বৈদিক সাহিত্য
উপনিষদ
শ্রীহিরেন্দ্রনাথ দত্ত
প্রথম অধ্যায়
বৈদিক সাহিত্য/চতুর্বেদ
‘বেদাশ্চত্বয়ঃ’ -এ দেশের প্রচলিত ধারণা এই যে ঋক, যজু, সাম ও অথর্ব এই চারবেদ। পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরা এ কথা স্বীকার করেন না। তারা বলেন অথর্ববেদ বেদই নয়। তাঁদের মতে, অথর্ব বেদ অন্য তিন বেদ অপেক্ষা অনেক অর্বাচীন। অতএব বেদ চার নয়, তিন। যুক্তিতে তারা বলেন যে বেদের অপর একটি নাম ত্রয়ী। ত্রয়ী বললে ঋক, যজু ও সাম এই তিন বেদকে বুঝায়। অথর্ব বেদ তার অন্তর্গত নয়। অতএব যখন বেদের ত্রয়ী নাম দেওয়া হয়েছিল, তখনও অথর্ব বেদ বেদের ঐ পদবিতে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এ মত সমীচীন মনে হয় না। কারণ প্রাচীন বৈদিক সাহিত্যের স্থানে স্থানে অন্য তিন বেদের সাথে অথর্ব বেদেরও উল্লেখ করা হয়। ছান্দোগ্য উপনিষদে নারদ নিজ অধীত বিদ্যার পরিচয়ে অথর্ব বেদের উল্লেখ করেছেন।
ঋগ্বেদং ভগবোহধ্যেমি যজুর্বেদং সামবেদমাথর্বণম্।
ছান্দোগ্য ৭/১/২
আমি ঋগ্বেদ অধ্যয়ন করেছি, যজুর্বেদ অধ্যয়ন করেছি, সামবেদ অধ্যয়ন করেছি এবং চতুর্থ অথর্ববেদও অধ্যয়ন করেছি। ছান্দোগ্যের অন্যত্রও অথর্ববেদের প্রসঙ্গ আছে।
অথর্ব্বাঙ্গিরস এব মধুকৃতঃ।-ছান্দোগ্য ৩/৪/১
তে বা এতেহথর্ব্বাঙ্গিরসঃ এতদ্ ইতিহাসপুরাণম।–ছান্দোগ্য ৩/৪/২
এরকম তৈত্তিরীয় এবং বৃহদারণ্যক উপনিষদ্ও অথর্ববেদের উল্লেখ করেছেন।
অথর্ব্বাঙ্গিরস ইতিহাসপুরাণম্।-বৃহ ২/৪/১০, ৪/১/২ ও ৪/৫/১১
অথর্বাঙ্গিরসঃ পুচ্ছং প্রতিষ্ঠা।– তৈত্তিরীয় ২/৩/১
এইভাবে প্রশ্ন ও মুণ্ডক উপনিষদেও অথর্ববেদের প্রসঙ্গ আছে।
ঋষীণাং চরিতং সত্যমথর্ব্বাঙ্গিরসামসি-প্রশ্ন ২৮
ঋগ্বেদো যজুর্ব্বেদঃ সামবেদোহথর্ব্ববেদঃ।-মুণ্ডক ১/১/৫
পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরা ত্রয়ী শব্দের উপর নির্ভর করে যে যুক্তির অবতারণা করেছেন, তা সুসঙ্গত নয়। প্রাচীন মতে যজ্ঞই বেদে মুখ্য প্রতিপাদ্য।
‘আম্নায়স্য ক্রিয়ার্থত্বাৎ’-জৈমিনি সূত্র, ১/২/১
যে তিন বেদের যজ্ঞে প্রয়োগ, যাদের কে অবলম্বন করে যজ্ঞ প্রতিপন্ন তাঁদেরই সংহতি-সংজ্ঞা ত্রয়ী। অথর্ববেদের যজ্ঞে ব্যবহার নেই, সেই জন্য ত্রয়ী মধ্যে তার গণনা করা হয়নি। এজন্য অথর্ববেদের অনস্তিত্ব বা অবেদত্ব প্রমাণিত হয় না।
পুরাণে বেদ-সঙ্কলনের যে বিবরণ লেখা হইয়েছে তা থেকে দেখা যায় যে, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সমকালে মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন প্রচলিত ঋক, যজু, সাম ও অথর্ব-মন্ত্র-সমূহ সংহিতা আকারে সঙ্কলন করেন। বিষ্ণুপুরাণে এ সম্বন্ধে এইরকম লেখা আছে:-
ব্রহ্মণা চোদিতো ব্যাসো বেদান্ ব্যস্তুং প্রচক্ৰমে।
অথ শিষ্যান্ স জগ্রাহ চতুরো বেদপারগান।।- বিষ্ণুপুরাণ, ৩/৪/৭
ব্রহ্মার আদেশক্রমে ব্যাস বেদ-সমূহের সংকলন আরম্ভ করলেন এবং বেদপারগ চারজন শিষ্যকে (ঐ কাজে) নিযুক্ত করলেন।
এই চারজন শিষ্যের নাম- পৈল, বৈশম্পায়ন, জৈমিনি ও সুমন্তু। পৈল ঋগ্বেদের সংকলন বিষয়ে গুরুর সহায়তা করলেন; বৈশম্পায়ন যজুর্বেদের, জৈমিনি সামবেদের এবং সুমন্তু অথর্ববেদের। বেদব্যাসের আগেও ঋক, যজুঃ, সাম সাম ও অথর্ব মন্ত্রসমূহ প্রচলিত ছিল। তাঁর পূর্ববর্তী ঋষিগণ বহু শতাব্দী ধরে ঐ সমস্ত মন্ত্ৰ আর্য সমাজে প্রচারিত করেছিলেন। বেদব্যাস শিষ্যদের সাহায্যে সেই সমস্ত মন্ত্রই একত্র সংকলিত করলেন। তিনি চারবেদের ব্যাস(compiler) মাত্র, রচনাকার নন।
এ সম্বন্ধে বিষ্ণু-পুরাণ এভাবে লিখেছেন-
ততঃ স ঋচমুদ্ধৃত্য ঋগ্বেদং কৃতবান্ মুনিঃ।
যজূংষি চ যজুর্ব্বেদং সামবেদঞ্চ সামভিঃ।।
রাজ্ঞস্ত্বথর্ব্ব বেদেন সর্ব্বকর্ম্মাণি স প্রভুঃ।
কারয়ামাস মৈত্রেয়! ব্রহ্মত্বঞ্চ যথাস্থিতি।। -বিষ্ণূপুরাণ, ৩/৪/১৩-১৪
‘পরে ব্যাস ঋক সমূহের উদ্ধার করে ঋগ্বেদ সংকলন করলেন; যজুঃ সমূহের উদ্ধার করে যজুর্বেদ এবং সামসমূহের উদ্ধার করে সাম সংকলন করলেন এবং তিনি অথর্ববেদ দ্বারা যথাবিধানে ব্রহ্মত্ব-স্থাপন এবং রাজার সমুদয় কর্ম নিষ্পন্ন করলেন।”
এর থেকে জানা গেল যে, বেদ-সংহিতায় সংকলিত মন্ত্র সমূহ আগে থেকেই বিক্ষিপ্ত আকারে বিদ্যমান ছিল। এ কথা সপ্রমাণ করা কঠিন নয়। কারণ, ঋগ্বেদের পুরুষসূক্ত থেকে জানা যায় যে, ‘ঋচঃ যজুংষি সামানি ও ছন্দাংসি’ পূর্ব অবধিই ঋষি-সমাজে প্রচলিত ছিল।
তস্মাদ্ যজ্ঞাৎ সর্ব্বহুত ঋচঃ সামানি জজ্ঞিরে।
ছন্দাংসি-জজ্ঞিরে তস্মাৎ তস্মাদ্ যজুরজায়ত।।
অর্থাৎ সেই মহা পুরুষ-যজ্ঞ থেকেই ঋক, যজুঃ, সাম এবং ছন্দ উৎপন্ন হল।
ঋচঃ সামানি ছন্দাংসি পুরাণং যজুষা সহ।– অথর্ব, ১১/৭
এই ছন্দস্ সমূহ’ই পরে অথর্ববেদ-সংহিতায় সংগৃহীত হয়েছিল। অতএব বেদ-গণনায় অথর্ববেদের গণনা না করা অসঙ্গত।
প্রথম অধ্যায় সমাপ্ত
এই ধারাবাহিক লেখার সর্বশত্ব সনাতন স্বস্তিক সভা ব্লগ সাইট এর।
সংকলনে- #কৃষনকমল।
কোন মন্তব্য নেই