বেদ ও ভারতের আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য- পর্ব ০২
স্বামী সমর্পণানন্দ
১ম পাঠ ২য় পর্ব
১ম পাঠ ২য় পর্ব
হিন্দু জাতি বা ধর্ম বলতে যা বোঝায় তার সব কিছুই, বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা, পূজার বিভিন্ন পদ্ধতি, যাগ-যজ্ঞ, দর্শন সব কিছু সরাসরি বেদ থেকেই এসেছে, বেদের বাইরে কিছু পাওয়া যাবে না। হিন্দু ধর্মে এমন কোন কিছুই পাওয়া যাবে না যার কথা বেদে বলা হয়নি। এখন প্রশ্ন আসতে পারে তাহলে হিন্দু ধর্মের পুরান, তন্ত্র, রামায়ণ, মহাভারত, গীতা ইত্যাদি যে সব বিভিন্ন শাস্ত্র রয়েছে তাহলে এদের সাথে বেদের কি সম্পর্ক। বেদ হচ্ছে সমস্ত শাস্ত্রের মূল। কিন্তু বেদে কিছু কিছু বিধিবাদ আছে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে বেদের সীমা রেখা টেনে দেওয়া হয়েছিল। এর ফলে বেদের শিক্ষা জনসাধারণের মধ্যে সম্প্রসারিত করা সম্ভব হচ্ছিল না। তখন মহান আচার্য্যরা বেদের শিক্ষাকে জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেবার জন্য অন্য কোন মাধ্যমের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। এই অনুভব থেকেই ভারতে হিন্দুধর্মের বিশাল শাস্ত্র সমুদয়ের সৃষ্টি হয়েছিল।
সব থেকে মজার ব্যাপার হল দুই হাজার বছর থেকে আজ পর্যন্ত হিন্দুরা বেদ বলে যে তাদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ আছে জানলেও বেদকে চোখেই দেখেনি। কিন্তু কোন হিন্দুকেই পাওয়া যাবে না যে বেদের প্রতি তার অশ্রদ্ধা মনোভাব পোষণ করবে। হিন্দু মানেই তাকে বেদকে স্বীকার করতে হবে, যেটা বেদ বলবে সেটা করা হবে, যেটা বেদ বলবে না সেটা করা যাবে না। পরবর্তী কালে হিন্দু ধর্মের যত শাস্ত্র রচিত হয়েছে সব শাস্ত্রেই এই নিয়মকে অনুসরণ করা হয়েছে তাকেই অনুসরণ করা হয়েছে। যদি কেউ জিজ্ঞেস করে হিন্দু কাকে বলা হয়? এই প্রশ্নের একটাই পরিষ্কার উত্তর- যে বেদকে Ultimate authority বলে মনে করে। যিনি বেদ পড়েছেন তাকেই হিন্দু বলা হবে না, বেদের কথাই হচ্ছে শেষ কথা এই বিশ্বাস যার আছে সেই হিন্দু।
ভারতে দুই ধরণের দর্শনের আবির্ভাব হয়েছে- একটা হচ্ছে আস্তিক দর্শন আর দ্বিতিয়টি হচ্ছে নাস্তিক দর্শন। আমরা সচরাচর মনে করি যার ঈশ্বরে বিশ্বাস আছে তাকে আস্তিক বলা হয় আর যে ঈশ্বরকে মানে না তাকে নাস্তিক বলা হয়। কিন্তু যখন আমরা দর্শন শাস্ত্র অধ্যয়ন করতে যাব তখন দেখতে পাই দর্শনে আস্তিক কথার অর্থ যিনি বেদকে Ultimate authority হিসাবে মানেন আর যারা দর্শনে বেদের কথাকে শেষ কথা বলে মানে না তাদের দর্শনকে নাস্তিক দর্শন বলা হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে আস্তিক দর্শনে এমন অনেক দর্শন আছে যেখানে ঈশ্বর বলে কোন শব্দ তো নেইই আর তারা ঈশ্বরকেও মানে না। অথচ বেশির ভাগ মানুষ মনে করে যারাই হিন্দু ঋষি, দার্শনিক সবাই ঈশ্বর মানেন। কিন্তু খুব মনোযোগ সহকারে যদি হিন্দু-দর্শনগুলিকে বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে দেখা যাবে শঙ্করাচার্যের আগে পর্যন্ত এমন অনেক হিন্দু দার্শনিক ছিলেন যাঁরা আদপেই ঈশ্বর বলে কেউ আছেন বলে মানতেন না, অথচ তাঁরা ছিলেন প্রচণ্ড ধার্মিক ও উচ্চ আধ্যাত্মিক সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। এর কারণ হচ্ছে বেদে আধ্যাত্মিক সত্তাকে বিভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, এখানে বেদ উপনিষদ সব মিলিয়েই বলা হচ্ছে, সেই ব্যাখ্যাগুলিকে যে যেভাবে নিতে শুরু করবে, ঈশ্বরকে মানা না মানাটাও সেইভাবে নির্ধারিত হবে। কেউ যদি বলেন আমি ঈশ্বর মানিনা, তা সত্ত্বেও তিনি একজন উচ্চকোটির ঋষি হতে পারেন। তখনকার দিনে যাঁরা চার্বাক দর্শনের অনুগামী ছিলেন এবং পরবর্তী কালে বৌদ্ধ, জৈনরা বেদকে Ultimate authority বলে মানতেন না। জৈন বা বৌদ্ধ দর্শন যদি খুব গভীর ভাবে অধ্যয়ন করা হয় তাহলে দেখা যাবে যে বেদের আধ্যাত্মিক সত্তাকে তারা অস্বীকার করছে না, কিন্তু একটা জায়গাতে এসে তারা বেদের সাথে অমত প্রকাশ করছে। প্রথম যেটা হচ্ছে তারা বেদকে Ultimate authority বলে মানবে না আর বেদের বর্ণপ্রথাকে বৌদ্ধ ধর্ম মানে না। এই দুটো জিনিষকে মানেনা বলে বৌদ্ধ ধর্ম হিন্দু থেকে আলাদা। এই দুটো প্রভেদকে যদি সরিয়ে দেওয়া হয় তখন বৌদ্ধ দর্শন পড়ার সময় বোঝাই যাবে না যে আমি বৌদ্ধ ধর্মের দর্শন পড়ছি না উপনিষদ পড়ছি।
পুরো বেদকে যদি খুব ভালো করে খতিয়ে দেখা হয়, তাহলে আমরা বেদে কি পাব? এই বিশাল গ্রন্থে এনারা এতো কথা কি বলছেন? তখন দেখা যাবে একটা জিনিষকেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলা হয়েছে, আর তা হচ্ছে চতুর্বর্গ পুরুষার্থ। এই চতুর্বর্গ বেদ থেকে এসে ধীরে ধীরে সমস্ত হিন্দুদের মধ্যে ছড়িয়ে গেছে। চতুর্বর্গ পুরুষার্থের পুরুষার্থ কথার অর্থ হচ্ছে জীবনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য, প্রত্যেক মানুষের জীবনে চারটে উদ্দেশ্য- ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ। অর্থ হচ্ছে যাদের লক্ষ্য জীবনে প্রচুর অর্থোপার্জন করব, জমি, বাড়ি, গাড়ি বানাব। কাম হচ্ছে যারা জীবনে প্রচুর ভোগ করতে চাইছে, ভালো খাবো, বেড়াব, দামী দামী সাজ-পোষাক দিয়ে নিজেকে সাজাব, আর সুখে থাকব। ধর্ম হচ্ছে পূজা, পাঠ, সকাল বিকেল মন্দিরে যাওয়া, ভোরে গঙ্গাস্নান, সাধুদের সেবা করা, দান ধ্যান করা ইত্যাদি। মোক্ষ হচ্ছে একমাত্র আত্মোপলব্ধিই যাদের লক্ষ্য।
এই চারটাকে কেন্দ্র করে হিন্দুধর্মের বিভিন্ন শাখা একটা আরেকটা থেকে আলাদা হয়ে যায়। যেমন কথামৃতে আমরা দেখতে পাই ঠাকুর অর্থ আর কামকে প্রায় পুরোপুরি বাদ দিয়ে রেখেছেন। কিন্তু কৃথামৃতেই অনেক জায়গাতে ঠাকুর ও কিন্তু সংসারীদের অর্থ সঞ্চয়ের কথা বলেছেন। ঠাকুর বলছেন টাকা দিয়ে কি হয়? সাধু সেবা হয়। আবার বলছেন দুটি সন্তান হয়ে গেলে স্বামী-স্ত্রী ভাইবোনের মত থাকবে। এখানে তো ঠাকুর দুটি সন্তানের কথা বলছেনই। ঠাকুর কিন্তু কোথাও কামিনী-কাঞ্চনকে উড়িয়ে দিতে বলেছেন। নারী হচ্ছে মা, সৃষ্টি এদের থেকে চলছে-এই কথা ঠাকুরই বলছেন। ঠাকুর কার জন্য কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগের কথা বলছেন? ঠাকুরের কাছে বিভিন্ন থাকের মানুষ আসছেন। একটা থাক হচ্ছে যারা শুধুই উচ্চ আধ্যাত্মিক অনুভূতির জন্য নিবেদিত। স্কুলে যখন বাচ্চারা ভর্তির জন্য আসে তাদের মধ্যে কিছু ছেলের মধ্যে অত্যন্ত মেধা, প্রচণ্ড বুদ্ধি দেখতে পাওয়া যায়, এদের প্রশিক্ষণ পুরোপুরি আলাদা হয়, অন্যান্য বাচ্চাদের থেকে এদের অনেক সামলে সুমলে রাখতে হয়। জাগতিক অর্থে আমরা যা বুঝে থাকি সে ধরণের কোন কিছু ঠাকুরের ছিল না, তাই ঠাকুরকে কখনও আমরা দেখতে পাই না যে তিনি কারোর রোগ ভালো করে দিচ্ছেন, কাউকে চাকরি করে দিচ্ছেন, মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না, সন্তান হচ্ছে না ঠাকুর তার ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। কিন্তু এই ঠাকুরই আবার মথুরবাবুকে টাকা পয়সার অনেক ঝামেলা থেকে বাঁচিয়েছিলেন, নরেনকে বলেছেন তোরা খাওয়া পড়ার অভাব হবে না। তিনি যাঁদের কে পুরোপুরি টেনে নিয়েছিলেন, যাদের মাধ্যমে তিনি তাঁর অবতারত্ব গ্রহণের উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করবেন, তাদের জন্যই তিনি সম্পূর্ণ ভাবে কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগের কথা বলেছিলেন। এরা যদি কামিনী-কাঞ্চন না ত্যাগ করে তাহলে এরা এগোতে পারবে না আর অবতারের কাজের দায়িত্ব নেওয়ার ক্ষমতাও হবে না। বাকীদের ক্ষেত্রে তিনি বলেছেন, কর্ম কর, অর্থোপার্জন কর, তবে যাই করবে ধর্ম পথে করতে বললেন। কেন ধর্ম পথে করতে বললেন? এই কারণে যে এটাই এর স্বাভাবিক, আমি নিষেধ করলেও তুমি কর্মের পেছনে ছুটবে। সংসারীদের যেমন বলে দিতে হয় না যে টাকা সব খরচ করবেন না, ব্যাঙ্কে কিছু রাখবেন, সংসারীরা এমনিতেই অর্থ সঞ্চয় করবেন।
এখন বেদে কেন অর্থ আর কামের কথা বলা হয়েছে? ঠাকুর কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগের কথা বলছেন অথচ বেদ চারটি পুরুষার্থের কথাই বলছে। আর পুরো বেদ, বিশেষ করে সংহিতাতে বলছে- প্রভু টাকা দাও, প্রভু সন্তান দাও। তাহলে কি ঠাকুর বেদবিরোধী কথা বলছেন? ঠাকুর যদি বেদবিরোধী কথা বলেন তাহলে হিন্দুরা প্রথমেই ঠাকুরকে ছুঁড়ে ফেলে দিত। এর উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে ফিরে যেতে হবে, বিশেষ করে পুরাণে যেখান দেখা যায় ব্রহ্মা প্রথম সৃষ্টি করলেন চার কুমারের- সনক, সনন্দন, সনাতন ও সনৎকুমারদের। ব্রহ্মার মানসপুত্র হওয়ার জন্য এই চার কুমারেরা ত্যাগ বৈরাগ্যেতে পূর্ণ ছিলেন। এঁরা জন্ম নিয়েই দেখছেন আমরা কোথায় সংসারে এসে ফেঁসে গেছি, সঙ্গে সঙ্গে কমণ্ডলু তুলে নিয়ে চার কুমার সংসার ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। ব্রহ্মা পড়ে গেলেন মহা মুস্কিলে, এত কষ্ট করে চারটে ছেলেকে সৃষ্টি করলাম যাতে এরা সৃষ্টিটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, কিন্তু সংসারকে ছেড়ে দিয়ে এরা তপস্যাতে চলে গেল। এখন সৃষ্টি চলবে কি করে? ব্রহ্মা তখন আবার নতুন করে সৃষ্টি করলেন। এবার যাদের সৃষ্টি করলেন যদিও এরা আগের চার কুমারের মত প্রচণ্ড বৈরাগ্যবান ছিলেন না, কিন্তু প্রায় ঐ রকমই হলেন। এরা বিয়ে করেছেন কিন্তু সংসার কাজে কোন ভাবেই সম্পর্ক না রাখাতে সমস্যা দেখা দিল। এই রকম ঋষিদের আরও বড় সমস্যা হয়ে গেল। ঋষিরা বিয়েথা করে গৃহস্থধর্ম পালন করতেন, কিন্তু কিছুতেই তাঁরা সন্তানের জনক হতে চাইতেন না। এই রকমই হয়, যাঁরাই খুব বেশি ধর্মপ্রাণ পুরুষ হন, তাঁদের মন কিছুতেই জাগতিক কোন ব্যাপেরে দিতে চাননা। দেখা যেত গুরু যদি পূর্ণ ত্যাগী হতেন তখন তাঁর শিষ্যরাও গুরুর মত হয়ে যেতেন, সাংসারিক ব্যাপারে সমস্ত আগ্রহ হারিয়ে কেমন একটা উদাস উদাস ভাবে থাকতেন। এটাকে আটকানোর জন্য অর্থ আর কামের কথাও বলা হয়েছিল।
ভারতের এটা একটা জাতীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে জাগতিক ব্যাপারে ভারতীয়রা কোন আগ্রহই অনুভব করত না, যার ফলে যারা আধ্যাত্মিক পথে অজ্ঞ ছিলেন তাদেরকে অলসতা আর নিষ্কর্মতা গ্রাস করে কুসংস্কারে আচ্ছন্ন করে দিত। গত আট দশ বছর ধরে ভারতের লোকেরা বুঝতে পারল যে সুস্থ দেশের এইটাই ছিল জাতীয় রোগ, এখানে প্রেমের কবিতা লিখে দেবে কিন্তু কিছুতেই অর্থ আর কামের জন্য খাটবে না। আমাদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন ঋষি, আমাদের শিক্ষা-দীক্ষা সব ঋষিদের কাছ থেকে পরস্পরা ভাবে এসেছে। ফলে কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ আমাদের কাছে স্বাভাবিক। কিন্তু অন্য দিকে মনের মধ্যে কামিনী-কাঞ্চনের বীজ রয়েছে, বীজ রয়েছে, বীজ না থাকলে তো সে মুক্ত পুরুষ হয়ে যেত, আকাঙ্ক্ষা রয়েছে কিন্তু খাটবে না, কায়িক শ্রমে সব বিমুখ। কায়িক শ্রমবিমুখতার জন্য তাদেরকে জোর করে কাজে লাগাবার জন্য বলা হত- ওহে ভাই তুমি কি মোক্ষ লাভ করতে চাইছ? মোক্ষের কথা শুনেই বলবে- না না, ওসব মোক্ষ-টোক্ষতে আমার মোটেই বিশ্বাস নেই ওসব ফালতু কথা। তাহলে তুমি ধর্ম কর্ম কি করবে? ধর্ম! না না, শীতের মধ্যে ভোর চারটেয় গঙ্গাস্নান আমার দ্বারা হবে না। ঠিক আছে, তুমি যখন ধর্ম ও মোক্ষ কোনটাই পারবে না তখন তুমি অর্থ সাধন ও কাম সাধন কর। কিন্তু বেশির ভাগই অর্থ ও কাম সাধন না করে চাইত জীবন যেমন ভাবে চলছে চলতে থাকুক। ধর্ম ও মোক্ষ তো দূরের কথা এদের শরীর কাম সাধনেরও উপযুক্ত নয়, কারুর হজমের গোলমাল, কারুর ব্লাডপ্রেসার, কারুর হাঁপানি। তিন কিলো মিটার হাঁটতে দিলেই হাঁটু আর বুকে ব্যাথা হয়ে যাবে। খেতে দিলে বলবে আমার খাবারে তেল মশলা কম দেবেন এগুলো আমার সহ্য হয় না, এসিড হয়ে যায়। আবার এদিকে ব্যাঙ্ক-ব্যালেন্সও সেই রকম আহামরি কিছু নেই। পরিষ্কার ভাবেই বোঝা যাচ্ছে এদের শারীরিক ও মানসিক গঠন কোন সাধনের পক্ষেই যোগ্য নয়। ভারতে বেশির ভাগই এই শ্রেণীর লোক। সেইজন্য আমাদের বেদ বলেছিল- এই চারটের মধ্যে যে কোন একটাকে উদ্দেশ্য করে কিছু একটা কর। তাই বেদ কোন আজেবাজে কথা মোটেও বলেনি। মোক্ষ সাধন হচ্ছে সব কিছু ছেড়ে দেওয়া, নিজের শরীর যে এত প্রিয় সেই শরীরের মমত্বকেও ত্যাগ করতে হবে। এখন ভোরবেলা শীতকালে গঙ্গাস্নান করলেই সর্দি-কাশি হয়ে যাবে, এই হচ্ছে আমাদের শরীরের অবস্থা, তাই বেদ বলল-তুমি তো বাপু এসব পারবে না, তাই অর্থ আর কামের জন্য লেগে পড়।
কিন্তু কাম ও অর্থ সাধন যে মন ও বুদ্ধি দিয়ে করবে সেই মন-বুদ্ধিই হয়ে আছে মূঢ় ও বিক্ষিপ্ত। নির্দিষ্ট ভাবে কোন কিছুতেই একাগ্র হয়ে লেগে থাকতে চাইবে না। বেদ কাম ও অর্থ সাধনের পুরো ব্যাপারটাকে একটা নির্দিষ্ট দিকে নির্দেশ করে দিল। আর আমরা যা কিছুই করতে যাই না কেন আমাদের শেষ হাতিয়ার হচ্ছে মন। এই মন আর বুদ্ধি ছাটা তো আমাদের কিছু নেই। ঈশ্বর উপলব্ধি এই মন বুদ্ধি দিয়েই করতে হবে, ভালো মন্দ যা কর্ম এই মন বুদ্ধি দিয়েই করতে হয়। এই মন বুদ্ধিই যখন আমাদের প্রধান অস্ত্র তাই এই মন বুদ্ধিকে সর্বাগ্রে সাণিত করতে হবে। ঠাকুর বলছেন মানুষের মন হচ্ছে সরষের পুটলি, পুটলির মুখ খুলে সরষে ছড়িয়ে গেছে। বেদ এই ছড়ানো মনকে কুড়িয়ে আনতে সাহায্য করে। যখন আমরা কাম ও অর্থ সাধন অরতে থাকি তখন এই সাধনই আমাদের মনকে কুড়িয়ে নিয়ে একাগ্র করে উদ্দেশ্যের দিকে এগিয়ে দেয়। শুধু তাই নয়, এই সাধনের ফলে মানুষের মনে যে নানান কুবৃত্তি গুলি রয়েছে যেমন হিংসা, বিদ্বেষ, ক্রোধ, লোভ, চাহিদা ইত্যাদি এগুলিকেও নিয়ন্ত্রণ করতে খুব সাহায্য করে। ভারতের বেশির ভাগই হচ্ছে নিষ্কর্মা প্রকৃতির লোক। আইটি সেক্টরে একটা কথা আছে- বলা হয় ভারতে চাকরিত কোন অভাব নেই, এখানে অভাব কর্ম প্রবণতার।
এই কর্ম বিমুখতাকে কাটাবার জন্য বেদ এদের জন্য অর্থ আর কামের কথা বলল। এই অর্থ আর কামের সাধনা করে এদের চেতনা যখন একটু জাগ্রত হল তখন ধীরে ধীরে এদের মনকে ধর্মের দিকে নিয়ে যাবে। ধর্ম সাধন করার পর আস্তে আস্তে তাকে মোক্ষের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আরেক ধরণের দ্বিতীয় শ্রেণীর লোক আছে যারা খুব অতিরিক্ত মাত্রায় ছটফটে, এরা আবার প্রচণ্ড ক্ষমতা লোভী, মনে করে আমিই একা লুটেপুটে খাব। একদিকে এদের মনের ইতিবাচক আবেগ নেই, অন্য দিকে এরা আবার অন্যদের মত নিষ্কর্মাও নয় কিন্তু নেতিবাচক আবেগে মনটা আচ্ছন্ন হয় রয়েছে। নেতিবাচক আবেগ মানে হিংসা, বিদ্বেষ, ক্রোধ, লোভ, ঘৃণা ইত্যাদি। এরা বলবে- হ্যাঁ, আমি ধর্ম করব কিন্তু তার আগে আমি একে মেরে শেষ করব। যে চারিদিকে শত্রু তৈরী করে রেখেছে, একে মারব, তাকে শেষ করব, এই যাদের মনোভাব, এদের কি করে ধর্ম করতে বলবে! পৃথিবীর কোন ধর্মে কোথাও এদের ধর্মের দিকে মনটাকে ফিরিয়ে আনার কোন উপায়ের কথা বলা নেই। এদের মন সব সময় বিষিয়ে রয়েছে, এই ধরণের লোকের সব থেকে ভালো উদাহরণ হচ্ছে দুর্যোধণ, মেঘনাদ। দুর্যোধন আর মেঘনাদের মন সব সময় পাণ্ডবদের আর লক্ষণের বিরুদ্ধে হিংসায় পুড়ছে।
আপাত দৃষ্টিতে বলতে গেলে এদের জন্য ধর্ম নেই। সব ধর্মই এদের বলবে আগে তোমার মন থেকে এগুলো পরিষ্কার কর। কিন্তু বেদ সব সময় এদের জন্যও হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। বেদ বলবে তুমি তোমার শত্রুকে মারতে চাও? তাহলে এই নাও আমার শত্রু মারণ যজ্ঞ, এই যজ্ঞ করলে তোমার শত্রু মরবেই। এখন সে শত্রুকে মারার জন্য পুরোদমে নেমে যাবে যজ্ঞ করতে। যেমন মেঘনাদ নেমে পড়ল লক্ষ্মণকে মারতে যজ্ঞ করতে। কিন্তু কি হল? যজ্ঞের গল হবে কি হবে না আমাদের জানা নেই। কিন্তু মাঝ পথেকোন কারণে যজ্ঞটা পণ্ড হয়ে গেল। যজ্ঞ পণ্ড হয়ে যাওয়া, যজ্ঞ পণ্ড না হলে কি হত সেটা আমাদের কাছে গুরুত্ব নয়। গুরুত্বটা হচ্ছে, যজ্ঞের যে প্রস্তুতি পর্বে যজ্ঞাকর্তা খেটেখুটে যে এতো কিছুর যোগাড় করছে, এত আহুতি দিচ্ছে মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে, বিভিন্ন দেবতাদের আহবান করা হচ্ছে, এর ফলে মনটা কিছু কিছু শোধরাতে থাকে।
শাস্ত্রতো বলে দিল তোমার মনে যা নোংরা আছে এটাকে পরিষ্কার না করলে তোমার কিছুই হবে না। আমিও জানি আমার মনে নোংরা আছে। একটা বাচ্চা ছেলেও জানে যে তার খেলার দিকে মন বেশি, লেখাপড়াতে মন কিছুতেই দিতে পারছে না, আর এটাও সে জানে মন দিয়ে পড়লেই ভালো রেজাল্ট করতে পারবে। সে যদি বলে আমি মন খেলাতে দিতে চাইছি না, লেখাপড়াতেই মন দিতে চাইছি কিন্তু আমার মন খেলাতেই টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আমি জানি আমার দুর্বলতা কোথায়, কিন্তু আমি এই দুর্বলতাকে কাটাতে পারছি না। তখন আমরা তাকে কি পথ দেখাব? কোন পথ আমাদের কাছে নেই? আমরা কোন পথা দেখাতে পারিনা। কিন্তু বেদ বলবে- হ্যাঁ উপায় আছে, তুমি এই এই যজ্ঞ কর। আবার অনেকে বলছে আমরা কোন সন্তান নেই তাই একটা ব্যাথা বেদনায় মনটা খুব অস্থির হয়ে আছে, আমার যদি একটা সন্তান হয়ে যায় তাহলে আমার মনের অস্থিরতা কেটে গিয়ে মনের শান্তি হয়ে যাবে। বেদ তখন বলে দেবে- ঠিক আছে, তুমি পুত্রোষ্টি যজ্ঞ কর। এখন পুত্রষ্টি যজ্ঞ করার জন্য কয়েক মাস থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে, এই উপোশ কর, এই এই জিনিষ খাবে না, এই এই দেবতার নামে পূজা দাও, রোজ এত স্নান কর, ভূমিশয্যাতে শয়ন করে। এটাই তপস্যা হয়ে গেল। এইভাবে কিছু ব্রত পালনের পর যজ্ঞের জন্য মনটাকে তৈরী করে নিল। এখন যজ্ঞ করে সন্তান হবে কি হবে না আমাদের জানা নেই। আলোচনা করতে করতে এর উত্তরো আমরা পেয়ে যাব। অনেক দিন আগে বেদের এই প্রসঙ্গে এক ব্রহ্মচারী বলছিল ‘এগুলো সব ফালতু কথা, যজ্ঞ করলে কখন সন্তান হয় না কি? সব গাঁজাখুড়ির গপ্প’। স্বামী ভূতেশানন্দজী সেই সময় ব্রহ্মচারী ট্রেনিং সেন্টারে আচার্য ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রচণ্ড রসিক। ব্রহ্মচারীর এই কথা শুনে তিনি তাঁর স্বভাব সুলভ সুরে মজা করে বললেন ‘একবার করে দেখই না’।
পুত্রেষ্টি যজ্ঞের প্রচুর দৃষ্টান্ত আমরা শাস্ত্রেই পাই, যেমন শ্রীরামচন্দ্রের জন্ম পুত্রেষ্টি যজ্ঞ থেকে হয়েছিল। দ্রৌপদী, ধৃষ্টদ্যুম্নের জন্মও যজ্ঞ থেকে হয়েছিল। দুর্যোধনের জন্ম যজ্ঞ থেকে। এত যে ঘটনার কথা শাস্ত্রে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে, ইচ্ছে করলে এগুলোকে কেউ বিরাটাকারের ধাপ্পা বলতে পারেন। কিন্তু বেদের বিভিন্ন যজ্ঞের ধারণা পরবর্তি কালে এসে অন্য রূপ নিল। যজ্ঞের ধারণাটা আস্তে আস্তে পূজা পদ্ধতিতে এসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। কাশীতে বিশ্বেশ্বরের কাছে মানত করে ভূবনেশ্বরী দেবী নরেন্দ্রনাথকে পেলেন। এইটাই বেদের সময়ে পুত্রষ্টি যজ্ঞ নামে করা হত। শুধু পুত্রষ্টি যজ্ঞই নয়, যে কোন কিছুর জন্য, আমার বাড়িতে প্রায়ই চুরি হয়। যজ্ঞ কর তোমার বাড়িতে চুরি বন্ধ হয়ে যাবে, বাড়িতে সাপের উৎপাত হয়, সর্পযজ্ঞ করে দাও সাপের উপদ্রব কমে যাবে। স্বমীজী মজা করে বলছেন- তোমার যদি গরু হারিয়ে গিয়ে থাকে, সেটাও তুমি বেদে খুঁজে পাবে। বেদের সম্বন্ধে মানুষের এই রকমের ধারণাই ছিল। বেদের মন্ত্রগুলি এত শক্তিশালী যে শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস নিয়ে ঠিকঠিক ভাবে উচ্চারণ করলে সেই মন্ত্র কাজ করবেই করবে। বেদ বলে দিচ্ছে তুমি এই যজ্ঞ করলে তোমার এই ফল লাভ হবে, কোন কিছুই এই ফল লোভকে আটকাতে পারবে না।
এই চারটাকে কেন্দ্র করে হিন্দুধর্মের বিভিন্ন শাখা একটা আরেকটা থেকে আলাদা হয়ে যায়। যেমন কথামৃতে আমরা দেখতে পাই ঠাকুর অর্থ আর কামকে প্রায় পুরোপুরি বাদ দিয়ে রেখেছেন। কিন্তু কৃথামৃতেই অনেক জায়গাতে ঠাকুর ও কিন্তু সংসারীদের অর্থ সঞ্চয়ের কথা বলেছেন। ঠাকুর বলছেন টাকা দিয়ে কি হয়? সাধু সেবা হয়। আবার বলছেন দুটি সন্তান হয়ে গেলে স্বামী-স্ত্রী ভাইবোনের মত থাকবে। এখানে তো ঠাকুর দুটি সন্তানের কথা বলছেনই। ঠাকুর কিন্তু কোথাও কামিনী-কাঞ্চনকে উড়িয়ে দিতে বলেছেন। নারী হচ্ছে মা, সৃষ্টি এদের থেকে চলছে-এই কথা ঠাকুরই বলছেন। ঠাকুর কার জন্য কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগের কথা বলছেন? ঠাকুরের কাছে বিভিন্ন থাকের মানুষ আসছেন। একটা থাক হচ্ছে যারা শুধুই উচ্চ আধ্যাত্মিক অনুভূতির জন্য নিবেদিত। স্কুলে যখন বাচ্চারা ভর্তির জন্য আসে তাদের মধ্যে কিছু ছেলের মধ্যে অত্যন্ত মেধা, প্রচণ্ড বুদ্ধি দেখতে পাওয়া যায়, এদের প্রশিক্ষণ পুরোপুরি আলাদা হয়, অন্যান্য বাচ্চাদের থেকে এদের অনেক সামলে সুমলে রাখতে হয়। জাগতিক অর্থে আমরা যা বুঝে থাকি সে ধরণের কোন কিছু ঠাকুরের ছিল না, তাই ঠাকুরকে কখনও আমরা দেখতে পাই না যে তিনি কারোর রোগ ভালো করে দিচ্ছেন, কাউকে চাকরি করে দিচ্ছেন, মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না, সন্তান হচ্ছে না ঠাকুর তার ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। কিন্তু এই ঠাকুরই আবার মথুরবাবুকে টাকা পয়সার অনেক ঝামেলা থেকে বাঁচিয়েছিলেন, নরেনকে বলেছেন তোরা খাওয়া পড়ার অভাব হবে না। তিনি যাঁদের কে পুরোপুরি টেনে নিয়েছিলেন, যাদের মাধ্যমে তিনি তাঁর অবতারত্ব গ্রহণের উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করবেন, তাদের জন্যই তিনি সম্পূর্ণ ভাবে কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগের কথা বলেছিলেন। এরা যদি কামিনী-কাঞ্চন না ত্যাগ করে তাহলে এরা এগোতে পারবে না আর অবতারের কাজের দায়িত্ব নেওয়ার ক্ষমতাও হবে না। বাকীদের ক্ষেত্রে তিনি বলেছেন, কর্ম কর, অর্থোপার্জন কর, তবে যাই করবে ধর্ম পথে করতে বললেন। কেন ধর্ম পথে করতে বললেন? এই কারণে যে এটাই এর স্বাভাবিক, আমি নিষেধ করলেও তুমি কর্মের পেছনে ছুটবে। সংসারীদের যেমন বলে দিতে হয় না যে টাকা সব খরচ করবেন না, ব্যাঙ্কে কিছু রাখবেন, সংসারীরা এমনিতেই অর্থ সঞ্চয় করবেন।
এখন বেদে কেন অর্থ আর কামের কথা বলা হয়েছে? ঠাকুর কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগের কথা বলছেন অথচ বেদ চারটি পুরুষার্থের কথাই বলছে। আর পুরো বেদ, বিশেষ করে সংহিতাতে বলছে- প্রভু টাকা দাও, প্রভু সন্তান দাও। তাহলে কি ঠাকুর বেদবিরোধী কথা বলছেন? ঠাকুর যদি বেদবিরোধী কথা বলেন তাহলে হিন্দুরা প্রথমেই ঠাকুরকে ছুঁড়ে ফেলে দিত। এর উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে ফিরে যেতে হবে, বিশেষ করে পুরাণে যেখান দেখা যায় ব্রহ্মা প্রথম সৃষ্টি করলেন চার কুমারের- সনক, সনন্দন, সনাতন ও সনৎকুমারদের। ব্রহ্মার মানসপুত্র হওয়ার জন্য এই চার কুমারেরা ত্যাগ বৈরাগ্যেতে পূর্ণ ছিলেন। এঁরা জন্ম নিয়েই দেখছেন আমরা কোথায় সংসারে এসে ফেঁসে গেছি, সঙ্গে সঙ্গে কমণ্ডলু তুলে নিয়ে চার কুমার সংসার ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। ব্রহ্মা পড়ে গেলেন মহা মুস্কিলে, এত কষ্ট করে চারটে ছেলেকে সৃষ্টি করলাম যাতে এরা সৃষ্টিটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, কিন্তু সংসারকে ছেড়ে দিয়ে এরা তপস্যাতে চলে গেল। এখন সৃষ্টি চলবে কি করে? ব্রহ্মা তখন আবার নতুন করে সৃষ্টি করলেন। এবার যাদের সৃষ্টি করলেন যদিও এরা আগের চার কুমারের মত প্রচণ্ড বৈরাগ্যবান ছিলেন না, কিন্তু প্রায় ঐ রকমই হলেন। এরা বিয়ে করেছেন কিন্তু সংসার কাজে কোন ভাবেই সম্পর্ক না রাখাতে সমস্যা দেখা দিল। এই রকম ঋষিদের আরও বড় সমস্যা হয়ে গেল। ঋষিরা বিয়েথা করে গৃহস্থধর্ম পালন করতেন, কিন্তু কিছুতেই তাঁরা সন্তানের জনক হতে চাইতেন না। এই রকমই হয়, যাঁরাই খুব বেশি ধর্মপ্রাণ পুরুষ হন, তাঁদের মন কিছুতেই জাগতিক কোন ব্যাপেরে দিতে চাননা। দেখা যেত গুরু যদি পূর্ণ ত্যাগী হতেন তখন তাঁর শিষ্যরাও গুরুর মত হয়ে যেতেন, সাংসারিক ব্যাপারে সমস্ত আগ্রহ হারিয়ে কেমন একটা উদাস উদাস ভাবে থাকতেন। এটাকে আটকানোর জন্য অর্থ আর কামের কথাও বলা হয়েছিল।
ভারতের এটা একটা জাতীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে জাগতিক ব্যাপারে ভারতীয়রা কোন আগ্রহই অনুভব করত না, যার ফলে যারা আধ্যাত্মিক পথে অজ্ঞ ছিলেন তাদেরকে অলসতা আর নিষ্কর্মতা গ্রাস করে কুসংস্কারে আচ্ছন্ন করে দিত। গত আট দশ বছর ধরে ভারতের লোকেরা বুঝতে পারল যে সুস্থ দেশের এইটাই ছিল জাতীয় রোগ, এখানে প্রেমের কবিতা লিখে দেবে কিন্তু কিছুতেই অর্থ আর কামের জন্য খাটবে না। আমাদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন ঋষি, আমাদের শিক্ষা-দীক্ষা সব ঋষিদের কাছ থেকে পরস্পরা ভাবে এসেছে। ফলে কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ আমাদের কাছে স্বাভাবিক। কিন্তু অন্য দিকে মনের মধ্যে কামিনী-কাঞ্চনের বীজ রয়েছে, বীজ রয়েছে, বীজ না থাকলে তো সে মুক্ত পুরুষ হয়ে যেত, আকাঙ্ক্ষা রয়েছে কিন্তু খাটবে না, কায়িক শ্রমে সব বিমুখ। কায়িক শ্রমবিমুখতার জন্য তাদেরকে জোর করে কাজে লাগাবার জন্য বলা হত- ওহে ভাই তুমি কি মোক্ষ লাভ করতে চাইছ? মোক্ষের কথা শুনেই বলবে- না না, ওসব মোক্ষ-টোক্ষতে আমার মোটেই বিশ্বাস নেই ওসব ফালতু কথা। তাহলে তুমি ধর্ম কর্ম কি করবে? ধর্ম! না না, শীতের মধ্যে ভোর চারটেয় গঙ্গাস্নান আমার দ্বারা হবে না। ঠিক আছে, তুমি যখন ধর্ম ও মোক্ষ কোনটাই পারবে না তখন তুমি অর্থ সাধন ও কাম সাধন কর। কিন্তু বেশির ভাগই অর্থ ও কাম সাধন না করে চাইত জীবন যেমন ভাবে চলছে চলতে থাকুক। ধর্ম ও মোক্ষ তো দূরের কথা এদের শরীর কাম সাধনেরও উপযুক্ত নয়, কারুর হজমের গোলমাল, কারুর ব্লাডপ্রেসার, কারুর হাঁপানি। তিন কিলো মিটার হাঁটতে দিলেই হাঁটু আর বুকে ব্যাথা হয়ে যাবে। খেতে দিলে বলবে আমার খাবারে তেল মশলা কম দেবেন এগুলো আমার সহ্য হয় না, এসিড হয়ে যায়। আবার এদিকে ব্যাঙ্ক-ব্যালেন্সও সেই রকম আহামরি কিছু নেই। পরিষ্কার ভাবেই বোঝা যাচ্ছে এদের শারীরিক ও মানসিক গঠন কোন সাধনের পক্ষেই যোগ্য নয়। ভারতে বেশির ভাগই এই শ্রেণীর লোক। সেইজন্য আমাদের বেদ বলেছিল- এই চারটের মধ্যে যে কোন একটাকে উদ্দেশ্য করে কিছু একটা কর। তাই বেদ কোন আজেবাজে কথা মোটেও বলেনি। মোক্ষ সাধন হচ্ছে সব কিছু ছেড়ে দেওয়া, নিজের শরীর যে এত প্রিয় সেই শরীরের মমত্বকেও ত্যাগ করতে হবে। এখন ভোরবেলা শীতকালে গঙ্গাস্নান করলেই সর্দি-কাশি হয়ে যাবে, এই হচ্ছে আমাদের শরীরের অবস্থা, তাই বেদ বলল-তুমি তো বাপু এসব পারবে না, তাই অর্থ আর কামের জন্য লেগে পড়।
কিন্তু কাম ও অর্থ সাধন যে মন ও বুদ্ধি দিয়ে করবে সেই মন-বুদ্ধিই হয়ে আছে মূঢ় ও বিক্ষিপ্ত। নির্দিষ্ট ভাবে কোন কিছুতেই একাগ্র হয়ে লেগে থাকতে চাইবে না। বেদ কাম ও অর্থ সাধনের পুরো ব্যাপারটাকে একটা নির্দিষ্ট দিকে নির্দেশ করে দিল। আর আমরা যা কিছুই করতে যাই না কেন আমাদের শেষ হাতিয়ার হচ্ছে মন। এই মন আর বুদ্ধি ছাটা তো আমাদের কিছু নেই। ঈশ্বর উপলব্ধি এই মন বুদ্ধি দিয়েই করতে হবে, ভালো মন্দ যা কর্ম এই মন বুদ্ধি দিয়েই করতে হয়। এই মন বুদ্ধিই যখন আমাদের প্রধান অস্ত্র তাই এই মন বুদ্ধিকে সর্বাগ্রে সাণিত করতে হবে। ঠাকুর বলছেন মানুষের মন হচ্ছে সরষের পুটলি, পুটলির মুখ খুলে সরষে ছড়িয়ে গেছে। বেদ এই ছড়ানো মনকে কুড়িয়ে আনতে সাহায্য করে। যখন আমরা কাম ও অর্থ সাধন অরতে থাকি তখন এই সাধনই আমাদের মনকে কুড়িয়ে নিয়ে একাগ্র করে উদ্দেশ্যের দিকে এগিয়ে দেয়। শুধু তাই নয়, এই সাধনের ফলে মানুষের মনে যে নানান কুবৃত্তি গুলি রয়েছে যেমন হিংসা, বিদ্বেষ, ক্রোধ, লোভ, চাহিদা ইত্যাদি এগুলিকেও নিয়ন্ত্রণ করতে খুব সাহায্য করে। ভারতের বেশির ভাগই হচ্ছে নিষ্কর্মা প্রকৃতির লোক। আইটি সেক্টরে একটা কথা আছে- বলা হয় ভারতে চাকরিত কোন অভাব নেই, এখানে অভাব কর্ম প্রবণতার।
এই কর্ম বিমুখতাকে কাটাবার জন্য বেদ এদের জন্য অর্থ আর কামের কথা বলল। এই অর্থ আর কামের সাধনা করে এদের চেতনা যখন একটু জাগ্রত হল তখন ধীরে ধীরে এদের মনকে ধর্মের দিকে নিয়ে যাবে। ধর্ম সাধন করার পর আস্তে আস্তে তাকে মোক্ষের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আরেক ধরণের দ্বিতীয় শ্রেণীর লোক আছে যারা খুব অতিরিক্ত মাত্রায় ছটফটে, এরা আবার প্রচণ্ড ক্ষমতা লোভী, মনে করে আমিই একা লুটেপুটে খাব। একদিকে এদের মনের ইতিবাচক আবেগ নেই, অন্য দিকে এরা আবার অন্যদের মত নিষ্কর্মাও নয় কিন্তু নেতিবাচক আবেগে মনটা আচ্ছন্ন হয় রয়েছে। নেতিবাচক আবেগ মানে হিংসা, বিদ্বেষ, ক্রোধ, লোভ, ঘৃণা ইত্যাদি। এরা বলবে- হ্যাঁ, আমি ধর্ম করব কিন্তু তার আগে আমি একে মেরে শেষ করব। যে চারিদিকে শত্রু তৈরী করে রেখেছে, একে মারব, তাকে শেষ করব, এই যাদের মনোভাব, এদের কি করে ধর্ম করতে বলবে! পৃথিবীর কোন ধর্মে কোথাও এদের ধর্মের দিকে মনটাকে ফিরিয়ে আনার কোন উপায়ের কথা বলা নেই। এদের মন সব সময় বিষিয়ে রয়েছে, এই ধরণের লোকের সব থেকে ভালো উদাহরণ হচ্ছে দুর্যোধণ, মেঘনাদ। দুর্যোধন আর মেঘনাদের মন সব সময় পাণ্ডবদের আর লক্ষণের বিরুদ্ধে হিংসায় পুড়ছে।
আপাত দৃষ্টিতে বলতে গেলে এদের জন্য ধর্ম নেই। সব ধর্মই এদের বলবে আগে তোমার মন থেকে এগুলো পরিষ্কার কর। কিন্তু বেদ সব সময় এদের জন্যও হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। বেদ বলবে তুমি তোমার শত্রুকে মারতে চাও? তাহলে এই নাও আমার শত্রু মারণ যজ্ঞ, এই যজ্ঞ করলে তোমার শত্রু মরবেই। এখন সে শত্রুকে মারার জন্য পুরোদমে নেমে যাবে যজ্ঞ করতে। যেমন মেঘনাদ নেমে পড়ল লক্ষ্মণকে মারতে যজ্ঞ করতে। কিন্তু কি হল? যজ্ঞের গল হবে কি হবে না আমাদের জানা নেই। কিন্তু মাঝ পথেকোন কারণে যজ্ঞটা পণ্ড হয়ে গেল। যজ্ঞ পণ্ড হয়ে যাওয়া, যজ্ঞ পণ্ড না হলে কি হত সেটা আমাদের কাছে গুরুত্ব নয়। গুরুত্বটা হচ্ছে, যজ্ঞের যে প্রস্তুতি পর্বে যজ্ঞাকর্তা খেটেখুটে যে এতো কিছুর যোগাড় করছে, এত আহুতি দিচ্ছে মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে, বিভিন্ন দেবতাদের আহবান করা হচ্ছে, এর ফলে মনটা কিছু কিছু শোধরাতে থাকে।
শাস্ত্রতো বলে দিল তোমার মনে যা নোংরা আছে এটাকে পরিষ্কার না করলে তোমার কিছুই হবে না। আমিও জানি আমার মনে নোংরা আছে। একটা বাচ্চা ছেলেও জানে যে তার খেলার দিকে মন বেশি, লেখাপড়াতে মন কিছুতেই দিতে পারছে না, আর এটাও সে জানে মন দিয়ে পড়লেই ভালো রেজাল্ট করতে পারবে। সে যদি বলে আমি মন খেলাতে দিতে চাইছি না, লেখাপড়াতেই মন দিতে চাইছি কিন্তু আমার মন খেলাতেই টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আমি জানি আমার দুর্বলতা কোথায়, কিন্তু আমি এই দুর্বলতাকে কাটাতে পারছি না। তখন আমরা তাকে কি পথ দেখাব? কোন পথ আমাদের কাছে নেই? আমরা কোন পথা দেখাতে পারিনা। কিন্তু বেদ বলবে- হ্যাঁ উপায় আছে, তুমি এই এই যজ্ঞ কর। আবার অনেকে বলছে আমরা কোন সন্তান নেই তাই একটা ব্যাথা বেদনায় মনটা খুব অস্থির হয়ে আছে, আমার যদি একটা সন্তান হয়ে যায় তাহলে আমার মনের অস্থিরতা কেটে গিয়ে মনের শান্তি হয়ে যাবে। বেদ তখন বলে দেবে- ঠিক আছে, তুমি পুত্রোষ্টি যজ্ঞ কর। এখন পুত্রষ্টি যজ্ঞ করার জন্য কয়েক মাস থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে, এই উপোশ কর, এই এই জিনিষ খাবে না, এই এই দেবতার নামে পূজা দাও, রোজ এত স্নান কর, ভূমিশয্যাতে শয়ন করে। এটাই তপস্যা হয়ে গেল। এইভাবে কিছু ব্রত পালনের পর যজ্ঞের জন্য মনটাকে তৈরী করে নিল। এখন যজ্ঞ করে সন্তান হবে কি হবে না আমাদের জানা নেই। আলোচনা করতে করতে এর উত্তরো আমরা পেয়ে যাব। অনেক দিন আগে বেদের এই প্রসঙ্গে এক ব্রহ্মচারী বলছিল ‘এগুলো সব ফালতু কথা, যজ্ঞ করলে কখন সন্তান হয় না কি? সব গাঁজাখুড়ির গপ্প’। স্বামী ভূতেশানন্দজী সেই সময় ব্রহ্মচারী ট্রেনিং সেন্টারে আচার্য ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রচণ্ড রসিক। ব্রহ্মচারীর এই কথা শুনে তিনি তাঁর স্বভাব সুলভ সুরে মজা করে বললেন ‘একবার করে দেখই না’।
পুত্রেষ্টি যজ্ঞের প্রচুর দৃষ্টান্ত আমরা শাস্ত্রেই পাই, যেমন শ্রীরামচন্দ্রের জন্ম পুত্রেষ্টি যজ্ঞ থেকে হয়েছিল। দ্রৌপদী, ধৃষ্টদ্যুম্নের জন্মও যজ্ঞ থেকে হয়েছিল। দুর্যোধনের জন্ম যজ্ঞ থেকে। এত যে ঘটনার কথা শাস্ত্রে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে, ইচ্ছে করলে এগুলোকে কেউ বিরাটাকারের ধাপ্পা বলতে পারেন। কিন্তু বেদের বিভিন্ন যজ্ঞের ধারণা পরবর্তি কালে এসে অন্য রূপ নিল। যজ্ঞের ধারণাটা আস্তে আস্তে পূজা পদ্ধতিতে এসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। কাশীতে বিশ্বেশ্বরের কাছে মানত করে ভূবনেশ্বরী দেবী নরেন্দ্রনাথকে পেলেন। এইটাই বেদের সময়ে পুত্রষ্টি যজ্ঞ নামে করা হত। শুধু পুত্রষ্টি যজ্ঞই নয়, যে কোন কিছুর জন্য, আমার বাড়িতে প্রায়ই চুরি হয়। যজ্ঞ কর তোমার বাড়িতে চুরি বন্ধ হয়ে যাবে, বাড়িতে সাপের উৎপাত হয়, সর্পযজ্ঞ করে দাও সাপের উপদ্রব কমে যাবে। স্বমীজী মজা করে বলছেন- তোমার যদি গরু হারিয়ে গিয়ে থাকে, সেটাও তুমি বেদে খুঁজে পাবে। বেদের সম্বন্ধে মানুষের এই রকমের ধারণাই ছিল। বেদের মন্ত্রগুলি এত শক্তিশালী যে শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস নিয়ে ঠিকঠিক ভাবে উচ্চারণ করলে সেই মন্ত্র কাজ করবেই করবে। বেদ বলে দিচ্ছে তুমি এই যজ্ঞ করলে তোমার এই ফল লাভ হবে, কোন কিছুই এই ফল লোভকে আটকাতে পারবে না।
রামায়ণের একটি ঘটনার দ্বারা বেদমন্ত্রের শক্তি আর তার কার্যকারিতার প্রমাণ পাওয়া যায়। শ্রীরামচন্দ্র চৌদ্দ বছরের জন্য অযোধ্যা ছেড়ে বনবাসের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেছেন। ভরত শ্রীরামচন্দ্রকে অযোধ্যায় ফিরিয়ে আনার জন্য খুঁজতে গেছেন। যেতে যেতে সন্ধ্যে হয়ে গেছে, ভরত সৈন্য সামন্ত নিয়ে ভরদ্বাজ মুনির আশ্রমে এক রাতের জন্য আশ্রয় নিয়েছেন। ভরদ্বাজ মুনি চিন্তায় পড়ে গেলেন, রাজা এসেছেন, সঙ্গে এত লোকজন, এদেরকে তো আর গাছের তথায় রাখা যায় না, আর সামান্য ফলমূল খাইয়ে অতিথি সৎকার করাও উপযুক্ত হবে না। ভরদ্বাজ মুনি তখন বেদ মন্ত্রের আবাহন করতে শুরু করলেন। বেদের ঋচাগুলি আবাহন করতে লাগলেন তখন দেখা গেলে স্বর্গ থাকে বিভিন্ন রকমের খাদ্যসামগ্রী, পেয় পদার্থ আশ্রয়ে পড়তে লাগল। স্বর্গ থেকে অপ্সরারাও নেমে এসেছেন সবাইকে পরিচর্যা করবার জন্য। সৈন্যরা এই ধরণের সুস্বাদু খাবার, পানীয় কোন দিন চোখেই দেখেনি, তারপরে অপ্সরাদের সাথে নাচগান করার সুযোগ পেয়ে সৈন্যরা বলছে ‘রামচন্দ্রই রাজা হোক কি ভরতই রাজা হোক তাতে আমাদের আর কি যায় আসে, আমরা এখানেই সুখে আছি, এই জায়গা ছেড়ে আমরা আর কোথাও যাবো না, এখানেই আমাদের জীবন সার্থক’। সকালের আলো ফুটতেই দেখে সব ভোঁ ভোঁ, কিছুই নেই। বেদ মন্ত্র দিয়ে যে কোন জিনিষকেই নিয়ে আসা যায়, এই ধারণাটা আমাদের প্রাচীন কাল থেকেই চলে আসছে। হ্যারি পটারের মত ম্যাজিক কিছু নয়, সত্যি সত্যিই এই জিনিষই হবে।
আমাদের মূল কথা হচ্ছে ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ। ধর্মপতের অনুপযুক্ত লোকেদের জন্য অর্থ আর কামের সাধনার ব্যাবস্থা বেদ করে দিয়েছে। হাজরাকে ঠাকুর কত গালাগাল দিয়ে বলছেন- হাজরার গর্ভধারিণী দেশে কত কষ্টে পড়ে আছে, এদিকে হাজরা এখানে লোকের কাছে চেয়ে চেয়ে বেড়ায়, আবার ধারকজ্জও করে রেখেছে। কই ঠাকুরতো হাজরাকে বলছেন না যে হরিনাম কর। কিন্তু তার বদলে বলছেন তোমার বাড়ির লোককে কি বামুনপাড়ার লোক এসে খাইয়ে যাবে। দেশে গিয়ে চাষবাস করে অর্থ রোজগারের দ্বারা মায়ের প্রতিপালনের কথাই ঠাকুর বলতে চাইছেন। ঠাকুর বলছেন কলিতে মানুষের অন্নগত প্রাণ, লোকেদের সময় খুব কম, এই অল্প সময়ের মধ্যে যদি সাধন ভজন করতে যায় তার হবে না। আবার ঠাকুরের কাছে যেসব শুদ্ধসত্ত্ব ছোকরারা আসছে তাদের যাতে সময় নষ্ট না হয় তাই সরাসরি তাদের কামিনী-কাঞ্চনের ত্যাগের কথা দিয়ে বলছেন ঈশ্বর দর্শনই জীবনের উদ্দেশ্য। কিন্তু প্রত্যেক হিন্দুকেই ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ এই চারটির মধ্যে যে কোন একটাকে জীবনের উদ্দেশ্য করে সেইভাবে জীবন যাপন করতে হবে। অনেক টাকা যদি কেউ রোজগার করতে চায় তাতে কোন দোষ নেই। এইটাই হচ্ছে সকলের জন্য বেদের উপদেশ।
আমাদের মূল কথা হচ্ছে ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ। ধর্মপতের অনুপযুক্ত লোকেদের জন্য অর্থ আর কামের সাধনার ব্যাবস্থা বেদ করে দিয়েছে। হাজরাকে ঠাকুর কত গালাগাল দিয়ে বলছেন- হাজরার গর্ভধারিণী দেশে কত কষ্টে পড়ে আছে, এদিকে হাজরা এখানে লোকের কাছে চেয়ে চেয়ে বেড়ায়, আবার ধারকজ্জও করে রেখেছে। কই ঠাকুরতো হাজরাকে বলছেন না যে হরিনাম কর। কিন্তু তার বদলে বলছেন তোমার বাড়ির লোককে কি বামুনপাড়ার লোক এসে খাইয়ে যাবে। দেশে গিয়ে চাষবাস করে অর্থ রোজগারের দ্বারা মায়ের প্রতিপালনের কথাই ঠাকুর বলতে চাইছেন। ঠাকুর বলছেন কলিতে মানুষের অন্নগত প্রাণ, লোকেদের সময় খুব কম, এই অল্প সময়ের মধ্যে যদি সাধন ভজন করতে যায় তার হবে না। আবার ঠাকুরের কাছে যেসব শুদ্ধসত্ত্ব ছোকরারা আসছে তাদের যাতে সময় নষ্ট না হয় তাই সরাসরি তাদের কামিনী-কাঞ্চনের ত্যাগের কথা দিয়ে বলছেন ঈশ্বর দর্শনই জীবনের উদ্দেশ্য। কিন্তু প্রত্যেক হিন্দুকেই ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ এই চারটির মধ্যে যে কোন একটাকে জীবনের উদ্দেশ্য করে সেইভাবে জীবন যাপন করতে হবে। অনেক টাকা যদি কেউ রোজগার করতে চায় তাতে কোন দোষ নেই। এইটাই হচ্ছে সকলের জন্য বেদের উপদেশ।
good post
উত্তরমুছুনধন্যবাদ- এই পর্ব গুলি আমরা নিয়মিত পোষ্ট করছি, সাইটে ভিউয়ার বাড়াতে সাহায্য করুন এবং ব্লগটি ফলো করুন।
মুছুন