সনাতনে সংগঠনের লক্ষ্য, আদর্শ ও উদ্দেশ্য সমূহ
সনাতনের লক্ষ্য, আদর্শ ও উদ্দেশ্য
১। যুবশক্তির জাগরণঃআজকের যুবকরা ভবিষ্যতের নীতিনির্ধারক - তাই এই যুবকদের জাগ্রত করতে পারলে ভবিষ্যতে আমরা সুন্দর ও শক্তিশালী সনাতন সমাজ গঠন করতে পারবো। ‘সনাতন’ প্রতিনিয়ত যুবকদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে শ্বাশত সনাতন বার্তা; আমরা গর্বের সাথে বলতে পারি আমাদের যুব শক্তি তৈরী হচ্ছে ভবিষ্যতের সুন্দর ও শক্তিশালী সনাতন সমাজ গঠনের জন্য।
২। শিশুদের প্রগতিশীল শিক্ষার পাশাপাশি ধর্ম শিক্ষায় শিক্ষিত করাঃ
শিশুরা আমাদের ভবিষ্যত। কাঁচা মাটিকে যে ছকে ফেলবেন সেই আকারই ধারণ করবে। আপনি যদি আপনার শিশুকে আপনার ছকে ফেলতে না পারেন তবে অন্য কেউ সেই মাটিকে তার ছকে ফেলে নিজের মত করে আকৃতি প্রদান করবে। কুলত্যাগ তথা ধর্মান্তর রোধ করতে আমাদের প্রত্যেককেই সচেতন থাকতে হবে। তাই শৈশব থেকেই আপনার সন্তানকে আপনার পূর্ব পুরুষের পরম্পরায় গড়ে তুলুন। সনাতনের শ্বাশত বাণী আপনার সন্তানের প্রতিটি অনুভূতিকে সনাতন ভাবধারায় জাগ্রত করবে।
৩। সহযোগিতার বলয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করাঃ
আমরা বিশ্বাস করি, কর্মমুখী সমাজ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে সনাতন সমাজ অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধশালী হবে। ইতিহাস বিচারে আমরা দেখি পরিশ্রমী ও কর্মমুখী সম্প্রদায় আজ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ। কর্মক্ষম মানুষই পারে ‘সনাতন’কে শক্তিশালী করতে। পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সৃষ্টির প্রয়াস আমাদের সর্বদাই থাকবে। এই বিষয়ে আমরা সকলের সহযোগিতা কামনা করি। সনাতন সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরা যদি সাহায্যের হাত প্রসারিত করেন তাহলে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে পড়বে এই প্রবণতা এবং যোগ্যতা অনুসারে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকবে আমাদের যুবকরা।
৪। আমাদের কৃষ্টি এবং কালচারকে সমাজের কাছে তুলে ধরাঃ
আমাদের আছে গৌরবময় ইতিহাস। যখন পৃথিবী অশিক্ষা ও কুসংস্কারের অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল তখন আমাদের বৈদিক সমাজ জ্ঞানচর্চার নিমিত্তে বেদ পাঠ করতো, গণিত চর্চা ও নীতিশিক্ষা হতো। তখন আমাদের উন্নত বৈদিক সমাজব্যবস্থা ছিল। চর্চাহীনতার কারণে আমরা আজ বিভ্রান্ত। প্রকৃত ধর্ম কি- সেটাই অনেকে জানি না। না জেনে, না বুঝে কিছু আচার আচরণ সর্বস্ব ধর্ম পালন করছে অনেকে। আচার আমাদেরকে ধর্মীয় ভাবের সাথে সমন্বিত করে - কিন্তু মূল ভাব সম্পর্কে জ্ঞান না থাকলে আচার আমাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করতে পারবে না। এই মূল ভাব সম্পর্কে জানতে হলে সকলকে অধ্যয়ন করতে হবে। সনাতন ধর্মের মূল গ্রন্থগুলি হলো বেদ, উপনিষদ ও গীতা। পুরাণ ও ইতিহাস হলো আচারের সমষ্টি যা রূপক রহস্যের মাধ্যমে বোঝানোর জন্য। আমাদের ব্যস্ত জীবনে বেদ, উপনিষদ, গীতা ও পুরাণ পাঠ করে জ্ঞান অর্জন করা অনেকের পক্ষেই অসম্ভব ব্যাপার। তাই আমাদের উচিৎ শঙ্করাচার্য, স্বামী বিবেকানন্দ, ঋষি অরবিন্দ, ঋষি অনির্বাণের মত জ্ঞানী পণ্ডিতদের বিশ্লেষণ ধর্মী গ্রন্থ গুলো পাঠ করে জ্ঞান অর্জনে চেষ্টা করা। প্রকৃত পক্ষে ‘জীব প্রেম, প্রকৃতি প্রেম, মানব প্রেম ও আত্মজ্ঞান উপলব্ধিই হলো সনাতন ধর্ম’। এই প্রেম মানে পূজা, এই প্রেম মানে সমর্পণ। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ধর্মের পাঁচটি মূলাধার নির্ধারণ করেছেন। এই পাঁচ মূলাধার হলোঃ জ্ঞান, প্রেম, ন্যায়, সমর্পণ, ধৈর্য্য। এই মূলাধারগুলোকে জীবনের উপলব্ধির সাথে সংযুক্ত করতে পারলে আমরা সনাতন ধারায় পরিচালিত হতে পারবো। অনেকে শুধু পাঠ-কে পূণ্য জ্ঞান করে। মর্ম অনুধাবনবিহীন গীতা বা বেদপাঠ, যা আমাদের জীবনের উপর প্রভাব বিস্তার করে না বা যে পাঠের ফল জীবনে পরিলক্ষিত হয় না – সে পঠন অর্থহীন।
আমরা বেদশিক্ষাকে তরুণদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাই। হাজার হাজার বেদজ্ঞানী তরুণ সৃষ্টি করতে চাই। সঠিক বেদচর্চা ও তার জ্ঞানই একমাত্র আমাদের অভিন্ন জাতিসত্তায় আত্মপ্রকাশ ঘটাতে সাহায্য করতে পারে।
৫। যৌতুক প্রথাঃ
বিয়ের নামে দান গ্রহণ, উপহার পাবার লিপ্সা সমাজের সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তির আচরণ। যৌতুককে না বলুন। সামাজিক এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবার জন্য তরুণদেরই এগিয়ে আসতে হবে। কন্যা সন্তান গৃহলক্ষ্মী। যৌতুকের মতো কুপ্রথা সমাজ থেকে চিরতরে উচ্ছেদ করতে না পারা গৃহলক্ষীর অমর্যাদার অন্যতম কারণ। এর কুফল সুদূর প্রসারী। যৌতুককে সমাজ থেকে চিরতরে বিদায় করা সনাতনের অন্যতম লক্ষ্য।
৬। কন্যাসন্তানদের পিতা-মাতার ও স্বামীর সম্পদের অধিকার প্রদানঃ
সম্পদে সমান অধিকার অগ্রসর সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। পিতার সম্পদে কন্যার অধিকার থাকবে। জামাতা বা অন্য কারো নয়। স্বামীর সম্পদের উপরও স্ত্রীর অধিকার থাকবে। ছেলে বা মেয়েকে সম্পদের অধিকার প্রদানের পূর্বে বা পরে তিনি যদি কুলত্যাগ করেন তবে সেই কুলত্যাগী/কুলত্যাগিনী সমস্ত সম্পদের অধিকার হারাবেন। কারণ তিনি তাঁর জন্মকে ও জন্মপরিচয়কে অস্বীকার করেছেন। সম্পদ পাবার পর যদি তিনি কুলত্যাগী/কুলত্যাগিনী হন তবে কুলত্যাগ এর সাথে সাথে প্রাপ্ত সম্পদ পিতা বা মাতা বেঁচে থাকলে তাঁদের নিকট হস্তান্তরিত হবে। কারণ উক্ত সম্পদ তার উপার্জিত নয়। যদি পিতা বা মাতা জীবিত না থাকেন তবে প্রাপ্ত সম্পদ ভাই বা বোনদের মধ্যে সমহারে বন্টন করা হবে। ভাই বা বোন যদি না থাকে তবে প্রাপ্ত সম্পদ রক্তসম্পর্কিতদের মধ্যে বন্টন করা হবে। এক কথায় সনাতন কুলত্যাগ করলেই তিনি কোনো প্রকারের সম্পদের অধিকার পাবেন না। এই বিষয়গুলি আইন দ্বারা নির্ধারিত হোক। আইন দ্বারা নির্ধারিত না হলেও অনেকগুলি দাবি আমরা আপাতত আমাদের সচেতনতা দ্বারাই পূর্ণ করতে পারি। আমাদের সম্পদ আমাদেরকেই রক্ষা করতে হবে। প্রয়োজনে নিজের আবেগের চাইতে বৃহত্তর স্বার্থকেই প্রাধান্য প্রদান করতে হবে। নারী অধিকার নিশ্চিত করতে না পারলে আমাদের পক্ষে শক্তিশালী সনাতন সমাজ গঠন করা সম্ভব হবেনা।
৭। সব সম্প্রদায়ের সাথে একটি সোপান তৈরী করাঃ
পারস্পরিক অবিশ্বাস, সন্দেহ, অশ্রদ্ধা, অহংকার আমাদেরকে ঐক্যহীন করেছে। নানা গুরু, নানা ধর্মমত, ধারা-উপধারায়, বিভক্ত হয়ে সামান্য ধর্মীয় উপাদান বা আচার-আচরণকে প্রধান জ্ঞান করে একদা শক্তিশালী হিন্দুরা আজ বহুধাবিভক্ত। ফলে হিন্দুরা আজ দুর্বল জাতি। দিন দিন দুর্বল হচ্ছে আরো। এই ক্রান্তিকালে ঘুরে দাঁড়ানো ছাড়া বিকল্প নেই। বেদ আমাদের মূল ধর্মগ্রন্থ। বেদচর্চার পরম্পরা সমাজে ফিরিয়ে এনে হিন্দুরা আবার পরাক্রমশালী অজেয় জাতিসত্তায় আর্বিভূত হতে পারে।
তবে ঐক্যের স্বার্থে অবিভক্ত ও অমীমাংসিত বিষয়গুলিকে যে যার মত করে পালন করুন। কেউ কারো মুখোমুখি হবেননা। সকল মত ও পথের পথিকরা এক ও অভিন্ন এই কথাটা আমাদের সকলকে মনে রাখতে হবে। সনাতন ধর্ম বৈচিত্র্যে ভরপুর। নানা বৈচিত্র্যের মাঝেই ঐক্য – এটাই আমাদের ধর্মের অন্যতম সৌন্দর্য্য।
৮। যৌথ পরিবার প্রথার পুনঃ জাগরণঃ
যৌথ বা একান্নবর্তী পরিবার সৃষ্টি হয়েছে সনাতন সমাজ থেকেই। অথচ আমরা আত্মবিস্মৃত হয়ে ভগ্ন ও একক পরিবারকেই আমাদের নিয়তি ধরে নিয়েছি। যৌথ পরিবার থেকে একটা ছেলে/মেয়ে যে ভাবে শিক্ষা নিয়ে বেড়ে উঠে একক পরিবার থেকে সেই ভাবে বেড়ে উঠতে পারেনা। কারণ শিশুর প্রথম শিক্ষা পরিবার থেকেই গ্রহণ করে থাকে। বলার অপেক্ষাই রাখে না যে, সামাজিক নিয়ম কানুনের বিষয়গুলি বই পড়ে যতটুকু শিক্ষা গ্রহণ করা যায়, তার থেকেও অধিক উপযোগী সামাজিক শিক্ষা যৌথ পরিবার থেকেই অর্জন করা যায়। যৌথ পরিবার থেকে বেড়ে উঠা ছেলে-মেয়েরা একক পরিবারের ছেলে-মেয়েদের তুলনায় অনেক গুণ বেশি সহনশীল, আচারনিষ্ট ও চরিত্রবান হয়। যৌথ পরিবার ভেঙ্গে একক পারিবারিক ব্যবস্থাকে গুরুত্ব প্রদান করার কারণে সনাতন সমাজ পেয়েছে অসহিষ্ণু, ধর্মহীন, তথাকথিত আধুনিক ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাব সম্পন্ন একটি নাজুক জাতি। ‘সনাতন’ সংগঠন এই সমাজ ব্যবস্থার উত্তরণ ঘটিয়ে যৌথ পারিবারিক ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তনে প্রতিনিয়ত উৎসাহ প্রদানে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে।
৯। সমাজ থেকে কু-প্রথা দূর করাঃ
‘সনাতন’ সংগঠন কোন ধরণের তাবিজ, কবজ, ওঝা বা তথাকথিত কাল্পনিক জাদু-টোনায় বিশ্বাসী নয়। মানুষের মনের দুর্বলতাকে পুঁজি করে অনেক মানুষকে সর্বস্বান্ত হতে হচ্ছে। সুতরাং কোন ধরনের কুপ্রথাকে আমরা আশ্রয় ও প্রশ্রয় দেব না। তাবিজ কবজ দিয়ে বিদ্যার্জন, চিকিৎসা, চাকুরির সমাধান হলে এত এত স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, বিজ্ঞানীর প্রয়োজন হতো না। এমনকি ধর্মীয় কিংবা লোকাচারের নামেও কু-প্রথা সমূহকে আমরা সমূলে উচ্ছেদ করতে চাই।
১০। বিধবা প্রথা ধরণের আলাদা কোনো প্রথা থাকবে নাঃ
আমরা মনে করি এর কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। কারো স্বামী মারা গেলে সে স্বামীহারা হতে পারে কিন্তু তাকে বিশেষ পোষাক ও বিশেষ খাদ্য গ্রহণে বাধ্য করা এবং সামাজিক সমস্ত শুভ কাজে অংশগ্রহণের অধিকার হরণ করা অন্যায়।
১১। বৃদ্ধাশ্রম সমাজের ক্ষতঃ
বৃদ্ধাশ্রমের উপস্থিতি সামাজিক নির্মমতার চূড়ান্ত রূপ। এমন পুত্র-কন্যা কোন সমাজ জন্ম দেয় যারা ঈশ্বরতুল্য আপন জনক-জননীকে নিজেদের জীবন থেকে সরিয়ে দেয়? এ নিয়ে মনস্তাত্বিক গবেষণার প্রয়োজন আছে। যে সমাজ এরূপ কুসন্তান জন্ম দেয় সে সমাজের ক্ষত সারাতে হবে। আমরা চাই সমস্ত বৃদ্ধাশ্রম পৃথিবী থেকে উঠে যাক।
১২। রাজসিক ও তামসিক নয়, সাত্ত্বিক পূজা চাইঃ
পূজার সময় অসহনীয় শব্দদূষণকে আমরা সমর্থন করিনা। আমরা চাই পূজা হবে সাত্ত্বিক ভাবে। আরতি হবে ঢোল, কাঁসা, শাঁখ ও ঘন্টার মাধ্যমে, যা সনাতন চিরন্তনী ঐতিহ্য। কিন্তু পূজার সময় ডিজে এবং মাত্রাতিরিক্ত অলোক সজ্জার আয়োজনকে আমরা সমর্থন করি না। এটা সামাজিক অবক্ষয়ের চূড়ান্ত রূপ। আনন্দ সবাই উপভোগ করতে চায়। আর তা একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সুশৃঙ্খলভাবেই করা সম্ভব। শব্দ অবশ্যই শ্রবণ সীমার মধ্যেই থাকতে হবে। নিজ ধর্ম পালনের সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন অন্যধর্মাবলম্বীদের ধর্ম পালনে কোন বিঘ্ন না ঘটে। দু:খের সাথে বলতে হয়, অনেক কিশোর-কিশোরী পূজা আয়োজন ও প্রতিমা বিসর্জনের সীমাহীন আড়ম্বরের কারণে বিনোদন হিসেবে মাদক গ্রহণ করে ফেলে। এটা আজকের করুণ বাস্তবতা। তাছাড়া পূজার আয়োজন সর্বজনীন হওয়া উচিত। ব্যক্তিগত, পারিবারিক পূজা অনেক সময় সামাজিক অনৈক্যের সূত্রপাত ঘটায়। এসব বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিল লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে ‘সনাতন’।
১৩। সনাতন পূজা পদ্ধতির প্রকৃত উদ্দেশ্যঃ
বৈদিক যাগ-যজ্ঞ থেকেই আমাদের পূজাপদ্ধতির প্রচলন হয়েছে। প্রাচীন ঋষিরা অনুধাবন করেছিলেন মানব দ্বারা প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটবে। প্রকৃতির শক্তি যে ঈশ্বরের শক্তি সেটা মানুষ বিস্মৃত হয়ে প্রকৃতির সুষম সমন্বয়কে বিঘ্নিত করবে। প্রকৃতপক্ষে প্রকৃতি নিয়মে বন্দী। এই কারনেই প্রাকৃতিক সমন্বয়হীনতা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণ হয়। আমাদের পুজা পদ্ধতিতে যে সকল উপকরণগুলি ব্যবহৃত হয়ে থাকে সেগুলি মূলত ঔষদি, ফলজ ও বনজ বৃক্ষ থেকেই সংগৃহীত হয়। আবার ফুলের ব্যবহার অনিবার্য। একবার নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করুন - কেন আমরা ফুল, বেলপাতা, ধূপ, ফল, আমপাতা, তুলসী পাতা, দূর্বা, বট, অশ্বথ, নিম, চন্দন, বিভিন্ন উৎসের জল, কলাপাতা ইত্যাদি ব্যবহার করে থাকি? আমাদের ইষ্ট দেবতারা কি এই সকল পাতা খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করেন? প্রকৃত পক্ষে আমাদের ঋষিরা আমাদের এই নিয়ম নীতির মাধ্যমে প্রকৃতিকে রক্ষার বিষয়টিকে গুরুত্ব প্রদান করেছেন। আমাদের যেহেতু পূজা করতে হবে সেহেতু আমাদেরকে এসব বৃক্ষ সংরক্ষণও করতে হবে। এই কারণে প্রতি হিন্দুবাড়িতে কিছু গাছ অবশ্যই থাকবে। যেমন: তুলসী, ফুল, বেল, নারিকেল, কলা, নিম, বট, অশ্বথ, আম প্রভৃতি গাছ। শহরে স্থান সংকুলন না হবার কারণে বড় গাছ লাগাতে না পারলেও তুলসী এবং বিভিন্ন প্রজাতির ফুল গাছ রোপণ করে থাকি আমরা। সুতরাং আমরা মূলত প্রকৃতিকেই বন্দনা করি। আবার লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, আমাদের দেব-দেবীরা এক এক জন এক এক প্রাণীকে ধারণ করেছেন নিজেদের বাহণ রূপে। এর মানে কিন্তু এই নয় যে, দেব-দেবীরা ঐ প্রাণীগুলি ছাড়া চলতে পারেন না। প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেব-দেবীর বাহন যখন সাপ, পাখি, পশু তাই আমরা তাদের নিধন করিনা বিনা কারণে। এই ভাবে পূজা পদ্ধতি আমাদেরকে প্রকৃতি পূজার কথাকে মনে করিয়ে দেয়, যা প্রকৃত পক্ষে বেদের মূল জ্ঞান থেকে আমরা অর্জন করেছি। আমরা আত্মবিস্মৃত হয়ে শুধু তামসিকতাকে পূজার প্রধান উপযোগিতা বানিয়ে ফেলেছি। তাই প্রকৃত সত্যকে অনুধাবন করে আমাদের আচার পালন করা উচিৎ বলে আমরা মনে করি। এর পরও থাকছে পূজার সামাজিক আবেদন। তাই বলতে পারি পূজা পদ্ধতি একটা অনন্য সৃষ্টি যা ঈশ্বরের দর্শনের সাথে আমাদেরকে একীভূত করছে।১৪। বিবাহের নামে ৭ টি অনুষ্ঠান সময় ও অর্থের অপচয়ঃ
বিয়ে বৈদিক মতে মন্দিরে হতে হবে বা যেখানে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত রয়েছে বা যেখানে প্রতিদিন নারায়ণ পূজা হয় সেখানে।
সনাতন রীতিতে বিয়েতে ৭ টি অনুষ্ঠান কে আমরা শ্রদ্ধার সাথে গ্রহণ করি কিন্তু ঐ ৭ টি অনুষ্ঠানে (আশীর্বাদ, বস্ত্রালংকার, বিয়ে, বাসি-বিয়ে, বৌ-ভাত, জামাই-ভাত, বেয়াই-ভাত) অনেক লোক খাওয়ানোর রীতির নামে কন্যাপক্ষকে অন্যায় চাপ প্রদান করাকে আমরা সমর্থন করিনা, উভয় পক্ষ মিলে একটি অনুষ্ঠান (লোক খাওয়ানোর রীতি) করে বিবাহ সম্পূর্ণ করাকেই আমরা সমর্থন করি।
কিছু কিছু অঞ্চলে, যেমন চট্টগ্রামে, কম্যুনিটি সেন্টারে বিয়ে অনুষ্ঠান করার একটি অলিখিত বাধ্যবাধকতা আছে। সামাজিক মিথ্যা মর্যাদাবোধ ও তথাকথিত স্ট্যাটাস বৃদ্ধিতে এটা সহায়তা করে অনেক মূঢ় মানুষের বিশ্বাস। এই বিশ্বাস সমাজ ও ধর্মের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। কম্যুনিটি সেন্টার বিয়ে করার কুপ্রথা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। অনেক হিন্দু পরিবার নি:স্ব হয়ে যায় বিশেষ দিনে মানে লগ্নের দিন কম্যুনিটি সেন্টার ভাড়া করতে গিয়ে। অনেক সাধারণ হিন্দু পরিবার সারা জীবনের সঞ্চয় তুলে দেয় কম্যুনিটি সেন্টারের মালিকের হাতে। এটা করতে বাধ্য করে হিন্দু সম্প্রদায়েরই একটা মুর্খ অংশ। এ অপব্যয় না হলে বর কনে বা উভয় পক্ষ তাদের এ সঞ্চয় পারিবারিক কাজে ব্যয় করতে পারতো বা ভবিষ্যতের জন্য রেখে দিতে পারত।
আমরা চাই বিয়ের মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানটা মন্দিরেই হতে হবে; লগ্নের দিন। এরপর সুবিধামত সময়ে কনে এবং বর পক্ষ মিলে একটি নিমন্ত্রণ অনুষ্ঠান করলে ক্লাবগুলি আমাদের থেকে বাড়তি অর্থ আদায় করতে পারত না। বাংলাদেশের কোনো কোনো এলাকায় মালিকরা যেহেতু লগ্ল অনুযায়ী তাদের কম্যুনিটি সেন্টার ভাড়া বহুগুণ বাড়িয়ে দেয় শুধুমাত্র ঐ রাতের জন্য, যেদিন হিন্দু সম্প্রদায়ের বিয়ের লগ্ন আছে; আমরা চাই হিন্দু সমাজ সর্ম্পূণ পরিত্যাগ করবে কম্যুনিটি সেন্টারে বিয়ে। তাছাড়া কম্যুনিটি সেন্টার অপবিত্র স্থান, (হরদম গরু কাটা হচ্ছে, রান্না হচ্ছে, একই ডেকচিতে সকালে গরু, বিকালে হিন্দু বিয়ের রান্না) বিয়ের মতো একটি পবিত্র কাজ কম্যুনিটি সেন্টারে হতে পারে না। তাই সনাতনে সংগঠনের তরুণরা এসব অঞ্চলে কোনো কম্যুনিটি সেন্টার অনুষ্ঠিত বিয়ের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করে না।
মন্দিরভিত্তিক বিয়ে না হলে তা যাতে সামাজিক মর্যাদা না পায় তার ব্যবস্থা করতে চাই আমরা।
সরকারী ভাবে বিবাহকে নথিভুক্ত করতে হবে যা শুধু মাত্র সরকারী সনদের জন্যে; কোন অবস্থাতেই ডিভোর্সের জন্যে নয়। আর সরকারীভাবে বিবাহকে নথিভুক্ত করলেই সনাতনী সমাজে স্বামী- স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ শুরু হয়ে যাবে এই ধারণা সঠিক নয়- এটা হাস্যকর একটা চিন্তা। আমরা বৈদিক মতে ঈশ্বরকে ও অগ্নিকে সাক্ষী রেখে স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে গ্রহণ করি এবং আমাদের বন্ধন এত দুর্বল নয় যে তা নথিভুক্ত করলেই ছিন্ন হবে।
১৫। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতাঃ
বাংলাদেশ সরকারের প্রচলিত সমস্ত আইন এর প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল। আমরা মনে করি সরকারও আমাদের অধিকারের প্রদানের ক্ষেত্রে সচেতন। ‘সনাতন’ এর কোন সদস্য যদি সরকার বিরোধী কোন কাজে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে যুক্ত থাকেন তা তিনি নিজ দায়িত্বে করবেন। তার সাথে সনাতনের কোন সম্পর্ক থাকবেনা। আইন অমান্যকারীকে আমরা ঘৃণা করি। কোন ধরনের রাজনৈতিক কাজে ‘সনাতন’ সংগঠনকে ব্যবহার করা যাবে না। রাজনীতির সাথে সনাতনের কোন সম্পর্ক নেই। এটি একটি অরাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন।
১৬। গুরুকুল প্রতিষ্ঠাঃ
এই গুরুকুলে থাকবে বিজ্ঞান, অর্থনীতি, ইতিহাস,শরীরচর্চা, দর্শন সহ সকল ধরনের প্রগতিশীল শিক্ষা ব্যবস্থা। শিশু-কিশোর মানসিক ও শারীরীক বিকাশের জন্য থাকবে সাংস্কৃতিক চর্চা ও খেলাধূলার ব্যবস্থা। ছাত্র-ছাত্রীরা লেখাপড়ার পাশাপাশি কর্মমুখী শিক্ষায় অভ্যস্থ হবে গুরুকুলে। হস্তশিল্পের কাজ করতে হবে সকল ছাত্র-ছাত্রীকে। পরম্পরার শিক্ষা দেওয়া হবে গুরুকুলে। সনাতন ধর্ম ও দর্শনের চর্চা ও গবেষণা হবে গুরুকুলে। প্রকৃত শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র হিসাবে আমরা গুরুকুলের প্রতিষ্ঠা করতে চাই।
সনাতনের কয়েকটি প্রধান কর্মসূচীঃ
আমরা বেদশিক্ষাকে তরুণদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাই। হাজার হাজার বেদজ্ঞানী তরুণ সৃষ্টি করতে চাই। সঠিক বেদচর্চা ও তার জ্ঞানই একমাত্র আমাদের অভিন্ন জাতিসত্তায় আত্মপ্রকাশ ঘটাতে সাহায্য করতে পারে। অনতিবিলম্বে এ কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছি আমরা।দেশে ঘটমান, জাতিগোষ্ঠীর উপর যে কোনো অন্যায় বা আঘাতের উপর আমরা নজর রাখতে চাই। কোনো ঘটনাই যেন বিচারহীনতায় হারিয়ে না যায়, দেশের যে কোনো প্রান্তে কোনো হিন্দুর উপর আঘাত ‘সনাতনে’র উপর আঘাতের সামিল বলে ভাবি আমরা; স্বাধীনতার পর থেকে আজ অবধি নিয়মিত মুহুমুর্হ চলমান ঘটনাসমূহের প্রেক্ষিতে আজ আমরা এভাবে ভাবতে বাধ্য হয়েছি। দুর্বৃত্তদের দমন ও আইনের আওতায় নিয়ে আসা নিয়মিত হলে এসব ঘটনার অবসান হবে। কোন ঘটনাই আমরা হারিয়ে যেতে দিতে পারি না, প্রয়োজনে নিয়মিত সেমিনার, ফেসবুক পেজে উপস্থাপন ও অন্যান্য উপায়ে সকল নির্যাতন ও বঞ্চনার ঘটনা আমরা তুলে ধরব। আমরা কখনোই নিজদের হাতে আইন তুলে নেব না।
আমাদের আইনজীবী ফোরাম থাকবে, নিরাপত্তার স্বার্থে যে সম্প্রদায়ের উপর হামলাকারী দুবৃর্ত্তদের আইনের হাতে নিয়ে আসতে এ ফোরাম নিয়মিত কাজ করবে। এভাবে আমরা যে কোনো প্রান্তে যে কোন ভিকটিমের পাশে দাঁড়াতে চাই।
ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে আলোচনা সভা যামেধা অনুসারে উপযোগী শিক্ষা পদ্ধতি গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
মাতৃ-সম্মেলন করে পারিবারিক ধর্ম শিক্ষার ও চর্চার পুন: জাগরণ ঘটানো।
পেশাজীবী সম্মেলন করে কর্ম সংস্থান সৃষ্টি ও বিভিন্ন পেশা সম্পর্কে যুবকদের ধারনা দেয়া। যেখানে নানা পেশায় সফল ব্যক্তিবর্গ তাদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করবেন যাতে তরুণরা নানা পেশা বিষয়ে সম্যক ধারণা লাভ করতে পারে।
অসহায়, শিক্ষা ও চিকিৎসাবঞ্চিত জনগণের পাশে দাঁড়াবে সনাতন। কোনো মন্দির প্রাঙ্গণে নিয়মিত ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প চালুর পরিকল্পনা। একইসাথে ফ্রি ওষুধ বিতরণ।
মেধাবী কিন্তু দরিদ্র কোনো তরুণ যেন শুধুমাত্র অর্থাভাবে শিক্ষাবঞ্চিত না হয়, যেন সফলভাবে তার শিক্ষাজীবন সম্পন্ন হয়, তার ব্যবস্থা করা।
কোনো অবস্থাতেই দেশত্যাগ সমাধান নয়। এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি ও পারষ্পরিক ঐক্যের মাধ্যমে আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনা।
নিয়মিত মিটিং অব্যাহত রাখা। যেন কর্মীদের আন্ত:সম্পর্ক ও ঐক্য অটুট থাকে এবং একটি শক্তিশালী ও সংঘবদ্ধ শক্তিতে রূপান্তরিত হতে পারে সনাতন।
নিয়মিত প্রকাশনা। যাতে ধর্মীয়, সামাজিক নানা চিন্তা ও কার্যপরিকল্পনার উপস্থাপন থাকবে। মত বিনিময় থাকবে। নানা কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের প্রচেষ্টা থাকবে। প্রকাশনা ও সনাতনের বার্তা নিয়ে কর্মীরা সারাদেশের প্রতিটি হিন্দু বাড়িতে উপস্থিত হবে।
আমাদের জনগোষ্ঠির প্রত্যেকের পাঁচটি মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য সব করণীয় স্থির করতে নিরলস শ্রম ও সাধ্যমত উদ্যোগ অব্যাহত রাখা।
‘সনাতন’ হল একটা ভাণ্ডার, যেখানে সকল সদস্য তাঁদের ধর্মীয় ও সামাজিক চিন্তা-চেতনা ও পরিকল্পনা তুলে ধরবেন এবং তাতে নিজের যুক্তি এবং বুদ্ধি দিয়ে সে চিন্তাকে আরো বিকশিত করবেন সকলকে। সুতরাং সনাতন হল পারস্পরিক জ্ঞান, ভাবনা, চিন্তা-চেতনা ও পরিকল্পনা আদান প্রদান এর স্থান। যার মূল উদ্দেশ্য হবে হিন্দু সম্প্রদায়ের কল্যাণ সাধন।
** নিচের লিংক এ লাইক দিয়ে সনাতন পেইজের সাথে যুক্ত হতে সকলকে অনুরোধ করছি।
কোন মন্তব্য নেই