কুরু বালকদের বাল্য খেলা
দ্বিতীয় অধ্যায়।
কুরু বালকদের বাল্য খেলা।
দুই লক্ষে একটি শুক্র কীটাণু মধ্যেও একজন মহাপুরুষ শায়িত থাকেন, ক্ষুদ্র একটা বট বীজ মধ্যে প্রকাণ্ড একটি বট বৃক্ষ লুক্কায়িত থাকে। কাল সেই মহাপুরুষ কে প্রবুদ্ধ করে, কালে ঐ বট বৃক্ষ প্রকাশিত হয়।
শতাধিক কুরু বালক একত্রে অধ্যয়ন করে, একত্রে খেলা করে। দ্রোণাচার্য এদের গুরু। দ্রোণ ব্রাহ্মণ, ব্রাহ্মণ হয়ে ক্ষত্রিয় ধর্ম শিক্ষা দেন, এজন্য দ্রোণ আচার্য গুরু শ্রেষ্ঠ।
বালকেরা এক সঙ্গে খেলা করত, কিন্তু কে জানত এদের মধ্যে কুরুকুল বিনাশের উপাদান রয়েছে, কে জানত এদের মধ্যে প্রাতঃ স্মরণীয় পুণ্যশ্লোক ধর্মপুরুষ আছেন, কে জানত এদের মধ্যে সর্বগুণান্বিত ভগবত কৃপাপাত্র এমন মহাপুরুষ আছেন, যাঁকে নিমিত্ত মাত্র করে ভগবান্ জীব নিস্তারের সৰ্বপ্ৰকার উপায় প্রকাশ করবেন, যাঁকে লক্ষ্য করে এই সর্বশান্ত্রময়ী গীতা জগতের জন্য কর্ম, ভক্তি ও জ্ঞানপথ উন্মুক্ত করবেন, যে ধর্মময়ী গীতা শ্রীকৃষ্ণ পাদপদ্মে অব্যভিচারিণী দাস্য ভক্তি প্রদান করবে, যা “জায়তে সততং সখ্যং সর্ব্বজীবগণৈঃ সহ”, যে গীতাশাস্ত্র অবলম্বন করে ভগবান্ স্বয়ং জীবকে আশ্রয় প্রদান করবেন, যে গীতা আশ্রয় করে ভগবান পরস্পর বিরোধী প্রাণিসঙ্খের প্রতিপালন করবেন, কে জানত এই বালকদের মধ্যে এই সমস্ত মহাপুরুষ লুকায়িত আছেন। কাল এদের প্রকাশক।
বালকেরা বালকের খেলা করত। সমস্ত বাল্য খেলাতেই এদের বিশেষ তেজস্বিতা প্রকাশ পেত। এদের মধ্যে একটি বালক, স্পর্ধা পূর্বক সবেগে গমন, লক্ষ্য অভিহরণ ও অন্যান্য খেলায় অন্য সকলকে পরাস্ত করত, এই বালকটি সর্বাপেক্ষা বলিষ্ঠ, সে
“যাইতে পবন সম, সিংহ সম হাঁকে
আস্ফালনে গজ সম, মেঘ সম ডাকে।”
বালক দ্রুতবেগে বাহুর জোরে যখন কুরুবালকদের মধ্য দিয়ে চলে যেত, এমনকি দশ বিশ জনকে ভূমি পাতিত করে যেত। খেলা করার সময় এল বালক অন্য বালকদের পরস্পরের মাথায় ঠোকাঠুকি করে দিত। কখনও অন্য বালকদেরকে মাটিতে ফেলে চুল ধরে এমন জোরে আক্ৰমন করত যে, কেউ ক্ষত হাঁটু, কেউ ক্ষত মাথা, কেউ বা ক্ষত কাঁধ হয়ে প্রাণ নাশ ভয়ে পরিত্রানের জন্য আৰ্তস্বরে চিৎকার করত। তার উৎপীড়নে দশ বিশ জন বালক একত্র হয়ে যখন তাকে ঝাপটিয়ে ধরত, প্রবল পরাক্রমশালী এই বালক অবহেলে শরীর ঝাঁকার দিয়ে মুক্ত হত, পরে দুই হাতে দুই চার জনের হাত ধরে চক্রাকারে গমণ করে ছেড়ে দিত ; তারা মৃতের মত কতক্ষণ পড়ে থাকত। জল খেলায় এই দুরন্ত শিশু একসাথে পাঁচ সাত জনকে জল মধ্যে ডুবিয়ে রাখত এবং প্রাণ মাত্র রেখে ছেড়ে দিত। যখন অন্য বালকেরা ফল পারতে গাছে উঠত তখন এই প্রচণ্ড শিশু পায়ের আঘাতে সেই গাছটি নাড়াত। তারা সহ্য করতে না পেরে ফলের সাথে গাছ থেকে মাটিতে পড়ে যেত। বাল্যকাল থেকেই সকলে একে যমের সমান দেখত। এর ক্রিয়াকলাপ অসাধারণ, বল-সংস্থান ও তার বিকাশের পরিচায়ক, অথচ এর হৃদয় বাল্যকালের সরলতা মাখা। এই বালক বড় হয়ে কুরুক্ষেত্র সমরে অদ্ভুত কর্ম করেছিল। একবারে একশত জনকে বিনাশ করেছিল, এবং একজনের বক্ষ বিদীর্ণ করে রক্ত পানে নিজের প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করেছিল। দুর্যোধন বাল্যকাল থেকে চিন্তা করত
“বয়োধিক হইলে হইবে মহাবল
ইহার জীবনে নাই আমার কুশল।”
এই কাল থেকেই ভীম দুর্যোধনের বিদ্বেষ ভাব সঞ্চারিত হতে লাগল। ভীম ও দুর্যোধন ঠিক এক দিনে জন্মগ্রহণ করেছিল। দুর্যোধনের জন্ম সময়ে বালক গর্দভের মত চিৎকার করল, লোকে বুঝল দুর্যোধন হতে কুরুকুলের অন্ত হবে। ভবিষ্যত দুর্ঘটনার সূচনা দুর্নিমিত্তের(পাপের নিমিত্ত শাস্তিভোগ) দ্বারাই হয়ে থাকে।
দুর্যোধন অধর্মবীজ; তার বিকাশও তেমনই হবে। যে বাল্যকালে সাধারণতঃ লোকের প্রতিহিংসা থাকে না, সেই কাল হতেই দুর্যোধন শত্রুসংহার চিন্তা করত, ভাবত-
“ভীমে মারি চারি ভাই রাখিব বান্ধিয়া
তবে ত ভুঞ্জিব রাজ্য নিষ্কণ্টক হইয়া।”
দুর্যোধন ভাবল- যখন ভীম পুবোদ্যানে নিদ্রিত থাকবে, তখন একে ধরে গঙ্গায় নিক্ষেপ করব। যেমন বাসনা জাগল, অমনি কাজ হতে চলল। জল-খেলা শেষে বিশ্রামের জন্য গঙ্গাতীরে কাপড় ও কম্বল নির্মিত বিচিত্র গৃহ প্রস্তুত হল, গৃহে গৃহে অশেষ প্রকার খাদ্য বস্তু রাখা হল। গৃহে গৃহে অত্যুন্নত পতাকা সমূহ উড়ানো হল। দুর্যোধন জল খেলার জন্য পাণ্ডবদের কে আহ্বান করল। সরল মনের যুধিষ্ঠীর সম্মত হলেন। বৃকোদর উদর সেবায় ব্যকুল পাপাত্মা দুর্যোধন ভীমকে বধ করার আশায় মিষ্টান্নে বিষ মিশ্রিত করে নিজ গিয়ে ভ্রাতার ন্যায় ভীমের পাতে বিষ মিশ্রিত মিষ্টান্ন প্রদান করল, ভীম সরল হৃদয়ে প্রীতি পূর্বক সেটাই খেয়ে নিল। দুরাত্মা দুর্যোধন মনে মনে হাসল।
সন্ধ্যা হয়ে গেল। বালকদের জল-খেলা সমাপ্ত হল। সকলে বিশ্রাম ঘরে গিয়ে ধৌত বস্ত্র পরিধান করল, বিচিত্র অলঙ্কার ধারণ করল। কেৱল একাকী ভীম বিষ ভক্ষণ ও অধিক ব্যায়াম বশতঃ নিতান্ত ক্লান্ত হয়ে গঙ্গার তীরে শোয়া মাত্র ঘুমে অচেতন ও মৃতের মত রইলেন। দুর্যোধন সেই সুযোগে তাকে লতাপাতা দিয়ে বেঁধে স্থল থেকে জলে নিক্ষেপ করল। ভীম সংহারে দুর্যোধনের এই প্রথম উদ্যম।
গঙ্গা জলে পতিত হয়ে ভীম কালকূট প্রভাবে অচেতন হল। তার উপব ভীমকে সাপে দংশন করল। বিশে বিষ ক্ষয় হল, জলে থাকার জন্য শীঘ্র ভীম বিষ মুক্ত হলেন। মহাভারতে দেখা যায়, ভীম ভাসতে ভাসতে পাতালপুরে বাসুকি ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। অষ্টম দিন পরে নিদ্রা ভঙ্গ হয়। বাসুকি ভীমকে স্বদৌহিত্র কুন্তি ভোজের দৌহিত্র জেনে অমৃত পান করালেন, এবং প্রচুর ধনরত্ন প্রদান করলেন। দুর্জনের বুদ্ধি রচিত চাতুরী জাল যে বিধাতার অদ্ভুত নিয়মে অনেক সময় বহির্ঘটনায় প্রতিহত হয়, এটা তার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।
এদিকে সকলে বাড়ি যাবার জন্য প্রস্তুত, কেবল ভীম নেই। সকলে রথে অশ্বে গজে উঠল। ভীমের অনুপস্থিতি ধর্মবীর যুধিষ্ঠীর প্রথম অনুভব করলেন। যুধিষ্ঠির ব্যাকুল হলেন।
“ভ্রাতৃগণে ডাকিয়া কহেন যুধিষ্ঠির।
সবে আছে না দেখি কেবল ভীম বীর।।
ফল হেতু ভীম কিবা গিয়াছে কাননে।
গঙ্গাজলে গেল কিম্বা বিহার কারনে।।”
ভ্রাতৃগণ চারদিকে ভীমের অনুসন্ধান করল।
“কেহ গেল গঙ্গাতীরে কেহ মধ্যভাগে।
ভীম ভীম বলি কেহ ডাকে চতুর্দিকে।।”
কিন্তু ভীমের সন্ধান কেউ পেল না। যুধিষ্ঠিরের মুখ শুকাল, ভাবলেন ভীম আগে গেছে। যুধিষ্ঠিরের মনে তখন পর্যন্ত কোন সন্দেহ ছিলনা। তিনি ধর্মবৃক্ষ, ধর্মের সারল্যই ভূষণ। যুধিষ্ঠির বাড়ি আসলেন, জননীকে অভিবাদন করলেন, জিজ্ঞাস করলেন, “মা! বৃকোদর যে ঘরে এসেছে তাকে দেখছি না কেন? সে কোথায় গেছে? তুমি তো ভীমকে কোথাও পাঠাও নি? সেখানে উদ্যান বন তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম, ভাবলাম ভীম আগেই বাড়ি এসেছে। মা! এখানেও ত দেখতে পাচ্ছি না, মা! ভীমের জন্য প্রাণ বড়ই ব্যাকুল হচ্ছে।” যুধিষ্ঠির কাঁদছেন। যুধিষ্টিরের ক্রন্দনে কুন্তী ভয় পেয়েছেন বলছেন, “বৎস আমি ত ভীমসেনকে দেখি নি, সে ত গৃহে আসে নি, দেখ সে কোথায় গেল?” কুন্তী তখন দ্রুত পায়ে বিদুরের নিকট গেলেন, আজ কুন্তী আলু থালু কুন্তলা, বড়ই চঞ্চল চিত্তে বলছেন, “ক্ষত্ত! আজ কুমারেরা উদ্যান খেলতে গিয়েছিল, সকলে এসেছে ভীমসেন আসে নি। ভীম কোথায় রইলো কেউ তার অনুসন্ধান করতে পারেনি। দুর্মতি দুর্যোধন তাকে দেখতে পারেনা। দুষ্ট কি আমার ভীমসেনকে প্রাণে বধ করেছে? ক্ষত্ত! আমি কিছুতেই স্থির থাকতে পারছি না।”
বিদুর স্তম্ভিত হয়েছেন। আগেই কুন্তীকে সাবধান করছেন কল্যাণি! ও কথা আর মুখে এনও না। চণ্ডাল দুর্যোধন এ কথা শুনলে বড়ই উপদ্রব করবে। তুমি কাঁদবে না, ভীমের জন্য কোন চিন্তা নেই। মহামুনি ব্যাস বলেছেন, তোমার পুত্ররা দীর্ঘায়ু। পৃথিবীতে পাণ্ডবেরা অবধ্য। তাঁর বাক্য মিথ্যা হবার নয়। তুমি চিন্তা করো না। ভীমসেন শীঘ্রই চলে আসবে। তখন বিদুর চারদিকে ভীমের সন্ধানে লোক পাঠালেন।
আটদিন কেটে গেল। কুন্তী পুত্র শোকে উঠতে পারেন না, আট দিন আহার নিদ্রা নেই। প্রথম প্রথম ঘর বাহির করেছিলেন, কেউ আসলেই জিজ্ঞাসা করতেন- “ভীমের কি সংবাদ পাওয়া গেল?” প্রতি ঘণ্টায় শতবার এমন করছেন। ক্রমে শরীর দুর্বল হল। যুধিষ্ঠিরও মৃতপ্রায় হয়েছেন। চোখ থেকে নিরন্তর অশ্রু ধারা ঝরছে, কাউকেও কিছু বলতে পারেন না। ভাই চারজন যুধিষ্ঠিরের প্রাণ অপেক্ষা প্রিয়।
হঠাৎ অষ্টম দিনে ভীমসেনের নিদ্রা ভঙ্গ হল। নাগলোকে সকলে ভীমকে সচেতন দেখে বাড়ি আসতে বলল।
“চারি ভাই শোকাকুল কাঁদয়ে জননী
অষ্টদিন হৈল কেহ তত্ত্ব নাহি জানি।।”
নাগেরা ভীমকে খেলার মাঠে পৌঁছে দিয়ে ফিরে গেলেন। ভীমসেন বাড়ি ফিরল। প্রথমে এসে জননীকে প্রণাম করল, পরে যুধিষ্ঠিরকে অভিবাদন করে কনিষ্ঠদের মস্তক চুম্বন করল।
“আনন্দিত যুধিষ্ঠির দেখি বৃকোদর।
হরিষে চক্ষুর জলে সিক্ত কলেবর।।
জিজ্ঞাসেন কোথা ভাই এতদিন ছিলা।
আমা সবা পরিহরি কেমনে রহিলা।”
‘আমা সবা পরিহিরি কেমনে রহিলা।’ যুধিষ্ঠিরের এই এক বাক্যে কতদূর হৃদয় প্রকাশ করছে ?
ভীমসেন, দুর্যোধনের দুষ্ট চেষ্টা থেকে পাতালপুর হতে ফিরে আসা পর্যন্ত সমস্ত বৃত্তান্ত বিস্তারে খুলে বললেন।
বিবরণ শুনে যুধিষ্ঠীর চমকে গেলেন। বললেন, আমরা এখন থেকে পরস্পর পরস্পরের রক্ষণ বিষয়ে সচেষ্ট থাকব। আর আমাদের এই সব কথা যেন কোনভাবেই কেউ জানতে না পারে বা বুঝতে না পারে। আরও দেখ-
"দুর্য্যোধন দুষ্টে কেহ না যাবে বিশ্বাস।
একা হৈয়া কেহ নাহি যাবে তার পাশ ।।”
পাণ্ডবেরা সাবধান হয়ে চলতে লাগল। ধর্মপ্রাণ হলেও কর্মপথে বহির্জগতের উপর সাবধান লক্ষ্য রাখা আবশ্যক, এর দ্বারা এটাই ধ্বনিত হচ্ছে। ধৃতরাষ্ট্র, দুর্যোধন, শকুনি নানা উপায়ে হিংসা করতে চেষ্টা করত, কিন্তু বিদুরের পরামর্শে পাণ্ডবদের কোনই অনিষ্ট হত না।
সৌজন্যে-
কোন মন্তব্য নেই