বেদ ও ভারতের আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য-পর্ব ০১
স্বামী সমর্পণানন্দ
১ম পাঠ-১ম পর্ব
১ম পাঠ-১ম পর্ব
যদিও হিন্দু ধর্মের সমস্ত শাস্ত্রের জনক বেদ কিন্তু হিন্দু ধর্মের অন্যান্য শাস্ত্র থেকে বেদ সম্পূর্ণ আলাদা। সাধারণ মানুষের পক্ষে বেদ সত্যিই অত্যন্ত কঠিন। বেদ অধ্যয়ন ও অধ্যায়নের জন্য আচার্য্যের সংখ্যাও ইদানীং খুবই কম। কমে যাওয়ার পেছনেও অনেক কারণ আছে। তার প্রথম কারণ হচ্ছে বেদের পরিধি এত বিশাল যে এর বিশালত্বকে আমরা ধারণাই করতে পারব না, অধ্যয়ন করা তো তার পরের কথা। চারটি বেদের চারটে করে ভাগ আছে, সুতরাং যে ষোলটি ভাগ পাচ্ছি তার মধ্যে ঋগ্বেদের যে সংহিতা, তাতে শুধু মন্ত্রই আছে। কিন্তু শুধু মন্ত্র পড়লে বেদের কিছুই বোঝা যাবে না, সাথে সাথে ভাষ্য না পড়লে মন্ত্রগুলির সঠিক অর্থ অনুধাবন করা অত্যন্ত দুঃসাধ্য হবে। বেদের উপরে ভাষ্য রচনা করার দুঃসাহস কেউ করেন না। কিন্তু সায়নাচার্য ঋগ্বেদের শুধু সংহিতার অর্থাৎ মন্ত্র অংশের ভাষ্য রচনা করে গেছেন। সায়নাচার্য শঙ্করাচার্যের পরবর্তী কালের, তাও আজ থেকে প্রায় এক হাজার বছর আগে। শঙ্করাচার্যও বেদের ভাষ্য রচনা করেননি, কিন্তু সায়নাচার্য পরে এই গুরু দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। তাও তিনি চারটি বেদের মধ্যে ঋগ্বেদের সংহিতার মন্ত্রগুলিকেই বেছে নিলেন ভাষ্য রচনা করার জন্য, আর তাতেই তার মোটা মোটা বারোটা খণ্ড লেগে গেল। ভাষ্য ছাড়া বেদের কিছুই বোঝা যায় না, যেগুলি খুবই সহজ সরল সেই মন্ত্রগুলিই আমরা সচরাচর আবৃত্তি করে থাকি। ম্যাক্সমুলার সায়নাচার্যের ভাষ্য পড়ে বেদের অনুবাদ করতে গিয়েও অনেক ক্ষেত্রে গোলমাল করে ফেলেছেন। এটা অবশ্য মানতে হবে যে চারটি বেদের মধ্যে ঋগ্বেদ সব থেকে বৃহৎ। তা সত্ত্বেও একটা জিনিষ বুঝতে হবে ঋগ্বেদের শুধু মন্ত্রের অর্থ লিখতে যদি বারোটা খণ্ড লাগে তাহলে আর বাকি ঋগ্বেদের তিনটে বিভাগ এবং সামবেদ, যজুর্বেদ ও অথর্ব্ব বেদের চারটে করে যে বিভাগ আছে- মন্ত্র, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ, বেদের এই সমগ্র পুঁথিগুলিকে যদি একসাথে রাখা হয় তাহলে পুরো একটা ঘরই ভরে যাবে। সুতরাং একজনের পক্ষে এক মনুষ্য জন্মে সমগ্র বেদকে অধ্যয়ন করা দুঃসাধ্য। এই স্বল্প পরিসরের মধ্যে বেদের সামগ্রিক আলোচনা করাও তাই কখনই সম্ভব নয়। যারা বেদ নিয়ে চর্চা করেন তাঁরাও সমগ্র বেদের ব্যাপারে বলতে গেলে খেই হারিয়ে ফেলেন।
বেদের নিজস্ব একটা ব্যাকরণ সহ একটি অভিধান আছে, যার শেষ সংস্করণ হয়েছে যিশু খ্রীষ্টের জন্মের চারশো বছর আগে। এর থেকে বোঝা যায় আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে বেদের ভাষা অপ্রচলিত হয়ে গেছে। সেই অপ্রচলিত ভাষা কে বোঝার জন্য আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে একটা অভিধান লেখা হয়েছিল। বেদকে কেন বেশির ভাগ লোকই বুঝতে পারে না, ভাষাগত কারণও তার মধ্যে অন্যতম। আরও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যে বেদের যে কত পুঁথি হারিয়ে গেছে তার কল্পনাই করা যায় না। যা আমাদের কাছে এখন আছে তার একটা ধারণা এখানে দেওয়া হল। সেই জন্য বেদের সামনে এসে মানুষ হাত-পা ছেড়ে অসহায় হয়ে বসে পড়ে। যারা গবেষণা করে খুব বড় বিশেষজ্ঞ হয়েছেন তারা একটু আধটু বোঝেন, আর দক্ষিণ ভারতে, বেনারসে এখনও কিছু কিছু ব্রাহ্মণ পরিবার আছেন যারা এখনও নিষ্ঠা সহকারে অধ্যয়ন করে বেদকে বংশ পরম্পরায় ধরে রেখেছেন।
বেদের সামগ্রিক চিত্রকে তুলে আনা এখানে সম্ভব নয়, কিন্তু আমরা জানতে চেষ্টা করব বেদে মূলতঃ কি আছে, আর কিছু কিছু প্রচলিত মন্ত্রগুলি নিয়ে আলোচনা করা হবে। বেদ আসলে কি বলতে চাইছে একবার সেই ব্যাপারে একটা স্পষ্ট ধারণা হয়ে গেলে ভারতীয় অন্যান্য ধর্মশাস্ত্র গুলি অধ্যয়ন করার সময় মূল জিনিষ গুলি বোঝার ক্ষেত্রে অনেকটাই সুবিধা হবে। যেমন গীতাতে এমন অনেক শ্লোক আছে যা কিছুতেই বোঝা যায় না কি বলতে চাইছে। বিভিন্ন আচার্য্যরা তাদের ভাষ্যে বিভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করলেও পরিষ্কার হয় না, কিন্তু বেদের ধারণা ঠিকমতো হয়ে গেলে তখন বোঝা যায় এই শ্লোকগুলি এই এই কারণে বলা হয়েছে। গীতার পঞ্চোদশ অধ্যায়ে আছে- কর্ম ব্রহ্মোদ্ভবং বিদ্ধি ব্রহ্মাক্ষরসমুদ্ভবং, এই ধরণের শ্লোকগুলি বেদের ধারণা যতক্ষণ না হচ্ছে ততক্ষণ বোঝা যায় না, তা না হলে শ্লোকগুলি মাথা থেকে হারিয়ে যাবে।
বহু কাল ধরে আমাদের মধ্যে একটা প্রচলিত ধারণা চলে আসছে যে শুদ্রদের বেদ শুনতে নেই। কিন্তু বেদেই একটা মন্ত্র আছে যা আমাদের এই বহু দিনের ধারণার উল্টো কথাই বলছে। যজুর্বেদের ছাব্বিশ অধ্যায়ে এই মন্ত্রের মূল তাৎপর্য হচ্ছে- একজন ঋষি প্রার্থনা করছেন যে হে ঈশ্বর, আমি যেন বেদের এই সুমধুর কথাগুলো, বেদের সুমহান তত্ত্বগুলি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, শূদ্র, আমার সন্তানদের, অন্যের সন্তানদের, দেশে বিদেশের আপামর সাধারণ মানুষকে বলতে পারি। স্বামীজীর খুব প্রিয় মন্ত্র- শৃণ্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্যা পুত্রা, এখানেও সারা বিশ্বের সমস্ত মানুষের কথা বলা হচ্ছে। এটা একটা মারাত্মক ভুল ধারণা যে সবাইকে বেদ বলতে নেই। অনেক ঋষিরা চাইতেন যে আমার এই অনুভূতিলব্ধ জ্ঞান যাতে মুর্খদের কাছে না যায়। কিন্তু এখানে ঋষি বলছেন আমি যেন আমার উপলব্ধ জ্ঞান সবাইকে বলতে পারি। পরের দিকে বেদ মুষ্টিমেয় কয়েকজন বোদ্ধাদের জন্য রেখে সাধারণ মানুষের জন্য প্রাচীর তুলে দিয়েছিলেন। মনুস্মৃতিতেই আবার বলা হয়েছে ব্রাহ্মণ যেন না পড়িয়ে মরে যায় কিন্তু তবুও সে যেন অপাত্রে কখনই বিদ্যা দান না করে। কিন্তু বেদের মূল দর্শন যেখানে আছে সেখানে কিন্তু এই ধরণের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয় নি শুরু বিদ্যাকে অপাত্রে দান করার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা ছিল। অপাত্রে দান করলে অনেক সমস্যা এসে যায়। দর্শনের গভীর তত্ত্বগুলি ভুল হাতে বা অপাত্রে চলে যাওয়াটা সামাজিকতার দিক থেকে ও আধ্যাত্মিকতার দিক থেকে উভয় ক্ষেত্রেই বিপজ্জনক। যেমন গীতার খুব বিখ্যাত শ্লোক ‘ন হন্যত হন্যমানে শরীর’ অর্থাৎ যাঁর আত্মজ্ঞান হয়ে গেছে তিনি জানেন যে কেউ কারুকে বধ করেন না। এখন এই তত্ত্বটা যদি কোন মুর্খের কাছে চলে যায়, তখন সে বলতে পারে যে আত্মার যখন মৃত্যু নেই তখন আমি যাকেই বধ করি না কেন আমার পাপ লাগবে না। এইটাই হচ্ছে দর্শনের অপপ্রয়োগ। কারণ যাঁর আত্মজ্ঞান হয়েছে সে কখনই কাউকে বধ করতে যাবে না। ঠাকুর বলছেন ‘যার ঈশ্বর দর্শন হয়েছে তার আর বেতাল পা পড়ে না’। এটাকে আটকাবার জন্য আমাদের ঋষিরা বেদ উপনিষদের দর্শনের ক্ষেত্রে একটা প্রাচীর তুলে দিলে বললেন- যাদের এখনও প্রস্তুতি হয় নি তাদেরকে এই বিদ্যা দিও না।
অবশ্য সব সময়ই ধর্মকে যুগোপযোগী করে দেওয়া হয়, এটা না করলে ধর্মের অধঃপতন হয়ে যায়। স্বামীজী বলছেন ঠাকুরের আগমনের পর থেকে সত্যযুগ গুরু হয়েছে। শাস্ত্রের যে জিনিষ গুলোকে এত দিন যাবৎ রুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল, সেই জিনিষগুলিকে এখন উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। বেদ এখন সবার কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। স্বামীজী চেয়েছিলেন প্রত্যেক হিন্দুর বাড়িতে শালগ্রামের সাথে বেদেরও যেন পূজা হয়। শালগ্রাম মানে কুলদেবতার কথা বলা হচ্ছে। তার মানে সর্ব্বোচ্চ বেদেরও পূজা হবে সাথে সাথে পারিবারিক কুল দেবতাদেরও পূজা হবে। আমরা এখন নিজের নিজের কুলদেবতার মধ্যে আবদ্ধ হয়ে আছি। স্বামীজী এই সঙ্কীর্ণতা ভাঙ্গতে চেয়েছিলেন। কারণ পুরো বেদ ও উপনিষদের দর্শনকে যখন মানুষ বুঝে নেবে তখন ধর্মের বাহ্যিক ও অন্তর্মুখী আচরণে আমূল পরিবর্তন এসে যাবে এবং ধর্মের প্রকৃত স্বরূপ মানুষের মধ্যে উদ্ভাসিত হয়ে যাবে।
স্বামীজীর খুব ইচ্ছা ছিল সবাই যেন বেদ পড়তে পারে। এই কারণেই তিনি চেয়েছিলেন বেলুড় মঠে যেন একটি বেদ বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। আজ বেলুড় মঠে বেদ বিদ্যালয় স্থাপন করে স্বামীজীর স্বপ্নকে সার্থক করা হয়েছে। কিন্তু প্রথমেই এই বেদ বিদ্যালয় নিয়ে বেলুড় মঠ কর্তৃপক্ষদের প্রচুর সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, প্রথম দিকে যেসব আচার্য্যরা এসেছিলেন তাঁরা বললেন আমরা ব্রাহ্মণ ছাড়া বেদ পড়াব না। মঠ কর্তৃপক্ষ এতে আপত্তি করে দৃঢ় ভাবে স্বামীজীর ইচ্ছাকেই ধরে রইলেন- আমরা চাই বেদ যেন সবাই অধ্যয়ন করতে পারে। পরে কয়েক জন ব্রাহ্মণ রাজী হয়ে গেলেন। এখন বেলুড় মঠেরই নিজস্ব আচার্য্যরা বেদে অধ্যয়ন করাবার জন্য তৈরী হয়ে গেছেন।
ক্রমশঃ
অবশ্য সব সময়ই ধর্মকে যুগোপযোগী করে দেওয়া হয়, এটা না করলে ধর্মের অধঃপতন হয়ে যায়। স্বামীজী বলছেন ঠাকুরের আগমনের পর থেকে সত্যযুগ গুরু হয়েছে। শাস্ত্রের যে জিনিষ গুলোকে এত দিন যাবৎ রুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল, সেই জিনিষগুলিকে এখন উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। বেদ এখন সবার কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। স্বামীজী চেয়েছিলেন প্রত্যেক হিন্দুর বাড়িতে শালগ্রামের সাথে বেদেরও যেন পূজা হয়। শালগ্রাম মানে কুলদেবতার কথা বলা হচ্ছে। তার মানে সর্ব্বোচ্চ বেদেরও পূজা হবে সাথে সাথে পারিবারিক কুল দেবতাদেরও পূজা হবে। আমরা এখন নিজের নিজের কুলদেবতার মধ্যে আবদ্ধ হয়ে আছি। স্বামীজী এই সঙ্কীর্ণতা ভাঙ্গতে চেয়েছিলেন। কারণ পুরো বেদ ও উপনিষদের দর্শনকে যখন মানুষ বুঝে নেবে তখন ধর্মের বাহ্যিক ও অন্তর্মুখী আচরণে আমূল পরিবর্তন এসে যাবে এবং ধর্মের প্রকৃত স্বরূপ মানুষের মধ্যে উদ্ভাসিত হয়ে যাবে।
স্বামীজীর খুব ইচ্ছা ছিল সবাই যেন বেদ পড়তে পারে। এই কারণেই তিনি চেয়েছিলেন বেলুড় মঠে যেন একটি বেদ বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। আজ বেলুড় মঠে বেদ বিদ্যালয় স্থাপন করে স্বামীজীর স্বপ্নকে সার্থক করা হয়েছে। কিন্তু প্রথমেই এই বেদ বিদ্যালয় নিয়ে বেলুড় মঠ কর্তৃপক্ষদের প্রচুর সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, প্রথম দিকে যেসব আচার্য্যরা এসেছিলেন তাঁরা বললেন আমরা ব্রাহ্মণ ছাড়া বেদ পড়াব না। মঠ কর্তৃপক্ষ এতে আপত্তি করে দৃঢ় ভাবে স্বামীজীর ইচ্ছাকেই ধরে রইলেন- আমরা চাই বেদ যেন সবাই অধ্যয়ন করতে পারে। পরে কয়েক জন ব্রাহ্মণ রাজী হয়ে গেলেন। এখন বেলুড় মঠেরই নিজস্ব আচার্য্যরা বেদে অধ্যয়ন করাবার জন্য তৈরী হয়ে গেছেন।
ক্রমশঃ
এটা কি বাংলাদেশে নাকি ভারতে শিখানো হয়????
উত্তরমুছুননমস্কার, অনুগ্রহ পূর্বক রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ বিশ্ববিদ্যালয়, বেলুড় মঠ এ যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে।
মুছুন