বেদ ও ভারতের আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য-পর্ব ০৩
১ম পাঠ, ৩য় পর্ব
বেদ শব্দটা এসেছে বিদ্ ধাতু থেকে। যে কোন ভারতীয় ভাষায় শব্দের একটা root থাকে একে বলা হয় ধাতু। এই ধাতুর সাথে যখন প্রত্যয়াদি যুক্ত করা হয় তখন একটা শব্দের সৃষ্টি হয়। উল্টোপাল্টা কোন শব্দ উচ্চারওণ করলেই তাকে প্রকৃত শব্দ বলা যাবে না, যেমন বলে দিন ‘দুম্’ এখন যদি দুম্ শব্দটা কোথা থেকে এসেছে, এর ইতিহাস যদি খুঁজতে যাওয়া হয় তাহলে দেখা যাবে সংস্কৃতে এটা কোন শব্দই নয়। কোন শব্দ নয়? দুম্ টা হচ্ছে আসলে ধ্বনি, এর কোন ধাতু নেই। ধাতু না থাকলে তাকে শব্দ বলা যাবে না। যেমন সংস্কৃত এই শব্দটার অর্থ হচ্ছে সম্যক রূপে কৃ ধাতু। কৃ মানে করা, সম্যক রূপে করা মানে ভালো করে পরিষ্কার করে কিছু করা। সংস্কৃত ভাষাকে তাই খুব পরিষ্কার, সাফসুতরো ভাষা বলা হয়, এখানে কোন ধরণের কোন আবর্জন কিছু নেই। যে ভাষা যত বেশি গ্রামাঞ্চলে ব্যবহৃত হয় সেই ভাষাতে তত বেশি আবর্জন ঢুকে জংলী ভাষাতে পরিণত হয়ে যায়। ইংরাজী শব্দ টেনশানকে হিন্দী ভাষায় পাল্টে দিয়ে বলবে টেনশানিয়া। এগুলো কোন শব্দই নয় কেননা যে কোন শব্দের একটা ধাতু বা রুট থাকা চাই, তা নাহলে সেটাকে কোন শব্দ বলেই গণ্য করা হবে না, নিছক ধ্বনি মাত্রই থেকে যাবে। যে কোন ধাতুরও আবার একটা বিশেষ অর্থ আছে। পাণিনির ব্যাকারণ শাস্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী এই বিদ্ ধাতুর পাঁচটি অর্থ হয়। এই পাঁচটার মধ্যে একটা হচ্ছে জানা। এইভাবে সৃপ্ ধাতু থেকে এসেছে সর্প, সৃপ্ মানে যেটা সরে সরে যায়, গরু এসেছে গম্ থেকে, গম্ মানে যে জিনিষটা চলে। বিদ্যা, বিদ্বান যত শব্দ আছে সব এই রকম বিদ্ ধাতু থেকে এসেছে। যখন যে কোন বিদ্যাকে জানা হয়, সে যে ধরণের বিদ্যাই হোক না কেন তাকেই বেদ বলা হয়, কারণ এর সবটাই হচ্ছে বিদ্ ধাতু থেকে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পণ্ডিতেরা বেদের অর্থ করেছেন, স্বামীজীও বেদের অর্থ বলতে গিয়ে বলছেন- যে কোন জ্ঞান, যা কিছু বিদ্যা সেটাই হচ্ছে বেদ।
আমাদের কাছে বেদের একটা অর্থ হচ্ছে Common noun সাধারণ নাম বা বিশেষ্য হিসেবে যেমন ধনুর্বেদ, যেখানে ধনুর বিজ্ঞান বলা হয়েছে, আয়ুর্বেদ, যে বিদ্যার দ্বারা আয়ু বৃদ্ধি করা যায়। এই ধরণের যত বিদ্যা আছে এগুলোকে বেদ বলা হচ্ছে সাধারণ নাম হিসাবে, যে কোন বিদ্যার সাথে বেদ নাম দিয়ে ব্যবহার করা যেতে পারে। আবার যখন গুণ বা বিশেষণ adjective রূপে ব্যবহার করা হয়, কোন জিনিষকে মর্যাদা দেওয়ার জন্য বেদ শব্দকে ব্যবহার করা হয়, যেমন ভাগবতকে অনেক সময় বলা হয় পঞ্চম বেদ। চারটে বেদই আছে, কিন্তু পঞ্চম বেদ যখনই বলা হয় তখন বেদ শব্দকে বিশেষণ হিসেবে ব্যবহার কররে ভাগবতের সন্মান বাড়িয়ে দেওয়া হল। সব শেষে হচ্ছে proper noun যখন proper noun হিসাবে ব্যবহার করা হয় তখন এই চারটে বেদকে –ঋক্, সাম্, যজুঃ ও অথর্ব বেদকে বোঝাবে।
প্রথমেই আমরা বলেছিলাম এই চারটে বেদের আবার চারটে করে ভাগ আছে- মন্ত্র বা সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক এবং উপনিষদ। মন্ত্র মানে এখানে সচারচর আমরা যেসব মন্ত্র বলি যেমন ‘ওঁ নমঃ শিবায়’ মন্ত্র বলি, এই মন্ত্রকে বোঝাচ্ছে না। মন্ত্রকে সংহিতাও বলা হয় – যদি বলা হয় ঋকবেদ সংহিতা তখন বুঝতে হবে এখানে ঋকবেদের অন্য কোন অংশের কথা বলা হচ্ছে না, ঋকবেদের শুধু মন্ত্র অংশের কথাই বলা হচ্ছে। সংহিতাতে বেশির ভাগই হচ্ছে বিভিন্ন দেবতাদের স্তুতি, এবং বিশেষ যজ্ঞের মন্ত্রগুলি দেওয়া আছে। বেদের ব্রাহ্মণ অংশের সাথে ব্রাহ্মণ জাতির কোন সম্পর্ক নেই। ব্রাহ্মণে সাধারণত মন্ত্র অংশে যা দেওয়া হয়েছে সেগুলিকেই বড় করে টীকাকারে ব্যাখ্যা করা হয়েছে- যে যজ্ঞটা করা হবে সেই যজ্ঞটা কিভাবে করা হবে, কিভাবে যজ্ঞের বেদি তৈরী করা হবে ইত্যাদি। এর আগে যে পুত্রেষ্টি যজ্ঞের কথা বলে হয়েছিল, এই পুত্রষ্টি যজ্ঞে কি কি মন্ত্র পাঠ করা হবে সেটা সংহিতাতে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যজ্ঞটা কি নিয়মে, কিভাবে করা হবে সেটা এই ব্রাহ্মণ অংশে পাওয়া যাবে। তৃতীয় হচ্ছে আরণ্যক। বয়স হএ গেলে যখন আর যজ্ঞ করতে পারবে না, তখন সে কিভাবে মানসিক যজ্ঞ করবে সেটাই আরণ্যকে বলা হয়েছে। যে যজ্ঞ গুলি আগে বাহ্যিক উপকরণ ও পুরোহিত ব্রাহ্মণদের দ্বারা সম্পন্ন করা হত এখন সেই যজ্ঞই মনে মনে কল্পনার দ্বারা করা হবে। সব শেষে আসছে উপনিষদ। এই রকম পরিষ্কার বিভাজন যে আগাগোড়াই মানা হয়েছে তা নয়, অনেক ক্ষেত্রেই মন্ত্র অংশটা ব্রাহ্মণে চলে গেছে আবার ব্রাহ্মণের কিছু কিছু মন্ত্র অংশ চলে গেছে। যজুর্বেদে বিখ্যাত উপনিষদ ঈশোপনিষদ যেটা মন্ত্রের চল্লিশতম অধ্যায়ে দেওয়া হয়েছে, তার মাঝখান থেকে ব্রাহ্মণ অংশটা হারিয়ে গেছে। এই যে বিভাজনটা করা হয়েছে এটা সাধারণ ভাবে করা হয়েছে, সব সময় এই নিয়মটাই বরাবর অনুসরণ করা হয়নি। যেভাবে শ্রেণীবিন্যাস করা হোক না কেন সবটাই মিলবে না, কিন্তু এই চারভাগে শ্রেণী বিভক্ত করলে মোটামুটি কাছাকাছি আসে।
বেদকে জানার ক্ষেত্রে দুই ধরণের দৃষ্টিভঙ্গীকে মানা হয়, একটা হচ্ছে western approach ম্যাক্সমূলার, ডয়েটসনদের মত বড় বড় Ideologists আরেকটা হচ্ছে আমাদের পরম্পরা traditional approach এরা দুজন দুজনকে মানেনা। আমরা যে বেদ অধ্যয়ন করছি এটা পুরোপুরি ভারতীয় পরম্পরা দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে করা হচ্ছে। এই যে বলা হল যজুর্বেদে উনচল্লিশ অধ্যায় পর্যন্ত হচ্ছে মন্ত্র, অর্থাৎ এর বিভিন্ন অধ্যায়ের মন্ত্রগুলি বিভিন্ন যজ্ঞের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে, আর হঠাৎ চল্লিশ অধ্যায়ে এসে ঈশোপনিষদ এসে গেল, যার মন্ত্র যজ্ঞে ব্যবহার করা হয় না। এখন যদি কেউ জিজ্ঞেস করে এই উনচল্লিশটা অধ্যায় হচ্ছে মন্ত্র অংশের আর চল্লিশ অধ্যায় হচ্ছে উপনিষদ এটা কে ঠিক করে দিয়েছে? কেউ বলতে পারবে না কে ঠিক করে দিয়েছে। আদিম কাল থেকে এটা এই ভাবেই চলে আসছে। কোথাও কোন গুরু বলে দিয়েছিল এই ঊনচল্লিশটি অধ্যায় হচ্ছে মন্ত্র আর চল্লিশতম অধ্যায়টা হচ্ছে উপনিষদ। সেই থেকে তার শিষ্য আবার তার শিষ্যকে বলেছে, এইভাবে গুরুশিষ্য পরম্পরায় চলে আসছে। গুরু পরম্পরায় হতে হতে শঙ্করাচার্যের কাছে এসেছে। এখন ঈশোপনিষদের উপর শঙ্করাচার্য ভাষ্য রচনা করে দিলেন। তাঁর ভাষ্যের প্রথম লাইনটাকেই অনেকে ধরতে পারে না, তিনি বলছেন- কর্মসু অবিনিয়োগঃ, অর্থাৎ এই অধ্যায় শুক্লযজুর্বেদের চল্লিশতম অধ্যায়, এই অধ্যায়কে যজ্ঞে যে ব্যবহার করা হয় না সেটা ঠিকই করা হয়। কেন কর্মে বা যজ্ঞে ব্যবহার করা হয় না বোঝাই যাবে না। তাহলে এই অধ্যায়টা কিসের জন্য? বলা হচ্ছে- এটা ধ্যানের জন্য, এইটা চলে আসবে উপাসনাতে।
এখানে অন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিককে আমাদের মাথায় রাখতে হবে, প্রথম থেকেই গুরু পরম্পরায় চলে আসছে। এখন কোন গুরু তাঁর শিষ্যদের বলে দিলেন- তুমি সংহিতাটুকু মুখস্ত রাখো, তুমি ব্রহ্মণটুকু, তুমি আরণ্যক আর তুমি উপনিষদের অংশটুকু মুখস্ত রাখো। এভাবে পরে যে শিষ্য যে অংশের মন্ত্র মুখস্ত রেখেছিল সে আবার তার শিষ্যকে সেই মন্ত্রটা মুখস্ত করিয়ে যাচ্ছে। এখন মাঝখান থেকে যে ব্রাহ্মণ অংশটা মুখস্ত রেখেছিল সে ভালো শিষ্য পেলো না, কিংবা সে মরে গেল। এরপর কি হবে? এখানে এসে ঐ বেদের ব্রাহ্মণ অংশটা গেল হারিয়ে। আর এই ভাবেই বেদের অনেক শাখা হারিয়ে গেছে। কেননা তাঁরা কিছু লিখে রাখতেন না।
পরের দিকে এনারা মন্ত্রটাকে খুব গুরুত্ব দিলেন আর আরণ্যককে ততটা গুরুত্ব দিতেন না। কারণ আরণ্যক যে জিনিষকে অবলম্বন করে তৈরী হয়েছিল সেটা মন্ত্র অংশে আগে থাকতেই আছে। আর যে উদ্দেশ্যকে সে নির্দেশ করছে সেটাও আগেই উপনিষদে নির্দেশ করে দিয়েছে। এই কারণে সব থেকে প্রথমে আরণ্যক অংশটাই নষ্ট হতে আরম্ভ করেছে, কেননা আরণ্যকের উপযোগিতাই কেউ সেইভাবে অনুভব করতেন না। একটা নিজিষ যত ব্যবহার হতে থাকবে সেটা তত প্রচলিত থাকবে, আরণ্যকের ব্যবহার কমে যাওয়াতে আস্তে আস্তে এটা অপ্রচলিত হতে থাকল। ব্রহ্মণের ক্ষেত্রে দেখা গেল, এর মধ্যে বিভিন্ন কাহিনী আছে আর যজ্ঞ-যাগ কিভাবে করতে হবে তার বর্ণনা করা হয়েছে। পরের দিকে যজ্ঞ-যাগ করার জন্য যে নিয়মাবলী ছিল সেগুলো কল্পসূত্র, গৃহসূত্র ইত্যাদি নামে আলাদা অভিধান বানিয়ে নিয়েছিল। এর ফলে ব্রাহ্মনের গুরুত্বও কমে গেল। পণ্ডিতেরা তখন করলেন কি একদিকে তাঁরা মন্ত্র মুখস্ত করতে থাকল আর অন্য দিকে উপনিষদকেও মুখস্ত রাখতে থাকল। যার ফলে মন্ত্র অংশ ও উপনিষদের অংশটা সহজে হারিয়ে যেতে পারল না। কিন্তু এই দুটো ব্রাহ্মণ আর আরণ্যক ভীষণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেল। পরবর্তিকালে দেখা গেল বেদের এই ব্রাহ্মণ আর আরণ্যক অংশ আমাদের পুরানাদি গ্রন্থে নানা আকারে ঢুকে গিয়ে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে। সেইজন্য আমরা কখনই বলতে পারিনা যে ব্রাহ্মণ আর আরণ্যক আমাদের ভারত থেকে সম্পুর্ণ ভাবে হারিয়ে গেছে। তবে এই দুটো অন্য ভাবে জায়গা করে নিয়ে এখনও আধ্যাত্মিক পিপাসু মানুষের অনেক চাহিদা পূরণ করে চলেছে।
খুব সুন্দর সহজ সরল বোধ্যগম্য বিশ্লেষন
উত্তরমুছুনপ্রনাম গুরুমহারাজ