বেদ কি ?
দ্বিতীয় অধ্যায়
বেদ কি ?
বেদ বললে কি বুঝায়? পাশ্চাত্য মতে মন্ত্রই বেদ। অৰ্থাৎ ঋক, যজুঃ, সাম ও অথর্ব এই চার বেদের যে সংহিতা-অংশ (যাতে মন্ত্রসমূহ সংকলিত হয়েছে), মাত্র সেই অংশ’ই বেদ। এ দেশের মত ভিন্ন রকম। এ দেশের প্রাচীন মৎ এই যে প্রত্যেক বেদের দুই ভাগ- কর্ম-কাণ্ড ও জ্ঞান-কাণ্ড। কর্ম কাণ্ড বেদের লক্ষ্য, জীবকে অভ্যুদয়ের ভাগী করা; এবং জ্ঞান-কাণ্ড বেদের উদ্দেশ্য জীবকে নিশ্রেয়সের অধিকারী করা। কর্ম-কাণ্ডের ফল স্বর্গ, জ্ঞান-কাণ্ডের ফল অপবর্গ। বেদের যে অংশ কর্ম-কাণ্ডের প্রতিপাদন করছে তার নাম সংহিতা ও ব্রাহ্মণ; এবং যে অংশ জ্ঞান-কাণ্ডের প্রতিপাদন করছে, তার নাম আরণ্যক ও উপনিষদ। অতএব এ মতে বেদের চার বিভাগ। সংহিতা ও ব্রাহ্মণ নিয়ে কর্ম-কাণ্ড এবং আরণ্যক ও উপনিষদ নিয়ে জ্ঞান-কাণ্ড। সুতরাং এ দেশের প্রাচীন ধারণা এই যে বৈদিক যুগের সূত্রপাত থেকেই ভারতীয় ঋষি-সমাজে কর্ম-কাণ্ডের সঙ্গে জ্ঞান-কাণ্ড, মন্ত্র ও ব্রাহ্মণের সাথে আরণ্যক ও উপনিষদ প্রচলিত ছিল।
পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরা এ মত ভ্রান্ত বলে প্রচার করেছেন। তাঁরা বিবেচনা করেন যে, বৈদিক যুগের ঊষাকালে কেবলমাত্ৰ বেদ মন্ত্রই প্রচলিত ছিল। পরে পৌরোহিত্য-প্রধান কৃত্রিমতার যুগে প্ৰথমে ব্রাহ্মণ, তারপর আরণ্যক এবং সর্বশেষে উপনিষদ সমূহ রচিত হয়েছিল।
বিস্তুতঃ পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরা বৈদিক সাহিত্যকে চারটি বিভিন্ন যুগে বিভক্ত করেছেন। ছন্দ-যুগ, মন্ত্র-যুগ, ব্রাহ্মণ-যুগ, সূত্ৰ-যুগ। তাঁরা বলেন যে, ছন্দ-যুগে মন্ত্র সমূহ রচিত হয়েছিল; মন্ত্রযুগ তাঁদের সংকলন-কাল। ব্রাহ্মণ-যুগের প্রথমাংশে ব্রাহ্মণ-সমূহ ও শেষাংশে আরণ্যক ও উপনিষৎ সমূহ বিরচিত হয়েছিল। সূত্র-যুগে কল্প, গৃহ্য, শ্রৌত প্রভৃতি সূত্র সকল রচিত হয়। এটাই বৈদিক যুগের অপরাহ্ণ। এ মত একেবারে অমূলক নয়। কিন্তু এতে সত্যাংশ অপেক্ষা ভ্রমাংশই অধিক। পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরা যে সিদ্ধান্ত করেছেন যে, গদ্য উপনিষদের পূর্বকালে বেদের সংহিতা ও ব্রাহ্মণ ভিন্ন আর কিছুই ছিল না, এটা নিতান্ত অসঙ্গত। কারণ, যে সকল উপনিষদকে তাঁরা প্রাচীনতম বলে স্বীকার করেন, তা থেকেই যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় যে তার-পূর্ববর্তী কালেও বৈদিক সাহিত্য বহু বিস্তৃত ছিল। ছান্দোগ্য উপনিষদের ৭ম অধ্যায়ের প্রথম খণ্ডে এমন বিবরণ দেখা যায় । কোন সময়ে নারদ ভগবান সনৎকুমারের নিকট উপস্থিত হয়ে তাঁর নিকটে বিদ্যা জানতে চান; তাতে সনৎকুমার নারদকে প্রশ্ন করলেন যে, তুমি কি কি বিদ্যা অধ্যয়ন করেছ, তার পরিচয় বল; তারপরে যা শিক্ষণীয় তা শিক্ষা দিব। তার উত্তরে নারদ বললেন-
ঋগ্বেদং ভগবোহধ্যেমি যজুর্ব্বেদং সামবেদমাথর্ব্বণং চতুর্থমিতিহাসপুরাণং পঞ্চমং বেদানাং বেদ্যং পিত্র্যং রাশিং দৈব্যং নিধিং বাকোবাক্যমেকায়নং দেববিদ্যাং ব্রহ্মবিদ্যাং ভূতবিদ্যাং ক্ষেত্রবিদ্যাং নক্ষত্রবিদ্যাং সর্পদেবজনবিদ্যামেতদভগবোহধ্যামি। -ছান্দোগ্য ৭/১/২
"There are in the Vedic age four distinct periods which can be established with sufficient evidence, They nay be called the Chhandas period, Mantra Brahmana period and Sutra period.- Max Muller’s History of Ancient Sauskrit Literature-Page 70.
“আমি ঋগ্বেদ অধ্যয়ন করেছি, যজুর্বেদ ও সামবেদ অধ্যয়ন করেছি; চতুর্থ অথর্ববেদ, তাও অধ্যয়ন করেছি। পঞ্চমবেদ ইতিহাস-পূরাণও অধ্যয়ন করেছি; পিত্র্য (পিতৃবিদ্যা), রাশি (গণিত), দৈব (Science of portents) নিধি (জ্যোতিষ), বাকোবাক্য (তর্কশাস্ত্র), একায়ন(নীতিশাস্ত্র), দেব-বিদ্যা, ব্রহ্ম-বিদ্যা, ভূত-বিদ্যা, ক্ষত্র-বিদ্যা (ধনুর্বেদ), নক্ষত্র-বিদ্যা, সর্প-বিদ্যা, দেবজন-বিদ্যা (নৃত্য-গীত-বাদ্য শিল্পাদি বিজ্ঞানানি-শঙ্কর)-এ সমস্তই অধ্যয়ন করেছি।” এই তালিকা থেকে বৈদিক যুগে বিদ্যার পরিমাণ, প্রকার ও ভেদ কতক অংশে বুঝা যায়।
বৃহদারণ্যকের ২য় অধ্যায়ের ৪র্থ ব্ৰাহ্মণে এমন উল্লেখ হয়েছে-
অস্য মহতো ভূতস্য নিঃশ্বাসিতমেতদ যদ্ঋগ্বেদো যজুর্ব্বেদঃ সামবেদোহথর্ব্বাঙ্গি৷ ইতিহাসঃ পূরাণং বিদ্যা উপনিষদঃ শ্লোকাঃ সূত্রাণ্যনুব্যাখ্যানানি ব্যাখ্যানান্যস্যৈবৈতানি সর্ব্বাণি নিঃশ্বসিতানি। -বৃহদারণ্যক, ২/৪/১০
অর্থাৎ ঋগ্বেদাদি সেই পরমাত্মারই নিশ্বাস। সম্বন্ধ বিদ্যার তা হতেই প্রবৃত্তি; তিনিই তাদের আধার ও আশ্রয়। বৃহদারণ্যকের প্রদত্ত তালিকা হতে নিম্নলিখিত বিদ্যা-সমূহের নাম পাওয়া গেল। যথা- ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ, ইতিহাস, পূরাণ, বিদ্যা(বিদ্যা=দেবজন বিদ্যা (Fine arts)-শঙ্কর ভাষ্য), উপনিষদ, শ্লোক, সূত্র, অনুব্যাখ্যান ও ব্যাখ্যান। এই তালিকা হতে দেখা যায় যে, বৃহদারণ্যক রচনারও পূর্বকালে ইতিহাস এবং পুরাণ, শ্লোক এবং সূত্ৰ বর্তমান ছিল। এমন অনুমান করা অসঙ্গত নয় যে, এই সকল প্রাচীন সূত্রই সংকলিত ও পরিবর্ধিত হয়ে, পরে পাণিনির ব্যাকরণ সূত্রে, বৌধায়ন আশ্বলায়ন গৃহ্য সূত্রে এবং ন্যায়বৈশেষিক প্রভৃতি দর্শন সূত্রে পরিণত হয়েছিল। শ্লোক সাহিত্যের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ করার অবসর নেই; কারণ ছান্দোগ্য, বৃহদারণ্যক, তৈত্তিরীয় প্রভৃতি উপনিষদে প্রমাণ স্বরূপ শ্লোক উদ্ধৃত দেখা যায়।* এই সকল উপনিষদেরও পূর্ববর্তী তৈত্তিরীয় আরণ্যকের প্রথম প্রপাঠকের তৃতীয় অনুবাকে এই মন্ত্রটি দেখা যায়।
স্মৃতিঃ প্রত্যক্ষম্ ঐতিহম অনুমানশ্চতুষ্টরম।
এতৈরাদিতা মণ্ডলং সর্ব্বৈরেব বিধাস্যতে-১/২
মাধ্বাচার্য্য ঐতিহ্য অর্থে ইতিহাস পুরাণ গ্ৰন্থ বুঝিয়েছেন। তা অসঙ্গত নয়। পরন্তু এই বচনে আমরা ‘স্মৃতি'র ও উল্লেখ পেলাম। অতএব বৈদিক যুগে যে স্মৃতিগ্রন্থের ও প্রচার ছিল, এটা মনে করা অসঙ্গত নয়। এই সকল উপনিষদ ও আরণ্যকের অপেক্ষাও প্রাচীনতর শতপথ ব্রাহ্মণের একাদশ ও চতুর্দশ কাণ্ডে চারবেদ, ইতিহাস, পুরাণ, নারশংস এবং গাথার উল্লেখ আছে এবং তাঁদের স্বাধ্যায় (subjects of study) করার কথা আছে। ঐ ব্রাহ্মণেরই ১২শ কাণ্ডে অ্যাথ্যান, অন্বাখ্যান ও উপাখ্যানের প্রসঙ্গ কাছে এবং ১৩শ কাণ্ডে অনেকগুলি গাথা উদ্ধৃত হয়েছে; ঐ সকল গাথার অনেক স্থানে সুপ্রাচীন বৈদিক আকার রক্ষা করা হয়েছে। এর কারণ এই যে, তখনও বৌদ্ধযুগ অনেক দূরবর্তী। এইরকম তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে অথর্বাঙ্গিরস, ব্রাহ্মণ, ইতিহাস, পুরাণ, কল্প,
*এই প্রসঙ্গে ছান্দোগ্য ৫/২/৯, ৫/১০/৮, ২/২১/৩, ৭/২৬/২ বৃহদারণ্যক ১/৫/১, ২/২/৩, ৪/৩/১১, ৪/৪/৭-২১ ও তৈত্তীরীয় ২/৮ দ্রষ্টব্য।
This verses repeatedly Contain very old vedic forms, The words Arhat, sharamans, Mahabrahmana And pratibuddha ocour but not in the Buddhistic sense. -Weber. এর কারণ এই যে, তখনও বৌদ্ধযুগ অনেক দূরবর্তী।
অভিযজ্ঞ গাথা উদ্ধৃত দেখা যায়। এর থেকে বৈদিক যুগের সাহিত্যের বিস্তৃতি ও বিভাগের কতক আভাস পাওয়া যায়; এবং বৈদিক যুগে যে বেদ ও ব্রাহ্মণ ব্যতীত, উপনিষদ, পুরাণ, ইতিহাস, স্মৃতি, বেদাঙ্গ প্রভৃতি নানা আধ্যাত্মিক ও লৌকিক বিদ্যার প্রচলন ছিল, তার পরিচয় পাওয়া যায়।
দ্বিতীয় অধ্যায় সমাপ্ত।

ভাই আপনাদের কাছে কি সাম বেদ আছে নাকি?
উত্তরমুছুন