sanatansangbed

Introduction of SANATAN dharma scriptures

"ধর্ম্মোহস্য মূলানি।"

সদাচারের মূল ধর্ম। ধর্ম অর্থে শাস্ত্রীয় বিধির প্রতিপালন। এখনকার কালে বিধি প্রতিপালনের ব্যাঘাতক পাঁচটি বস্তু দেখা যায়।

১) বিধি বিষয়ক অজ্ঞতা, 

২) বিধির প্রতি শ্রদ্ধাহীনতা,

৩) বিজাতীয় অনুকরণের আতিশয্য,

৪) স্বেচ্ছাচারিতার প্রাবল্য,

৫) স্বাভাবিক আলস্য।

আপাত দর্শনে আমাদের মধ্যে এই পাঁচটি দোষই বাড়ছে বলে বোধ হয়।

১) ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা বৃত্তিবিহীন হয়ে অন্ন-চিন্তায় বিব্রত হয়েছেন; তারা শাস্ত্রের অধ্যয়ন অধ্যাপন পূর্ব্বের ন্যায় মনঃসংযোগ সহকারে নির্বাহ করতে পারেন না; সুতরাং শাস্ত্রীয় বিধির সম্বন্ধে তাঁদের নিজের এবং জনসাধারণের অজ্ঞতা জন্মেছে। 

২) বিজাতীয় শিক্ষার প্রভাব বৃদ্ধি হওয়াতে শাস্ত্রীয় বিধির প্রতি শ্রদ্ধা-হীনতা জন্মেছে। এখন শৈশব অবধি যে ইংরেজী বিদ্যার শিক্ষা হয়, তাতে শাস্ত্রীয় বিধির কিছু মাত্র উল্লেখ থাকে না, প্রত্যুত সাক্ষাৎ বা পরস্পরা সম্বন্ধে দেশীয় শাস্ত্রজাতের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশই থাকে; সুতরাং শিক্ষার কাল হতেই লোকের মনে শাস্ত্রাচারের প্রতি অবিশ্বাস জন্মে যায়।

৩) এতদ্দেশে শাস্ত্রাচার-বিহীন বিজাতীয় জনগণের ভূতি দর্শনেও শাস্ত্রাচারের প্রয়োজনীয়তা বোধটি ন্যুন হয়ে পড়ে এবং ঐ বিভব-সম্পন্ন বিজাতীয়েরা কিভাবে এবং কেমন সকল বিষয়ে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়েছে তার বিচার না করে, মোহবশতঃ দেশীয় জনগণ আপনাদের শাস্ত্রবিরোধী ব্যবহারের অনুকরণে প্রবৃত্ত হন। 

শাস্ত্রাচার লোপের উল্লিখিত তিনটি হেতুই আগন্তুক। ওগুলি পূর্ব্বে অল্প বলবান ছিল এখন প্রবল হয়েছে। উহাদের অপনয়ন অতি কঠিন হলেও একান্ত অসাধ্য বলে মনে করা যায় না। 

১) যদি শাস্ত্রীয় বিধি সকল জানার জন্য তেমন অভিলাষ হয়, তবে তা জানা যেতে পারে। এখনও দেশে অনেকটা শাস্ত্রজ্ঞান আছে, এখনও দেশের মধ্যে অনেক লোকে শাস্ত্রীয় বিধির পালন করে চলতে চেষ্টা করেন এবং পালন করে থাকেন। 

২) বিজাতীয় শিক্ষার দোষও ছাত্র-ছাত্রীদের কৈশোরে এবং যৌবনেই অতি প্রবল হয়, বয়োহধিক এবং চিন্তাশীলদের মধ্যে ঐ দোষ অনেক ন্যুন হয়ে থাকে, এবং যে বিজাতীয় শিক্ষার দোষে শাস্ত্রাচারের প্রতি অশ্রদ্ধা জন্মে, সেই বিজাতীয় শিক্ষার বিশেষ প্রগাঢ়তা জন্মিলেও ঐ দোষ অনেকটা কেটে যেতে পারে। যেমন মলিন বস্তুদ্বারা বলবৎ ঘর্ষণে তৈজস আদির পূর্বের অমলিনতা বিদূরিত হয়, তেমনি যে বিজাতীয় শিক্ষা আচার মালিন্য জন্মায়, তারই সম্যক্ অনুশীলনে ঐ মালিন্য অপনীত হবার সম্ভাবনা। ইউরোপীয় বিজ্ঞান বিদ্যার বিশেষ অনুশীলনের দ্বারা স্বদেশীয় শাস্ত্রাচারের সারবত্তা বহু পরিমাণে যুক্তি মুখেও সুপরিস্ফুট হয়ে উঠে। পূর্বে ইংরেজি পড়ে দেশীয় যুবকেরা যেমন দিগ্বিদিক্ জ্ঞানশূন্যের ন্যায় কথা বলতেন এবং ব্যবহার করতেন, এখনকার ইংরাজী শিক্ষিতেরা প্রায় কেউই তেমন উন্মাদ্গ্রস্ত হন না।

৩) যে ইংরাজ জাতি ভারতবর্ষে প্রাধান্য লাভ করেছিল, তাঁদের প্রাবল্যের প্রকৃত হেতু কি, তা ভাল করে বুঝবার চেষ্টা করলেই দেখা যায় যে, ঐ প্রাধান্যের হেতু অনাচার বা অত্যাচার নয়, উহার হেতু তাঁদের স্বদেশের ও স্বধর্মের উপযোগী আচার রক্ষা নিবন্ধন শরীর এবং মনের-দৃঢ়তা এবং পটূতা এবং পরস্পর ঐকান্তিক সমানুভূতি। আমাদেরও শাস্ত্রোক্ত আচার গুলির উদ্দেশ্য বিচার করলে সুস্পষ্ট ভাবেই অনুভূত হয় যে, শাস্ত্রাচার দ্বারা শরীরের সারবত্তা, তেজস্বিতা এবং পটূতা জন্মে এবং মনের উদারতা এবং সাত্ত্বিকতা সম্বর্দ্ধিত হয়। সুতরাং শাস্ত্রোক্ত আচার রক্ষা দ্বারাই এতদ্দেশীয় জনগণ ইংরাজদের অপেক্ষা ও উচ্চতর গুণের অধিকারী হতে পারেন। লোকের মন যে ক্রমে ক্রমে এই তথ্যের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে এবং ইংরাজের অযথারূপ অনুকরণ যে এদেশে অনিষ্টকর এবং নীচ প্রকৃতিকতার লক্ষণ বলেই অনুভব করছে, তার সন্দেহ নেই। এখন ইংরাজীতে কথা বলার সাধ, পেন্টেলুন্, হ্যাট পরিবার সাধ, টেবিলে বসে খানা খাওয়া সাধ, অনেকটা কমে গেছে। ঐ সকল সাধ যেমন হিন্দু কলেজের প্রথম ছাত্রদলের মধ্যে ছিল, বিশ্বাবিদ্যালয়ের বি, এ, এম, এ প্রভৃতি উপাধি প্রাপ্ত ব্যক্তিদেরও মধ্যে তেমন নেই। 

অতএব শাস্ত্রাচার লোপের যে তিনটি আগন্তুক কারণ এখন প্রবল হয়েছে সতঃই সে তিনটি কারণের প্রাবল্য উপশমিত হতে পারে।

কিন্তু মানুষের হৃদয়ের যে সাহজিক দুইটি দোষ নিবারণের জন্য শাস্ত্র আচারের সৃষ্টি, শুদ্ধ কর্ম সহকারে অথবা অন্য কোন উপায়ে সে দোষ নিবারণ হওয়ার নয়। সে দুইটির নিবারণ একমাত্র শাস্ত্রাচারের অবলম্বনেই সিদ্ধ হতে পারে।   

মানুষের মধ্যে পশু ধর্ম এবং জড় ধর্ম দুই’ই আছে। 'পশুধর্ম' হতে স্বেচ্ছাচার জন্মে। যখন যাহা করতে ইচ্ছা হল তখনই তা করতে প্রবৃত্ত হওয়া, তার ফলাফল বিচার না করা, পশুর ধর্ম। ঐ পশু ভাবের নূন্যতা সাধন আমাদের শাস্ত্রের একটি মুখ্য উদ্দেশ্য। শাস্ত্রের অভিপ্রায়, মানুষ আপন উদ্দেশ্যের স্থিরতা, মনোযোগের ঐকান্তিকতা, চিত্তের প্রশস্ততা, এবং শরীরের পটুতা সম-বর্দ্ধন সহকারে সকল কাজ করেন। খাবার সামগ্রী দেখলেই খেলাম, শয়নের ইচ্ছা হলেই শুইলাম, ক্রোধ আদির প্রবৃত্তি হলেই তদনুসারী কাজ করলাম, এমন যথেচ্ছব্যবহার আর্য শাস্ত্রের বিগর্হিত। এগুলির নিবারণ শাস্ত্রাচারের পালনেই সত্ত্বগুণের সম-বর্দ্ধন হয়ে ঐ সকল রজোগুণ-সম্ভুত দোষের পরিহার হতে পারে।

মানুষে যে 'জড়ধর্ম' আছে তার অতি সুস্পষ্ট লক্ষণ তার আলস্য। শাস্ত্রাচার আলস্য নাশ করে। শাস্ত্রকর্ত্তৃক সমস্ত জীবিত কালের উপযোগী বিশেষ বিশেষ কাজের নির্দেশ হওয়াতে জড়তা প্রাপ্তির অবসর থাকে না। আবার শাস্ত্র বিনির্দ্দিষ্ট কাজ গুলি এমনে যে, তাদের যথোচিত সাধনে সাধারণতঃ শরীরের বলবত্তা এবং তেজস্বিতার বৃদ্ধি হয়। শাস্ত্র একবারও আমাদেরকে একান্ত আল্গা হতে দেয় না। যথোচিত কালে এবং যথাযোগ্য অবস্থায় আমাদেরকে আহার, বিহার, নিদ্রা আদি সেবন করতে বিধি প্রদান করেন; কিন্তু লোভ, সুখেচ্ছা, অথবা আলস্যের বশীভূত হয়ে কিছুই করতে দেন না। 

শাস্ত্রাচারের এই জড়তা-নাশক গুণটির প্রতি তেমনি লক্ষ্য না করে এর স্বেচ্ছাচার নিবারণের প্রতি সমধিক দৃষ্টি করা হয়, সেই জন্য দুইটি আপত্তির উন্থাপন হয়ে থাকে। 

কেউ বলে শাস্ত্রাচার সমস্ত প্রবৃত্তির পথ একেবারেই রুদ্ধ করে দেন। মানুষের জীবনে কিছুকাল তেজস্বিতা থাকতে দেন না। মানুষকে নির্জীব বৎ করে ফেলেন। কোন শান্তশীল সুবোধ ব্যক্তি নিন্মে উদ্ধৃত শ্লোক কয়েকটি শুনছিলেন- 


আত্মানং রথিনং বিদ্ধি শরীরং রথমেব তু৷

বুদ্ধিং তু সারথিং বিদ্ধি মনঃ প্রগ্রহমেব চ৷৷

ইন্দ্রিয়ানি হয়ান্ আহুঃ বিষয়াংস্তেষু গোচরান্৷

আত্মেন্দ্রিয়মনোযুক্তং ভোক্তে ত্যাহুর্মনীষিণঃ.৷

যস্তু বিজ্ঞানবান্ ভবত্যযুক্তেন মনসা সদা৷

তস্যেন্দ্রিয়ান্যবশ্যানি দুষ্টাশ্বা ইব সারথেঃ.৷

যস্তু বিজ্ঞানবান্ ভবতি যুক্তেন মনসা সদা৷

তস্যেন্দ্রিয়ানি বশ্যানি সদশ্বা ইব সারথেঃ.৷

(প্রথম অধ্যায়.৷ তৃতীয় বল্লী, ৩-৬ মন্ত্র)


আত্মাকে রথী, শরীরকে রথ, বুদ্ধিকে এর সারথি, মনকে মুখরজ্জু, ইন্দ্রিয়গণকে (চোখ নাক কান চামড়া জিভ) গণকে অশ্বরূপ জানবে। ঐ অশ্বগণ বিষয়ভোগ গতিশীল। জ্ঞানিগণ বলে যে, ইন্দ্রিয় এবং মনের যোগে আত্মা বিষয় ভোগ করেন। যিনি জ্ঞানহীন এবং মন দ্বারা অযুক্ত, তাঁর রথ দুষ্ট অশ্বের দ্বারা বাহিত রথের ন্যায় হয়। যিনি সুবোধ এবং মন দ্বারা সংযুক্ত তাঁর ইন্দ্রিয় সকল সদশ্ব বিশিষ্ট সারথির অশ্বের ন্যায় বশীভূত থাকে। 

কৃষ্ণযজুর্বেদীয় বা কঠোপনিষদে নচিকেতার কাছে যমরাজ আত্মতত্ত্ব ব্যাখ্যা করার শ্লোকগুলি তিনি শুনে বললেন, অশ্বেরা দুষ্ট হলে মনরূপ প্রগ্রহ দ্বারা তাদেরকে টেনে রাখতে হয়, কিন্তু যদি অশ্বেরা এমুনি দুর্বল হয়ে যায় যে আর চলতেই না পারে, তাহলে কি করতে হইবে, তা তো বলা হল না। 

শাস্ত্রাচারের সম্বন্ধে এমন একটি ভ্রম কখনো কখনো হয়ে থাকে। তাহার একটি কারণ শাস্ত্রাচারের জড়তা নাশক এবং তেজস্বিতা-সাধকগুণের প্রতি লক্ষ্য না করা। অপর কারণ; শাস্ত্রাচারের মধ্যে গৃহস্থ কর্ত্তব্য এবং বানপ্রস্থ আদির কর্ত্তব্যে যে পার্থক্য আছে, তার অনুধাবন না করা। গৃহস্থ আশ্রমীর পক্ষে শরীরের পীড়ন বা ক্ষয় করা শাস্ত্রে নিষিদ্ধ। পূর্বেকার লোকেরা অধিক পরিমাণে শাস্ত্রাচার পালন করতেন; তাঁদের -আহার অধিক, বল অধিক, ও আয়ুস্মত্তা অধিক ছিল। তাঁদের ইন্দ্রিয়গণ এখনকার শাস্ত্রাচার বিহীন অলসদের ইন্দ্রিয়গণের ন্যায় বলহীন এবং অকর্ম্মণ্য হোত না। 

অপর কেউ কেউ বলেন যে শাস্ত্রীয় বিধি সকল আমাদেরকে অশেষ বন্ধনে নিবন্ধ করে ফেলেছে; উহা একেবারেই আমাদের স্বাধীনতা বিলুপ্ত করেছে। কিন্তু শাস্ত্রাচার স্বাধীনতা নষ্ট করে না; উহার দ্বারা জড়তার হ্রাস হওয়াতে প্রকৃত স্বাধীনতার বৃদ্ধিই হয়। একটি সামান্য দৃষ্টান্ত দেওয়া যাচ্ছে। শীতকালে যখন সকালে নিদ্রাভঙ্গ হয়, অনেকেই শয্যা ত্যাগ করে উঠতে পারেন না, রৌদ্র প্রখর হলে তবে উঠেন, হয়ত বিছানায় বসেই তামাক এবং চা খান। সমস্ত দিন তাঁদের শরীরে এক প্রকার জড়তা থেকে যায়। কিন্তু যাঁরা শাস্ত্রের বিধি পালন পূর্ব্বক নিদ্রাভঙ্গ হলেই ঈশ্বর স্মরণ করে শয্যা ত্যাগ করেন এবং প্রাতঃকৃত্য সম্পন্ন করেই স্নান সেরে আসেন, তাঁদের শীত-ভীতি থাকে না, জড়তা থাকে না, সজীবতা এবং কার্য্যক্ষমতা উগ্রিক্ত হয়, এবং সমস্ত দিন স্বচ্ছন্দে যায়। ঐ দুই প্রকার লোকের মধ্যে কাহারা স্বাধীন-শীত ভীতেরা, না প্রাতঃস্নায়ীরা? 

বিশেষ ভেবে দেখলে পৃথিবীর কোথাও সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেখতে পাওয়া যায় না। মানুষ ও হয় সামান্য প্রবৃত্তির, না হয় বিধি ব্যবস্থার 'বশ' হয়ে থাকে। এ দুয়ের মধ্যে 'অবিচারিত প্রবৃত্তির' বশ হওয়া অপেক্ষা 'বিচারিত বিধির' বশ হওয়াই শ্রেয়ঃ। 

উপনিষদে এই কথাই সুদৃঢ়ভাবে এবং রূপক অলঙ্কারে উক্ত হয়েছে "দেবাসুরাঃ সংযেতিয়ে"- দেবাসুরের যুদ্ধ হয়েছিল। ভগবান ভাষ্যকার বলেন- শাস্ত্রোদ্ভাসিত ইন্দ্রিয়গণ দেবতা, আর স্বাভাবিক বা তমোগুণাত্মক ইন্দ্রিয় অসুর। উহাদের যুদ্ধক্ষেত্র মনুষ্য শরীর। ইন্দ্রিয় বৃত্তির তমোগুণ নির্জিত হলেই দেবতার জয় হয় অর্থাৎ শাস্ত্রাচারের ফল হয়। সেই জন্য ধর্মই শাস্ত্রাচারের মূল। 


কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.