আচার্য শঙ্কর প্রণােদিত গীতার সম্বন্ধভাষ্য-পর্ব ০৩
আচার্য শঙ্কর প্রণােদিত গীতার সম্বন্ধভাষ্য
পর্ব ০৩
ওঁনারায়ণঃ পরোহ ব্যক্তাদণ্ডম ব্যক্ত সম্ভব।
অণ্ডস্যান্তস্ত্বিমে লোকঃ সপ্তদ্বীপাচ মেদিনী।।
আচার্য এমন একটি মন্ত্রকে নিয়ে এসেছেন যে মন্ত্র দিয়ে পুরো হিন্দু ধর্মের দর্শন কে স্পষ্ট করে দাঁড় করিয়ে দেওয়া যায়। গীতাতেই পরে আসবে যেখানে বলা হচ্ছে কোন শুভ কাজ করার আগে ওঁ উচ্চারণ করে কাজ শুরু করতে হয়। ওঁ সব সময় স্বস্তিবাচক। কোন কিছু ব্যবহার করার সময় মনে কোন সংশয় থাকলে ওঁ উচ্চারণ করে দিলে ওই দ্রব্যের সব দোষ কেটে যায়। কোথাও আবার ওঁ সম্মতি বাচক। হিন্দুদের কাছে ওঁ অত্যন্ত পবিত্র ধ্বণি। এখানে অব্যক্ত মানে প্রকৃতি, প্রকৃতি আবার ত্রিগুণাত্মিকা সত্ত্ব, রজ আর তমো এই তিনটে গুণকে মিলিয়ে প্রকৃতি। প্রকৃতিকে এখানে যেমন অব্যক্ত বলা হচ্ছে ঠিক তেমনি অব্যক্ত ছাড়াও প্রকৃতি কে অন্য অনেক নামে সম্বোধিত করা হয়, প্রকৃতি কে কখন বলা হয় মূলা। আবার প্রকৃতি কে কখন ব্যক্ত ও বলা হয়, কারণ এই প্রকৃতি কে ইন্দ্রিয়ের দ্বারা জানা যাচ্ছে বলে ব্যক্ত বলা হচ্ছে। আবার এই প্রকতি কে ঠিক ঠিক জানা যায় না বলে অব্যক্ত ও বলা হয়। এই জগতে জড় বলতে যা কিছু আছে সবই প্রকৃতি, জড় মানেই প্রকৃতি। প্রকৃতির বাইরে হলেন শুদ্ধ চৈতন্য। যে কোন প্রাণীর দুটো করে সত্তা, একটি তার জড় সত্তা আরেকটি তার চৈতন্য সত্তা। একজন মানুষ চলছে ফিরছে কথা বলছে সেই মানুষ যখন মারা যায় তখন তার দেহটা জড় পদার্থের মত পড়ে থাকবে। কিন্তু যখন বেঁচে ছিল তখন যে চলছিল, ফিরছিল, কথা বলছিল তখন সেখানে বোঝা যাচ্ছিল যে তার মধ্যে চৈতন্য আছে। প্রত্যেক প্রাণীই হল এই চিৎ আর জড়ের একটা করে গ্রন্থি শাস্ত্রের পরিভাষায় যাকে বলা হয় চিজ্জড় গ্রন্থি। আমি হাত নাড়ছি এটাও জড়, এই হাত কে আমার স্নায়ু গুলো নাড়ছে এই স্নায়ু গুলো ও জড়, স্নায়ু কে পরিচালিত করছে মস্তিষ্ক সেটাও জড় আর মস্তিষ্ক কে মন পরিচালনা করছে এই মনটাও জড়। হিন্দুদের কাছে মনটা ও জড়। আমাদের ঋষিরা জানতেন মন যদি জড় না হয় তাহলে যুক্তি গত অনেক সমস্যা এসে যাবে। বিজ্ঞান আর ধর্মের মধ্যে এই জায়গাতেই বিবাদ শুরু হয়। বিজ্ঞানের মতে মন হল পুরোপুরি চৈতন্য আর বেদান্ত মনকে চৈতন্য বলে মানবেই না,এই নিয়ে তাঁরা কোন কথাই বলবেন না, তাঁদের কাছে মন পুরোপুরি জড় পদার্থ। মন যদি জড় হয় তাহলে মন অবশ্যই প্রকৃতির এলাকার বস্তু। এই মন দিয়ে আমরা যা কিছু কে গ্রহণ করছি যখনই ভালো লাগা, খারাপ লাগা, আনন্দ লাগা, দুঃখ লাগা, কষ্ট পাওয়া, সুখ পাওয়া বলছি তার মানে আমি প্রকৃতির এলাকার মধ্যে পড়ে রয়েছি। মা যখন তার সন্তানকে ভালোবাসছে তখন সেটাও যেমন প্রকৃতির এলাকা, আমরা যখন বেদ, গীতা, উপনিষদ অধ্যয়ন করছি সেটাও তখন প্রকৃতির এলাকা।যিনি ভগবান নারায়ণ তিনি হলেন ‘পরোহব্যক্তাদ’ অর্থাৎ তিনি অব্যক্ত মানে প্রকৃতির ও পারে। শুদ্ধ চৈতন্য যিনি, ভগবান যিনি, আত্মা যিনি চৈতন্য যিনি, তিনি মনের পারে। সব থেকে স্থুল হল এই পরিদৃশ্যমান জগৎ। এই স্থূল জগৎ থেকে আরও সূক্ষ্ম হল ইন্দ্রিয় গুলো, যার দ্বারা এই স্থুল জগৎ কে জানা যায়। ইন্দ্রিয় থেকে মন আরও সুক্ষ্ম। কারণ মন ইন্দ্রিয় কে নিয়ন্ত্রণ করছে। এই মনের এলাকার পারে যিনি আছেন তিনিই ঈশ্বর। এটা কোন তত্ত্ব নয়, এটাই সত্য, এটাই বাস্তব, ঋষিরা ধ্যানের গভীরে এটাই দেখেছেন। আমার মন যত দূর যেতে পারে, মন যত উচ্চ থেকে উচ্চ স্তরের চিন্তা করতে পারে, তারপর একটা উচ্চ অবস্থার পর মন আর কিছু গ্রহণ করতে পারে না মন খসে পড়ে যায়, সেই অবস্থার ও পারে ভগবান নারায়ণ। সেই জন্য এই মন দিয়ে কোন দিন ঈশ্বর কে জানা যাবে না। কেউ যদি বলেন আমি ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করে দেখিয়ে দেব বুঝতে হবে তিনি কিছুই বোঝেননি। কারণ যখনই বলছে প্রমাণকরে দেব, তার মানে তিনি এখনও মনের এলাকাতেই পড়ে আছেন, অথচ ভগবান মনের এলাকার ও পারে। এই একই কথা উপনিষদ ও বলছে। তৈত্তিরীয় উপনিষদ পরিষ্কার বলে দিচ্ছে- যতো বাচো নিবর্তন্তে অপ্রাপ্য মনসা সহ। কোন বস্তুর বর্ণনা করার জন্য আগে মন দিয়ে সেই বস্তু কে ধরে বুদ্ধির বিষয় করতে হবে তারপরেই তাকে বাণী দিয়ে প্রকাশ করা যাবে। তাই বাণী দিয়ে ঈশ্বরকে বর্ণনা করা তো অনেক দূরের কথা, তোমার মন তো সেখানে পৌঁছাতেই পারছে না।
অণ্ডমব্যক্ত সম্ভবম্ অণ্ডম্- মানে এখানে ব্রহ্মা কে যিনি সৃষ্টির কার্যে ব্যপ্ত তাঁকে বলা হচ্ছে। সেই ব্ৰহ্মার কোথা থেকে জন্ম হয়, প্রকৃতি থেকে ব্রহ্মার জন্ম হয়। খুব সহজ ভাবে বলতে গেলে বলা যেতে পারে, সেই শুদ্ধ ব্ৰহ্ম রয়েছেন, যাঁকে ঈশ্বর বা ভগবান বলা হয়, যাঁকে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন এই শুদ্ধ ব্ৰহ্মই আছেন, এঁর বাইরে আর কিছু নেই। কিন্তু কোন এক কারণে এই শুদ্ধ ব্রহ্মের উপর একটা মায়ার আবরণ পড়ে যায়। যখনই এই মায়ার আবরণ এসে যায় তখন যিনি নির্গুণ নিরাকার তাঁকে সগুণ সাকারের মত দেখাতে শুরু করে। মায়া যদি না থাকে তখন কখনই ঈশ্বর কে দেখা যাবে না মায়ার বাইরে ঈশ্বর কে বোধে বোধ করতে হবে। কিন্তু সেই ঈশ্বরের কোন গুণ নেই। যেমনি তাঁর নিজের মায়া এই নির্গুণ ঈশ্বরের উপর দিয়ে দেওয়া হয় তখন তাঁকে গুণময় দেখায়। স্বামীজী ঠাকুরের যে আরত্রিক স্তব রচনা করেছেন, সেখানেও ঠিক এইভাবে তিনি বর্ণনা করছেন-নির্গুণ গুণময়। এই যে যিনি নির্গুণ তাঁকেই গুণময় দেখাচ্ছে এটাই তাঁর মায়া বা তাঁর শক্তি। মায়া বলতে এখানে কোন ম্যাজিকের মত কিছু নয়, মায়া মানে ঈশ্বরের নিজেরই একটা বিশেষ শক্তি। সেই জন্য এই শক্তিকেই বলা হয় বৈষ্ণবী ভগবান বিষ্ণুর বিশেষ শক্তি। মায়া আর মিথ্যাও এক নয়। লোকেদের একটা ভুল ধারণা হয়ে আছে যে, টাকা-পয়সা, নারী এগুলো মায়া, সব মিথ্যা। কিন্তু এই মায়া মিথ্যা নয়, এটাই ভগবান বিষ্ণু বা নারায়ণের বিশেষ শক্তি। যাই হোক, সেই অব্যক্ত থেকে অণ্ডম এর অর্থাৎ ব্রহ্মার উৎপত্তি হয়।
রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ বিশ্ববিদ্যালয়, বেলুড় মঠ।
প্রবচন- স্বামী সমর্পণানন্দ।
কৃতজ্ঞতা- অমিত রায় চৌধুরী
ক্রমশ-
কোন মন্তব্য নেই