sanatansangbed

Introduction of SANATAN dharma scriptures

কুরুক্ষেত্র, গীতা ও মহাভারত

প্রথম পরিচ্ছেদ।
প্রথম অধ্যায়।

নারায়ণং নমস্কৃত্য নরঞ্চৈব নরোত্তম।
দেবীং সরস্বতী চৈব ততো জয়মুদীরয়েৎ॥ 
আজও সমন্তপঞ্চক মহাতীর্থে বহু লোক নিত্য স্নান করে। কুরুক্ষেত্রে সমন্তপঞ্চক তীর্থ। উত্তরে সরস্বতী ও দক্ষিণে দৃষদ্বতী; কুরুক্ষেত্র এই উভয় নদীর মধ্যবর্তী। থানেশ্বর হয়ে কুরুক্ষেত্রে যেতে হয়।
ত্রেতা ও দ্বাপর যুগের সন্ধিতে জামদগ্ন্য পরশুরাম পিতৃ হত্যার কথা শুনে পৃথিবীকে একুশ বার নিঃক্ষত্রিয় করেন এবং ক্ষত্রিয় রক্তে রক্তময় পাঁচটি হ্রদ প্রস্তুত করেন। সেই রক্তময় পাঁচ হ্রদের নিকটে যে সকল প্রদেশ আছে তারই নাম পরম পবিত্র সমন্তপঞ্চক তীর্থ। কলি ও দ্বাপরের সন্ধি কালে এই সমন্তপঞ্চক তীর্থে কুরু ও পাণ্ডবদের ঘোরতর যুদ্ধ হয়।
যার নাম হতে কৌরব বংশের উৎপত্তি তারই নাম অনুসারে সমন্তপঞ্চকের নাম কুরুক্ষেত্র। রাজা কুরু আপন রাজধানী প্রয়াগ পরিত্যাগ করে এই স্থান কর্ষণ করেছিলেন বলে এর নাম কুরুক্ষেত্র। কালক্রমে কুরুক্ষেত্র পুন্যক্ষেত্র হয়ে উঠে। এখনও কুরুক্ষেত্রে ভারত সমরের স্মারক অনেক চিহ্ন দেখা যায়।
দৈর্ঘ্য প্রস্থে দশ যোজন(১০ মাইল) ব্যাপী সৈন্য সজ্জিত হয়েছে। বিস্তীর্ণ কুরুক্ষেত্রে স্থান নেই। আঠার অক্ষৌহিণী সৈন্য যুদ্ধের জন্য এখানে সমবেত। প্রতি বীর হৃদয়ে অগ্নি জ্বলছে-কিন্তু সে অগ্নি উৎপত্তি স্থান ভিন্ন কিছুই দগ্ধ করছে না। অচিরে এক অগ্নিকাণ্ড ঘটবে। যে অগ্নি ব্যাপার আঠারো দিন ব্যাপী সংঘটিত হয়েছিল, যে অগ্নিকাণ্ডে কুরু-কুল ভস্মীভূত হয়েছিল, যে মহাসমর শেষে একপক্ষে তিনটি ও অন্য পক্ষে সাতটি ভিন্ন সমস্ত অক্ষৌহিণী সেনা বিনষ্ট হয়েছিল, যে অগ্নিকাণ্ড আবহমান কাল থেকে জগতকে দগ্ধ করছে- সেই অগ্নিকাণ্ডের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে গীতা উপদিষ্ট হয়েছিল।
যে দিক দিয়েই দেখ- ব্যষ্টি বা সমষ্টি, যে ভাবেই বল, ধর্ম অধর্মের যুদ্ধ নিয়ে এই মায়িক সংসার আড়ম্বর। এই ধর্ম ও অধর্মের, জ্ঞান ও অজ্ঞানের মায়িক ঝগড়াঝাঁটি মিটালেই প্রকৃতি ক্ষোভ শূন্য। তখন সে অনন্ত সমুদ্রের বুকে এই পরিদৃশ্যমান জল বুদ বুদ ভেসেছিল আবার তাতেই ইহা বিলীন হল। এটাই প্রকৃতির সাম্য অবস্থা, এখন সৃষ্টি নেই। এটাই মহাপ্রলয়। যে মায়ার সাহায্যে ‘এক’ ‘বহু’ হয়েছিলেন, মায়া অন্তে এক একই রয়েছেন। ভেদাভেদ সমস্তই মায়ার জন্য। যুদ্ধও ভেদ এর জন্য। প্রকৃতি হতে এই ধর্ম অধর্মের যুদ্ধ দুর হলেই প্ৰকৃতির বিরাম ও লয়। জীবও নিজ হৃদয়ে যে মুহূর্তে এই বিবাদ মিটাল, যে মুহূর্তে ধর্মের দ্বারা অধর্ম পরাজিত হল, জ্ঞান প্রকাশে অজ্ঞান দূর হল, জীব সেই মুহূর্ত থেকে ভগবত সাগরে সমাধিমগ্ন হল। কিন্তু যতদিন অধর্মের জয় ততদিন প্রকৃতির দারুণ বৈষম্য -ততদিন সৃষ্টি বিস্তার। অধর্মের জয়ে সৃষ্টি-বিস্তার সকলেই প্রত্যক্ষ করছেন, অধর্ম জয়ের ব্যাপার এখানে উল্লেখ করা অনাবশ্যক।
ধর্ম অধর্মের যুদ্ধ, সত্য ত্রেতা দ্বাপর ও কলি এই চার যুগ ধরে চলে আসছে। সত্যযুগে দেব অসুরের যুদ্ধ, ত্রেতায় রাম রাবণের যুদ্ধ, দ্বাপরে কুরু-পাণ্ডবে যুদ্ধ এবং কলিযুগে প্রতি জীব হৃদয়ে ধর্মের সঙ্গে অধর্মের ঘোরতর বিবাদ। যে অধর্ম-প্রবাহ আবহমান কাল থেকে চলে আসছে, সকল জাতির ধর্মশাস্ত্র ও ইতিহাসে এর এক একটা নাম আছে আর্য জাতি এই অধর্ম কে পাপ, অজ্ঞান, অবিদ্যা, মায়া, প্রকৃতি, শক্তি, জড়, তমঃ ইত্যাদি বহু নাম দিয়েছেন। ‘জিন্দাভেস্তায় এর নাম তাহবিমান বা অন্ধকার, বাইবেল এ এর নাম শয়তান। এই অধর্মকে পরাজয়ের জন্য নানাজাতির মধ্যে নানারকম উপদেশ আছে। আর্থার (Arthur) এর উচ্ছেদের জন্য নাইটহুড সৃষ্টি করেন। আর্য জাতির সমাজ, ধর্ম, আচার ব্যবহার সমস্ত কাজ, সমস্ত অনুষ্ঠান এই অধর্ম অজ্ঞান বা মায়ার হাত থেকে মুক্তি লাভের জন্য। আর্য জাতি এই অধর্ম কি করে জয় করতে হবে তার মূর্তি গড়ে পূজা করেন। ধন-শক্তি জ্ঞান শক্তি, দেব শক্তির পদতলে পশুশক্তির একত্র সমাবেশ আবশ্যক। কিন্তু সর্ব প্রথম সিদ্ধির জন্য শুভেচ্ছা আবশ্যক- পরে কর্ম করলেই এই অসুর জড় হয়।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ ও এই আবহমান কাল প্রধাবিত ধর্ম অধর্ম যুদ্ধের অঙ্গ। যুদ্ধটা ঐতিহাসিক হলেও ব্যাসদেব দেখিয়েছেন অন্তর্নিহিত যুদ্ধই বাইরের আকার গ্রহণ করে মাত্র। মানুষ কিছুই নয়, অন্তর্নিহিত স্বভাবের মূর্তি মাত্র।
“আলোচ্য মহাভারতের দুৰ্য্যোধন ক্রোধময় মহাবৃক্ষ, কর্ণ তার কাণ্ড, শকুনি শাখা, দুঃশাসন ফল ও পুষ্প, মনস্বী রাজা ধৃতরাষ্ট্র তার মূল। অন্যদিকে যুধিষ্ঠির ধর্মময় মহাবৃক্ষ, অর্জুন কাণ্ড, ভীমসেন শাখা, মাদ্ৰীসুত নকুল সহদেব তার পুষ্প ও ফল এবং কৃষ্ণ ব্রহ্ম ও ব্রাহ্মণগণ তার মূল। মূল শ্লোক এই-
“দুর্যোধনো মন্যুময়ো মহাদ্রুমঃ
কর্ণঃ স্কন্ধঃ শকুনিস্তস্য শাখাঃ।
দুশ্শাসনঃ পুষ্পফলে সমৃদ্ধে
মূলং রাজা ধৃতরাষ্ট্রোঽমনীষি। ১-১-১২৮ (১২৮)
যুধিষ্ঠিরে ধর্মময়ো মহাদ্রুমঃ
স্কন্ধোঽর্জুনো ভীমসেনোঽস্য শাখাঃ।
মাদ্রীসুতৌ পুষ্পফলে সমৃদ্ধে
মূলং কৃষ্ণো ব্রহ্ম চ ব্রাহ্মণাশ্চ॥” 
কেউ কেউ এই দেখে মহাভারতে ঐতিহাসিকত্ব উড়িয়ে দিতে চান। ‘মহাভারত রূপক মাত্র’, ‘কুরুক্ষেত্রে আঠারো অক্ষৌহিণী সেনা আটতে পারে না’  ইত্যাদি মত গুলি বড়ই ভ্রমাত্মক। কর্ণাল, অমিন, বাণগঙ্গা, ভীষ্ম শরশয্যার স্থান, গীতা উপদেশ প্রভৃতি স্থান এবং কুরুক্ষেত্রের আধুনিক অবস্থা এরা যদি নিজ চোখে দর্শন করেন. এই ভ্রমাত্মক মত দিয়ে সাধারণের বিশ্বাস নষ্ট করার প্রয়াস থেকে এরা নিশ্চয় বিরত হবেন।
কিন্তু বলছিলাম- অগণিত কুরুসৈন্য অনুত্তরঙ্গ সমুদ্রের ন্যায় এখনও স্থির হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এখনও কুরুবংশ ধ্বংসকারী অনল রাশি দিগন্ত ছড়িয়ে পড়ে নেই।
কখনও জল ভরা মেঘ দেখেছ? যে মেঘমালা দেখতে দেখতে দিনের আলোক রাশি ডুবিয়ে ক্ষণকাল মধ্যে দশদিক অন্ধকারে ছেয়ে ফেলে? মেঘ জলপূর্ণ অথচ বৃষ্টি হচ্ছে না। অচিরে প্রবল ঝড়-বাদলে আকাশ ভেঙ্গে পড়বে কিন্তু এখনও প্রকৃতি নিস্তব্ধ, যেন মৃদু শ্বাস-প্রশ্বাস পর্যন্ত অবরুদ্ধ। আঠারো অক্ষৌহিণী সৈন্য এখনও স্থির। এই সময়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুন কে গীতা উপদেশ করেছিলেন।
যে ক্রোধানল আঠারো দিনে পৃথিবীর ভার লাঘব করেছিল, সেই অনল রাশির উৎপত্তি ও বিস্তৃতি কোথায়, কিভাবে আরম্ভ হল? জানার কথা বটে।
আমরা এই পুস্তকে এই যুদ্ধের উৎপত্তি ও বিস্তৃতিও দেখাব। আর যদি দিন পাই, যুদ্ধের অবসানও দেখাব। সঙ্গে সঙ্গে ভারতের শিক্ষা- যে শিক্ষায় নীচত্ব দূর হয়, যে শিক্ষায় মানুষ কর্ম করতে করতে একদিকে পরমানন্দ প্রাপ্তি, অন্যদিকে জগত চক্র পরিচালনা পূর্বক জীবে দয়া করতে পারে, তাও দেখাব।
কুরু বালকদের বাল্য ক্রীড়া, বিদ্যা পরীক্ষা, জতু গৃহ দাহ, দ্রৌপদীর স্বয়ম্ভর, লক্ষণাহরণ, সুভদ্রাহরণ, রাজসূয় প্রভৃতি থেকে দেখানো যাবে কিভাবে এই প্রলয়কারী সমরানল বর্ধিত হয়েছিল, কিকরে সময়ে সময়ে প্রসারিত হয়ে ইহা দুই একবার বাইরে দগ্ধ করেছিল, কি-ভাবে পরক্ষণেই আবার নিভে ছিল। 
রাজসূয় যজ্ঞের পর দ্যূতক্রীড়া, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ, পাণ্ডব নির্বাসন, অজ্ঞাতবাস, বিরাট রাজ্যে ক্ষুদ্র যুদ্ধ, এই সমস্ত থেকে দেখাব কি-ভাবে ইহা পূর্ণত্ব প্রাপ্ত হয়ে কুরুকুল গ্রাস করেছিল। সঙ্গে সঙ্গে দেখাব কিকরে যুদ্ধের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে গীতা উপদেশ দেবার প্রকৃত সময়। প্রধান কর্তব্য প্রতিপালনের পূর্বে কিভাবে কর্তব্য প্রতিপালনকারীর জাগ্রত হওয়া আবশ্যক, এও দেখানো হবে। ভারত যুদ্ধের পর গীতা উত্তর অধ্যায়েও ব্যাসদেব দেখিয়েছেন কোন্ উপায়ে শোক মোহ হতে পরিত্ৰাণ লাভ করে মানুষ পরমানন্দ লাভ করতে পারে। প্রথমে ও যে শিক্ষা, শেষে ও সই শিক্ষা। সর্বত্র আর্য শাস্ত্রের এক লক্ষ্য- সর্বদুঃখ নিবৃত্তি ও পরমানন্দ প্রাপ্তি। এরই অন্য নাম মোক্ষ।
নিবেদনে- সনাতন সংবেদ 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.