বৈদিক যুগে নারীর অবস্থান- পর্ব ০৫
পতি-পত্নীর সম্বন্ধ যে অতি পবিত্র ছিল, তাতে সন্দেহ নেই। আমরা টেনিস,নর Princess কাব্যে যখন পড়তে পাই যে স্ত্রী ব্যতীত পুরুষ অর্ধেক এবং পুরুষ ব্যতীত স্ত্রী অর্ধেক মানুষ মাত্র, এবং উভয়ের সংযােগেই পূর্ণ মনুষ্যত্ব সৃষ্ট হয়, তখন উহাকে উচ্চ ভাব বলে প্রশংসা করে থাকি। পতি-পত্নীর সম্বন্ধের বিচারে এবং প্রাচীন যুগের বিবাহের মন্ত্রে দেখতে পাই যে খাটি ঐ ভাবটি এ দেশে বহুকাল পূৰ্বে পরিস্ফুট ছিল। স্ত্রী তার স্বামীর অর্ধাঙ্গ (শতপথ ব্রাহ্মণ ৫/২-১/১০) এবং স্ত্রী ব্যতীত পুরুষ অসম্পূর্ণ, এবং স্ত্রীপুরুষের সংযােগেই মনুষ্যত্বের পূর্ণতাবিধান (বৃহদারণ্যক ১/৪/১৭), এটাই ছিল প্রাচীনকালের আদর্শ।
‘বরুণ প্রঘাস’ নামক যাজ্ঞিক অনুষ্ঠান লক্ষ্য করে একজন ইউরােপীয় পণ্ডিত বলেছেন যে, বৈদিক যুগে পতিরা পত্নীদের চরিত্রের পবিত্রতার প্রতি বড় লক্ষ্য করতেন না। কথাটা বড়ই ভুল। অনুষ্ঠানটি এই যে, বরুণ প্রঘাস যজ্ঞবিধির সময় পতি পত্নীকে জিজ্ঞাসা করতেন, বিবাহের পূর্বে তার কোন জার(গুপ্তপতি) ছিল কি না। যদি কোন জার ছিল, তাহলে তা তাকে বলতে হবে। এতে এই মাত্র সূচিত হয় যে, সদাচারসম্পন্ন হলে দেবতা সমক্ষে পূর্বের অপরাধের ক্ষমা হত; কিন্তু চরিত্রের চপলতা আদৃত বা উপেক্ষিত হত না।
কুমারী অবস্থায় নারী নিজে যা উপার্জন করতেন এবং বিবাহের পর তিনি যে সকল উপহার পেতেন, তা সম্পূর্ণভাবে তাঁর নিজের সম্পত্তি ছিল, এবং তিনি সেই সম্পত্তি নিজের ইচ্ছা মত হস্তান্তর করতে পারতেন। নারীরা যখন মন্ত্র রচনা করতে পারতেন; তখন তাদের সুশিক্ষার অভাব ছিল, এ কথা বলা চলে না। নারীরা সকলেই যে নৃত্য এবং গীত শিখতেন, এসব ঋক এবং অথর্ব বেদের অনেক সূক্ত থেকেই বুঝা যায়। নারীরা যেমন পেশস্ নামক কারুকাজের বস্ত্র পরে নৃত্য করে থাকেন, দেবদুহিতা উষা তেমনি ভাবে নৃত্য করেন বলে ঋগ্বেদে উল্লেখিত আছে।
বৈদিক যুগে ছেলে-মেয়েদের নিকট মাতার সম্মান বড় অধিক ছিল। মাতাকে বয়ঃপ্রাপ্ত পুত্রের অধীনে থাকতে হবে, পরবর্তী যুগের শাস্ত্রকারদের এই নির্দেশ খাঁটি বৈদিক যুগে পাওয়া যায় না। তবে কোন পরিবারে বয়োজ্যেষ্ঠ পুরুষ না থাকলে বোনকে তার রক্ষণাধীনে থাকতে হত; ভাই না থাকলে ‘ভ্রাতৃব্যেরা’ও রক্ষণাবেক্ষণের ভার গ্রহণ করতেন। ইচ্ছা করে বৈদিক যুগের ভ্রাতৃব্য শব্দটি ব্যবহার করলাম। এ যুগে cousin অর্থজ্ঞাপক কোন শব্দ প্রচলন নেই বলে বৈদিক ভাষার ভ্রাতৃব্য কথাটির প্রচলন করতে ইচ্ছা করছি।
সত্য যুগের কথা হলে ও বৈদিক যুগে পতিতা রমণী ছিল, এবং তারা বড় বড় ঋষিদের ও অস্পৃশ্যা ছিল, এ কথা বলা চলে না। পতিতারা বিশ্ বা আর্যশ্রেণীর লােক সাধারণের ভােগ্য ছিল বলে তাদের নাম হয়েছিল ‘বিশ্যা’। শব্দটির ব্যুৎপত্তির কথা বিস্তৃত হওয়াতে সংস্কৃত ভাষায় বৈদিক শব্দের ই’কার স্থানে এ-কার হয়ে গিয়েছিল। বিশ্যার অন্য নাম ছিল ‘রামা’ এবং ‘ন-গ্না’, ‘গ্না’ শব্দের অর্থ প্রথমে ছিল সম্মানিতা মহিলা, এবং পরে অর্থ হয়েছিল দেব-পত্নী। যাদের পক্ষে গ্না হওয়া সম্ভব ছিল না, তারাই হত ন-গ্না। কালক্রমে ব্যবহারের নির্লজ্জতার হিসাবে নগ্না অর্থ লজ্জাহীন হয়েছিল, এবং ঐ শব্দের একটি পুংবাচক নূতন শব্দ সৃষ্টি হয়ে পুরিচ্ছদশূন্য অর্থে ‘নগ্ন’ শব্দ রচিত হয়েছিল।
সমাপ্ত।
আলোচিত প্রবদ্ধটি ভারতী পত্রিকা বর্ষ-৩৭ সংখ্যায় শ্রীবিজয়চন্দ্র মজুমদার মহাশয় তুলে ধরেছিলেন।
#শ্রীকৃষ্ণকমল
কোন মন্তব্য নেই