sanatansangbed

Introduction of SANATAN dharma scriptures

সনাতন বা হিন্দু ধর্ম গ্রন্থ

ধর্ম শব্দের অর্থ হল ধারণ করা। যা ধারণ করে মানুষ তার জীবনকে সর্বাঙ্গীণ সুন্দর ও সুখময় করে তােলে তাই ধর্ম।
জৈমিনি মিমাংসা সূত্র বলেছেন-
"য এব শ্রেয়ঙ্কর স এব ধর্ম্ম শব্দেনোচ্যতে" (মীমাংসা ১/২ সূত্রভাষ্য)
যে কাজের অনুষ্ঠান করলে মঙ্গল হয়, তার নামই ধর্ম এবং যা ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান, অতীত অর্থ অবগত হওয়া যায়, তার নাম ধর্ম, যা কিছু শ্রেয়, অর্থাৎ মঙ্গলজনক তার নাম ধর্ম।
সভ্যতা বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে যে সাহিত্য সংস্কৃতি ভারতের মাটিতে স্বয়ং উদ্ভূত হয়েছিল, সেই সাহিত্য পৃথিবীর অন্যান্য সভ্যদেশে যখন জ্ঞানের দীপ জ্বলেনি তখন সেই অজ্ঞানের যুগে আর্যদের জ্ঞানগরিমা ভারতের বুকে বিকশিত হয়ে উঠেছিল।
ঋগ্বেদের সূক্তগুলির আবির্ভাবের সময় থেকে বেদাঙ্গ রচনার শেষ সময় পর্যন্ত যে বিশাল সাহিত্যের সন্ধান পাই, সংক্ষেপে বৈদিক সাহিত্য বলতে এটাকেই বুঝায়। বৈদিক সাহিত্য ধর্মকে আধার করে  আবির্ভুত এবং আধ্যাত্মিক সত্যে পরিপূর্ণ।
মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিদের প্রজ্ঞানের মাধ্যমে আসা মন্ত্র গুলিকে মহাঋষি বেদব্যাস সংগ্রহ করেন এবং বিন্যাস করে সাজিয়ে দেন চার ভাগে।
বেদঃ (রচনাকাল ২০০০-২৫০০ খ্রী পূর্ব) ‘বেদ’ শব্দ বিদ ধাতু থেকে জাত। বিদ্ ধাতুর অর্থ জানা। অর্থাৎ যে গ্রন্থ বা যে শব্দরাশি মানবজাতিকে ধর্ম, অর্থ, কাম, মােক্ষ- এই চতুর্বর্গের সন্ধান দেয় তা’ই বেদ। মোট মন্ত্রসংখ্যা ২০৪৩৪।
ক) ঋক্‌বেদ (মন্ত্র সংখ্যা ১০৫৮৯), খ) সামবেদ (মন্ত্রসংখ্যা ১৮৯৩), গ) যজুর্বেদ(শুক্ল ও কৃষ্ণ, মোট মন্ত্র সংখ্যা ১৯৭৫) এবং ঘ) অথর্ববেদ (মন্ত্রসংখ্যা ৫৯৭৭)।
প্রত্যেক বেদের দুটি অংশ তা হলঃ
ক) ব্রাহ্মণ- বেদের যে ভাগে যাগ যজ্ঞের বিবরণ ও মন্ত্রের নানারকম ব্যাখ্যা আছে তার নাম ব্রাহ্মণ। একে বেদের আদিম ব্যাখ্যা বা বিবরণ বলা যেতে পারে ব্রহ্ম(ন্‌) শব্দের অর্থ বেদ। তার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ থাকায় ইহা ব্রাহ্মণ। এই ব্রাহ্মণ গুলির মধ্যে কর্ম ও জ্ঞান উভয়ের আলোচনা আছে। 
খ) আরণ্যক- ব্রাহ্মণ গুলির যে অংশে কর্ম ও জ্ঞান উভয়েরই সাংকেতি বা আধ্যাত্মিক আলোচনা আছে তাকে আরণ্যক বলা হয়, কেননা ইহা অরণ্যে অর্থাৎ বনে পাঠ করা হোতো, কারণ এসব কথা দুরূহ যেখানে সেখানে যাকে-তাকে শেখানো হোতো না এবং অবধারণ করার জন্য অতি নির্জন স্থান আবশ্যক। অনেক উপনিষদ্‌ এই আরণ্যকের অন্তর্ভুক্ত।

উপবেদঃ মূল বেদের সহকারী গ্রন্থ বলে এদেরকে উপবেদ বলে। যথাঃ- ক) আয়ুর্বেদ (ভেষজশাস্ত্র), খ) ধনুর্বেদ (অস্ত্রবিদ্যা), গ) গন্ধর্ববেদ (সঙ্গীত বিদ্যা) এবং ঘ) স্থাপত্যবেদ (কৃষিবিদ্যা)

উপনিষদঃ উপনিষদের সংখ্যা অনেক। বর্তমানে ১১২টি উপনিষদের নাম জানা গেছে। এ ১১২ খানা উপনিষদের মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য হলঃ ক) বৃহদারণ্যক, খ) শ্বেতাশ্বতরো, গ) ছান্দোগ্য, ঘ) ঐতরেয়, ঙ) তৈত্তিরীয়, চ) ঈশ, ছ) কেন, জ) কঠ, ঝ) প্রশ্ন, ঞ) মন্ডুক এবং ট) মান্ডুক্য প্রভৃতি।
বেদকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়- জ্ঞানকাণ্ড ও কর্মকাণ্ড। বৈদিক গ্রন্থে কর্ম বা জ্ঞানের আলোচনার কমবেশী একারণে নাম করণ হয়েছে। কর্মের মাধ্যমে প্রবৃত্তি থেকে নিবৃত্তিতে যাবার উপার কর্মকাণ্ড। মানব কল্যানের অন্য পথ জ্ঞানের পথে তাই জ্ঞানকাণ্ড। উপনিষদ গুলি জ্ঞানকাণ্ডের অন্তর্গত ও বেদের শেষভাগ। বহু উপনিষদ্‌ আরণ্যকের অন্তর্গত। কেবল ঈশোপনিষদ মন্ত্র বা সংহিতার মধ্যে পড়ে। উপনিষদের আরেক নাম বেদান্ত, বেদ এর অন্ত।
বেদাঙ্গঃ উপনিষদের যুগের পর আসে বেদাঙ্গ। বেদের অঙ্গ তাই বেদাঙ্গ। বেদের মর্ম যথার্থভাবে উপলব্ধি করার জন্য বেদের ছয়টি অবয়ব গ্রন্থ অধ্যায়নের প্রয়োজন। এই অবয়ব গ্রন্থগুলিকে বলা হয় বেদাঙ্গ। বেদাঙ্গ শাস্ত্রগুলো হলঃ ক) শিক্ষা, খ) কল্প, গ) ব্যাকরণ, ঘ) নিরুক্ত, ঙ) ছন্দ এবং চ) জ্যোতিষ।
স্মৃতি-সংহিতাঃ যা যা স্মৃত হয়েছে তাই স্মৃতি। স্মৃতি শব্দের অর্থ স্মরণ। স্মৃতি-সংহিতা পাঠ করে হিন্দুরা জানতে পারে মানুষের আচার ধর্ম-কর্ম কি। আমাদের বিশটি স্মৃতি-সংহিতা রয়েছে। এদের মধ্যে তিনটি স্মৃতি-সংহিতা প্রধান ও প্রসিদ্ধ। তা হলঃ ক) মুন-স্মৃতি, খ) যাজ্ঞবল্ক-স্মৃতি এবং গ) পরাশর-স্মৃতি।
রামায়ণ ও মহাভারতঃ বৈদিকযুগে কোনো প্রাচীন গল্প বলার সময় “ইতি হ আস” অর্থাৎ এইরকম ছিল- বলে গল্প আরম্ভ করা হোত। তার থেকে প্রাচীন কোনো গল্প বা কাহিনীর নাম ইতিহাস হয়েছে। উপনিষদ আর ব্রাহ্মণের মধ্যে অনেক প্রাচীন ইতিহাস বা গল্প রয়েছে। এখন এই জাতীয় গ্রন্থগুলির মধ্যে সর্ব প্রাচীন রামায়ণ আর মহাভারত। রামায়ণ বাল্মীকি আর মহাভারত বেদব্যাস রচনা করেন। রামায়ণ কাব্যাংশে আর মহাভারত সাহিত্যাংশে সর্বশ্রেষ্ঠ। কাব্য বলতে এখানে কেবল রসকে আর সাহিত্য বলতে বিজ্ঞান নীতি প্রভৃতি বিষয়ের সাথে যোগকে লক্ষ্য করা গেল। খ্রীস্টপূর্ব পাঁচশো বছর আগেই রামায়ণ মহাভারত বর্তমানরূপে পরিণত হয়েছিল।
বেদের শাশ্বত সনাতন সত্যগুলি ঐতিহাসিক কথা-কাহিনীর মধ্য দিয়ে জনসমাজে প্রচার করা এই ধর্মগ্রন্থ দুটির মুখ্য উদ্দেশ্য। জীবন দিয়ে দিলেও মহাভারতের সব কিছুকে মাথার মধ্যে পুরােপুরি বসিয়ে নেওয়া যায় না। গীতার মত শাস্ত্র মহাভারতের অন্তর্ভুক্ত, গীতার মত ছােট বড় মিলিয়ে আঠারােটা গীতা মহাভারতে আছে। বিদগ্ধ পণ্ডিতরা বলেন মহাভারতে তিন ধরণের শিক্ষা দেওয়া আছে। প্রথমে বলেন, আস্তিকাদি। আস্তিকাদি মানে ঐতিহাসিক, বলছেন মহাভারতে ঐতিহাসিক বর্ণনাদি আছে। দ্বিতীয় শিক্ষা হল, মথাদি, মনু আদি, মনু বলতে মানুষকে বলা হচ্ছে। মথ্যাদি হল, নৈতিক শিক্ষা, মানুষের কোনটা করা উচিত কোনটা করা উচিত নয়। তৃতীয় শিক্ষা ঔপরিচয়। ঔপরিচয় বলতে বােঝায় আধ্যাত্মিক বিবর্তনের বর্ণনা। মহাভারত পরিষ্কার ভাবে এই তিন রকমের আলােচনা করছে, ঐতিহাসিক, নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতা। এর বাইরেও মহাভারতে পাব ইতিহাস। এই অসাধারণ পুরুষ হিসেবে স্বীকৃত ব্যক্তিত্ববান পুরুষের জীবনের কয়েকটা  ঐতিহাসিক ঘটনার আধার করে যখন ধর্ম, অর্থ, কাম ও মােক্ষের শিক্ষা দেওয়া তখন তাকে বলা হয় ইতিহাস।

শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতাঃ মহাভারতের ভীষ্মপর্বের অন্তর্গত সুপ্রসিদ্ধ শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতা মহাভারতের অন্তর্গত হলেও স্বতন্ত্র ধর্মগ্রন্থরূপে হিন্দু সমাজে সমাদৃত। ‘চতুর্বেদের সার উপনিষদ, উপনিষদের সার এই গীতা’। ধর্মের গুঢ়তত্ত্ব গীতায় প্রকাশিত। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ প্রাক্কালে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হিন্দুধর্মের সারতত্ত্ব তৃতীয় পান্ডব অর্জুনের কাছে ব্যাখ্যা করেন।

পুরাণঃ রামায়ণ মহাভারতের পরে আসে পুরাণের কথা। ভারতবর্ষে সাধারণত অষ্টাদশ মহাপুরাণ আর অষ্টাদশ উপপুরাণেরই প্রাধান্য।যা পুরাতন তাই পুরাণ। বেদের পুরাতন দার্শনিকতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব নানাভাবে উপাখ্যানের মাধ্যমে পুরাণ প্রচার করেছে বলে একে পুরাণ বলা হয়। পুরাণে ভারতীয় দর্শন, ধর্মমত, আচার, বিচার সাধনার কথাতে ভরা। কাজেই সেদিক দিয়ে এর মূল্য কম নয়। পুরাণে সৃষ্টিতত্ত্ব, ইতিহাস, দার্শনিকতত্ত্ব, সাধন প্রণালী প্রভৃতি নানাবিধ বিষয় পুরাণে আলোচিত হয়েছে। পুরাণের পাঁচটি লক্ষণ আছে। যথা- ক) সর্গ, খ) প্রতিসর্গ, গ) বংশ, ঘ) মন্বন্তর এবং ঙ) বংশানুচরিত। পুরাণকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথাঃ- ক) মহাপুরাণ এবং খ) উপপুরাণ।
পুরাণ সম্বন্ধে একটা বিষয় ভাবার আছে- একটা সময় স্ত্রী ও শূদ্রে বিদ্যা বন্ধ হয়ে যাবার পর স্ত্রীলোক শূদ্র আর আচারহীন ব্রাহ্মণদের বেদে অধিকার ছিল না। তাই তাদের শাস্ত্র কথা জানার জন্যে পুরাণের পথ খোলা রাখা হয়েছিল। পুরাণের বক্তারাও সূতজাতীয়। আজকাল গণশিক্ষা বলতে যে অর্থ আমরা বুঝি, সেই গণশিক্ষা এই পুরাণের দ্বারাই তখনো চলত এখনো চলে আসছে।
পুরাণের গল্পে অতিলৌকিক, অসম্ভব সব কথা আছে। অশিক্ষিত মানুষ সবদেশেই অলৌকিক কথায় আকৃষ্ট হয়। লোক আকর্ষণের জন্যই ঐসব কথা। সেগুলিকে নিছক সত্যি বলে মানতে কুমারিল ভট্ট নিষেধ করে বলেছেন গল্প গুলির তাৎপর্য গ্রহণ করবে, ঘটনাকে নয়।

মহাপুরাণঃ হিন্দুশাস্ত্রে আঠারোটি মহাপুরাণ রয়েছে। এই আঠারোটি পুরাণের মধ্যে সাতটি পুরাণ উল্লেখযোগ্য। যথাঃ ক) বিষ্ণুপুরাণ, খ) পদ্মপুরাণ, গ) বায়ুপুরাণ, ঘ) স্কদ্ধপুরাণ, ঙ) মার্কন্ডেয়পুরাণ এবং চ) ভাগবত পুরাণ প্রভৃতি। ভাগবত পুরাণকে আবার দুই ভাগে ভাগ করেছেন। যথাঃ ক) দেবী ভাগবত (শ্রীদুর্গার শক্তি ও মাহাত্ম্য বর্ণিত) এবং খ) শ্রীমদ্ভাগবত বা বিষ্ণু ভাগবত (শ্রীকৃষ্ণের শক্তি ও মাহাত্ম্য বর্ণিত)।

উপপুরাণঃ মহাপুরাণের মতো উপপুরাণও আঠারো-খানা রয়েছে। উপপুরাণ গুলি সম্প্রদায় বিশেষের ধর্মাচারের সহায়ক।  যথাঃ ক) আদি, খ) নৃসিংহ, গ) বায়ু, ঘ) শিবধর্ম, ঙ) দুর্বাসঃ, চ) বৃহন্নারদীয়, ছ) নন্দিকেশ্বর, জ) উশনঃ, ঝ) কপিল, ঞ) বরুণ, ট) শাম্ব (এটি যাচাই করে নিবেন) ঠ) কালিকা, ড) মহেশ্বর, ঢ) দেবী, ণ) ভার্গব, ত) বশিষ্ট থ) পরাশর এবং দ) সূর্য ইত্যাদি।

চন্ডিঃ চন্ডি মার্কন্ডেয় পুরাণের অন্তর্ভুক্ত হলেও প্রকৃতি পক্ষে একটি স্বতন্ত্র ধর্মগ্রন্থ রূপে স্বীকৃত। জগৎ জননী মা দুর্গার আগমনে অর্থাৎ দুর্গা পূজার সময় পাঠ করা হয়। এছাড়াও গীতা মত চন্ডি হিন্দুদের নিত্য-পাঠ্য বিষয়। চণ্ডি বা চণ্ডিকা দেবীমাহাত্ম্যম্ গ্রন্থের সর্বোচ্চ দেবী। তিনি মহাকালী, মহালক্ষ্মী ও মহাসরস্বতী দেবীর সমন্বয়ে চণ্ডীকে ঐ গ্রন্থে সর্বোচ্চ সত্ত্বা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। গ্রন্থের অন্তভাগে মূর্তিরহস্য অংশে তাকে অষ্টাদশভূজা মহালক্ষ্মী নামে অভিহিত করা হয়েছে।

আগম শাস্ত্রঃ হিন্দুধর্মে আগম শাস্ত্রের সংখ্যা অনেক। আগম শাস্ত্র হল দেবদেবীর পূজা-অর্চনার পদ্ধতি বিষয়ক সম্প্রদায়ক গ্রন্থ। তন্ত্র বা আগম সাধারণত তিন শ্রেণীতে বিভক্ত- শৈবাগম, শাক্তাগম ও বৈষ্ণবগম। শিব ও শক্তি অভিন্ন, সুতরাং শৈব সাধকের সঙ্গে শাক্ত সাধকের অমিল নেই, ভাবভেদে মাত্র নাম প্রভেদ। বৈষ্ণব আগমকে পঞ্চরাত্র বলে। ঐ সমস্ত আগমের বহু উপবিভাগ আছে। বাংলার শাক্ত সম্প্রদায় ও কাশ্মির বা উত্তর পশ্চিমের তন্ত্র সাধকেরা অদ্বৈতবাদী। তাঁরা জীবাত্মা ও পরমাত্মার অভেদত্ব স্বীকার করেন অর্থাৎ জীব ভাব বর্জিত হলে আত্মা পরমাত্মায় লীন হন। তাদের মতে, আত্ম মানবদেহে চৈতন্য শক্তি, কিন্তু আত্মা দেহ ও মনরূপ শক্তির আবরণে আবরিত, মূলশক্তি-ব্রহ্মচৈতন্য বা আত্মার স্বরূপ। এ সম্প্রদায়ের কাছে শিব, বিষ্ণু ও মহামায়া-ই হল পরমতত্ত্ব।

ষড়দর্শনঃ আধ্যাত্মিকতা ভারতীয় দর্শন শাস্ত্রের মূল ভিত্তি। ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ, এই চতুর্বর্গের মধ্যে মোক্ষই পরম পুরুষার্থ। চিত্ত শুদ্ধির কারণ কর্ম। বেদের কর্মকাণ্ড নিয়েই মীমাংসা দর্শন। জৈমিনি এই দর্শন শাস্ত্রের প্রণেতা। কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য স্বর্গ আদি লাভ ও চিত্তশুদ্ধি। শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন(নিরন্তর অনুধ্যান বা বিচার), এই তিনটি চিত্ত শুদ্ধির উপায়। প্রথমে বিষয়টি শুনতে হয়, তার পর চিন্তা করতে হয়, বিচার করে যুক্তি দিয়ে বুঝতে হয়, তার পর সতত ধ্যান-পরায়ণ হতে হয়। ধ্যান দ্বারাই সত্য জ্ঞানের স্ফুরণ হয়। চিত্তশুদ্ধি না হলে জীবন গঠিত হয় না। ঐ তিন উপায়ের দ্বারাই আত্ম-সাক্ষাৎকার ঘটে। শুধু আপ্তবাক্যের দোহাই দিলে হয় না, সেটি বিচার ও নিরবিচ্ছিন্ন ধ্যান দ্বারা জীবনে ফুটিয়ে তুলতে হয়। জীবন কে গঠন করা নিজের হাতে, তাই দর্শন শাস্ত্রের আর এক নাম মনন শাস্ত্র। এই শাস্ত্র সাহায্যে তত্ত্বজ্ঞান আসতে পারে, কিন্তু মাত্র তত্ত্ব-বুদ্ধির দ্বারা প্রত্যক্ষ আত্ম-ভ্রম-ইন্দ্রিয়গত অহং বোধ-যায় না, সুতরাং চাই সাক্ষাৎকার বা প্রত্যক্ষাত্মক তত্ত্বজ্ঞান, যাতে ঐ ভ্রম দূরীভূত হয়।
ছয়টি দর্শন শাস্ত্র প্রসিদ্ধ- ন্যায়, বৈশেষিক, সাংখ্য, পাতঞ্জল, মীমাংসা ও বেদান্ত। ন্যায় ও বৈশেষিক কে সমান তন্ত্র বলা হয়। সাংখ্য ও পাতঞ্জল এক শ্রেণীভুক্ত, সাধারণ নাম- সাংখ্য-প্রবচন। পাতঞ্জল দর্শন কে সেশ্বর সাংখ্য বলা হয়, কপিলের সাংখ্যদর্শন নিরীশ্বর সাংখ্য নামে বিদিত। (সাংখ্য = সম্যক-জ্ঞান)। মীমাংসা ও বেদান্ত শ্রুতি প্রমাণ কে অবলম্বন করে বিচার করেছেন, অন্যান্য দর্শন কেবল যুক্তির দ্বারাই বুঝিয়েছেন। -মাধবাচার্য, তাঁর সর্বদর্শন সংগ্রহে ১৫টি দর্শন শাস্ত্রের নাম করেছেন; তাঁর অন্য একটি গ্রন্থে শাঙ্কর দর্শনের উল্লেখ করেছেন। অতএব হয় ১৬টি দর্শন অর্থাৎ ঐ প্রসিদ্ধ ষড়দর্শন ও আরও ১০টি দর্শন। চার্বাক দর্শন, আর্হত (জৈন) দর্শন, বৌদ্ধ দর্শন, রামানুজ দর্শন, পূর্ণ-প্রজ্ঞ দর্শন, রসেশ্বর দর্শন ও পাণিনি দর্শন- এই ৭টি, ষড়দর্শনের অতিরিক্ত দর্শন। পূৰ্ণপ্রজ্ঞ দর্শন ও শৈব দর্শন, বেদান্তের প্রস্থান বিশেষ বলে গণ্য। বেদ যেমন সকল দর্শনের মূল ভিত্তি, তন্ত্রের মধ্যেও তেমনি সমস্ত দর্শনের মূল তত্ত্ব বিদ্যমান। পূর্বমীমাংসা বা কর্ম-মীমাংসা বৈদিক কর্মকাণ্ডের প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়েই তার মীমাংসা করেছেন। এই শাস্ত্রে জ্ঞান থাকলে তবে কর্মকাণ্ড বোঝা যায়। কর্ম-মীমাংসার আর একটি নাম অধ্বর-মীমাংসা, আর ব্যাস প্রণীত মীমাংসা দর্শনের নাম উত্তর মীমাংসা বা শারীরিক মীমাংসা বা বেদান্ত দর্শন। অতএব মীমাংসাশাস্ত্র একটি ও তার দুটি অংশ। বেদ-অপৌরুষেয়- এটা সকলে স্বীকার করেন।

এছাড়াও বিভিন্ন সম্প্রদায় গুরুপরম্পরায় গঠিত সম্প্রদায়ের মহাপুরুষদের মুখের বাণী ও শাস্ত্র আলোচনাকে ঘিরে নানা ধর্মগ্রন্থ আধুনিক যুগে নিজ নিজ শিষ্যদের কাছে আদরণীয়।
#শ্রীকৃষ্ণকমল মিন্টু
সনাতন বাংলাদেশ। 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.