sanatansangbed

Introduction of SANATAN dharma scriptures

গীতা পূর্বাধ্যায়- প্রস্তাবনা

প্রস্তাবনা

গীতাতে সকল প্রকার মানুষের সকল প্রকার কর্তব্য নিশ্চয় করা হয়েছে। যে ধর্ম আচরণ করলে জীবের সর্ব দুঃখ নিবৃত্তি এবং পরমানন্দ লাভ হয়, গীতা সেই ধর্ম সংস্থাপন করছেন। এটাই আদি ধর্ম, এটাই সনাতন ধর্ম। প্রাচীন ঋষিগণ এই ধর্ম আচরণ করতেন, রাজর্ষী গণ এই ধর্ম আচরণ করে ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ চার-বর্গ লাভ করেছিলেন।
ভারত সমর কাল্পনিক নয়, সত্য ঘটনা। একবার কুরুক্ষেত্র দেখে আস, ভ্রম ভাঙ্গবে। দ্বাপরের প্রধান ঘটনা এই কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ। মহাভারত শুধু কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ইতিহাস নয়। ইহা ইতিহাস, ধর্মশাস্ত্র ও মোক্ষশাস্ত্র। কুরু পাণ্ডবের যুদ্ধই মহাভারতের সর্ব চিত্তাকর্ষক ঘটনা। এর চরিত্রগুলি চিরদিন নতুন থাকবে। আমরা যুধিষ্ঠিরাদি পাণ্ডবগণ ও দুর্যোধনাদি প্রধান প্রধান কৌরবদের চরিত্র এই পুস্তকে বিশ্লেষণ করব। কিন্তু ভীষ্ম দ্রোণ এবং কর্ণ সম্বন্ধে প্রাসঙ্গিক উল্লেখ করব মাত্র।
ভীষ্ম, দ্রোণ এবং কর্ণ- এই তিন বীর পুরুষ যেন জীবের কর্তব্য শেখানোর জন্য। ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ এই তিন চরিত্রই জটিল- জটিল বলে এরা এত রমণীয়। ভীষ্ম ও দ্রোণ কৌরব অপেক্ষা পাণ্ডবদেরকে স্নেহ করতেন। যুধিষ্ঠিরাদি এদের নিতান্ত প্রিয়। তথাপি দুর্য্যোধন এর কাছ থেকে এনারা নানা প্রকার উপকার পেয়েছেন। এনারা কৃতজ্ঞ, কৃতঘ্ন নন। প্রাণে পাণ্ডবের পক্ষ হয়েও এনারা দুর্য্যোধন এর জন্য পাণ্ডবদের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন। এ যুদ্ধ কর্তব্য অনুরোধে। সকলেই জানতেন, যথোধর্ম্মস্ততোজয়। কিন্তু নিয়তির বশে ধার্মিক অধার্মিকের পক্ষ। একদিকে প্রাণহানি অন্যদিকে কৃতজ্ঞতা রক্ষা। দুৰ্য্যোধন এর অন্ন গ্রহণ করেছেন বলে অধর্ম পক্ষে যোগ দিয়ে জীবন বলি দিতেও কুন্ঠিত হন নি। শ্রীকৃষ্ণকে ভগবান জেনেও তাঁর বিপক্ষে দণ্ডায়মান হয়েছিলেন। যদি এনারা পাণ্ডব পক্ষে যোগ দিতেন তবে এদেরকে কৃতঘ্ন হতে হত।
গোঘ্নে চৈব সুরাপে চ চৌবে ভগ্নব্রতে তথা।
নিষ্কৃতির্বিহিতা সদ্ভিঃ কুতঘ্নে নাস্তি নিষ্কৃতিঃ।। রামায়ণ কিষ্কিন্ধ্যা ৩৪/১২
গোঘ্ন, সুরাপায়ী, তস্কর ও ভগ্ন ব্রত ব্যক্তিদের নিষ্কৃতি সাধুগণ ব্যবস্থা করেছেন কিন্তু কৃতঘ্নের নিষ্কৃতি বিধান কুত্রাপি নেই। রামায়ণে যে উক্তি, মহাভারতেও তাই। শান্তিপর্বে ১৭২ অধ্যায় বলছেন, ধর্মরাজ! যে ব্যক্তি কৃতঘ্ন, রাক্ষসেরাও তাকে ভোজন করে না। বরং ব্রহ্মঘ্ন সুরাপায়ী তস্কর ও ব্রতঘ্ন ব্যক্তির নিস্তার আছে, কিন্তু যে কৃতঘ্ন তার কিছুতেই নিষ্কৃতি নেই। যে নরাধম মিত্র দ্রোহী, কৃতঘ্ন ও নৃশংস, রাক্ষস ও অন্যান্য কীটেরাও তাকে ভক্ষণ করে না। রামায়ণ বলেন ‘কৃতঘ্ন সর্ব্বভূতানাং বধ্যঃ’ ‘তা মৃতানপি ত্রুব্যাদাঃ কৃতঘ্নান্নোপভূঞ্জতে’। এই শিক্ষায় জাতি গঠিত হয়েছিল। রাজপুত শিখ প্রভৃতি বীরদের মধ্যে এখনও আছে ‘যার লবণ খেয়েছি তার বিরুদ্ধাচরণ করব না।’ ভীষ্ম দ্রোণ এই জন্যই আপন প্রাণ বিসর্জন দিলেন, তথাপি কৃতঘ্ন হতে পারলেন না।
আর কর্ণ! কর্ণ যুধিষ্ঠীরেরও জ্যেষ্ঠ। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে কর্ণ এটা জানতেন কুন্তীও এটা জানতেন, আর জানতেন শ্রীকৃষ্ণ। কর্ণ বাইরে নিতান্ত কঠোর ব্যবহার করলেও ভ্রাতৃ স্নেহ বিসর্জন দেননি। জ্যেষ্ঠ হয়েও কনিষ্ঠের সাথে যুদ্ধ করেছেন। যুদ্ধে কপটতা করেন নি। তখনও ভারতবাসী কপটতার শিক্ষা লাভ করেনি, দুৰ্য্যোধন এর দ্বারা উপকৃত হয়েছিলেন বলে আপন সহোদরদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে বিরত হননি। ভিতরে পাষাণ চাপা দিয়ে কর্তব্য করেছেন, প্রাণ হারাবেন জেনেও কর্তব্য লঙ্ঘন করেন নি। হায়! কবে ভারতবাসী আবার কৃতজ্ঞতার শিক্ষা লাভ করবে? গৃহশত্রু দ্বারাই জাতির উচ্ছেদ সাধন হয়, কৃতঘ্ন ব্যক্তির কপটাচারেই জাতির জীবন ধ্বংস হয়ে যায়। মহাভারতের চরিত্র সমূহে মানবজাতির শিক্ষণীয় কতই আছে!
সংক্ষেপ এ ভারতের শিক্ষা এই- জীব শোক-মোহ আক্রান্ত হলেই স্বধর্ম ত্যাগ করে ও পরধর্ম গ্রহণ করে। পরধর্ম আচরণই জীবের সর্ব দুঃখের কারণ। পরধর্ম স্বভাবের প্রতিকুল। কিভাবে জীবের সর্ব দুঃখ নিবৃত্তি হয়, ভারত তাই দেখাচ্ছেন। সর্ব দুঃখ নিবৃত্তি করতে হলে দুঃখটাও দেখান আবশ্যক। ভারত সমরে সর্বপ্রকার দুঃখ প্রদর্শিত হয়েছে এবং দুঃখ নিবৃত্তির উপায় ও বলা হয়েছে। যত দিন মানব হৃদয় থাকবে, যত দিন শোক মোহ থাকবে, তত দিন কুরুক্ষেত্র সমর, গীতা ও সমর অবসানে কুরু পাণ্ডবদের আচরণ জীবের সর্ব শিক্ষার শীর্ষ স্থান অধিকার করবে। আর একটি কথা- এই গ্রন্থে যা অপ্রাসঙ্গিক বলে বোধ হবে তার কোনটা সাক্ষাৎ সম্বন্ধে ঈশ্বর অনুরাগ বৃদ্ধির জন্য, কোনটা বা গৌণ ভাবে চিত্ত প্রকৃতিস্থ করে যাতে চিত্ত ঈশ্বর অনুরাগ লাভ করতে পারে তার চেষ্টা মাত্র। ঈশ্বর অনুরাগ ভিন্ন সর্ব দুঃখ নিবৃত্তি ও পরমানন্দ প্রাপ্তির অন্য উপায় নেই। আর্য শাস্ত্রে কোথাও প্রলাপ বাক্য নেই। বুঝবার দোষে প্রলাপ বলে মনে হয়। এ দোষ শাস্ত্রের নয়, আমাদের, কারণ যাদের লক্ষ্য ঠিক আছে তাদের বৃথা প্রলাপে রুচি হয় না।
রায় কালীপ্রসন্ন সিংহ বাহাদুর অনুদিত মহাভারত এবং কাশীরামের মহাভারত অবলম্বনে গীতা-পূর্বাধ্যায় লেখা। উক্ত মহোদয় গণের সাহায্যে মহাভারত ও গীতার শিক্ষা হৃদয়ঙ্গম করার জন্য এই প্রয়াস।
গ্রন্থাকার  
শ্রীরামদয়াল মজুমদার। 
সর্ব শর্ত সনাতন স্বস্তিক সভা ব্লগের। 
পিডিএফ থেকে ওয়ার্ড এ রূপান্তর করেছেন, কৃষ্ণকমল। 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.