আর্যপ্রভা-সৃষ্টিতত্ত্ব-বেদ
সৃষ্টিতত্ত্ব-বেদ
মানুষের নানা ভাব। মত, নানা ভাবের মধ্য দিয়ে প্রত্যেকটি ভাবকে উপলব্ধি করাতে হয় সম্প্রদায় সৃষ্টি, নানা গুরুর বিশেষ বিশেষ ভাব-ধারা। সাম্প্রদায়িক মতামত বা বিরোধের আভাষ মাত্র বৈদিক ভারতে দেখা দিলে ও অন্যান্য সব যায়গার মত দল-দেবতা (tribal god) নিয়ে সংগ্রাম দেখা দেয় নি। পাশ্চাত্য মতে ঐরকম সংঘর্ষের প্রমাণ বেদে না থাকলেও নিশ্চয়ই তা প্রাগৈতিহাসিক যুগে ছিল। তারা বলতে চান যে সমস্ত সভ্যতা একই ভাবে একই নিয়ম অনুসারে বিবাদ বিসম্বাদের মধ্য দিয়ে ঠেঙ্গাঠেঙ্গি করে সব যায়গায় বিকশিত হয়েছে, সুতরাং ভয় হতেই এসেছে ধর্ম! সর্বত্রই কেন যে একই নিয়মে সভ্যতার উৎপত্তি ও গঠন হবে, তার কারণ পাশ্চাত্য নির্দেশ করেন না। বিকাশে ক্রম থাকবে এটা বোঝা যায়, কিন্তু সেই ক্রমটা যে সকল স্থানেই এক ঘেয়ে ভাবে দেখা দেবে, তার মধ্যে কোন বিচিত্রতা থাকবে না, এটা কোন প্রাকৃতিক বিধি অনুসারে যখন বৈচিত্রই প্রকৃতির লক্ষণ, যখন বহি: প্রকৃতির অগণন বিচিত্রতার সঙ্গে অন্তঃ প্রকৃতির অন্তহীন রূপ সম্ভার বিরাজিত ?
পাশ্চাত্য মতে,
নীহারিকারূপে দৃষ্ট ব্যোমপথে ঘূর্ণ্যমান তাপ ঘনীভূত হলে সূর্যাদির উৎপত্তি
হয়, তাপ ক্রমশঃ ঠাণ্ডা হলে, ঐ বৃহৎ জড় পিণ্ডের
মধ্যে জল স্থল দেখা দেয়, ধীরে ধীরে সেখানে বৃক্ষ লতা আদির জন্ম
হয়, জলস্থল ক্রমশ অসংখ্য জীবে পূর্ণ হয়। এখানে আমাদের মনে রাখতে হবে যে,
ঐ অসংখ্য জীবের প্রত্যেকটির অভাব বোধ বিভিন্ন, প্রত্যেকটির জীবন সংগ্রামের ধারা বিভিন্ন, প্রত্যেকটির
অভিব্যক্তি প্রণালী বিভিন্ন। এই বিভিন্নতার মধ্যে শক্তির ও বুদ্ধি
বিকাশের তারতম্য দেখা যায়। পাশ্চাত্য দেখাচ্ছেন যে, জড় ও জড়ের প্রকাশ সৃষ্টিতে প্রথম, চৈতন্যের আগমন পরে, আর মানবে ঐ চিৎসত্ত্বার বা চৈতন্যের
সর্বশ্রেষ্ঠ বিকাশ। তাহলে মানবের মধ্যে যে বুদ্ধি বিকাশের
তারতম্য থাকবে ও কোন স্থানে যে তার বিশেষ বিকাশে মৌলিকতা থাকবে বা থাকতে পারে তা অসম্ভব
হয় কিসে? চেতনার বিকাশ পরে,
প্রথম ছিল না- এই
সেকেলে পাশ্চাত্য মতবাদ ডাঃ জগদীশ্চন্দ্র খণ্ড বিখণ্ড করেছেন, চেতন বীজ সর্বস্থানে দেখিয়েছেন। বর্তমান পাশ্চাত্য মনীষিরা বলছেন যে সবই শক্তি-তরঙ্গ, (Quanta of energy) এবং জড় তার লক্ষণ মাত্র (Symptom)। অবশ্য
পাশ্চাত্যের শক্তি চেতন সত্ত্বা নয়। কোন বস্তু বুঝতে হলে দুটি প্রণালী অবলম্বিত
হয়- অনুলোম (Analytical)
ও বিলোম (Synthetical), ভারত ছাড়া সর্বত্রই বিজ্ঞান
সম্মত সৃষ্টিতত্ত্ব বোঝার জন্য প্রথম প্রণালী (Analytical) অবলম্বিত
হয়েছে। একমাত্র ভারত বিলোম প্রণালী গ্রহণ করেছেন অর্থাৎ এক হতে বহুর প্রকাশ
দেখিয়েছেন। এটি আর্য ভারতের বৈশিষ্ট্য এক্ষেত্রেও। সেই জন্য
এখানে সৃষ্টি তত্ত্বের সঙ্গে অধ্যাত্ম ভাব পূর্ণমাত্রায় জড়িত। ইহুদি
ধর্মে, হুকুমবাদ-ঈশ্বরের আদেশেই সৃষ্টি।
ঋগ্বেদে অগ্নি,
ইন্দ্র, বরুণ, মিত্র আদি
বহু দেবতার উপাসনা দেখতে পাওয়া যায়, কিন্তু ঐ সমস্ত দেবতাকে একেরই
বিকাশ বলা হয়েছে- ‘একং সৎ বিপ্রাঃ বহুধা বদন্তি।’
যে সাধক যে দেবতার উপাসক, তার কাছে সেই দেবতাই
সৎ স্বরূপ। ইষ্টবাদের বীজ এখানেই। প্রত্যেক দেবতাই সেই নিত্য সত্তার প্রতীক, এই নিত্য সত্তাকে নাম দেওয়া হয়েছে আদিত্য। আর্য ভয়, পাপ ও পাপের জন্য ক্ষমা এসব ভাবকে প্রশ্রয় দেন নি। মাত্র একটি যায়গায় বরুণের কথায় এই ভাবের বীজ মাত্র, ক্ষীণ বীজ
দেখা যায়, কিন্তু যখন সবই একেরই
প্রকাশ, তখন ঐ সব ভাব দাঁড়ায় কোথায় ?
(And in the case of Varuna there is another idea, just the germ of one
idea, which came but was immediately suppressed by the Aryan mind and that was
the idea of fear. In another place we read they’re afraid and they have sinned
and ask Varuna for pardon. These ideas were never allowed... to grow on Indian
Soil, but the germs were there, the idea of fear and the idea of sin"
(Vedanta and Sankhya-Swamiji)
তাই বেদ বলেন ‘অভয়ং অমৃতম্’। আর্য সভ্যতার সমগ্র ইতিহাস অন্তর্মুখী মনের পরিচয়। ভারতে আগে তত্ত্ব উপলব্ধি-সত্ত্বাধার স্পর্শ, তার পর পুরাণ আদি
(Mythology)। ভারতে, ভাবকে স্থায়ী আকার দেবার জন্য তিনটি উপায় অবলম্বিত হয়েছে, (১) মনমুখ এক করে ক্ষুরধার বিচারপ্রণালী-মনস্তত্ত্বের গঠন (Philosophy and Psychology) ও তাকে
স্বায়ত্তীভূত করবার জন্য জীবন যাপন-অর্থাৎ (Realization)-দর্শন বা লাভ; (২) ঐ সব চিন্তার
উদ্দীপক ঘটনাবলী-সত্যদর্শীর চরিত্র বর্ণনাদি-পুরাণাদি (Mythology), (৩) যাতে
ঐ সব চিন্তা ও উচ্চ ভাব নিজ জীবনে প্রতিফলিত হয়, তার সাধন ও আচার
প্রকাশ-ক্রিয়া অনুষ্ঠানাদি (Ritual)। ঐ তিন উপায় ভারতেতর দেশে ও আছে,
কিন্তু সে সব স্থানে ক্রম বিভিন্ন। সেখানে
আগে Mythology-ভয় হতে উৎপত্তি,
দলদেবতা হতে উৎপত্তি প্রভৃতি, Mythologyর পর আসে
Ritual-Mythologyর অর্থ নতুন হয়, সর্বশেষে দেখা দেয় মনস্তত্ত্বের বিচার
বা Philosophy, তখন আবার পূর্বের অনেক ভাব বর্জিত হয়। বহির্মুখী ও অন্তর্মুখী ভাব হিসাবে যেমন সভ্যতার দুটি পৃথক রূপ
আছে, ঐ তিনটির প্রয়োগে তেমনি
সংস্কার ও সভ্যতা হিসাবে পার্থক্য বিদ্যমান।
ঋগ্বেদে সৃষ্টিতত্ত্বের কথায় মাঝে মাঝে কতকগুলি গভীর প্রশ্ন করা
হয়েছে (১০ম মণ্ডল দ্রঃ)
দেখে পাশ্চাত্য বলেন যে, সৃষ্টিরহস্য বোঝার প্রথম
চেষ্টা আর্য সভ্যতায় সেই সময় আসে। তারা দেখেন না যে, প্রশ্নের পরে উত্তরও দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন দেখলেই যে মনে করতে হবে, ওটি সন্দিগ্ধ
মনের উন্মেষ চেষ্টা, ইহা বা কেন বলা হয়, উত্তর আছে কিনা না দেখে ?
বোঝার ভুল পাশ্চাত্যের হয়। এইজন্য
যে, পাশ্চাত্যের যা কিছু
সবই Investigation-বস্তু বিশ্লেষণ ও তার দ্বারা বস্তুর সত্তানুসন্ধান,
আর্যের এর বিপরীত, তপস্যা ও ধ্যান এবং তার দ্ধারাই বস্তুর স্বরূপ অনুসন্ধান,
তত্ত্বানুসন্ধান Meditation and Realisation, সুতরাং
আনর্থ্যের প্রশ্ন করার ধরণও অন্যরকম। তাতে তাঁর অন্তঃকরণের একটা প্রবল উৎকন্ঠাই
প্রকাশ পায়, হতাশের সন্দেহ নয়। এই রকম, কেণোপনিষদে প্রথমেই প্রশ্ন আছে, উত্তর আছে পরে। ঋগ্বেদ, দর্শনশাস্ত্র নয়, এটাও যেন
আমরা না ভুলি। (ঋগ্বেদ ১ম/১৬৪) কয়েকটি প্রশ্ন
আছে, (১) পৃথিবীর পরম অন্ত কোথায়?
(২) বিশ্বের নাভি কোথায়? (৩) অভীষ্ট ফল প্রদানকারী অশ্বের (বৃষ্ণ অশ্বস্য) রেত বিষয়ে জিজ্ঞাসা করি, (৪) পরম ব্যোম স্বরূপ বাক্ কি?
উত্তরে বলা হয়েছে যে (১) এই বেদই পরম অন্ত, (২) এই যজ্ঞই ভুবনের নাভি, (৩) ‘বৃষ্ণো
অশ্বস্য রেত’, (৪) ব্রহ্মা এটাই বাক্যের পরম ব্যোম।
[ঋগ্বেদে
অশ্ব= (১) বায়ু বা বায়ুর অশ্ব, (২) বাহন, পূষন দেবতা; (৩) পর্জন্য। নাভি = উৎপত্তিস্থান,
রেতঃ = মূল উপাদান (সায়ন)। চিদাকাশই পরম ব্যোম।]
‘মূর্দ্ধা দিবো নাভিরগ্নিঃ পৃথিব্যা’ (ঋক্
১/৫৯/২)।
[মূর্দ্ধা= ‘শিরোবৎ প্রধানভূতো ভবতি’। (সায়ন)]অর্থাৎ ব্যোমস্থ(আকাশস্থ, বায়ু মণ্ডলস্থ) জ্যোতির বা দীপ্তির (দিবো) উৎপত্তি স্থল অগ্নি।
ইহা কি নভোব্যাপ্ত
নীহারিকাদির কথা নয়, যা হতে পৃথ্বী আদির জন্ম হয় ? ঐ ৩য় মণ্ডলে আছে যে গূঢ় তমসা ভিদ্য হয়ে মহা-জ্যোতির (ব্রহ্মের) প্রকাশ হল।
প্রসিদ্ধ নাসদসীয় সুক্ত ও পরের সূক্তটিতে সৃষ্টিতত্ত্বের কথা বলা হয়েছে।
["নাসদাসীন্নোসদাসীওদানী নাসীন্দ্রজো ন ব্যোম পরো যৎ.....”।] (ঋক্
১০ম ১২৯), তার পরই-কামান্তদগ্রে।" (ঐ
৪র্থ ঋক্)।
সমগ্র হিন্দু শাস্ত্রমতে সৃষ্টি অনাদি, সুতরাং কর্মও
অনাদি। নাসদসীয় সূক্তে সৃষ্টির পূর্ব অবস্থা বর্ণিত হয়েছে, তখন
সৎ বা অসৎ, পৃথ্বী বা ব্যোম, দিক বা দেশ
(আবরণ) কিছুই ছিল না, তা হলে সেটি কেমন ছিল, কোথায় ছিল? সেই গহন গভীর কি সলিল-ব্যাপ্ত ছিল?
(ন মৃত্যুবাসীৎ...কামস্তদগ্রে), তখন মৃত্যু ছিল
না, অমরত্ব ছিল না, রাত্রি বা দিবা বা তাদের
ভেদ ছিল না, ছিল মাত্র তাঁর শ্বাস-বায়ু-সেই পরমাত্মা,
ছিল তখন অন্ধকারে আবৃত গুঢ় অন্ধকার, ব্যাপ্ত সলিল,
তুচ্ছের দ্বারা আবরিত। তুচ্ছ মানে অবিদ্যমানতা-সৎ বা অসৎ কিছুই নয়-অনির্বচনীয়
মহা তমঃ। এটাই কি মহাকুণ্ডলি? যাই হোক একটি জিনিষ বোঝার আছে।
কারণ ভিন্ন কার্য হয় না, কার্য কারণে থাকে। যা হেথা আছে তা সেথা
আছে। সুতরাং অহং ও ত্বংরূপ যে দুই ভাব দেখি আমরা তা সর্বকারণ কারণেও আছে-সর্বকারণ কারণে।
এই দুইটি একীভূত, কার্য কারণে লীন-একাত্ম-নিষ্ক্রিয়। অহং ত্বং
বা অহং, ইদং মহত-সমাবৃত। তপস্যার শক্তিতে, যে শক্তি তার নিজস্ব (স্বশক্তি), সেই সর্বগ্রাসী পরমাত্মা
স্ব-মহিমা প্রকট করলেন। অগ্রে তখন মনের উপাদান(বীজ) কাম ছিল। কবিগণ (সাধ্যগণ) প্রজ্ঞা-বলে
হৃদয়ে অনুধ্যান করে সৃষ্টিরহস্য বুঝলেন যে, অসৎ’ই সতের
আবরণ বা বন্ধন ইত্যাদি। এই ধরণের প্রশ্নোত্তরে ও ঋষিরা সন্তুষ্ট হননি। অতি সাহসিকতার
সাথে তাঁরা অগ্রসর হয়েছেন, প্রশ্ন শেষ
না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা কোথাও থামেন নি। সেই অগ্র-জাত হিরণ্যগর্ভ ভূত সমূহের পতি,
তিনি আত্মদা, বলদা-জীবন ও মৃত্যু তাঁর ছায়া (ঋক্
ঐ-১২১)। বিভিন্ন রুচি ও প্রকৃতি বিশিষ্ট সাধক-চিত্তের যত রকম স্তব হতে পারে সমস্তই
দেখতে পাওয়া যায় ঋগ্বেদে; কিন্তু ঐ সব প্রশ্ন এসেছে প্রকৃতি হতে-বহির্জগৎ
হতে। অন্তর্জগতের স্বরূপ অনুসন্ধানে রত হয়ে ঋষিরা ঐ সবের উত্তর খুঁজেছেন অতীন্দ্রিয়
রাজ্যে। সেই ব্যোমস্থ পুরুষ সৃষ্টি আদৌ করেছেন কি না করেছেন, তা তিনি জানতেও পারেন, নাও জানতে পারেন (ঐ ১২৯/৭)। এই
রকম অমীমাংসিত প্রশ্ন সব আসে যতক্ষণ দৃশ্য জগৎকে সৎ বা নিত্য বলে বোধ থাকে,
সুতরাং অতীন্দ্রিয় রাজ্যের অনুভূতি চাই-Being and Becoming, সৎ ও সম্ভূতি চাই। এই তত্ত্ব উপনিষদে ক্রমশঃ পরিস্ফুট হয়েছে।
পরবর্তি পর্ব দেখুন--------------------------
কোন মন্তব্য নেই