জাতি? এটা কোন আর্যা ও নয়, বৈতালিয়ম বা তার প্রকারভেদ ও নয়, মাত্রাসমকানির অন্তর্গত করা যায় না। এইরূপে ছন্দ শাস্ত্রের কোন পর্য্যায়ে ফেলা যায় না, কিন্তু কানে বাজে যে ছন্দ? সুতরাং পণ্ডিতজি একটিকে অতিরিক্ত মাত্রা ছন্দ, অপরটিকে অনুষ্টিভতুঙ্গ, কোনটিকে বৃহত্যাং কমলা বা মাত্রাসমক, জগত্যাংতামব্স ইত্যাদি বিভিন্ন অংশে দেখিয়েছেন।
[ছন্দ শাস্ত্রানুসারে লঘুকর বর্গ= Pericles and Treacle, প্রামাণবর্গ=lambus) দুটি সূত্র (পিঙ্গলা বলেন)-গ্নিতি সমনী, ল্লিতি প্রমানী= Trochaic and Iambic measures, সমাবৃত্ত ছন্দ-Blank verse ইত্যাদি।]
এখানে এইমাত্র বললেই হবে যে বৈদিক ছন্দের পরিমাপ, মাত্রার দ্বারা নিয়মিত নয়। বৈদিক ছন্দকেও অপৌরূষেয় বলা হয়। পানিনীয় অষ্টাধ্যায়িতে ঋগ্বেদের ভাষাকে ছান্দম্‌ বলা হয়েছে ও সংস্কৃত বর্ণমালাকে মাহেশ্বরী সূত্র বলা হয়েছে; কারণ, ব্রহ্মা যেমন যোগতত্ত্বের আদি উপদেষ্টা।

শিবই সেরকম প্রথম সরল ধ্বনিকে অর্থযুক্ত সাঙ্কেতিক আকার দেন। বৈদিক ছন্দ কোন বিধি মেনে চলে নি, তার লক্ষ্য যেমন সর্বশৃঙ্খলার পারে, ছন্দের গতি ও সেই রকম অবাধ। যা অপৌরুষেয় নয় তাই লৌকিক ছন্দ (গণছন্দ, মাত্রাছন্দ, অক্ষর ছন্দ-বৃত্তম, জাতি বা মাত্রাছন্দ)। যাই হোক, বৈদিক মন্ত্র গুলিতে লঘুগুরু বর্ণবিন্যাস পদ্ধতি (metre) আছে। পাশ্চাত্য মতে, ঐ রকম ভঙ্গির জন্যই মন্ত্রগুলি শুনে শুনে চলে আসতে পেরেছে। চাষা ঋষি বেচারিদের তা হলে লঘুগুরু হিসাবে রচনার বুদ্ধিটুকু যুগিয়েছিল, আর বংশপরম্পরায় বিদ্যার ধারা রক্ষা করা দরকার, এ বুদ্ধিটিও ঘটে এসেছিল, যদিও ঋষি বা আচার্যকে অত শব্দরাশি লিপি বিনা শিষ্যদের কণ্ঠস্থ করাতে, কি দুর্ভোগই না পেতে হয়েছিল। বেদ অধ্যয়ন করতে হত, যখন লিপি ছিল না তখন অধ্যয়ন মানে শুধু আবৃত্তি। আর বারবার আবৃত্তি করাতে সব কণ্ঠস্থ হত ও এই রকমে বংশপরম্পরায় শুনে শুনে চলে আসত! ঋক্, ১ম, ১৭০ সূক্তের (‘ননূনমস্তি নো শ্বা..’) অনুবাদ দত্ত মহাশয় এরকম করেছেন, “অদ্যতন বা কল্যতন কিছুই নাই। অদ্ভুত কার্যের কথা কে বলতে পারে? অন্য লোকের মন অত্যন্ত চঞ্চল, যা উত্তমরূপে পাঠ করা যায় তাও ভুলে যাওয়া যায়।” পাঠ বা আবৃত্তি করাটা কি বিনা লিপিতে বা বিনা গ্রন্থে হত?

বেদ বলেন যে বেদপাঠ বা আবৃত্তি ও অপর বিদ্যা।
[“নায়মাত্মা প্রবচনেন লভ্যো, ম মেধয়া বহুধা শ্রুতেন” (কঠ ২য়/২৩)। প্রবচনেন = “অনেক বেদ স্বীকরণেন”]
তন্ত্রে ও বহু স্থানে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে বহু শাস্ত্র আদি পাঠে কিছুই হয় না-জ্ঞানই একমাত্র মোক্ষের কারণ। অধ্যয়ন মাত্র আবৃত্তি নয়। ‘অধ্যয়নং চ স্বাধ্যায় সংস্কারঃ” (মহাভাষ্য)। স্বাধ্যায় বলতে বোঝায় বেদ। ‘স্বাধ্যায়ভ্যাসনঞ্চৈব বাঙ্ময়ং তপ উচ্যতে’ (গীত), বেদাভ্যাসই বাঙ্ময় তপস্যা। জ্ঞানি গৃহস্থ সর্বদা বাক্যে প্রাণবায়ু ও প্রাণে বাক্য আহুতি দেন।
[কথা বলবার সময়= “বাচি প্রাণং জুহোমি”, চুপ করে থাকলে= “প্রাণে বাচং জুহোমি”- (মনু ৪/২৩/২৪)]
বেদের সংস্কার কার্যই অধ্যয়ন। বেদজ্ঞান লাভ করবার জন্যই পুরুষার্থ চতুষ্টয়- ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ ও সাধন চাই, অর্থাৎ বেদজ্ঞানরূপ ভিত্তির উপরেই পুরুষার্থ দণ্ডায়মান। বেদের দ্বারা সাধন হয় বলেই, অধ্যয়ন দ্বারাই বেদের সংস্কার্য্য সিদ্ধ হয়। এই অধ্যয়নের সাক্ষাৎ ফল, বেদ-রূপ বর্ণরাশির স্বরূপ জ্ঞান, যাতে বিদ্যার স্ফুর্তি হয়। অনুষ্ঠানাদিতেও (কর্মকাণ্ডে) অর্থ বোধ চাই। চার রকমে বিদ্যার স্ফুর্তি হয়, (১) ‘আগম কালেন’-বেদবিদ্যা গ্রহণ কাল দ্বারা, (২) ‘স্বাধ্যায় কালেন’-অভ্যাস কাল দ্বারা, (৩) ‘প্রবচন কালেন’-অধ্যাপন কাল দ্বারা, (৪) ‘ব্যবহার কালেন’-প্রয়োগ কাল দ্বারা। এই যে প্রথা, এটা কি বংশপরম্পরায় বা গুরুপরম্পরায় চলে আসতে পারে না ? লিপি সম্বন্ধে প্রশ্ন ওঠে কেন ? জড়-বিজ্ঞান শাস্ত্র (Science) বুঝতে গেলে শুধু বই পড়ে হয় না, গুরুর কাছে বিদ্যা নিতে হয়, লেকচার কানে শুনতে হয়, হাতেনাতে অভ্যাস করতে হয়, অপরকে বোঝাবার মত স্পষ্ট ধারণা আনতে হয়, প্রয়োগ বা ব্যবহার জানতে হয়। গুরু বা আচার্য মুখে শুনে বোঝাকে আয়ত্তীকরণকে কি শ্রুতি বলা অসঙ্গত?

বেদে ছন্দ আছে, লঘুগুরু স্বরক্রম আছে, সাম গীত হয়, অতএব তখন সঙ্গীতবিদ্যা ও ছিল। প্রথম গানই সামগান। ব্রহ্মা হতে আসে বেদ তত্ত্ব বাক্‌ স্ফুটিত হয় প্রথম ব্রহ্মার মুখ হতে, শব্দের প্রকাশ হয়। শব্দ চার রকম- দ্রব্য, গুণ, ক্রিয়া, জাতি-যার মূল স্থানের নাম শব্দব্রহ্ম; তাই শব্দব্রহ্মের প্রকাশমুখ চার; ব্রহ্মার চার বদন- পুরাণস্য কবেঃ চতুর্ম্মুখ সমীবিতং…, তাই ব্রহ্মার শক্তি ‘বাক্‌দেবী’, তাই অধ্যয়নই ব্রহ্মযজ্ঞ।

[শতপথ ব্রাহ্মণ বলেন, এই যে ব্রহ্মযজ্ঞ, বাক্যই এই যজ্ঞের জুহূ, মন এর উপভৃৎ(ভরণ করা), চক্ষু এর ধ্রুবা, মেধা এর স্রুব, সত্যই এর অবভৃথ স্নান, স্বর্গলোক এর উদয়ন বা সমাপ্তি। ঋগ্‌ মন্ত্র এই যজ্ঞের ক্ষীরাহুতি, যর্জুমন্ত্র এর সোমাহুতি, অথর্ব্বাঙ্গিরস এর মেদাহুতি, পুরাণ ইতিহাস আদি এর মধুহুতি।’ (যজ্ঞকথা-রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী দ্রঃ)]।
আর্যপ্রভা- বেদ পর্বটি সমাপ্ত।

আর্যপ্রভা এর লেখা সমূহ পড়ে আপনার মন্তব্য জানাবেন-

লেখার সর্বসত্ত্ব ব্লগ সাইট এর।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.