বৈদিক যুগে নারীর অবস্থান- পর্ব ০২
নারী ছিলেন পারিবারিক বিষয়ের নেত্রী; তিনি ভোগ-বিলাসের রমণী বা কামিনী ছিলেন না। রমণী, কামিনী প্রভৃতি অতি ঘৃণিত শব্দ বৈদিক যুগে সৃষ্টি হয়নি। পুরুষেরা যেমন আদর করতে গিয়ে নারীকে রমণী এবং কামিনী সংজ্ঞা দিয়েছিলেন, অর্বাচীন যুগের সেই আদব থেকেই বুঝতে পারি যে নারী তখন পুরুষের বিলাসের উপকরণ-হিসাবেই গৃহিত হতেন, এবং পুরুষের সম্পত্তি মাত্র ছিলেন। বৈদিক ভাষায় রমণী শব্দ ছিল না, কিন্তু “রামা” শব্দের সৃষ্টি হয়েছিল। এই “রামা” শব্দের অর্থ ছিল বেশ্যা। এক দিন যারা নেত্রী ছিলেন, তাঁরাই পরবর্তী সময়ে পতিতার নামে আদৃতা হয়েছিলেন। নারীরা বলতে পারেন যে, ভগবান্ আমাদেরকে এই দুরবস্থা থেকে রক্ষা করুন।
বৈদিক যুগের পরবর্তীকালের সাহিত্যে দেখতে পাই যে, স্ত্রীরা আদরে সম্বোধনে “প্রেয়সী” শব্দের ব্যবহার প্রচলিত হয়েছে। সে কাল থেকে এ কাল পর্যন্ত ঐ শব্দটি আমাদের সাহিত্যে খুবই প্রচলিত রয়েছে। এ কালে "প্রেয়সী” শব্দ যথার্থ আদরে এবং সম্মানে ব্যবহৃত হতে পারে; কিন্তু ঐ শব্দটির উৎপত্তির যুগে এর বড় ভাল অর্থ ছিল না। যা যথার্থ কল্যাণকর ছিল, তাই ছিল শ্রেয়স; কিন্তু যা মানুষকে শ্রেয় থেকে দূরে নিয়ে যেত, অথচ তৃপ্তিদায়ক ও মধুর ছিল, সেই বিপথে যাবার যা সহায় স্বরূপ ছিল, তারই নাম ছিল প্রেয়স্। এই "শ্রেয়স-বিরোধী" প্রেয়স কথার স্ত্রীলিঙ্গে হয়েছে প্রেয়সী। নারী যখন ধর্মপথের বাধা, মুক্তির বাধা এবং মারের সহচরী হলেন, তখনই তিনি প্রেয়সী বলে আদৃতা হতে লাগলেন। এখানেই ব্যাকরণের কচকচি শেষ করলাম।
এ কালে ব্রাহ্মণপত্নীরাও শূদ্রের মত ব্যবহৃত হয়ে থাকেন; তাঁরা নিজ ঘরে প্রতিষ্ঠিত দেববিগ্রহকে স্পর্শ করতে পারেন না, এবং তার পূজায় নিযুক্ত হতে পারেন না; বেদপাঠেও তাদের অধিকার নেই। বৈদিক যুগে পত্নী অর্থই ছিল যজ্ঞাদিতে অধিকার প্রাপ্ত জায়া কেবল যে এই অধিকারেরই ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত দেওয়া চলে, তাই নয়; নারী যে ঋষি হতেন, মন্ত্র রচয়িত্রী হতেন, এবং নিজে স্বতন্ত্র ভাবে দেবতাকে তৃপ্ত করতে পারতেন, এরও অনেক দৃষ্টান্ত আছে। বিশ্ববারা (ঋক্ ৫, ২৮) প্রভৃতি নারী-ঋষির কথা, ঘোষা প্রভৃতি রমণীর স্বাধীন ধর্মযাজনের কথা এ দেশের অনেক সহজলভ্য সাহিত্যেই বিচরিত হয়েছে; কাজেই ঐ কথা নিয়ে অধিক আলোচনার প্রয়োজন নেই।
ক্রমশঃ
সূত্র- ভারতী পত্রিকা ৩২ সংখ্যা।
কোন মন্তব্য নেই