আর্যপ্রভা-ভূমিকা
আর্যপ্রভা
(হিন্দু সংস্কৃতির কথা)
শ্রীসুরেন্দ্রনাথ সেন
ভূমিকা
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ শতবার্ষিকী উপলক্ষে নানা ভাষায় নতুন সাহিত্যের সৃষ্টি হয়েছে। এই বর্ষ ব্যাপী পুন্য অনুষ্ঠানে আর্যপ্রভা’ গ্রন্থকারের ব্যক্তিগত উদ্যম। এ রকম নানা বিষয়ের আলোচনা এক জনের দ্বারা সম্ভব হয় না। সুতরাং আর্যপ্রভায় যে বহু ত্রুটি থেকে যাবে তা গ্রন্থকারের অবিদিত নেই। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ সমিতির উচিত ছিল যোগ্যতর ব্যক্তিকে নির্বাচন করা।
প্রায় পাঁচ বৎসর পূর্বে পার্শিবাগান শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ সমিতির সাপ্তাহিক অধিবেশনে ধারাবাহিক প্রবন্ধ পাঠ আরম্ভ করি। এরও কয়েক বৎসর পূর্বে আমার কোন প্রবাসী বন্ধুর সঙ্গে প্রবন্ধের বিষয় গুলি নিয়ে পত্র বিনিময় হয়। তার ফলে প্রবন্ধগুলি প্রশ্নোত্তর আকারে লিখে ফেলি। ঐ প্রশ্নোত্তর মালাই সমিতিতে পড়া হয়। সমিতির নির্দেশে প্রবন্ধ পাঠ প্রায় দুই বৎসর কাল চলে। প্রত্যেক অধিবেশনের পর যে সব অতিরিক্ত প্রশ্ন উত্থাপিত হত তার মধ্যে কতকগুলির উত্তর পরবর্তী অধিবেশনে দেওয়া হত। এইভাবে বিষয় অতিরিক্ত অনেক কথার আলোচনা অবশ্যম্ভাবী হয়েছে এবং নতুন শ্রোতার নতুন প্রশ্নের উত্তরের জন্য পুনরুক্তিও হয়েছে। ঐ গুলি লিখিত হয়ে মূল প্রবন্ধে যুক্ত হয়েছে।
কলকাতা টাউন হলে শতবার্ষিকী উপলক্ষে যে মহততর সভা হয়, তার প্রায় নয় মাস পূর্বে আৰ্যপ্রভার সমস্ত পাণ্ডুলিপি ছাপা খানায় প্রেরিত হয় ও ঐ গুলি ঐ খানেই এতাবত ছিল। নানা কারণে আর্যপ্রভা প্রকাশে বিলম্ব হল। প্রশ্নগুলি বাদ দেওয়ায় সমস্ত বিষয়টি টানা প্রবন্ধকারে লিখতে হয়েছে। পথ নির্ণয় প্রবন্ধগুলি সমিতির ১ম বারের শতবার্ষিকী অনুষ্ঠান উপলক্ষে লেখা হয় ও সমিতিতে পড়া হয়। কয়েকজন বন্ধুর অনুরোধে মন্ত্র বিদ্যার কতক অংশ পরিবর্দ্ধিত হয়েছে। পাদুকাতত্ত্ব’ ও চক্রভেদ’ প্রবন্ধদ্বয় সমিতিতে পড়া হয় নি।
মূল প্রবন্ধগুলিতে সর্বত্র শাস্ত্র প্রমাণ দেওয়া ছিল না। শতবার্ষিকী উপলক্ষে গ্রন্থাকারে ঐ গুলি প্রকাশ করার ইচ্ছার সঙ্গে প্রমাণ সংগ্রহ করার চেষ্টা হয়। এই দুরূহ কাজ সম্পাদন আমার দ্বারা অসম্ভব হত, যদি না জন্ ডিকেন্সনের সোদব প্রতিম শ্রীযুক্ত বাবু যতীন্দ্রনাথ দত্ত মহাশয়ের সাহায্য পেতাম। তিনি ঋগ্বেদ সংহিতা- মূল ও ভাষ্য, অথর্ববেদ সংহিতা-মূল ও ভাষ্য, আচার্য রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী অনুদিত ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, মহামহোপাধ্যায় বিধুশেখর শাস্ত্রী অনুদিত শতপথ ব্রাহ্মণ, মূল কুলার্ণব তন্ত্র ও অন্যান্য কয়েক খানি গ্রন্থ একে একে আমাকে এনে দেন। তিনি যে কেবল প্রমাণ সংগ্রহে সাহায্য করেছেন তা নয়, নিজের কাজ মনে করে গ্রন্থ প্রকাশে তিনি যেমন আগ্রহ প্রকাশ করেছেন তার জন্য গ্রন্থকার তার কাছে বিশেষ কৃতজ্ঞ। সেই রূপ প্রবন্ধগুলি টানা লেখার সময় সমিতির সম্পাদক পরম স্নেহভাজন শ্রীমান সত্যেশ্চন্দ্র মিত্র আমাকে কয়েকখানি উপনিষদ সংগ্রহ করে দেন। এজন্য আমি সত্যেশ ভাইয়ের নিকটও কৃতজ্ঞ। প্রুফ দেখার সময়ও কিছু প্রমাণ সংগৃহীত হয়। মৎপ্রণীত ভারতধারা’র মুখবন্ধে বলেছি যে, যে সব মহান চরিত্র দেখেছি, তাঁদের ছবি কোন তুলিতে চিত্রিত হওয়া অসম্ভব। ঐ সকল মহাজনের পদতলে বসে যা শুনেছি, যা শিখেছি, বা বুঝেছি, তারই মাত্র আংশিক ভাবকে আর্যপ্রভায় রূপ দেবার চেষ্টা করেছি। এই সমস্ত বুঝে সাধু ভক্ত ও সজ্জনগণ যেন গ্রন্থকারের ত্রুটি মার্জনা করেন।
আর্যপ্রভায় এক স্থানে শ্রীচৈতন্যকে পুরী সম্প্রদায়ের বলা হয়েছে। এই ভূলটি কোনক্রমে প্রবিষ্ট হয়েছে। শ্রীচৈতন্যের দীক্ষাগুরু ঈশ্বরপুরী, সন্ন্যাস গুরু কেশব ভারতী। কবি কর্ণপুর তাকে মাধ্ব সম্প্রদায়ের সাধক করেছেন, যদিও অনেকে কর্ণপুরের কথায় আস্থা স্থাপন করেন নি। মহাপ্রভু যে সম্প্রদায়েরই হোন তাতে কিছু এসে যায় না। দক্ষিণে শ্রীরামানুচাৰ্য যে ভক্তিবাদে তরঙ্গ তোলেন, সমস্ত পরবর্তী ভক্তিবাদে ঐ তরঙ্গের হিল্লোল বর্তমান।
বর্তমান হিন্দুর ধর্মাচার ও সংস্কৃতিতে তন্ত্রের প্রভাব স্পষ্ট। সেই জন্যই তন্ত্র সম্বন্ধে বিশেষ করে বলার জন্য সমিতি অনুরোধ করেন। বুনবাদ ও উত্তল এশিয়া (সস্তল) প্রভৃতি স্থানের প্রাচীন মতবাদ প্রভাবে অনুরঞ্জিত স্থান ছাড়া (মহাযান) বৌদ্ধ তন্ত্র ও শাক্ত-শৈব্যাগমে তত্ত্বগত পার্থক্য নেই। ঐ তন্ত্রের শূন্যতা=তৎ।
অনুষ্ঠান হতে জাতির মনস্তত্ব ও সংস্কৃতি অপেক্ষাকৃত সহজে বোঝা যায়। সুতরাং আর্যপ্রভায় ঐ গুলির স্থান আছে মনে করি। তারিখ বা সময় নিয়ে বেশী মাথা ঘামাই নি। সংস্কৃতি গত মূল ভাব ঠিক থাকলেই হল। তারিখ গুলি যেটা যেমন পেয়েছি সেই অনুসারে বিচার করেছি মাত্র।
সমিতিতে রাজনীতি চর্চা হয় না। সংস্কৃতি গত পার্থক্য দেখাবার জন্য যতটুকু রাজনীতি জ্ঞানের দরকার, মাত্র সেটুকুই আর্যপ্রভায় স্থান পেয়েছে। প্রধানতঃ হিন্দুশাস্ত্রকে ভিত্তি করে আর্যপ্রভায় সব কথা আলোচিত হয়েছে। আশা কবি অন্যান্য ধৰ্মবিশ্বাসীগণ তাদের নিজ নিজ শাস্ত্রগুলিকে ভিত্তি করে ভারতীয় সংস্কৃতির আলোচনা করবেন।
আর্যপ্রভায় শ্রীমদ স্বামী বিবেকানন্দকে সর্বস্থানে স্বামীজি’ বলা হয়েছে। সেইরকম শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলা প্রসঙ্গ’ স্থানে মাত্র লীলা প্রসঙ্গ লিখেছি।
ইতি গ্রন্থকার
শ্রীসুরেন্দ্রনাথ সেন
প্রীতি পুর্বক অনুরোধ- লেখাগুলি আপনাদের ভালো লাগলে শেয়ার করবেন। ‘সনাতন ধর্মতত্ত্ব’ ব্লগ এ প্রকাশের পর পাঠক আগ্রহ অনুসারে বই ছাপানোর কাজে মনোযোগ দেবার প্রত্যাশা রাখি।
সংকলনে- কৃষ্ণকমল।
কোন মন্তব্য নেই